Robbar

মেঘনাদবধ কাব্য আমার কাছে অভিনয়ের ক্লাস

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 25, 2024 4:31 pm
  • Updated:January 25, 2024 4:50 pm  

আমি কখনও ভাবিনি এই কাব‍্যকে মঞ্চস্থ করব। কবিতার মধ্যে যেমন অনেক না-বলা কথা থাকে, অভিনয়ের মধ্যেও তেমন, যাকে আমরা অভিনেতারা বলি ‘আনস্পোকেন ওয়ার্ডস’, তা নিহিত থাকে। তাই চিরকালই আমার অভিনয় চর্চার প্রধান মাধ্যম আজও কবিতা। শম্ভু মিত্রর কথা শুনে, তাঁর লেখা পড়ে, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর সঙ্গে থেকে বুঝেছি, কবিতা চর্চার মধ্যে থাকলে অভিনয় আরও সমৃদ্ধ হবে, আরও গভীরে যাবে। তাই অভিনয়ের শুরু থেকে, সেই চল্লিশ বছর আগে থেকে, আমি অভিনয়ের যন্ত্রটা কতভাবে বাজানো যায়, তার রংটা কতভাবে আবিষ্কার করা যায়, তা ভেবে গিয়েছি, খুঁজে গিয়েছি।

গৌতম হালদার

প্রথমে ‘নান্দীকার’ ও পরবর্তীতে আমার ‘নয়ে নাটুয়া’– এই দুই নাট‍্যদলেই ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ অভিনীত হয়েছে। সব মিলিয়ে এই নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে দীর্ঘ ২৯ বছরের ওপর। এই প্রায় তিন দশকে জীবন বদলায়, যাপন বদলায়, সমাজ বদলায়, তার বাকভঙ্গিমা বদলায়, গতি বদলায়, দর্শন বদলায়, দর্শনহীনতাও তৈরি হয়। বের্টোল্ট ব্রেখট-এর ‘গালিলেও’ নাটকের সেই কথা, দেশের নেতা তেমনই হবে, যেমনটা দেশের মানুষ চাইবে; কাজেই রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ম মেনেই বদলাবে। আর আমাদের বেঁচে থাকার নিয়ম হল, আমাদের সবসময়ই মনে হয়, এর চেয়ে খারাপ সামাজিক পরিস্থিতি বোধহয় আগে আসেনি। এই নাট‍্যের প্রেক্ষিতে যদি বলি, এর শুরুর সময়েও এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে যা নঞর্থক, আবার এখনও সেসব ঘটে চলেছে। কিন্তু জরুরি হল বাংলা ভাষার উচ্চারণ বদলে যাওয়া। একজন জীবিত অভিনেতার কাজ সেই বদলকে লক্ষ করে যাওয়া। আজ থেকে ২৯ বছর আগে, ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ শুরুর সময় ইন্দ্র বা লক্ষণ যেভাবে কথা বলত, এখন তা বদলাচ্ছে। প্রতিটা রিহার্সালে তা বদলে বদলে যায়। শব্দ মাইকেলেরই থাকছে, কেবল আঙ্গিক বদলাচ্ছে। ২৩ জানুয়ারি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ একটি শো ছিল, সেখানে একরকম হয়েছে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র জন্মদিনে গিরিশ মঞ্চে শো, সেদিন আবার অন‍্যরকম। এবং এটা একটা ঐতিহাসিক ব‍্যাপার, হিন্দু স্কুল, মাইকেলের স্কুলই ওঁর দ্বিশততম জন্মদিনের অভিনয়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

দর্শক বিশ্বাস করবে কি না জানি না, আমি কিন্তু কোনও দিন ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ মুখস্থ করিনি। এতবার আসলে আমার শরীর দিয়ে, মন দিয়ে আমি এই কাব‍্যকে চিনেছি, বুঝেছি, তাতেই এটি আমার কাছে স্মৃতিধার্য হয়ে থেকে গিয়েছে। কোনও শব্দর ব‍্যঞ্জনা যেভাবে মাইকেল ভেবেছেন, সেখান থেকে একটু বিচ‍্যুতি হলেও আমি এখন যেন তা বুঝতে পারি। আসলে অভিনয় অর্গানিক, শরীর দিয়ে টেক্সট-কে পাঠ করতে হয়। মাইকেলের এই কাব‍্য যেন আমার শরীরে প্রোথিত।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’-র অভিনয় শুরুর দিকে অনেকের মনে হয়েছিল, নাটকটা বুঝি শক্ত। আমি আশঙ্কা করছিলাম, খুব বেশি লোক এই প্রযোজনা দেখবে না। তারপর ধীরে ধীরে ক্রমাগত দর্শক বেড়েছে। ১৪ বছর আগে ‘নয়ে নাটুয়া’-র হয়ে প্রথম যে অভিনয়টা করলাম, সেখানে আমরা শুরুতেই শঙ্খধ্বনি সংযোজন করলাম। তারপরে পর্দা খুলছে যখন, প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে উন্মাদের মতো হাততালি দিয়ে উঠল দর্শক। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। সাধারণত ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ দর্শক চুপ করে দেখে, মন দিয়ে। সেই অভিনয়ে দর্শক কানায় কানায় ভর্তি তো ছিলই, অনেকে দাঁড়িয়ে দেখেছিল। সেই দিনটা আমাদের অনেকটা সাহস দিয়েছে, আশা জাগিয়েছে। তারপর যতগুলো অভিনয় হয়েছে, সেখানে দর্শক পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহেই দেখেছে এই অভিনয়। বহু দর্শক ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ একাধিকবার দেখেছে। একজন দর্শক আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি কলকাতার সবক’টি শো দেখেছেন। নতুন প্রজন্মের অনেকে এসেছে, হয়তো আগের প্রজন্মের থেকে জেনে। এইভাবেই এই নাট‍্য জারিত হয়েছে।

Meghnad Badh Kabya- Goutam Halder (clippings) - YouTube

মাইকেল মধুসূদনের এই ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ আমার কাছে ছিল অভিনয়ের ক্লাস, অভিনয় শিক্ষার অন‍্যতম প্রধান মাধ্যম। আমি কখনও ভাবিনি এই কাব‍্যকে মঞ্চস্থ করব। কবিতার মধ্যে যেমন অনেক না-বলা কথা থাকে, অভিনয়ের মধ্যেও তেমন, যাকে আমরা অভিনেতারা বলি ‘আনস্পোকেন ওয়ার্ডস’, তা নিহিত থাকে। তাই চিরকালই আমার অভিনয় চর্চার প্রধান মাধ্যম আজও কবিতা। শম্ভু মিত্রর কথা শুনে, তাঁর লেখা পড়ে, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর সঙ্গে থেকে বুঝেছি, কবিতা চর্চার মধ্যে থাকলে অভিনয় আরও সমৃদ্ধ হবে, আরও গভীরে যাবে। তাই অভিনয়ের শুরু থেকে, সেই ৪০ বছর আগে থেকে, আমি অভিনয়ের যন্ত্রটা কতভাবে বাজানো যায়, তার রংটা কতভাবে আবিষ্কার করা যায়, তা ভেবে গিয়েছি, খুঁজে গিয়েছি। তাই আমি বহু ধরনের নাচ শিখেছি, কত্থক, ভরতনাট‍্যম, কথাকলি– ইত‍্যাদির একেবারে প্রাথমিক স্তরটা আয়ত্ত করেছি। মার্শাল আর্টও শিখেছি ছোটবেলায়। আমার বন্ধু বিখ্যাত সেতার-বাদক, কিশোর চক্রবর্তী, যে কিনা নিখিল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের কোলের শিষ্য, তার থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রারম্ভিক ধারণাটা নিয়েছি, গুরু প্রবীর দত্তর কাছে ১৫ বছর তালিম নিয়েছি। স্বর নিয়ে অভিনেতাকে তো ভাবতেই হয়, সেই শিক্ষা আমাকে শাস্ত্রীয় সংগীত দিয়েছে। এই প্রতিটা উপাদান কিন্তু ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’-তে প্রযুক্ত হয়েছে। মেঘ, কৌশিকী কন্নড়, পিলু, কাফি, মালকোষ, টোরি, মুলতানি– এই সব রাগ এই প্রযোজনায় এসে জড়ো হয়েছে। এগুলো কোনওটাই জোর করে প্রবিষ্ট নয় এই নাটকে, আমি খেয়াল করে দেখেছি, কোন সংলাপ কখন দেওয়া হচ্ছে, কোন চরিত্র গভীর রাতে কিছু বলছে, আবার কোন চরিত্র বিকেলে বলছে তার কথা, সেই অনুযায়ী সুরগুলো এসেছিল। বলা যায়, মাইকেলের শব্দ থেকেই সুর এসেছিল। এই যে অভিনয়ের নানা রং, এগুলোর জন্য কবি মাইকেলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, ঋণী। তাঁর কাছ থেকেই যেন আমি উপহার হিসেবে পেয়েছি এটা।

……………………………………………………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন: মধুসূদন কখনও ফিরতে পারেননি, না ফেরাই তাঁর স্বলিখিত পথ

………………………………………………………………………………………………………………………………….

দর্শক বিশ্বাস করবে কি না জানি না, আমি কিন্তু কোনও দিন ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ মুখস্থ করিনি। এতবার আসলে আমার শরীর দিয়ে, মন দিয়ে আমি এই কাব‍্যকে চিনেছি, বুঝেছি, তাতেই এটি আমার কাছে স্মৃতিধার্য হয়ে থেকে গিয়েছে। কোনও শব্দর ব‍্যঞ্জনা যেভাবে মাইকেল ভেবেছেন, সেখান থেকে একটু বিচ‍্যুতি হলেও আমি এখন যেন তা বুঝতে পারি। আসলে অভিনয় অর্গানিক, শরীর দিয়ে টেক্সট-কে পাঠ করতে হয়। মাইকেলের এই কাব‍্য যেন আমার শরীরে প্রোথিত।

এই অভিনয়টা করতে করতে একসময় আমি ঝুঁকে পড়ছিলাম একটু পাশ্চাত্য ধরনের দিকে। চরিত্রগুলোকে আলাদা আলাদা করে দেখতে চাইছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল, রসটা যেন মরে যাচ্ছে। তখন মনে পড়ল, বাংলার একটা অন‍্যতম ধারা হচ্ছে, কীর্তন। যে কীর্তন করছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে, সে কৃষ্ণের মাহাত্ম্য, রাধার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে করতে হঠাৎ গানে চলে যাচ্ছে। সেই যাতায়াতটা অসম্ভব মসৃণ।তার কৃষ্ণভাব থেকে রাধাভাবে চলে আসার পথটাও তেমনই। এটা কিন্তু পাশ্চাত্যের ওই ‘কম্পার্টমেন্টালাইজড্’ ধরন, যেখানে প্রতিটা চরিত্র একটি কামরার আলাদা আলাদা বগির মতো, সেখানে ধরা পড়বে না। রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, মায়া, লক্ষণ, দূত, হাজার হাজার রক্ষসেনা, হনুমান– এই প্রতিটা চরিত্রের কথক কিন্তু একজন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত। একটি দৃশ্যের কথা বলি, যেখানে লক্ষণ ও বিভীষণ গুপ্তহত্যার জন্য নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন সেই নগরীর বর্ণনায় মাইকেল বলছেন, ‘কত যে দেখিলা রথী, কত যে শুনিলা, কী আর কহিবে কবি’। এই ‘কী আর কহিবে কবি’ তো আসলে মাইকেলের বর্ণনা! তিনি তো তাঁর রাজনীতি, সমাজ, দর্শন দিয়ে মহাকাব‍্যকে দেখছেন। তাই রাম তাঁর কাছে খলনায়কের মতো, ইন্দ্রজিৎ নায়ক। এই দর্শনকে আমি তুলে ধরছি। আমি হচ্ছি অন‍্য কথক, যে মাইকেলের সঙ্গে এই কথকতায় প্রবেশ করছি। আমি জ‍্যান্ত একজন মানুষ, আমার কল্পনা তো ভিন্নতর। কিন্তু আবার এই কথকতায় আমি আমার সমাজটাকেও দেখতে পাচ্ছি।

২৩ তারিখ যে অভিনয় হল, সেখানেও যখন মেঘনাদের মৃত্যু হচ্ছে, ‘লঙ্কার পঙ্কজ রবি গেলা অস্তাচলে’-র পর তার মাথা ঢলে পড়ল, তখন দর্শক ‘আহা’ বলে উঠল। তারা কিন্তু মেঘনাদের মৃত্যুকে বাহবা দিচ্ছে না, তারা বাহবা দিচ্ছে মাইকেলের এই অবিচারের বর্ণনায়। কাজেই আমি আসলে আমি নই, মাইকেলের কথাই যেন আমি পৌঁছে দিয়েছি।

অনেকেই বলেন, বিদেশে এই প্রযোজনা মঞ্চস্থ হলে তার কদর অন‍্যরকম হত। কিন্তু মাইকেল তো বাংলায় ফিরে এসে এই কাব‍্য রচনা করেছেন। কম সামাজিক প্রতিকূলতা তো তিনি সহ‍্য করেননি। আমাদের বাঙালি মনীষাদের তো তেমন অনেক বাধা, অনেক গঞ্জনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তারপরেও তাঁদের আকাশছোঁয়া প্রতিভা টলেনি। তাই আমি বাংলা ভাষা ও মাইকেল মধুসূদন দত্তর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’-র জন্য।

অনুলিখন: প্রিয়ক মিত্র