সদ্য-নোবেলজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার কবি ও সাহিত্যিক হান কাং-এর কল্পনার প্রসার, মননের মৌলিকতা এবং প্রতিভার প্রাবল্যকে আমি এতটুকু ছোট করছি না। কিন্তু যে-টেবিলে বসে তিনি ভাবতে পেরেছেন এমন একটি পর্ব উন্মোচনের গল্প, যে টেবিলে নিরন্তর পরিশ্রমে তিনি একবার নয়, হয়তো বারবার লিখেছেন, কেটেছেন, ফেলেছেন, আবার লিখেছেন, এডিট করেছেন, হয়তো নিজের হাতের লেখায়, হয়তো কম্পিউটারে, মনের মতো করে সাজিয়েছেন এবং টেবিলটার সঙ্গে রাত জেগেছেন গল্পটাকে মসৃণ গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে– সেই সৃজনে, গল্পের গঠনে ও চলনে টেবিলের কোনও ভূমিকাই নেই– এমন নির্মম কথাই বা বলি কী করে?
১১.
বিহ্বল এবং বিস্মিত আমি। এবং ‘গ্রিক লেসন্স’ উপন্যাসটি শেষ করার পর থেকে একটিই প্রশ্ন সমানে কড়া নাড়ছে। হান কাং কোথায় পেয়েছেন এমন এক লেখার টেবিল, যার ওপর কত সহজে ডালপালা, শিকড়বাকড়, ফুলপাতার বিস্তার ও বুনন ছড়িয়ে এমন অনন্য গদ্যে গজিয়ে উঠতে পেরেছে এক ক্রমশ অন্ধ-হয়ে যাওয়া শিক্ষক এবং এক আকস্মিক সংলাপ-হারানো ছাত্রীর কাহিনি!
সদ্য-নোবেলজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার কবি ও সাহিত্যিক হান কাং-এর কল্পনার প্রসার, মননের মৌলিকতা এবং প্রতিভার প্রাবল্যকে আমি এতটুকু ছোট করছি না। কিন্তু যে-টেবিলে বসে তিনি ভাবতে পেরেছেন এমন একটি পর্ব উন্মোচনের গল্প, যে টেবিলে নিরন্তর পরিশ্রমে তিনি একবার নয়, হয়তো বারবার লিখেছেন, কেটেছেন, ফেলেছেন, আবার লিখেছেন, এডিট করেছেন, হয়তো নিজের হাতের লেখায়, হয়তো কম্পিউটারে, মনের মতো করে সাজিয়েছেন এবং টেবিলটার সঙ্গে রাত জেগেছেন গল্পটাকে মসৃণ গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে– সেই সৃজনে, গল্পের গঠনে ও চলনে টেবিলের কোনও ভূমিকাই নেই– এমন নির্মম কথাই বা বলি কী করে?
প্রেমের গল্প তো জীবনে কম পড়িনি। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’-র মনন ও মৌলিকতা, তার রোশনাই এবং জীর্ণোদ্ধার এবং তার নবনির্মিতির সবকটি পরত মনে রেখেই বলছি, ‘গ্রিক লেসন্স’-এর মতো প্রেমের গল্প আগে পড়িনি। এই গল্পের নায়িকা আকস্মিক বাকরুদ্ধ। এই গল্পের নায়ক, যিনি গ্রিক ভাষার শিক্ষক, ক্রমশ অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন। অথচ এদের প্রেম ক্রমশ হয়ে উঠছে প্রদীপ্ত প্রত্যয়ের প্রেমপত্র, দু’টি মানুষের নিবিড় একাত্মতার প্রতি প্রেমের চিঠি। এক নারী যে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারে না। আবার কোনও একক শব্দের অভিঘাত, কোনও আকস্মিক উচ্চারণের দমকা বাতাস, তাকে ফিরিয়ে দেয় ভাষা। আর পুরুষটির চোখে ক্রমশ নিভে যাওয়া আলো ক্রমশ জানিয়ে দেয় এক অপ্রত্যাশিত দ্যুতি। এবং ঘটে এই নারী এবং পুরুষটির মধ্যে অনির্ণেয় সংযোগ– দু’টি পলাতক আত্মা পরস্পরকে স্পর্শ করে অস্তিত্বের কুহকী কিনারে। ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া এক অন্ধ বিদগ্ধ শিক্ষক আর ভাষাহারা এক স্পর্শময় নারী– তারা পরস্পরকে পরিয়ে দেয় বেদনার আংটি।
এই আংটি দেখা যায় না আঙুলে। এই আংটি হয়ে ওঠে না দৃশ্যমান অভিজ্ঞান। বহন করে না কোনও প্রতিশ্রুতির প্রতাপ ও প্রবাহ। এই আংটি, এই অদৃশ্য অলংকার, বিপুল বেদনার। যে-বেদনার শিকড়ে আমাদের নিয়ে যান হান কাং, অনন্য সৃজনের স্তরে-স্তরে। কী অসাধারণ তাঁর গদ্য! কী অনন্ত উন্মোচনে ঊষসী তাঁর গল্পের দ্যোতনা! সত্যিই যেন ভোরের আকাশে ব্যথার মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে এক বাক্যহারা নারী এবং এক দৃষ্টিহারা পুরুষের পরস্পরকে নিবিড় বন্ধনে পাওয়ার গল্প! এই অবিশ্বাস, অপ্রত্যয় এবং সংশয়ের যুগে হান কাং-এর উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন্স’ ফিরিয়ে নিয়ে এল বাক্যহীন চক্ষুহীন অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। যে আলোয় নারী এবং পুরুষটি খুঁজে পায় এক অলৌকিক বিবাহ, যা ভাষা প্রকাশ করতে পারে না, চোখ দেখতে পায় না। এই বিবাহ যেন গভীর অরণ্য, গহন সমুদ্র। এই মিলনের ও প্রাপ্তির নিবিড় আনন্দ পুরুষ ও নারী প্রকাশ করছে এই রকম অব্যর্থ অমোঘ সংকেতে। হান কাং ছাড়া এই সংলাপের নাগাল পাওয়া আর কার পক্ষে সম্ভব হত, জানি না। জানি না, মূল কোরিয়ান ভাষায় লেখা এই উপন্যাসের মাধুরী কতটা ধরা পড়েছে ডেবোরা স্মিথ এবং এমিলি ইয়া উন-এর ইংরেজি অনুবাদে। উপন্যাসের কিছুটা স্বাদ অন্তত পাওয়া যাবে– এই আশায় এই উদ্ধৃতি:
At one moment moving your index finger
over the flesh of my shoulder, you wrote.
