Robbar

পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 3, 2025 8:38 pm
  • Updated:March 3, 2025 11:07 pm  

পিটারের ‘টিল ডে ইউ ডু পার্ট’ নাটকের শুরুতেই দুই চরিত্রের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। দু’টি চরিত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ওরা পাথরের মূর্তি। ওরা স্বামী-স্ত্রী। ক্রমশ ওই দুই মূর্তি পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। পুরুষটি ক্রমেই হারাতে থাকে প্রাণ। আরও বেশি পাথরের মূর্তি হয়ে ওঠে ওই পুরুষ। আর যত বেশি পাথর হতে থাকে ওই পুরুষ, তত বেশি নারীত্ব দ্রব করে পাথরের ওই নারীমূর্তিকে। পুরুষ মূর্তিটির এই ক্রমিক প্রাণহীনতা, নারী মূর্তিটির এই ক্রমিক দ্রবতা ও প্রাণপ্রবাহ পিটার ফুটিয়ে তোলেন তাঁর বর্ণনায়।

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

২৯.

আমার ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে, এই অস্ট্রিয়ান লেখকের স্তইমিতা। লণ্ঠনের আলোর মতো স্তিমিত ভাষায় লেখেন তিনি গদ্য, তাঁর নাটকের সংলাপ, তাঁর স্বগতোক্তি, দুটি পাথরের মূর্তির প্রেমের গল্প, সেই গল্প নিয়ে এক নাটক, তেমন নাটক পড়িনি কখনও, লেখা যেতে পারে এমন নাটক– ভাবতেই পারিনি, লণ্ঠনের আলোর মতো মৃদু ভাষায় থাকতে পারে এমন প্রাণের তাপ, তাও জানতাম না। এমন অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয় লেখা কোন টেবিলে বসে, কলমে কালির বদলে কুয়াশা ভরে, আর কল্পনায় নিয়ে লণ্ঠনের নরম আলো আর স্মৃতিকে সঙ্গী করে মায়ের আত্মহত্যা লিখে চলেছেন কাঁটায় কাঁটায় আমার বয়সী লেখক পিটার হ্যান্ডকে?

Peter Handke wird 80 - Zwischen Provokateur und Waldgänger
পিটার হ্যান্ডকে

আমার ভাবতে ইচ্ছে করে পিটারকে অস্ট্রিয়ান শীতের সন্ধ্যেবেলা। বিকেল চারটে বাজলেই তো কুয়াশা নামে ঘনিয়ে। জুঁইফুলের মতো তুষার নামে বিস্তৃত আবছামির বুক থেকে। টেবিল ল্যাম্পের মায়াবৃত্তে, লাল ওয়াইনে চুমুক দিয়ে, ঘরের কোণে বড় একলা টেবিলের বুকে অপেক্ষমাণ কাগজে পিটার লেখেন: মানুষটি এখনও ঘুমিয়ে। যার গল্প আমি লিখছি এই কাগজের ওপর আমার লেখার টেবিলে, সেই মানুষ। সে এখনও জানে না, একটু পরেই তার ঘুম ভাঙাবে বিকট বজ্রপাতের শব্দ। মনে করা যেতে পারে এই বাড়ি এবং বিছানা কেঁপে উঠবে। এবং অনেকক্ষণ ধরে তিরতির করে কাঁপতে থাকবে। যতক্ষণ না তার চোখ খুলবে। তবে যে মানুষটির বিষয়ে লিখছি, তার বিষয়ে ওই চোখ খোলার ব্যাপারটা আসে না।

 

লণ্ঠনের আলোর মৃদুতায় এই মারাত্মক শেষ বাক্যটি লিখেছেন পিটার হ্যান্ডকে। তখনও তিনি জানেন না, ২০১৯-এ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবেন তিনি! ২০১৮ সালে প্রকাশিত হল এই উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। যার নায়ক এক অভিনেতা। উপন্যাসের বিষয় লণ্ঠনের আলোর মতোই স্তিমিত ওই অভিনেতার জীবনের একটি দিন। যা আমরা অভিনেতার জীবনে ভাবতে পারি না, ঠিক তাই। কম্পমান মৃদু বিচ্ছুরণ, ব্যস, আর কিছু না!
সদ্য মুক্তি পেয়েছে কলকাতায় উত্তমকুমার অভিনীত সেই কবেকার পুরোনো নায়ক তার শরীর থেকে বয়সের সব চিহ্ন সরিয়ে, নতুন ঝলকের সম্মোহ নিয়ে। নায়ক উত্তম চলেছেন দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার নিতে। ট্রেনে। সেখানে সুন্দরী নায়িকাও ঝলসে ওঠে। পিটারের অভিনেতা নায়কও চলেছে দেশের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার ও সম্মানপত্র গ্রহণ করতে। এমন এক উপন্যাসের নাম রেখেছেন পিটার– ‘গ্রেট ফল’, মহাপতন!

Days passed by, yet Uttam Kumar continues to rule hearts of many even today : 2024-07-24 | Aajkaal Bengali News, Bangla News, Breaking News in Bengali
‘নায়ক’ সিনেমায় উত্তমকুমার

মৃদু আলোকনের এই কাহিনি হঠাৎ অকল্পনীয় পথে পা বাড়াচ্ছে। অভিনেতা নায়ক, রাষ্ট্রপতির পুরস্কার নিতে যাচ্ছে, সে ট্রেনে, প্লেনে, গাড়িতে যাচ্ছে না। সে হাঁটছে। পরের দিন তার শুটিং আছে। তার জীবনের হয়তো শেষ ছবির শুটিং। তার বয়স হয়েছে। সে অবসর নেবে। সে হাঁটতে হাঁটতে পা ফেলে তার পরের ছবির গল্পটায়। কিংবা পরের দিনের শুটিংয়ে। রাষ্ট্রপতির বাড়ির পথ সে কবে হারিয়ে ফেলেছে। সে পা ফেলে আগামিকালে। যা এখনও ঘটেনি হয়ে ওঠে বর্তমান। এবং এই বর্তমান ইলেকট্রনিক টেকনোলজির সর্বগ্রাসী সর্বনাশ, কিন্তু ভাষাতে পিটার ধরে রাখছেন লণ্ঠনের মধ্যযুগীয় মৃদুতা!

An adventurer of the inner world | MODERN TIMES REVIEW

অভিনেতা পা ফেলে এক অরণ্যে। আর এই অরণ্য নিয়ে যায় তাকে চেনা সময়ের বাইরে। এই জঙ্গলে থাকে কিছু সমাজ হারানো মানুষ। এক বিতাড়িত বসতি। যেখানে ক্রমাগত তর্ক-বিতর্ক জীবনের খুদে খুদে বিষয় নিয়ে। অরণ্য শেষ হয় একটা পরিত্যক্ত রেল-ইয়ার্ডে। আমি পরিত্যক্ত রেল-ইয়ার্ডের সাহিত্য কখনও পড়িনি। একলা পড়ে থাকা রেলের ইয়ার্ড কত একলা, আমি জানতাম না। পিটার জানালেন। এই একাকিত্ব বিপজ্জনক। পরিত্যক্ত ইয়ার্ডের একাকিত্বে আবছা কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে বেড়ায় পুলিশের সন্দেহ। অভিনেতাকে কামড়ে দেয় পুলিশের দাঁত ইয়ার্ডের জঞ্জাল-ভরা আচ্ছন্ন কোণে। কিন্তু তারপর বোমা পড়ে! বোমাগুলো হৃদয়ের আকারে। ঠিক যে বোমা আমরা দেখলাম ক’দিন আগে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মাথায় ফেললেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আর ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্স। পিটারের ভাষায়, ‘the graphic representation of bomb strikes, portrayed at a distance as a heart, boom, boom.’

বৃদ্ধ অভিনেতা পৌঁছতে পারে না রাষ্ট্রপতি ভবনে। সে তো ভবিষ্যতে পা ফেলেছে। তার চারধারে বোমা পড়ছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বোমাগুলো দেখতে সব হৃদয়-আকারের। নেমে আসছে লণ্ঠনের আলোর মতো স্তিমিত আলোর আকাশ থেকে। ভারি মধুর আকাশ। কেমন মধুর? একটি অতুলনীয় বাক্য লিখেছেন পিটার, যা অনুবাদ করার সাহস পেলাম না: like the foliage and the bird merging into one.

ONI KOJI SU BOMBARDOVALI SRBIJU NE PRIPADAJU NI EVROPI NI ZEMLJI: Ovako je GOVORIO NOBELOVAC Peter

আমি পিটার হ্যান্ডকের লেখার টেবিলটাকে চুমু খেতে চাই।

পিটারের ‘টিল ডে ইউ ডু পার্ট’ নাটকের শুরুতেই দুই চরিত্রের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। দু’টি চরিত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ওরা পাথরের মূর্তি। ওরা স্বামী-স্ত্রী। ক্রমশ ওই দুই মূর্তি পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। পুরুষটি ক্রমেই হারাতে থাকে প্রাণ। আরও বেশি পাথরের মূর্তি হয়ে ওঠে ওই পুরুষ। আর যত বেশি পাথর হতে থাকে ওই পুরুষ, তত বেশি নারীত্ব দ্রব করে পাথরের ওই নারীমূর্তিকে। পুরুষ মূর্তিটির এই ক্রমিক প্রাণহীনতা, নারী মূর্তিটির এই ক্রমিক দ্রবতা ও প্রাণপ্রবাহ পিটার ফুটিয়ে তোলেন তাঁর বর্ণনায়। নারীটি কথা বলে। পুরুষটি কী শোনে? শুনতে পায়? নারীটি প্রাণ প্রকাশ করে এই ভাষায়, প্রাণ ও প্রণয় মিশে যায়:

A good man made me his wife, and I’m proud of that. A good man? For me, at least. For the dark, gloomridden person was, perhaps, its me, the woman here.

…………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………..

প্রশ্ন হল, এই নারীটি কে? সেই কী ছিল না ওই পুরুষটির মধ্যেই? পিটার লিখছেন নাটকের শেষে, গ্রিক পুরাণে ‘ইকো’ নামে এক চরিত্র আছে, আমার মনে পড়ছে। তেমন কিছু বড় চরিত্র নয়। হেলাফেলার এক দেবী। সাধারণ জলপরী। কিন্তু তার নিজস্ব একটি কণ্ঠ আছে। আমার নাটকে ওই পাথর হয়ে যাওয়া পুরুষকে প্রাচীন গ্রিকদেবী তার আধুনিক মনের কিছু কথা বলছে। এই সেই মনের কথার একটুখানি:

ওহে ভালো মানুষ পুরুষ, আমার জন্যে তুমি সত্যিই ভালোমানুষ। কেন-না আমাকে তুমি তোমার স্ত্রী করেছ। এটাই তো আমার অহংকার। এক সময়ে আমি থাকতাম অন্ধকারে, বিপন্ন বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন এক মানুষ। আর পুরুষ, তুমি ছিলে এক তুখোড় অভিনেতা। আলো-রাজ্যের চ্যাম্পিয়ন। আমিই সেই নারী কোনও এক যুগে যে পুরুষকে বলেছিল, আমি অবহেলা সহ্য করতে পারি। ‘I can put up with being ignored. Another woman once said to another man.’ তুমি সেই পুরুষ নও। আমি নই সেই পাতাল দেবী। আমার নাম আর নয় ইকো। আমি নই কারো প্রতিধ্বনি। খুঁজে পেয়েছি নিজের প্রকাশ ও প্রবাহ। প্রাণ ও প্রণয়। আমার তো মনে হয় পিটার, এই যে আমি খুঁজে পেলাম আমার কণ্ঠ, আমার তারল্য, স্বাধীন ঢেউ ও ফেনা, ঝাঁপিয়ে পড়ার সৈকত, কৈফিয়তহীন তরঙ্গ, তার নেপথ্যে তোমার ওই লেখার টেবিলটার অবদান কিছু কম নয়।

…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব  ……………………

পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?

পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!

পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল

পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো

পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়

পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!

পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে

পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে

পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি

পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল

পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল

পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল

পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে

পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে

পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা

পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল

পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে

পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?

পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব

পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি

পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল

পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি

পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে

পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল

পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা

পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা

পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে

পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল