রবীন্দ্রনাথের আঁকার টেবিলের বুক থেকে উঠে আসা ভাবনা যে অনেক বেশি আধুনিক ও আগ্নেয়! যে পেলব রোম্যান্টিকতা রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিলের আশ্রয় আঁকড়ে থাকল চিরকাল, তার কোনও স্থানই নেই রবীন্দ্রনাথের আঁকার টেবিলের জ্বলন্ত, গলন্ত লাভায়। এই কারণেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার টেবিল এবং তাঁর আঁকার টেবিলকে কখনও কাছাকাছি আসতে দেননি।
১২.
রবীন্দ্রনাথ বেয়াড়া ধরনের অন্য রকম বাঙালি। আমাদের চেনা কোনও বাঙালির সঙ্গে মিল নেই তাঁর। তিনি এক বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারেন না। তাঁর হাঁফ ধরে। তিনি বাড়ি পাল্টান। বাড়ি বদলালে বদলে যায় তাঁর লেখার টেবিল, তাঁর আঁকার টেবিল, তাঁর খাবার টেবিল। তিনি টেবিলে খান। এবং হাত দিয়ে খান না। কাঁটা-চামচ। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বায়না, তাঁর লেখার টেবিল থেকে আঁকার টেবিল, এমনকী, খাবার টেবিল– সব কিছু হাতের কাছে, একটা ঘরের মধ্যে পেতে চান তিনি। কেন এই বায়না? তাঁর লজিক অকাট্য। তাঁর মুখ থেকেই হুবহু শোনা যাক, যে-কথাগুলি লিখে রেখে গেছেন তাঁর ‘গুরুদেব’ নামের গ্রন্থে রানী চন্দ।
‘এবারে কয়দিন শুধু ছবিই আঁকব। ছবি আঁকতে আমি এত ভালবাসি, অথচ এরা আমার ছবি আঁকতে দেবে না। কেবলি বলে, এটা লেখো, ওটা লেখো। আর নয়, এবারে আমি খুশিমতো ছবি আঁকব, ইচ্ছেমতো কবিতা লিখব। কারও হুকুম মানব না। আন্ তো আমার রঙের ঝুড়িটা এখানেই।’
এবার জানাচ্ছেন রানী চন্দ, ‘বেতের বোনা একটা জাপানী ট্রেতে গুরুদেবের রঙের শিশি তুলি থাকে। পাশের ঘরে তোলা থাকত তা। ট্রে সমেত তুলে নিয়ে এলাম তাঁর কাছে।’
এবার রবীন্দ্রনাথ যা বললেন, ‘কিছুই হাতের কাছে পাবার জো নেই। বেশ লম্বা একটি ঘর হয় আমার, পরপর সব জিনিস সাজানো থাকে, ইচ্ছে হল লেখার টেবিলে বসে লিখলুম, আঁকার টেবিলে গিয়ে ছবি আঁকলুম, – তা নয়, একটা জায়গায় সব। ছবি আঁকব তো লেখার জিনিস সরাও, লিখব তো ছবির সরঞ্জাম দূর করো।’
ছোট ঘরই বেশি ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মনে হয়, ছোটো ঘরে ছোট একটি এক পা-ভাঙা লেখার টেবিল– এটা পেলে তিনি অনেক ভালো লিখতে পারবেন। শৌখিন ফার্নিচার রবীন্দ্রনাথ একেবারে পছন্দ করেন না। যত নড়বড়ে তেপায়া লেখার টেবিল, সেই তাঁর পছন্দ। তাঁর ভারি যুতসই লেখার টেবিল সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ হুবহু যা বলেছেন, ‘এর একটা পা না থাকাতে বরং ভালই হয়েছে, এই ভাঙা দিক দিয়ে টেবিলটা যত ইচ্ছে টেনে কোলের উপর এগিয়ে আনা যাবে। লিখতে আমার সুবিধে হবে। পা-টা থাকলে আটকাত।’ (গুরুদেব: রানী চন্দ, পৃষ্ঠা ৮৩)
ঠিক কেমন লেখার ঘর পছন্দ রবীন্দ্রনাথের? যে-ঘরে এক-পা-ভাঙা লেখার টেবিলে তিনি লিখতে আরাম পান একেবারে শেষ বয়সে?
রবীন্দ্রনাথ নিজে জানাচ্ছেন: ‘ছোট ঘরই আমি ভালবাসি। বেশ ছোটো ছোটো ঘর হবে, এক জায়গায় বসে হাত বাড়িয়ে এদিককার ওদিককার জিনিস নাগাল পাব। ঘরের জিনিসপত্র কাছে থাকলে মনে হয় যেন ঘরটি আমার আপন ঘর। নিচু ছাদ কাছে নেমে আসে, চারদিকের দেয়াল কাছে কাছে ঘিরে থাকে, বড় আরাম লাগে মনে। নয়তো কীসব বড় বড় ঘর, উঁচু উঁচু ছাদ, জিনিসপত্র ঐ কোণে সেই কোণে, একটি বই দরকার তো উঠে গিয়ে শেলফ্ থেকে পেড়ে আনো, সে যেন নিজের ঘরেই পর হয়ে থাকা’ (গুরুদেব: পৃষ্ঠা ৯৫)। কে বলবে এই মানুষটির জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতত মঞ্জিলে! কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার টেবিল বের করে আনেন শান্তিনিকেতনে তাঁর কোনও একটি বাড়ির বারান্দায়, যেখানে ঘেয়ো কুকুরগুলো উঠে আসে। দিব্য আরামে সেখানেই বসে লেখেন রবীন্দ্রনাথ। কিংবা লেখার টেবিল-চেয়ার সরিয়ে নিয়ে আসেন ইচ্ছে করে গাছের তলায় ঠিক সেইখানে, যেখানে মাথার ওপরে বিশাল এক মৌচাক।
মাথার উপর মৌচাক-ঝুলিয়ে নিবিড় হয়ে লিখে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ, এ-গল্প শুনেছিলাম আমি সাগরদার (সাগরময় ঘোষ) মুখে। “তখন শান্তিনিকেতনে গরমের ছুটি। ছাত্ররা সব বাড়ি চলে গেছে। আমি তো স্থানীয় ছেলে। থেকে গেছি। একদিন সকালবেলা দেখি গুরুদেব একটা গাছের তলায় চেয়ার-টেবিল লাগিয়ে লিখছেন। আমি কাছে যেতে বললেন, ‘তুই তো এখানকার। তাই তো ভয় নেই। দেখেছিস আমার মাথার ওপর কী ঝুলছে?’ তাকিয়ে দেখি খুব বড় একটা মৌচাক। তলায় বসে গুরুদেব লিখছেন। বললেন, ‘কেউ এখন কাছে আসতে সাহস পাবে না। আমি বেশ নির্বিঘ্নে লিখতে পারব। কোনও ব্যাঘাত ঘটার উপায় নেই, বুঝলি?”
………………………………………………………….
কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার টেবিল বের করে আনেন শান্তিনিকেতনে তাঁর কোনও একটি বাড়ির বারান্দায়, যেখানে ঘেয়ো কুকুরগুলো উঠে আসে। দিব্য আরামে সেখানেই বসে লেখেন রবীন্দ্রনাথ। কিংবা লেখার টেবিল-চেয়ার সরিয়ে নিয়ে আসেন ইচ্ছে করে গাছের তলায় ঠিক সেইখানে, যেখানে মাথার ওপরে বিশাল এক মৌচাক।
………………………………………………………….
রবীন্দ্রনাথের একটা বড় দুর্ভাবনা, যদি রাত্রে ঘুম থেকে উঠে তাঁর আঁকতে ইচ্ছে করে, তাহলে কী করবেন? তখন সেই গভীর রাতে কোন বাড়ির কোন ঘরে খুঁজতে যাবেন তাঁর আঁকার টেবিল? তাই তো তিনি চাইছেন এমন একটি ঘর যেখানে একই ঘরে থাকবে তাঁর লেখার টেবিল, আঁকার টেবিল, খাবার টেবিল, জানলার ধারে একলা বসে অলস ভাবনার টেবিল। রবীন্দ্রনাথের এই চাহিদা মেটাতে তৈরি হল তাঁর ‘কোনার্ক’ বাড়িটি, যে-বাড়ির এল্-শেপ ঘরে স্থান পেল একই ঘরে তাঁর সবক’টি টেবিল! কিংবা বলা উচিত একটা ঘরের মধ্যেই সবক’টি ঘর। আর তারমধ্যে রবীন্দ্রনাথের সবক’টি টেবিল।
রবীন্দ্রনাথ সেই ঘর দেখে খুব খুশি। বললেন রানীকে, ‘বাঃ, এ বেশ হয়েছে। এখন যদি আমার রাত্তির বেলা ছবি আঁকতে ইচ্ছে যায়, তোমায় তো ঘুম ভাঙিয়ে তুলে আনতে হবে না, বলতে হবে না, ছবির রঙগুলো যে ওই বাড়িতে রইল! আমার অমূক অমূক রঙটা দিয়ে যাও। এখন এই একটি ঘরেই আমার সব কিছু থাকবে।’
সে কেমন ম্যাজিক-রিয়েলিটি? যে-ঘরে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন, শোবেন, ঘুমবেন, স্নান করবেন, খাবেন, লিখবেন, আঁকবেন, ভাববেন– একা! ঘরে ঢুকেই, দরজা খুললেই, শোবার ঘর। দক্ষিণে একটু এগোলেই বসবার ঘর। আর একটু এগিয়ে লেখবার ঘর। পুবের দিকে চার পা গেলেই ছবি আঁকার ঘর। পাশেই খাবার ঘর। দু’-পা দূরে ড্রেসিংরুম। পাশে দু’-সিঁড়ি নেমে স্নানঘর।
এতগুলো ঘর কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘একই ঘরে সকল ঘর’। কারণ, দু’টি মাত্র দরজা। একটি ঢোকার। অন্যটি বেরনোর!