Woods, you wrote, woods.
I Waited for the next word.
Realizing no next word was coming, I
opened my eyes and peered at the darkness.
I saw the pale blur of your body in the darkness.
We were very close then.
We were lying very close and embracing each other.
The sound of the rain did not cease.
Something broke inside us.
In that place where both light and voice were absent, …
…………………………………………..
প্রেমের গল্প তো জীবনে কম পড়িনি। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’-র মনন ও মৌলিকতা, তার রোশনাই এবং জীর্ণোদ্ধার এবং তার নবনির্মিতির সবকটি পরত মনে রেখেই বলছি, ‘গ্রিক লেসন্স’-এর মতো প্রেমের গল্প আগে পড়িনি। এই গল্পের নায়িকা আকস্মিক বাকরুদ্ধ। এই গল্পের নায়ক, যিনি গ্রিক ভাষার শিক্ষক, ক্রমশ অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন। অথচ এদের প্রেম ক্রমশ হয়ে উঠছে প্রদীপ্ত প্রত্যয়ের প্রেমপত্র, দু’টি মানুষের নিবিড় একাত্মতার প্রতি প্রেমের চিঠি।
…………………………………………..
এরপর আমার বাংলা ভাবনুবাদে: আমি যতদূর জানি, হান কাং-এর ‘গ্রিক লেসন্স’ এই প্রথম প্রবিষ্ট হল বাংলা ভাষার আদরে ও আবেশে:
এই মুহূর্তে আমার ঘাড়ের ত্বকের ওপর তোমার তর্জনীর রেখায় তুমি কিছু লিখলে।
তুমি লিখলে ‘বন’, তুমি লিখলে ‘বন’।
আমি অপেক্ষা করলাম পরের শব্দটার জন্য।
কিন্তু যেই বুঝলাম, পরে কোনও শব্দ নেই
আমি চোখ খুলে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম অন্ধকার।
আমি দেখলাম অন্ধকারে তোমার শরীরের পেলব আবছায়া।
আমরা তখন খুব কাছাকাছি।
আমরা শুয়েছিলাম পরস্পরের খুব কাছে, জড়িয়ে শুয়েছিলাম আমরা।
বৃষ্টির শব্দ থামল না।
কিছু একটা ভাঙল আমাদের মধ্যে।
আমাদের মধ্যে কিছু একটা ভেঙে পড়ল সেই জায়গাটাতে
যেখানে যেখানে আলো এবং কণ্ঠ, উভয়েই অনুপস্থিত…
আমার বাহুতে জড়িয়ে নিলাম তোমার গলা।
আমি হাতড়ে নাগাল পেলাম তোমার কাঁধের, চুমু খেলাম সেখানে।
যাতে আমি তোমাকে আর না চুমু খেতে সক্ষম হই।
তুমি আমার মুখ জড়িয়ে ধরে ছোট্ট শব্দ করলে।
তোমার মুখে এই প্রথম শব্দ।
বুদ্বুদের মতো নরম দুর্বল শব্দ। এবং জলবিন্দুর মতো নিটোল গোল একটি শব্দ।
আমি নিশ্বাস বন্ধ করলাম।
তুমি নিশ্বাস নিতেই লাগলে।
আমি শব্দ পাচ্ছিলাম, তুমি নিশ্বাস নিয়েই চলেছ।
তারপর আমরা ধীরে ধীরে ওপরে ভেসে উঠলাম।
প্রথম স্পর্শ করলাম আমরা জলের ঝকঝকে ওপরের গা।
তারপর জলের কর্কশ ধাক্কা তাড়িয়ে নিয়ে গেল বেলাভূমিতে।
ভয়াবহ।
মোটেও ভয়াবহ নয়।
আমি চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছিলাম।
আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইনি।
তুমি আমার শরীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাওয়ার
আগে ধীরে আমাকে চুমু খেলে।
আমার কপালে চুমু খেলে।
আমার ভুরুতে চুমু খেলে।
আমার চোখের দু’টি পাতায় চুমু দিলে।
আমার মনে হল আমাকে সময় চুমু খেল।
যতবার আমাদের ঠোঁট এক হল, নিঃসঙ্গ অন্ধকার জমাট বাঁধল।
নৈঃশব্দ জড়ো করল তুষার। তুষারই তো চিহ্নলোপের চিরকালীন অস্ত্র।
নিঃশব্দে তুষার পৌঁছল আমাদের হাঁটুতে, আমাদের কোমরে, উঠে এল আমাদের অবয়বে।
‘স্নো দি ইটারনাল্ ইরেজার’।
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..
এমন প্রেমের উপন্যাস খুব বেশি, সত্যিই কি খুব বেশি পড়েছি? আর কখনও কোনও কাঠের টেবিলে খোদাই করা চেতনার গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি? এমন পূর্ণ লুপ্তির কাব্যিক ক্যাথারসিস?
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল