Robbar

কলকাতাই নজরুল এবং জসীমউদ্দিনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিল আব্বাসউদ্দিনকে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 30, 2025 5:39 pm
  • Updated:December 30, 2025 7:48 pm  
Abbasuddin Ahmed met Nazrul and jasimuddin in kolkata | Robbar

নজরুল ও আব্বাসউদ্দিন– দু’জনে মিলে বাংলা সংগীতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘ইসলামী সংগীত’ ধারা। এই ধারার কিছু গানে রয়েছে ইসলামের তত্ত্বগত দিক– যেমন, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে মধু পূর্ণিমাতে সেথা চাঁদ দোলে’, ‘এই সুন্দর ফুল এই সুন্দর ফল আর মিঠা নদীর পানি খোদা তোমার মেহেরবানি’। দ্বিতীয় ধারায় ইসলামের আচারগত দিক, বিশেষত রোজা, নামাজ, হজ, ঈদ, জাকাত ইত্যাদি সম্পর্কিত।

সুখবিলাস বর্মা

পঙ্কজকুমার মল্লিক স্মৃতিচারণায় তাঁকে ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী পল্লীগীতিশিল্পী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন ‘বাংলার অমর লোকশিল্পী’। জসীমউদ্দিন তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘অঞ্জনা তীরে খঞ্জনা পাখি’। তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জন, যাঁকে তিনি অনেক চিঠিতে ‘প্রিয় আলেয়া’ বলে সম্বোধন করতেন, তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেসার কাছে তিনি ‘গানের পাখি’। বাংলার লোকসংগীতের জাদুকর আব্বাসউদ্দিন আহমেদ (Abbasuddin Ahmed)। পঙ্কজকুমার মল্লিক ‘আমার যুগ আমার গান’-এ মন্তব্য করেছেন– ‘সে যুগের প্রখ্যাত পল্লীগীতি বিশারদ আব্বাসউদ্দীন আহমদ মহাশয়ের কথা একবার স্মরণ করা কর্তব্য মনে করি।… সঙ্গীত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর সংস্পর্শে এসে প্রচুর আনন্দ পেয়েছি। বাংলার লোকগীতির জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ ছিলেন তিনি। দেশ বিভাগের কিছু পরে তিনি যখন অন্য দিকে চলে যান তখন মর্মান্তিক কষ্ট পেয়েছিলাম’।

আব্বাসউদ্দিন আহমেদ

দেশভাগের পর বাংলা ও পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করে স্বাধীন ভারতের পতাকা ওড়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। ঢাকায় পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে একদিন আগে ১৪ আগস্ট। সেদিন ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন আব্বাসউদ্দিন। তাঁর নিজের কথায়, “এলাম ঢাকায়। এক অপরিচিত পারিপার্শ্বিকে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট, শবেবরাতের রাত। রাত ঠিক বারোটার পর ঢাকা রেডিওতে প্রথম কোরানের আয়াত গম্ভীর সুরে আবৃত্তি করলেন এক মওলানা। এর পরই আমার সৌভাগ্য হোল পাকিস্তানের রেডিওতে প্রথম পাকিস্তানের গান গাওয়ার– ‘সকল দেশের চেয়ে পিয়ারা দুনিয়াতে ভাই সে কোন স্থান? পাকিস্তান সে পাকিস্তান’।” 

আব্বাসের কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে যাওয়াতে, অর্থাৎ দেশ ছেড়ে যাওয়াতে শুধু পঙ্কজ মল্লিক নন, কলকাতার সংগীত ও সাহিত্য জগতের বিশিষ্টজন-সহ এপার বাংলার, বিশেষ করে উত্তর বাংলার কৃষক-মজুর আপামরজন ‘মর্মান্তিক কষ্ট’ পেয়েছিলেন। তাঁদের এই কষ্ট ও তজ্জনিত অভিমানের প্রকাশ আমরা স্বচক্ষে দেখেছি ১৯৯০ সালে ‘আব্বাসউদ্দীন স্মরণ সমিতি’ গঠনের পর। কোচবিহারে সমিতির প্রথম অনুষ্ঠানে আমরা কোচবিহার এলাকার সব বয়স্ক ভাওয়াইয়া শিল্পীদের সংবর্ধনা জানিয়েছিলাম। সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রত্যেকেই তাঁদের সেই মনোকষ্টের কথা তুলে ধরেছিলেন– কেন তিনি কোনও কারণ ছাড়াই আমাদের দেশত্যাগ করেছেন, কোচবিহার ত্যাগ করেছেন।

আব্বাসউদ্দিন, আলাউদ্দিন খাঁ এবং কাজী মোতাহার হোসেন

আসলে কোচবিহারের মানুষ আব্বাসউদ্দিন ও তাঁর পরিবারকে ভীষণ ভালোবাসেন। তিনি জন্মেছিলেন তৎকালীন দেশীয় রাজ্য কোচবিহারের একটি ছোট্ট গ্রাম বলরামপুরে ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর। লেখাপড়া করেছেন গ্রামের স্কুল, তারপর মহকুমা শহর তুফানগঞ্জ স্কুলে। কোচবিহারের বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ পাশ করেছেন, কিন্তু বিএ পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেননি, পরীক্ষার সময়ে বাবার কঠিন অসুখের কারণে।

জীবনের শৈশব থেকে যৌবনের একটা সময় পর্যন্ত তাঁর কেটেছে বলরামপুর, তুফানগঞ্জ ও কোচবিহারে। এই সময়ে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের চর্চা চলতে থাকে। কীভাবে চলেছে তাঁর সংগীতচর্চা, ভাওইয়া চর্চা– কার কাছে শিখেছিলেন সেসব গান? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে আব্বাসউদ্দিনের গ্রামের আর এক প্রতিভা প্রখ্যাত ভাওইয়া শিল্পী তাঁর অনুজপ্রতিম প্যারিমোহন দাসের সাবলীল উত্তর, ‘গ্রামের মানুষ এ-গান কারওর কাছ থেকে ধরাধরি করে শেখে না, শুনে শুনে আপনা-আপনিই শেখে। উঠতে বসতে মাঠে ঘাটে এ-গান শোনা যায়। যার কণ্ঠে সুর রয়েছে এবং শোনার ইচ্ছে রয়েছে তারা শুনে শুনেই শিখে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মে, প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে ভাওইয়া চটকার সুর আপনা-আপনিই গলায় বসে যায়।’

এটাই স্বভাবসিদ্ধ, এটাই রীতি। আব্বাসউদ্দিনের নিজের কথায়, ‘ছোট বেলা থেকে ঐ মোরগের ডাক, শিয়ালের ডাক, ঘুঘুর ডাক, পায়রার ডাক, ব্যাঙের ডাক, কোকিল, দোয়েল, বৌ কথা কও, পাপিয়ার সুর শুনে শুনে আমার গলার সুর বাসা বেঁধেছিল। এমন কি স্কুলের যখন ঘণ্টা পড়ত, সেই ঘণ্টার শব্দের শেষ সুরটুকু… ঢং-এর অং-টুকু গলায় তুলে নিতাম’। এটাই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘লোকসংগীতের বাহিরানা’। 

মহম্মদ হাফিজুর রহমানের সঙ্গে আব্বাসউদ্দিন আহমেদ

কিন্তু অনায়াসলব্ধ এই ভাওয়াইয়ার কণ্ঠসম্পদে আব্বাস সন্তুষ্ট থাকার মানুষ নন। উচ্চাঙ্গ সংগীত গায়ক রাজেন রায়-এর বৈঠকখানায় সুযোগ হয়েছিল জলপাইগুড়ির (বৈকুণ্ঠপুরের) রায়কত রাজবংশের প্রতিভাধর উচ্চাঙ্গ সংগীত গায়ক সরোজ রায়কতের গান শোনার। এসবের মধ্য দিয়ে সংগীতের প্রতি আকুলতা আরও বেড়ে যায়। 

ঠিক এই সময়ে তাঁর জীবনে আসে মহাসুযোগ! কলেজের মিলাদ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আব্বাসের গান শুনে মুগ্ধ হলেন। আব্বাসকে বললেন কলকাতা আসতে– গান রেকর্ড করার ব্যবস্থা হবে। সুযোগ এল কলকাতা যাওয়ার, বন্ধু জিতেন মৈত্রের বিয়ে উপলক্ষে। যোগাযোগ হল গ্রামোফোন কোম্পানির বিমল দাশগুপ্তর সঙ্গে এবং তাঁর সহায়তায় এইচএমভি থেকে প্রথম রেকর্ড বের হল আধুনিক গানের, কবি শৈলেন রায়ের লেখা দু’খানি গান ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে’ এবং ‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়’। সালটা ছিল ১৯৩০। বাড়ির কাউকে না বলেই এসেছিলেন কলকাতা। কণ্ঠগুণে প্রথম প্রচেষ্টাতেই কিস্তিমাত। ফিরে গিয়েছেন বলরামপুরে। রেকর্ড করা গান সংগীত জগতে যথাযোগ্য আদর পেয়েছে।

জসীমউদ্দিন

আব্বাস আবার কলকাতা এলেন ১৯৩১ সালে। এবারে লক্ষ্য একটি-দু’টি গান রেকর্ড করে বাড়ি ফিরে যাওয়া নয়। আইন কলেজের পুনর্মিলন উৎসবে জিতেন মৈত্রের উদ্যোগে সুযোগ পেলেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে সংগীত পরিবেশনের এবং তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন। এই অনুষ্ঠানের সফলতার মাধ্যমে স্কটিশচার্চ কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ওন হোস্টেল, বেকার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল, বালিগঞ্জ, শ্যামনগর, ডায়মন্ডহারবার, হাওড়া, হুগলি প্রভৃতি নানা স্থান থেকে এল সংগীত পরিবেশনের সুযোগ। আব্বাস হয়ে উঠলেন আধুনিক গানের এক সার্থক শিল্পী।

আধুনিক গান ছাড়াও তিনি রেকর্ড করেন পল্লি অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ভাটিয়ালি, জারি, সারি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী ইত্যাদি নানা আঙ্গিকের গান, নজরুল ও জসীমউদ্দিনের লেখা ভাটিয়ালি ও অন্যান্য পল্লিসংগীত। গেয়েছেন নজরুলের লেখা, ‘হিন্দু আর মুসলিম মোরা দুই সহোদর ভাই, এক বৃন্তে দুটি কুসুম এক ভারতে ঠাঁই’, ‘ভারতের দুই নয়ন-তারা হিন্দু মুসলমান, দেশ জননীর সমান প্রিয় যুগল সন্তান’ ইত্যাদি গান। গেয়েছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের ‘প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্ব তলায় বংশী বাজায় কে’, ‘বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে, গরুর কাধে লাঙ্গল দিয়া ঠেলতে ঠেলতে ঠেলতে’, ‘হাড় কালা করলাম রে দ্যাহ কালার লাইগ্যা রে, অন্তর কালা করলাম রে দুরন্ত পরবাসে’, ‘ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’, ‘ও রঙ্গিলা নাওয়ের মাঝি’ ইত্যাদি। এরই মধ্যে তাঁর বিখ্যাত দোতরাবাদক কানাই শীল সংগৃহীত গান গেয়েছেন অনেক– ‘গুরুর পদে প্রেম ভক্তি হল না মন হবার কালে’, ‘আমার গলার হার খুলে নে ওগো ললিতে’, ‘আমায় এত রাতে ক্যানে ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে’ ইত্যাদি গান। উল্লেখ করতে হয়, গিরিন চক্রবর্তীর সুরে ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই’।

ইতোমধ্যে গ্রামোফোন কোম্পানির চিৎপুরের রিহার্সাল রুমে কাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। তিনি আব্বাসকে যথারীতি সাহায্য করে চলেছেন। কোচবিহারে আব্বাসের কণ্ঠে শোনা ‘নদীর নাম সই কচুয়া মাছ মারে মাছুয়া মুই নারী দিছং ছ্যাকাপারা’ গানটি গাইতে বললেন। আব্বাস গাইছেন, কাজী সাহেব সেই সুরে গান লিখছেন, ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি’। সেদিন থেকেই শুরু হল এই দুই প্রতিভার সৃষ্টি ও প্রকাশ প্রচার। তাঁরই পরামর্শে আব্বাস ঠুংরির বাদশা ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁ-এর কাছে নাড়া বেঁধে কণ্ঠচর্চা করেছেন। 

ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁ

গানের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে শিল্পীর জীবনযুদ্ধ। কলকাতায় ও আশেপাশে দু’-একটি অনুষ্ঠানে যা পান তাতে তো চলছে না– তিনি তো বলরামপুরের বাড়িতে তাঁর স্ত্রীকে রেখে এসেছেন। নিজের খরচ বাদেও বাড়িতে স্ত্রীর কাছে পাঠাতে হবে। তাই তিনি দেখা করলেন তখনকার ডিপিআই-এর পি.এ জলপাইগুড়ির সফিকুল ইসলামের সঙ্গে; তিনিই ওই অফিসে মাসিক ৪৫ টাকা বেতনে একটি চাকরি জোগার করে দিলেন। সেখান থেকে যোগদান করলেন বাংলা সরকারের কৃষিবিভাগে, স্থায়ী পদে। এই পদে তিনি কাজ করেছিলেন দীর্ঘ ১২ বছর। অফিসে কাজ করছেন, গান চর্চা করছেন, পরের পর রেকর্ড করে যাচ্ছেন– কিন্তু মন তো পড়ে আছে বলরামপুরে, তুফানগঞ্জে ও কোচবিহারে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে একনাগাড়ে বাস করতে পারেননি। বাবার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো ছিল, কিন্তু বাবার কাছে কখনও হাত পাতেননি। তিনি থাকতেন কোনও মেস বা হোটেল-এ।

কলকাতাই তাঁর কাছে সবটুকু। সংগীত জীবনের স্ফুরণ থেকে মধ্যগগন পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বছরের বেশি সময় কেটেছে তাঁর কলকাতায়। কলকাতা তাঁকে সব দিয়েছে। বড় সাধ ছিল বেতারে গান গাইবেন, সেই সাধও পূর্ণ হয়েছে কলকাতায়। তিনি বলছেন, ‘প্রথম যেদিন রেডিওতে গান গাই সেদিন আমার শিল্পী-জীবনে নতুন এক অনুভূতির স্বাদ পেলাম।’ কলকাতাতেই তিনি সান্নিধ্য লাভ করেছেন তাঁর প্রধান গীতিকার, সুহৃদ, ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড কাজী নজরুল ইসলামের; পেয়েছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন ও গোলাম মোস্তফার মতো কবি গীতিকারের সহৃদয়তা। নজরুল ও তিনি– দু’জনে মিলে বাংলা সংগীতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘ইসলামী সংগীত’ ধারা। এই ধারার কিছু গানে রয়েছে ইসলামের তত্ত্বগত দিক– যেমন, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে মধু পূর্ণিমাতে সেথা চাঁদ দোলে’, ‘এই সুন্দর ফুল এই সুন্দর ফল আর মিঠা নদীর পানি খোদা তোমার মেহেরবানি’। দ্বিতীয় ধারায় ইসলামের আচারগত দিক, বিশেষত রোজা, নামাজ, হজ, ঈদ, জাকাত ইত্যাদি সম্পর্কিত। নজরুলের প্রথম ইসলামী সংগীত ‘ও মন রমজানের এই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ কিংবা ‘হে নামাজি, আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ’, ‘দে জাকাত দে জাকাত দে জাকাত তোরা দেরে জাকাত, তোর দিল খুলবে পরে ওরে আগা খুলুক হাত’ ইত্যাদি গানও এই সময়েই রচনা। 

কাজী নজরুল ইসলাম

আব্বাসউদ্দিনের সংগীত-জীবনের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান করার অভিজ্ঞতা। সভাগায়ক পরিচিতি তাঁর সংগীত-জীবনকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। এই সব সভায় তিনি প্রধানত ইসলামী সংগীত গাইতেন মুসলমান সমাজকে জাগ্রত করার জন্য, সংগীত-সংস্কৃতির প্রতি তাদের কুসংস্কার দূর করার জন্য।

গানের সুবাদে থিয়েটার ও সিনেমার সঙ্গেও যোগাযোগ ঘটেছিল। এ সবকিছুই ঘটেছে কলকাতাকে ঘিরে। তাঁর জীবনে নাম-যশ-অর্থ-প্রতিপত্তি সবই প্রায় কলকাতা-কেন্দ্রিক। সবই পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক। 

এইসব কিছুর মধ্যেও তিনি নিজের ভাষা রাজবংশী ও ‘ভাওয়াইয়া’ ভুলে যাননি। রেকর্ড কোম্পানি এইসব গান রেকর্ড করতে সহজে রাজি হয়নি। তিনি জেদ ধরেছিলেন, ভাওয়াইয়া রেকর্ড করতে না-দিলে তিনি আর কোনও রেকর্ড করবেন না! কোম্পানি বাধ্য হয়ে রাজি হল এবং তিনি গাইলেন, ‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে, কুন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে’, ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই হাকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে রে’ এবং ‘আজি ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’-র মতো অসংখ্য জনমুখী ভাওয়াইয়া আর ‘প্রেম জানে না অসিক কালাচন’, ‘আগা নাওয়ে ডুবু ডুবু পাছা নাওয়ে বইসো’র মতো মনমাতানো চটকা। সারা বাংলা মেতে উঠল এই গান শুনে। আব্বাসও মেতে উঠলেন ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি-জারি-সারিগান নিয়ে। হয়ে উঠলেন পল্লীগীতির যশস্বী শিল্পী, আর ‘ভাওয়াইয়া সম্রাট’।