তখন মন্মথ রায়ের বুকে পেসমেকার বসেছে বেশিদিন হয়নি। তা যেন ওঁর বুকপকেটের কাছে ফুলে থাকা মোটা ডায়রি। দুশ্চিন্তার মেঘ সরানো আমার উত্তর শুনে, মন্মথ রায় আমার মাথাটাকে নিজের কাছে টেনে বুকে চাপড়াতে লাগলেন। আমার মাথা ও ওঁর পেসমেকারের সংঘর্ষে ওঁর কী আনন্দ হত জানি না, তবে আমার ভাল লাগা, মন্দ লাগার থেকেও ভয় করতই বেশি। এই আহ্লাদের চোটে মেশিনটা যদি কোনও কারণে বিগড়ে যায়!
পাশাপাশি পাড়া। এদিকে সিমলে পাড়া, ওদিকে বিবেকানন্দ রোড। উত্তরে তখন সব হাওয়াই নানারকম উত্তর দিয়ে যেত। বিশ শতক অশীতিপর হয়েছে, তারই সঙ্গে সঙ্গে অশীতিপর হয়েছেন মন্মথ রায়। জীবনানন্দ দাশ এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৯৯-এ, সে বছর মন্মথ রায়ও, প্রথম দু’জনের সঙ্গে কোনওকালে দেখাসাক্ষাৎ সম্ভব হয়নি। কিন্তু পাকেচক্রে, কেমন করে যেন বিবেকানন্দ রোডের মন্মথ রায়ের বাড়িতে আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া হল। হ্যাঁ, একেবারে ‘পাকড়াও’ করে। কলেজে উঠেছি, একটু নিজের খেয়ালে দিন গুজরান করছি, তা না– কী উপদ্রব!
মন্মথ রায়ের বাড়ির লাগোয়া বাড়িতে যে থাকে, সেই অমিতাভদা, আমি কার্যত যাকে শুধুই ‘দাদা’ বলে ডাকি, সে এই গোবেচারা নিতান্ত নিরপরাধ ছেলেটাকে প্রায় বদলদাবা করে চলল। কোথায়? বলল, ‘তোকে এসব ভাবতে হবে না।’ সেদিন যেখানে উপস্থিত হলাম, সেটা মন্মথ রায়ের বাড়ির তিনতলা। কাঁচাপাকা চুলের এক বুড়ো। দশাসই লম্বা চেহারা। দাঁড়ালে খানিক ঝুঁকে থাকেন। বয়সের ভার। কাছে ডাকলেন, মাথায় হাত বোলালেন, বললেন, ‘আয় বোস।’ এর আগে যে ওঁকে দেখিনি বা চিনি না, তা নয়। কিন্তু এখন আরও খুঁটিয়ে দেখছি। বাধ সাধল দাদা। বলল, ‘তুমি যা যা চাইছিলে, ও সেগুলো সবই পারবে।’ মন্মথ রায় এবার একটু স্থির হয়ে চেয়ে রইলেন। বললেন, ‘ভাল কথা, বোস, বোস।’
কী চাইছিলেন মন্মথ রায়, ক্রমে আমার ‘মন্মথদাদু’, তা বুঝতে পেরেছিলাম দ্রুতই। তা হল, একজন অনুলেখক। কিন্তু তিনি তো মন্মথ রায়! এহেন পণ্ডিত লোকের কাছে আমি নেহাত উঠতি ২০-২১ বছরের বাচাল ছোকরা। হ্যাঁ, একটু-আধটু গান গাই, হাতের লেখা গোটা গোটা। কিন্তু এই গুণ নিয়ে মন্মথ রায়ের অনুলেখক হব!
অথচ হলাম। বাড়িতে ফোন আসত। মা ধরত। ‘তোর ছেলেটাকে একটু পাঠিয়ে দে’, এই ছিল তাঁর চাওয়া। বড় কোনও লেখা থাকত যে, তা নয়। কিন্তু ভাষণ, উদ্বোধনী বক্তৃতা, টুকরো কিছু লেখা আমাকে পাশে বসিয়ে লেখাতেন তিনি। আসলে সেসময় তিনি যে শুধু শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, তা নয়। তাঁর স্মৃতিও কাজ করত না অনেক সময়। তা, উনি ডাকতেন। আমি যেতাম, দীর্ঘক্ষণ থাকতাম, লিখতাম। খুচরো গল্পও বলতেন। আমার হাতের লেখা নিয়ে প্রায়শই খুব উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছি ওঁকে। ‘মুক্তাক্ষর’, ‘বাঁধিয়ে রাখার মতো’– এইসব বলতেন। এমনও হতে থাকল, মন্মথদাদু এমনিই ডাকতেন, একটু জল-মিষ্টি খেতাম, দুটো কথা বলতাম। বলতাম, ‘দাদু তুমি ঘুমবে না?’ বলতেন, ‘ঘুমিয়েছি, তারপর কী হয়েছে শোন না…’ বলে আবারও একটা নতুন গল্প। স্নেহ আর শ্রদ্ধা মিলেমিশে একটা জম্পেশ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দ্রুতই।
একবার মনে আছে, মন্মথদাদু কিছুতেই শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। ভাবছেন চুপ করে। ঠোঁটের তলায় আঙুল। আমার পেনের কালি থ মেরে পড়ে আছে। উনি আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘এই, যাকে ছাড়া একেবারেই চলে না, কী যেন?’ আমি একঝটকায় উত্তর দিলাম, ‘ইনডিসপেনসেবল’। ভাবলাম, শুনে খুশি হবেন– দেখি রেগে কাঁই! ‘আমি কি ইংরেজি বলছি নাকি, বাংলায় বল!’ থতমত খেয়ে বললাম, ‘বাংলায় তো– অপরিহার্য’। এই ঘটনা যখন ঘটছে, তখন মন্মথ রায়ের বুকে পেসমেকার বসেছে বেশিদিন হয়নি। তা যেন ওঁর বুকপকেটের কাছে ফুলে থাকা মোটা ডায়রি। আমার এই ‘অপরিহার্য’ উত্তরটা শুনে, মন্মথ রায় আমার মাথাটাকে নিজের কাছে টেনে বুকে চাপড়াতে লাগলেন। আমার মাথা ও ওঁর পেসমেকারের সংঘর্ষে ওঁর কী আনন্দ হত জানি না, তবে আমার ভাল লাগা, মন্দ লাগার থেকেও ভয় করতই বেশি। এই আহ্লাদের চোটে মেশিনটা যদি কোনও কারণে বিগড়ে যায়!
পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমির উদ্বোধন হবে। উদ্বোধন করবেন কে? না, মন্মথ রায়। গিরিশ মঞ্চে অনুষ্ঠান। এই বান্দার ডাক পড়ল। সক্কালবেলা। হাজির হলাম। লিখলাম, যা বললেন। মনে আছে, বিপুল সংশোধন ও কাটাকুটি ছিল তাতে। পরিষ্কার করে লিখে দিলাম। অতঃপর ছুটি। দিব্যি নিজের খেয়ালে আছি। কিছুক্ষণ পর, আবার ফোন। কী কেস? মন্মথবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন না। কিন্তু আমার ডাক পড়ল কেন? মন্মথবাবুর ইচ্ছে, আমি যাই, তাঁর ওই ভাষণ আমি পড়ে দিয়ে আসি।
ফোন গেল তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কাছে। মন্মথবাবু আমার নাম করে বললেন, ‘এই ছেলেটি যাবে।’ আমি সেইদিন মন্মথ রায়ের ভাষণ পড়ে দিয়েছিলাম স্টেজে উঠেই। সামনের দিকের একটি চেয়ারে বসেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, এমনকী, তাঁর যে-গাম্ভীর্য জগদ্বিখ্যাত, তা সরিয়ে রেখে হাসতেও দেখেছি সেদিন।
কী ভাষণ, তা আর মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, ঘি-ঘি রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে সিঁড়ি দিয়ে যখন খুব দ্রুত উঠছি, তখন এক গোঁফওলা ব্যস্ত ভদ্রলোক, খানিক থেমে, চশমার ফ্রেমের মধ্য দিয়ে আমাকে ও আমার পরিধান সম্পূর্ণ মেপে, নিজের পরিধানের দিকে একবার তাকিয়ে, চোখটা কপালে তুলে, দ্রুত মিলিয়ে গেলেন। এত গভীরভাবে নিরীক্ষণের একটা কারণ ছিল এই যে, আমার ও সেই ভদ্রলোকের পরিধানের পাজামা-পাঞ্চাবি শুধু এক নয়, আমাদের নকশাখানা পর্যন্ত ছিল এক। সেই ভদ্রলোক, আর কেউ নন, উৎপল দত্ত।
এর এক বছরের মধ্যেই চলে গেলেন মন্মথ রায়, আমার মন্মথদাদু। সেদিন আমি আর ও পাড়ায় যাইনি।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved