Robbar

সাম্রাজ্যবাদের বিষকে কবর দিয়ে সেই মাটিতেই ভালোবাসার পলাশ চাষ সম্ভব

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 16, 2023 8:45 pm
  • Updated:December 16, 2023 9:44 pm  

ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আমার কাছে একটা সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে অঙ্গীকার করা হয়েছে। আমি এই গণতন্ত্রের স্বপ্নে আস্থাশীল– এই গণতন্ত্রে আমার নিঃশর্ত অধিকার। আমার, আমার বোনেদের, সমস্ত কুইয়ার মানুষের– ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষের বেঁচে থাকার নিঃশর্ত অধিকার রয়েছে– অধিকার রয়েছে জমিতে, অধিকার রয়েছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের, অধিকার রয়েছে ন‌্যায‌্য মজুরিতে, পূর্ণ আত্মমর্যাদায়, স্বকীয় আত্মপরিচয়ে শ্রমদানের, অধিকার রয়েছে শিক্ষার, চিকিৎসার।

ঊর্মি ড্যানিয়েলা আজার

থাকবার ঘর চাই/ হাতে হাতে কাজ চাই

‘ছেলে ছেলেতে চুমু খেয়েছে। বেশ করেছে! বেশ করেছে!’ বেশ করেছেই তো। এতে সমস‌্যা কার?

জানাজানি হয়ে গেল– যারা চুমু খেয়েছে, সমস‌্যা তাদেরই। ছেলে হয়ে যে ছেলেকে চুমু খায়, তাকে চাকরি দেওয়া হবে না। ছেলে হয়ে যে ছেলেকে চুমু খায়, তাকে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে না। ‘সমাজের মানুষের মানসিকতার সমস‌্যা’ গোছের দার্শনিক সমাজতাত্ত্বিক গভীরতর আলোচনায় যাওয়ার উপলক্ষ‌ে এই প্রবন্ধ লিখতে বসিনি। আমি আগে ছেলে ছিলাম, এবং ছেলেদের চুমু খেতাম, এখন আমি মেয়ে, এবং মেয়েদের চুমু খাই। সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়ে আমি বিন্দুমাত্র আঁচ পাইনি আমার লিঙ্গ পরিচিতি কী এবং আমি কাকে চুমু খাই– এই প্রশ্নে এত অনায়াসে আমার মৌলিক অধিকার নাগরিক অধিকার হোলির আবিরের মতো রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে।

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন: সমকামিতার স্পন্দনকে ভূপেন খাকর অনুবাদ করেছিলেন ক্যানভাসে

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

‘সমাজের মানসিকতার সমস‌্যা’ আমাদের প্রকাশ‌্য রাস্তায় মলেস্ট করে, খুন করে। আমাদের পড়াশোনা-রোজগারে ইতি পড়ে। আমাদের মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে যায়। ‘মানসিকতার সমস‌্যা’ যাদের, রাষ্ট্র তাদের, আমরাই বে-নাগরিক। আমাদেরই পরিচয়পত্র নেই, শ্রমদানের অধিকার নেই, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকার নেই, শিক্ষার, স্বাস্থ্যের অধিকার নেই।

লিঙ্গপরিচয় সামাজিক নির্মাণ মাত্র নয়, লিঙ্গপরিচয় একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। গৃহশ্রম, রিপ্রোডাকশন লেবার, এবং অনেকাংশে জননশ্রমের মালিকানা নির্ণয় করে এই প্রতিষ্ঠান। লেনিন লক্ষ‌ করেছিলন, ‘মহিলাদের ব‌্যাপক পরিমাণ বিন-মজুরি গৃহশ্রমের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে পুঁজিবাদ।’

From Kolkata to Chennai, pride parades bring colours of love to Indian cities | Pics - India Today

২.

লিঙ্গপরিচয় অন‌্যায় মালিকানা স্থাপনের একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের একটা সরল মৌলিক গল্প আছে। যার শিশ্ন আছে, যার গর্ভ আছে, তারা বিয়ে করবে (রেনেসাঁ পরবর্তী সমাজে ‘তারা খুব ভলোবাসাবাসি করবে, তারপর বিয়ে করবে), ঘর-পরিবার গঠন করবে, যৌনসঙ্গম করবে, বাচ্চা হবে। এই গল্পেরই লাইনে লাইনে গৃহশ্রম, রিপ্রোডাকটিভ লেবারের মালিকানার হিসেব লেখা রয়েছে। বিয়ে না করে যৌনতা করলেই, অনেকের সঙ্গে ইচ্ছেমতো, ভালোবাসামতো, ভালোলাগামতো যৌনসঙ্গম করতে শুরু করলেই এই গল্পটা ঝুরঝুর করে ভাঙতে শুরু করে। ছেলেতে ছেলেতে, মেয়েতে মেয়েতে যৌনতা করতে চাওয়া এই লিঙ্গ প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। আর আমার গর্ভ নেই, যোনি নেই, তাও আমি নারী– একথা বলার চেয়ে বোধহয় ঘোরতর যুদ্ধ ঘোষণা আর হয় না।

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন: ৫০টির বেশি বাল্য বিবাহ ঠেকিয়ে রোশনি আজ রাষ্ট্রপুঞ্জের সামিটে

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

ভারত আধা উপনিবেশিক, আধা সামন্ততান্ত্রিক পর্যায়ে রয়েছে, সুতরাং ব্রাহ্মণ‌্যবাদের লিঙ্গপ্রতিষ্ঠানকেও সমভাবেও আলোচনায় আনছি। ‘পুরুষের’ যে স্বাধীন সামাজিক অস্তিত্ব, জমি ও ব‌্যবসার মালিকানার অধিকার থাকে– সেই পৌরুষত্বের অধিকার কেবল উচ্চবর্ণের পুরুষের। ‘নারীর’ জননশ্রম ও গৃহশ্রমে যেমন তার মরদের মালিকানা রয়েইছে, নিম্নবর্ণের নারীর জননশ্রম ও গৃহশ্রমে তদুপরি মালিকানা রয়েছে উচ্চবর্ণের পুরুষের।

তাই-ই, পাশ্চাত‌্য রাষ্ট্রগুলিও এটিকে সরাসরি যুদ্ধ বলেই স্বীকার করেছিল। কুইয়ার মানুষদের অধিকার মুছে দেওয়া তো ছিলই, সামান‌্যতম অধিকারের দাবি তুললেও নেমে আসত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

The History Of Pride Parades In India | Feminism in India

৩.

ভারতের প্রাইড আন্দোলনের গোড়াপত্তনে মূলত ছিল শহরের মোটামুটি ভালো মাইনের চাকুরিজীবীর শ্রেণি। প্রাইড হিজড়াখোলের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে গড়ে উঠতে পেরে এবং ইউরোপ ও আমেরিকার নারীবাদী ও কুইয়ার দর্শনের সংস্পর্শ পেয়ে একুশ শতকের ভারতে এক নতুন কুইয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগে থেকে যে কতি-জাপোতি-হিজড়া-থিরুনাঙ্গাই গোষ্ঠীগুলি ঔপনিবেশিক উৎপীড়ন পেরিয়েও টিকে ছিল– তাদের থেকেও এই নয়া কুইয়ার সংস্কৃতি আলাদা। এই নয়া-কুইয়ারের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা-পরিচিতি-চাহিদাও আলাদা ছিল। হিজড়া-থিরুনাঙ্গাই গোষ্ঠীগুলির সামাজিক অবস্থান সামন্ততন্ত্রের বেড়ি ছাড়িয়ে বেরতে পারেনি, ঔপনিবেশিক ও তৎপরবর্তী সময়ে একদিকে যৌন ও ধর্মীয় ফেটিশবস্তু হিসেবেই তারা আটকে থেকেছে সামাজিক মননে, অন‌্যদিকে তাদের ওপর নেমে এসেছে ক্রিমিনালাইজেশন ও আইনি নিপীড়ন। এর বিপ্রতীপে উদারবাদী কুইয়ার আত্মপরিচিতি গড়ে উঠেছে যৌনমুক্তি ও সম্ভ্রান্ত চাকরির স্বপ্ন নিয়ে। এই নয়া কুইয়ারের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ব‌্যাপকভাবেই উচ্চমধ‌্যবিত্ত চাকুরিজীবী জীবনের তুলনামূলক সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ভদ্রতাবিলাসের কাঙ্ক্ষী। এই আন্দোলনের ভাগীদার হিসেবে প্রচুর NGO গড়ে ওঠে এবং এরাই এই আন্দোলনের একটি মৌলিক চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে, পাশাপাশি থাকে আমলা-অ‌্যাকাডেমিক শ্রেণির অগ্রণী ভূমিকা। এই নয়া কুইয়ার আন্দোলনেরই হাত ধরে দেশীয় ভাষার সংস্কার হয়– কুইয়ার মানুষের জীবন-যৌনতা নিয়ে যে ভাষায় কথা বলা হবে– সেই ভাষা-পরিভাষা মেজে ঘষে ‘ভদ্রজনোচিত’ করে নেওয়া হয়. (কতি/হিজড়া নয়, কুইয়ার/সমকামী ট্রান্সজেন্ডার/ রূপান্তরকামী বলতে হবে)। এই সময়েই ভারতের কুইয়ার মানুষদের নিয়ে প্রচুর গবেষণামূলক সমীক্ষা ও কাজ হয়েছে ও হচ্ছে– এই অ‌্যাকাডেমিক কাজের ফলে ভারতের ইতিহাসে কুইয়ার মানুষের উপস্থিতি ও অবস্থান যেমন স্পষ্ট হচ্ছে, তেমনই বর্তমান সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিতেও কুইয়ার মানুষের পরিবর্তনশীল বাস্তব অবস্থান বোঝা যাচ্ছে আরও স্পষ্ট করে। কুইয়ার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও রূপরেখাও নতুন করে তৈরি হচ্ছে।

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন: নার্গেস মহম্মদির নোবেল প্রাপ্তি এক নতুন বসন্তের স্বপ্ন

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

নয়া কুইয়ার আন্দোলনের যখন যাত্রা শুরু– তখন এদেশে কুইয়ারদের আত্মপরিচিতির অধিকার দূরঅস্ত, তখনও ভারতে কুইয়ার হওয়া ফৌজদারি অপরাধ। সংসদে উচ্চমধ‌্যবিত্ত শ্রেণির গভীর আস্থা ও আমলাতান্ত্রিক ব‌্যবস্থায় গভীর আস্থার জায়গা থেকে প্রাইড আন্দোলনগুলি ও কুইয়ার NGOগুলি এই পরিস্থিতির প্রতিকারে সরাসরি আমলাতান্ত্রিক বিচারব‌্যবস্থার শরণাপন্ন হয়। এখনও কুইয়ার আন্দোলন রাষ্ট্রকে বা সমাজকে চ‌্যালেঞ্জ জানাতে গণপ্রচার, গণসংগঠন ও আন্দোলন তৈরি করা, ধরনা-অবরোধ-ঘেরাও– এই ধরনের গান্ধীবাদী তরিকা না নিয়ে কোর্টে-থানায় পিটিশন, PIL দাখিল করতে বেশি স্বচ্ছন্দ। সমকামিতা ক্রিমিনালইজেশননের আইন, ৩৭৭ রদ, ট্রান্সজেন্ডার মানুষের অস্তিত্বের স্বীকৃতিতে NALSA রায়– সবই এই আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এসেছে, এবং কুইয়ার মানুষদের আইনি স্বীকৃতির জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।

Kolkata celebrating pride month. Pride walk 2022 : r/india

এর পাশাপাশি দাবিগুলি প্রাইড মার্চে প্ল‌্যাকার্ডে উঠে আসে বছর বছর। সচেতনতা প্রসারেও মূলত ওয়ার্কশপ-সেমিনার-এগজিবিশন ধরনের ভদ্রজনোচিত পন্থা নেওয়া হয়, ঝটিকা পথসভা, টোটাতে মাইক নিয়ে প্রচার বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারের পন্থা বিরল। এলাকাভিত্তিক সংগঠন তৈরি করে এলাকার শ্রমজীবী-কৃষিজীবী-চাকুরিজীবী মানুষের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী তর্ক, আলোচনা ও সামাজিক যৌথকাজের মাধ‌্যমে সমাজে কুইয়ার মানুষের গ্রহণযোগ‌্যতা তৈরি ও আত্তীকরণ, বৃহত্তর সামাজিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনে কুইয়ার মানুষের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া– এই ব‌্যাপারটা প্রায় দেখাই যায় না, কোভিডের সময় এই পরিস্থিতির উল্লেখযোগ‌্য পরিবর্তন ঘটে এবং বিভিন্ন শহরে মূলত হিজড়া-জাগোতি-থিরুনাঙ্গাই মানুষেরা জান দিয়ে ত্রাণকার্যে ও গণহেঁসেল তৈরিতে নেমে পড়েন।

৪.

আম্বেদকরবাদী ও দলিত অধিকার আন্দোলনগুলি হিজড়া-জাগোতি-থিরুনাঙ্গাই গোষ্ঠীগুলির অধিকার লড়াইয়ে এসে শামিল হয়েছে, বিশেষত চেন্নাইয়ে, মুম্বইয়ে এই ধারার লড়াই খুবই শক্তিশালী হয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলি প্রথম দিকে কুইয়ার আন্দোলনে ব্রাত‌্য থাকলেও– একদিকে আম্বেদকরবাদী আন্দোলনের মধ‌্য দিয়ে, অন‌্যদিকে উদারবাদী ইন্টার সেকশানালিটির প্রভাবে এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে যুক্ত হয়েছে। যাঁরা প্রাত‌্যহিক পুলিশি অত‌্যাচারে জর্জরিত, প্রায় কোনওক্রমে বেঁচে ছিলেন– তাঁরা নিজেদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন কুইয়ার রাজনীতির সামনের পৃষ্ঠায় নিয়ে এসেছেন। এই গোষ্ঠীগুলির গভীরে সামন্ততান্ত্রিক অভ্যেসগুলি রয়ে গিয়েছে বিষের মতো– আম্বেদকরবাদী আন্দোলনের প্রভাবে সেই অভ্যেসগুলি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, তাঁদের সামাজিক স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাগুলিও নতুন ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ও চাকরির খাতে রূপান্তরকামী মানুষের জন‌্য সিট-সরক্ষণের দাবি আগ্রাধিকার পাচ্ছে। NGO গুলিতেও বিভিন্ন মুখ‌্য বা গোড়াপত্তনকারী ভূমিকায় এগিয়ে আসছেন রূপান্তরকামী/দলিত রূপান্তরকামী মানুষেরা। আবার, শহরতলি/রাজধানী শহরের চেয়ে দূরের জেলায়ও তাদের নিজস্ব প্রাইড আন্দোলন ও কুইয়ার/লিঙ্গমুক্তিকামী NGO গড়ে উঠছে।

Pride march in Delhi, Kolkata, Bengaluru and Mumbai, 2008: Colours of consent

ভারতের কুইয়ার আন্দোলন প্রথমে উচ্চমধ‌্যবিত্ত-চাকুরিজীবি শ্রেণির হাত ধরে শুরু হলেও সমস্ত শ্রেণির কুইয়ার মানুষই ক্রমে ক্রমে যুক্ত হয়েছেন ও সেই মতো আন্দোলনেরও ধারা বদলে বদলে গেছে। বর্তমানেও কুইয়ার মানুষদের বিবাহ সাম্যের প্রশ্নে ও রূপান্তরকামী মানুষের শিক্ষা-চাকুরিক্ষেত্রে রিজার্ভেশনের প্রশ্নে সংঘাত চলছে। বিবাহ সাম্যের চাহিদা (কুইয়ার বিবাহের আইনি স্বীকৃতি) মৌলিকভাবে উচ্চমধ‌্যবিত্ত শ্রেণির কাছে গুরুত্বপূর্ণ– কারণ এই আইনি স্বীকৃতির সঙ্গে তাদের বাড়ির মালিকানার প্রশ্ন, ব‌্যাঙ্ক নমিনি নির্ধারণের প্রশ্ন, ইত‌্যাদি আইনি বিষয় জড়িত। এই প্রশ্নে কিন্তু আবার সংঘাতের মূল তরিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভদ্রলোকি-পিটিশন, PIL ও সেমিনার ধরনের তর্ক। অন‌্যদিকে রিজার্ভেশনের প্রশ্নে রূপান্তরকামী মানুষেরা এই PIL-এর আবেদন-নিবেদনে সীমাবদ্ধ নেই, আম্বেদকরবাদীদের সহযোগে তারা গান্ধীবাদী পদ্ধতিতে ধরনা-অবরোধ-প্রকাশ‌্য আন্দোলন করে নিজেদের অধিকারের দাবি অগ্রসর করে চলেছে, এই আন্দোলনের ধারা প্রবল হয়ে উঠেছে মূলত মুম্বইয়ে ও চেন্নাইয়ে। শ্রমদানের মৌলিক অধিকার আদায়ের যে লড়াই– তা কখনওই ভদ্রলাকি হতে পারে না, কারণ ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি হিসেবে উচ্চবেতনভুক ও দালাল প্রকৃতির শ্রমিক শ্রেণি এবং তাদের শ্রমদানের অধিকার বা অন‌্যান‌্য নাগরিক অধিকার সচরাচর সবচেয়ে কম বিপন্ন।

৫.

বিগত কুড়ি বছরে NGO-গুলিতে ব‌্যাপক পরিমাণে টাকা ঢুকেছে মূলত ইউরোপীয় ও মার্কিন খয়রাতি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে। এই টাকা আসলে সাম্রাজ‌্যবাদী পুঁজি। এই টাকায় কুইয়ার ও ট্রান্সজেন্ডার মানুষের ব‌্যাপক ত্রাণ হয়েছে– এবং এই ত্রাণের পুরোভাগে অনেক সময়ই কুইয়ার মানুষেরাই থেকেছেন। সরকারের তরফেও ত্রাণ করা হয়েছে ব‌্যাপক মাত্রায়। ১) পরিবারের বা পাড়া-পড়শির নিপীড়নের হাত থেকে কুইয়ার মানুষকে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ও আইনি সহায়তা নিয়ে) উদ্ধার করে নিয়ে আসা, ২) ঘরছুট কুইয়ার-ট্রান্সজেন্ডার মানুষের আপাতকালীন বাসস্থানের ব‌্যবস্থা করা, ৩) কুইয়ার-ট্রান্সজেন্ডার মানুষের চাকরির সন্ধান দেওয়া, প্রয়োজনীয় ভোকেশানাল ট্রেনিং দেওয়া– এই প্রত্যেকটি ব‌্যাপারে NGO গুলি অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এসেছে ও এখনও নিচ্ছে। একই খয়রাতি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে কুইয়ার-ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের জন‌্য স্কলারশিপ ও আমাদের জীবন ও সমাজে লিঙ্গবৈষম‌্য বিষয়ে গবেষা খাতেও প্রচুর টাকা ঢুকছে– NGO, বিভিন্ন প্রাইভেট বা প্রাইভেট-পাবলিক-পার্টনারশিপের গবেষণা সংস্থা ও ইউনিভার্সিটির মাধ‌্যম দিয়ে।

এর আগেও লিখেছি– এই NGOগুলি বা গবেষণা সংস্থাগুলিরও অনেকগুলির পুরোভাগে কুইয়ার ট্রান্স মানুষেরা রয়েছেন, এবং এদের নিঃশর্ত সদিচ্ছা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রচুর কুইয়ার মানুষ বেঁচেও আছে, শ্রমের অধিকারও পেয়েছে। কিন্তু এই NGO রাজনীতির দৌড় ঠিক এই পর্যন্তই। শ্রমিক হয়ে যাওয়ার পর কুইয়ার শ্রমিকের অধিকার রক্ষার রাজনীতি করতে কখনওই পেরে ওঠে না ঔপনিবেশিক পুঁজির উদ্ধৃতভোগী NGO। বেশ কিছু NGO ট্রেনিং দিয়ে চাকরির ‘প্লেসমেন্ট’-এর সময় কোম্পানি কাছেই সরাসরি চুক্তিবদ্ধ থাকে যে কোনও কারণেই হোক, এক বছরের মধ্যে তারা যদি চাকরি ছেড়ে দেয়, সেই NGO থেকে তাকে ওই এক বছরে অন‌্য কোনও চাকরি খুঁজে দেওয়া হবে না। চাকরির বাজারে বিশেষত রূপান্তরকামী মানুষেরা এখনও ব‌্যাপকভাবে এই NGO-গুলির ওপরেই নির্ভরশীল, এবং শ্রমক্ষেত্রে স্পষ্টতই তারা কখনওই আমাদের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করতে পারবে না।

Kolkata: Participants hold a pride flag and participate in a pride rally #Gallery

এই একই সময়ে কতি মানুষেরা স্বাধীন উদ্যোগে ব‌্যবসাও গড়ে তুলেছে কিছুটা পারিবারিক পুঁজি আর কিছুটা ব‌্যাঙ্ক লোন বা খয়রাতি মারফত। কিন্তু এই আধা-ঔপনিবেশিক বাজারে টিকে থাকতে গিয়ে  ১) তারা সরাসরি বা বকলমে সাম্রাজ‌্যবাদী পুঁজির কাছে দেনা করেই ফেলে, ২) কম্পিটিশনে মুনাফার হার ধরে রাখতে গেলে তারাও তাদের অধীনস্ত (কতি বা স্ট্রেট) শ্রমিকদের বাজার-অনুপাতে সীমাহীন শোষণ করতে বাধ‌্য। সামন্ততান্ত্রিক পুঁজি ক্ষয়িষ্ণু এবং ব‌্যাপকত কতিদের মৃত্যুকামী ও বিরোধী, এবং আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক বাজারে নতুন স্বাধীন পুঁজির উত্থান সম্ভবই নয়। ফলে ভারতে কুইয়ার পুঁজিবাদ সর্বতভাবেই অসম্ভব, যা তৈরি হতে পারে এবং হয়েছে তা হল ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন রুচির একাধিক কুয়ার দালাল শ্রেণি।

আম্বেদকরবাদ যেভাবে হিজড়া-থিরুনাঙ্গাই-জাগোতি গোষ্ঠীগুলির ভেতর টিকে যাওয়া ব্রাহ্মণ‌্যবাদী/সামন্ততান্ত্রিক বিষের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়– উদারবাদ তা করে না। উদারবাদ/ইন্টারসেকশানালিটি এক ভাববাদী ডিকলোনাইজেশনের কথা বলে– অবশ‌্যই তা সাম্রাজ‌্যবাদী পুঁজির কবল থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলে না, কিন্তু ‘সাম্রাজ‌্যবাদী’ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সামন্ততন্ত্রের অন্ধকারে ফেরত যাওয়ার কথা বলে। তাদের ইতিহাস বিশ্লেষণ পড়লে মনে হবে ব্রাহ্মণ‌্যবাদে রূপান্তরকামী নারীরা সর্বারাধ‌্যা ছিলেন– দেবদাসীরাই আসল পুরোহিত ছিলেন তাদের এত সুগভীর সামাজিক সম্মানের জায়গা প্রথম টাল খায় জাহাজে করে ইংরেজরা আসার পরে। কোনও সামন্ততান্ত্রিক সমাজেই লিঙ্গপ্রতিষ্ঠান নাকি ছিল না– বিশ্বব‌্যাপী লিঙ্গপ্রতিষ্ঠান নাকি সাম্রাজ‌্যবাদের উত্তরাধিকার।

কতি-হিজড়া গোষ্ঠীর অন্তর্বতী ব্রাহ্মণ‌্যবাদী সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারাও সহজে চলে যাওয়ার নয়। বিজেপি একদিকে সংসদে ও সুপ্রিম কোর্টে ভীমকণ্ঠে ঘোষণা করে– সমকামিতা ভারতীয় সংস্কৃতি বিরুদ্ধ, অন‌্যদিকে সারা দেশে একাধিক রূপান্তরকামী নারী বিজেপির নেত্রী/প্রার্থী। উত্তরাখণ্ডে বিজেপি নেত্রী রাজ্ঞী রাউত (রুপান্তরকামী) বহু বছর ধরে স্থানীয় হিজড়া মানুষদের ওপর তোলাবাজি চালান– রীতিমতো পুলিশি মদতে। ভারত সরকার দ্বারা নিযুক্ত ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের মেম্বার, অপর্ণা লালিঙ্কর মনে করেন– জোগাথি আর ট্রান্সজেন্ডার আলাদা আলাদা ব‌্যাপার, জোগাথি-হিজড়া-থিরুনাঙ্গাইরা যেমন ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ, ট্রান্সজেন্ডাররা তেমন না, সেক্স-চেঞ্জ-অপারেশন করতে চাওয়া বিকৃতকামনা এবং সমকামিতা মুখ‌্যত একটি ব‌্যাধি। একদিকে উদারবাদী দর্শন, অন‌্যদিকে দেশীয় ব্রাহ্মণ‌্যবাদী স্বৈরাচারী শক্তির উত্থান– এই সাঁড়াশিতে ব্রাহ্মণ‌্যবাদ যত আমাদের টুঁটি চেপে ধরবে নতুন করে ও শক্ত করে– ততই উল্টোপিঠে ত্রাতার ভূমিকায় ঢাকঢোল পিটিয়ে এগিয়ে আসবে উদারবাদ, এবং আমাদের শ্রমমূল‌্য লুটে সাম্রাজ‌্যবাদের হাতে তুলে দেবে সহজ মুনাফা হিসেবে।

৬.

‘অহিংস আন্দোলন কার্যকরী হতে হলে নিপীড়কের বিবেক থাকা প্রয়োজন।’ গান্ধীর এই মৌলিক অনুমানই এখানে ভুল, আমাদের নিপীড়কের কোনও বিবেক নেই।

আমার নেত্রী হওয়ার বিলকুল শখ নেই। আমি অঙ্ক করতে ও শেখাতে ভালোবাসি, অঙ্কের গবেষণা ও শিক্ষকতা সমাজে ইতিবাচক ও সৎ শ্রম বলেই মনে করি। এই শ্রমের যা ন‌্যায‌্য মজুরি, তাতে আমার অন্নসংস্থান হয়ে যাওয়া উচিত। মাথার ওপর ছাদ থাকবে, যৌথ দায়িত্বে ফুলগাছ, সবজিবাগান, একটা আমগাছ, চারটে নারকোল গাছ, হেঁসেলে টান পড়বে না মাসের ২০ তারিখ। পড়ুয়াদের মাঝেসাধে পোলাও-পায়েস রেঁধে খাওয়াব। হাতে সময় যা পড়ে থাকবে– আমার ছবি আঁকতে ভালো লাগে, ঘরে রং-তুলি কাগজ থাকবে, একগজ ক‌্যানভাস প্রতি বছর। গান বাঁধি মাঝে মাঝে। আর দু’-চার জনের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করব। এটুকুই শখ। আমার কতি বোনেদের এবং ভায়েদেরও শখ একইরকম। সামান‌্যই। এই সামান‌্য শখটুকুও আমাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে।

Want To Volunteer For The Kolkata Rainbow Pride Walk? Sign Up For This Workshop

ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আমার কাছে একটা সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে অঙ্গীকার করা হয়েছে। আমি এই গণতন্ত্রের স্বপ্নে আস্থাশীল– এই গণতন্ত্রে আমার নিঃশর্ত অধিকার। আমার, আমার বোনেদের, সমস্ত কুইয়ার মানুষের– ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষের বেঁচে থাকার নিঃশর্ত অধিকার রয়েছে– অধিকার রয়েছে জমিতে, অধিকার রয়েছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের, অধিকার রয়েছে ন‌্যায‌্য মজুরিতে, পূর্ণ আত্মমর্যাদায়, স্বকীয় আত্মপরিচয়ে শ্রমদানের, অধিকার রয়েছে শিক্ষার, চিকিৎসার। এই অধিকার আমরা নিয়েই নেব। কোনও রকম আবেদন-নিবেদন-দরাদরি-দালালি-আপোস নয়।

লিঙ্গপ্রতিষ্ঠানের, ব্রাহ্মণ‌্যবাদের সাম্রাজ‌্যবাদের পচাগলা বিষ কবর দিয়ে সেই মাটিতে আমাদের ভালোবাসার পলাশ রুইব আমরা– সেই জমিতে বুনে নেব ধান-গম-সরষে-মুসুরের খেত।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। কুইয়ার অধিকার অক্ষয় হোক। শ্রমিক-কৃষক ঐক‌্য দীর্ঘজীবী হোক। নিষ্পাত যাক লিঙ্গপ্রতিষ্ঠান, ব্রাহ্ম‌ণ‌্যবাদ, সাম্রাজ‌্যবাদ– পৃথিবীর নিপিড়ীত, খেটে খাওয়া, ভালোবাসার স্বপ্ন দেখা মানুষ এক হোক।