রুটি কিনতে বেরিয়ে আহমদ যখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে পাহাড়ি পথ বেয়ে, ছুটতে থাকে বন্ধুর ঘরের খোঁজে, তখন আমরাও মনে-মনে তিনবার বলি ‘মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি’! এবং এই সত্য শিখি যে ভালোবাসা একটা শ্রমসাধ্য কাজ, বিরোধ ছাড়া, সংঘাত ছাড়া, রক্তক্ষরণ ছাড়া ভালোবাসা যায় না। নিজেকে রিক্ত না করে, বিপন্ন না করে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসা মানে ‘কর্তব্য’ও বটে, আর ভালোবাসার জন্য চাই বিরুদ্ধতার সাহস। আহমদের ওই ছুট– তার আবহে যে সংগীত বেজে ওঠে– তার ছন্দে-ছন্দে উপচে পড়ে সেই মহব্বতের পেয়ালা। যে-সে ভালোবাসা নয়, খাঁটি বিপ্লবী ভালোবাসা।
আব্বাস কিয়ারোস্তামির ছবি বলতে কেউ বোঝেন ইরানের সভ্যতা ও ভূপ্রকৃতির সম্মোহন; কেউ-বা ফারসি কবিতায় অবগাহন। দুটোই তাঁর চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত সত্যের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সত্যিই তো, বিভূতিভূষণের দেশে না জন্মালে কি সত্যজিৎ ‘পথের পাঁচালী’ রচনা করতেন? কিন্তু তার বাইরেও একজন কিয়ারোস্তামি আছেন, যিনি ছবি বানিয়েছেন সাচ্চা বিপ্লবীর মতো। যাঁরা ‘ক্লোজ-আপ’ দেখেছেন, তাঁরা জানেন, এই ছবিতে একটিমাত্র উদ্ধৃতি আছে। সেটা তলস্তয়ের। ‘শিল্পে আমরা দেখতে চাই সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা আর দুর্দশার জ্যান্ত ছবি’। আদ্যন্ত কোর্টরুম ড্রামা, অথচ এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিট এই ছবিতে কথা হয় শুধু শিল্প আর এথিক্স নিয়ে। শিল্প কাকে বলে, শিল্প কেমন হওয়া উচিত, মানুষের সঙ্গে– জীবনের সঙ্গে– মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি ও কারুবাসনার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক কীরকম হতে পারে, খুব সহজ ভাষায় ‘ক্লোজ-আপ’-এ এসব কথা বলা হয়েছে। আমি তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আমি বলতে চাই, এবং বেশ জোরের সঙ্গেই বলতে চাই– আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘কোথায় বন্ধুর ঘর’ ছবিটা দুনিয়াভর স্কুলপাঠ্য করা হোক। হয়তো ‘দ্য স্টিম রোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন’ এবং ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’-এর পাশাপাশি, তা হলে তা-ই হোক।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আহমদ আবিষ্কার করে সে ভুল করে তার সহপাঠী, বন্ধু মহম্মদ রেজা নেমাতজাদে-র হোমটাস্কের খাতা নিজের ব্যাগে ভরে ফেলেছে। ব্যাপার গুরুতর, কারণ মাস্টারমশায় নেমাতজাদে-কে ধমকে রেখেছেন, পরের দিন খাতা না নিয়ে এলে স্কুল ছাড়তে হবে। কাজেই, মায়ের কাছে আহমদ আর্জি জানায়, হোমটাস্কের খাতা ফেরত দিতে এখন তাকে যেতেই হবে বন্ধুর বাড়ি। মা রাজি হন না। ধমকে পড়তে বসাতে চান। আহমদ দমবার পাত্র নয়। ছেলে এমনিতে ভারী শান্ত, এক্কেবারে নির্বিরোধী, মুখ বুজে সবার সব কথা শোনে, ভাইয়ের মুখে দুধের শিশি গুঁজে দেয়, তার দোলনা দুলিয়ে দেয়, কিন্তু দেখা যায়, মায়ের শাসন যত তীব্র হয়, ততই সে নাছোড় হয়ে ওঠে। ততক্ষণে আহমদ ঠিক করে ফেলেছে, এখন নিজের হোমটাস্ক করতে বসার চেয়ে জরুরি হল নেমাতজাদে-র হোমটাস্কের খাতা ফেরত দিতে যাওয়া। বন্ধুকে বাঁচাতে হবে, খুঁজতে হবে তার ঘর। শুরু হয় আমাদের চিরপরিচিত মাতা-পুত্র দ্বৈরথ।
কৌতূহলী দর্শক লক্ষ করে থাকবেন, এই ছবিতে প্রায় অর্ধেক সংলাপ দুইয়ের বেশিবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। শুরুতেই মাস্টারমশায় ক্লাসরুমে নেমাতজাদে-কে বলেন, ‘তোমাকে আমি কতবার খাতা আনতে বলেছি? কতবার?’, কথাটা মনে রাখতে হবে। সংলাপটি উচ্চরিত হতে থাকে ততক্ষণ– যতক্ষণ না বাচ্চাটির চোখ ফেটে জল আসে। একটু পরেই আমরা দেখব, আহমদও তার মা-কে ক্রমাগত একই কথা বলে যায়। একই সংলাপ বারবার-বারবার উচ্চারিত হয়। সে অযথা তর্ক করে না, অনিয়ন্ত্রিত ক্ষোভপ্রকাশ করে না, চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে না, কিন্তু ওই এক কথা থেকে তাকে কিছুতেই নড়ানো যায় না।
বুঝতেই পারছেন, পেশাদার বিপ্লবীর কর্মনীতি গ্রহণ করেছিলেন বলেই কিয়ারোস্তামি জীবনের একটা পর্যায়ে তাঁর চলচ্চিত্রকে রাষ্ট্রীয় স্তরে পেডাগজি-চর্চার সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিলেন। কিন্তু এটাও বাইরের কথা। যেখানে পেডাগজির শেষ, সেখান থেকেই বিপ্লবের শুরু। যখন বোঝা যায় কথায় চিঁড়ে ভিজবে না, আহমদ (কিয়ারোস্তামির মতোই?) মনে-মনে ফন্দি আঁটতে থাকে। হোমটাস্কের খাতায় মিথ্যে পেনসিল বোলায়, আর ভাবে, কোন ফিকিরে কাজটা হাসিল করা যায়। সুযোগ সন্ধান করে (কেননা, কে না জানে– মানবেতিহাসে আসে যুগসন্ধিক্ষণ। তার জন্য ওত পেতে থাকতে হয়। একটা অছিলা, একটা উপায়ের জন্য! বাড়িয়ে বলছি?)। যদি রুটি কিনে আনার ফরমান জারি না-হত, তাহলে কী করত আহমদ?
সম্ভবত, অন্য কোনও ছুতো সে নিজেই তৈরি করে নিত। এমন কোনও সংঘর্ষ এড়াতে চাইত, যা আখেরে তাকে গন্তব্যচ্যুত করতে পারে। যে-কোনও বিপ্লবীর কিশোরবেলার গল্প পড়ুন। বুঝতে পারবেন, কেন মা-কে সত্যি বলে আহমদ কিছুতেই পারত না বন্ধুর খাতা ফিরিয়ে দিতে। কেন মায়ের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে, দাদুর সঙ্গে, তাদের সম্মিলিত পরাক্রমের সঙ্গে, তাদের দাবি-চাহিদা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আহমদের বিরোধ অনিবার্য ছিল। রুটি কিনতে বেরিয়ে আহমদ যখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে পাহাড়ি পথ বেয়ে, ছুটতে থাকে বন্ধুর ঘরের খোঁজে, তখন আমরাও মনে-মনে তিনবার বলি ‘মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি’! এবং এই সত্য শিখি যে ভালোবাসা একটা শ্রমসাধ্য কাজ, বিরোধ ছাড়া, সংঘাত ছাড়া, রক্তক্ষরণ ছাড়া ভালোবাসা যায় না। নিজেকে রিক্ত না করে, বিপন্ন না করে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসা মানে ‘কর্তব্য’ও বটে, আর ভালোবাসার জন্য চাই বিরুদ্ধতার সাহস। আহমদের ওই ছুট– তার আবহে যে সংগীত বেজে ওঠে– তার ছন্দে-ছন্দে উপচে পড়ে সেই মহব্বতের পেয়ালা। যে-সে ভালোবাসা নয়, খাঁটি বিপ্লবী ভালোবাসা।
দূরের গ্রামে গিয়ে আহমদ তার বন্ধুর ঘর খোঁজে, পায় না। পথশ্রমের ক্লান্তি নেই তার মুখে, শুধু বন্ধুর জন্য উদ্বেগ। পথে এক বুড়ো কাঠমিস্ত্রির (অথবা, বাতিল শিল্পী) সঙ্গে তার দেখা হয়। ইরানের ‘পালটানো সময়’-এর ইতিহাসের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে আহমদকে একটা ফুল দেয়। বুড়ো বলে, এই যে গ্রাম, আর পাশের আরও গ্রাম, এদের সকলের বাড়ির দরজা-জানালা একসময় আমিই বানিয়েছি। আহম্মকগুলো এখন সব খুলে দিয়ে লোহার দরজা বসাচ্ছে। এই দৃশ্যে জানালার রঙিন কাচ ভেদ করে আসা আলোর কী অপূর্ব মায়া! ইতিহাস আর ভাবীকাল হাত ধরাধরি করে সেই মিস্টিক যাত্রায়। এই ধীরপথে আহমদকে আরও একটা কথা বলেন বৃদ্ধ, ‘এখন তো সবাই শহরেই চলে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ যেখানে জন্মেছে, সেখানে থাকাটা জরুরি’। কিয়ারোস্তামি প্রায় ৪০ বছর আগে কথাটা বলেছিলেন। এই কথার সামনে আমাদের এখনও থমকে দাঁড়াতে হয়।
কে ঐ বৃদ্ধ? ইরানের আত্মা? যে ধুঁকছে, নুয়ে হাঁটছে, লিখে রাখছে গ্রামবাসী মানুষের দরজা-বদলের আর ঘরছাড়ার ইতিহাস? জানি না। কিন্তু আহমদ তার হাত ধরে হাঁটেনি। সম্মোহন মুছে গেছে। ইতিহাস, তুমি বও। কিন্তু আমার শুধু যাত্রা নয়, আমার আছে গন্তব্য। ততক্ষণে আহমদ বুঝে ফেলেছে নেমাতজাদে-কে খাতা ফিরিয়ে দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে। আর কী করে সে ভুলতে পারে বাড়ির জন্য রুটি নিয়ে যাওয়ার কথা? সে খাতাটা লুকিয়ে নেয় সোয়েটারের নিচে, বৃদ্ধকে বলে, ‘খাতা ফিরিয়ে দিয়েছি, এবার দ্রুত ঘরে ফিরতে হবে আমায়’। ফিরতে হবে অন্ধকারে, একাই।
তাহলে নেমাতজাদে-র কী হয়? তাকে বাঁচাতে একরকম ‘ইন্টারনাল সাবোটাজ’-এর পথ বেছে নেয় আহমদ। এই পন্থা, এটাও অনেকে জানেন, একান্তই কিয়ারোস্তামি-সুলভ (এবং হয়তো এ-কারণে তিনি সমালোচিতও হয়েছেন)। মহসিন মখমলবাখ অথবা জাফর পানাহির মতো তাঁকে রাষ্ট্রীয় লাঞ্ছনা সইতে হয়নি। কিন্তু মানবতার স্বপক্ষে, ভালোবাসার স্বপক্ষে তাঁর চলচ্চিত্রে যা কিছু রচিত হয়েছে, তার গুরুত্ব অনেক। পরদিন স্কুলে এসে আহমদ ত্রস্ত নেমাতজাদে-র সামনে মেলে ধরে তার খাতা, বলে, ‘তোমার হোমটাস্ক আমি করে দিয়েছি’। অর্থাৎ, কার্যসিদ্ধির জন্য চালাকির আশ্রয় নেয়। যে কোনও মূল্যে বিপন্ন বন্ধুকে বাঁচাতে হবে– এই লক্ষ্য থেকে কিছুতেই সে চ্যুত হয় না। এমনিতে নির্বিরোধী, শান্ত, তবু নীতির প্রশ্নে সে এক চুল জমি ছাড়তে প্রস্তুত নয়। যে-হৃদয় ভালোবাসার টানে নিজেকে বিপন্ন করে, রিক্ত মানুষের হাত ধরে বুক টান করে দাঁড়ায়, বন্ধুর জন্য পাড়ি দেয় অমসৃণ দীর্ঘ পথ– কিয়ারোস্তামি সারাজীবন তার খোঁজ করেছেন, নিজের মধ্যেও। নিজের মধ্যেও, তাই না তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল ভূমিকম্প-ধ্বস্ত গ্রামে? কিয়ারোস্তামি বন্দি হননি, কিয়ারোস্তামি দেশত্যাগ করেননি, তবু তাঁর পক্ষপাত চিনে নিতে আমাদের কখনও অসুবিধা হয় না।
যে-কথা বলছিলাম, আহমদ আর নেমাতজাদে, দু’জনের হোমটাস্কের খাতা পরপর দেখেন মাস্টারমশায়। আহমদের চালাকি কিন্তু তিনি ধরতে পারেন না (নাকি দেখেও দেখেন না?)। আমরা দেখি, তার বন্ধুর খাতায় গোঁজা আছে ঐ ছোট্ট হলুদ ফুল– আহমদের শ্রমক্লান্ত, নাছোড়বান্দা, একরোখা, জেদি ভালোবাসার স্মারক। ‘যে ভালোবাসার বীজ তুমি ছড়িয়ে যাবে, সে আরও-আরও বীজ ছড়াবে, আর তা পাবে অন্য কেউ’। তাকেই তো আমরা সুন্দর বলি! (কিয়ারোস্তামির ছবিতে তাই কিছু পথ হেঁটে এসে কেউ-কেউ ফুল পায়) ঐ ফুল– তার পুনর্দর্শনের প্রথম শিহরণে আবহে ঝঙ্কার ওঠে। ফের চলকে ওঠে পেয়ালা! আমাদের ছোট্ট আহমদের অন্তর্ঘাত ‘বৈপ্লবিক সাফল্যে’ উন্নীত হয়, কিয়ারোস্তামি তা উদ্যাপন করেন। দুই বন্ধুর সহজ প্রেমের গল্প একটা বিপ্লবী টেক্সটে রূপান্তরিত হয়।
অবশ্য ‘সহজ’ কথাটা খেলাচ্ছলে বলছি, বরং একটু তলিয়ে ভেবে দেখা উচিত, কেন এমন একটা গল্প বলতে চাইলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি? মানুষের শ্রম-শ্রান্তি-অবসাদ-প্রত্যাখ্যান আর আত্মহননস্পৃহার ফাঁকে-ফাঁকে কোথায় লুকিয়ে থাকে চেরির স্বাদ? শুধুই কি চেরির মধ্যে? না– মানুষ তার দুঃখ অন্য মানুষের গল্পে খুঁজে পায়। এ-ও এক আদিম রহস্য! চেরির স্বাদ, আসলে তা ‘ভালোবাসার মতো, বন্ধুত্বের মতো’ মিষ্টি। যে জানে, সে, কেবল সে-ই খুঁজে পায় বন্ধুর ঘর। কোথায় সে ঘর? ঈশ্বর যতখানি ভাবতে পারেন, তার চেয়েও সবুজ ওই পথ, যে-পথে ছড়িয়ে আছে ভালোবাসা– ‘বন্ধুত্বের নীল ডানার মতোই ব্যাপ্ত’, সেই পথে আছে তার সন্ধান। নিঃসঙ্গতার ফুল যেখানে, তার ঠিক দু’ পা আগে সে হাত বাড়াচ্ছে আমাদের দিকে। পাইন গাছের মাথায় নয়, সে রয়েছে পাশেই। যুদ্ধধ্বস্ত সেই পৃথিবীর হাত কি আমরা ধরতে পারব, ততখানি ভালোবাসার সাহস কি হবে আমাদের? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কিন্তু খুব সহজ নয়।