কিন্তু ‘একই ঘরে সকল ঘর’ হলেও, রবীন্দ্রনাথের আঁকার ঘরে আঁকার টেবিল আর লেখার ঘরে লেখার টেবিল-এর মধ্যে আলোকবর্ষের দূরত্ব। যদিও তাঁর আঁকার আঁতুড় ছিল তাঁর লেখার টেবিলে তাঁর অনন্য পাণ্ডুলিপির গায়ে অসংখ্য কাটাকুটিতে ফুটে ওঠা রেখাচিত্র! কিন্তু ক্রমশই রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির জগৎ আর তাঁর লেখার ভাবনা-ভুবন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেল। এতটাই পৃথক, যেন লেখক রবীন্দ্রনাথ এবং রঙ-তুলির রবীন্দ্রনাথ, দু’জন আলাদা মানুষ।
রবীন্দ্রনাথের আঁকার টেবিলের বুক থেকে উঠে আসা ভাবনা যে অনেক বেশি আধুনিক ও আগ্নেয়! যে পেলব রোম্যান্টিকতা রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিলের আশ্রয় আঁকড়ে থাকল চিরকাল, তার কোনও স্থানই নেই রবীন্দ্রনাথের আঁকার টেবিলের জ্বলন্ত, গলন্ত লাভায়। এই কারণেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার টেবিল এবং তাঁর আঁকার টেবিলকে কখনও কাছাকাছি আসতে দেননি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প– কোথাও প্রকাশ পায়নি তাঁর আঁকার উগ্র আধুনিকতা, তাঁর ছবির পর ছবিতে ফুঁসিয়ে ওঠা চাপা, নিহিত সেক্সুয়ালিটি। এই কারণেই যেন তাঁর লেখার টেবিলের কাছে আসতে দেননি তাঁর আঁকার টেবিলকে। যে-রবীন্দ্রনাথকে আগলে রেখেছে তাঁর লেখার টেবিল অতি সন্তর্পণে, সেই রবীন্দ্রনাথকে চেনে না, চিনতে হয়তো চায়ও না তাঁর আঁকার টেবিল, এই নির্মম সত্যটি বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যে-রবীন্দ্রনাথের দুর্নিবার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর আঁকার টেবিলে, প্রবল রং-তুলির অবিশ্বাস্য বিস্ফোরণে, সেই রবীন্দ্রনাথকেও শত চেষ্টা করে বুঝতে পারবে না তাঁর লেখার টেবিল, এই সত্যও রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল না।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….
বেপরোয়া নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেননি, এমন তো নয়। এমনও নয় তাঁর লেখায় ছুটে আসেনি আদিম তাড়না। কিন্তু তাঁর রঙ-তুলির কাজ তো প্লাবন! তাঁর ক্যানভাসে অবচেতনার বহ্নিস্রোত। তাঁর ছবিতে মগ্নচৈতন্যের অনির্ণেয় রহস্যলোক। তাঁর ছবি দেখে বিস্মিত ইউরোপ বলেছিল, আমরা যা পারিনি, আপনি পেরেছেন!
সেই আঁকার টেবিলের বৃদ্ধ উন্মত্ত বিরামহীন রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা, অচেনা, অব্যাখ্যাত এবং বাঙালির আদিখ্যেতার অতীত। এবং তবুও আমাদের এষণার নিরন্তর দাবিদার। এই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবির প্রায় সমস্ত নারীর চোখে আঁকলেন তাঁর নতুন বউঠানের চোখ। বললেন, অলজ্জ স্বীকারোক্তিতে, ‘নতুন বউঠানের চোখ আমি ভুলতে পারিনি!’ অথচ এই একই রবীন্দ্রনাথ জীবনে লিখলেন না লেখার টেবিলে একটিও প্রেমপত্র, এমনকী স্ত্রীকেও না। কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গুরুদেবত্ব থেকে বেরিয়ে এসে আঁকার টেবিলে প্রকাশ করলেন ছবির পর ছবিতে চাপা যৌন তাড়নার ভয়ংকর ফ্রয়েডিয়ান তোলপাড়! তাই নিঃসন্দেহে তাঁর আঁকার টেবিল, তাঁর রং তুলির ক্যানভাস, অক্লান্ত অনাত্মীয় তাঁর লেখার টেবিলের নিষণ্ণ নির্বেদের!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল