শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হারানো পাণ্ডুলিপি ও বুড়ো আঙুল বৃত্তান্ত
Published by: Robbar Digital
Posted on: November 24, 2023 9:15 pm
Updated: March 22, 2024 9:07 pm
দে’জ থেকে ‘যুগলবন্দী’ নাম দিয়ে শক্তি ও সুনীলের কবিতা একমলাটে প্রকাশিত হয়েছিল। দু’দিকে দুটো আলাদা আলাদা ভূমিকা ছিল সুনীল ও শক্তির। তাঁরা নিজেদের কবিতা বাছাই করে দিয়েছিলেন। এই বই প্রতি বইমেলায় বিক্রি হত কয়েকশো কপি করে। হাতে হাতে ঘুরতে দেখতাম সেই বই। ওই ‘যুগলবন্দী’ শব্দটা পছন্দসই হওয়ায়– প্রেমিক-প্রেমিকা, বা বন্ধুদের উপহার দেওয়ার চল হয়েছিল বেশ।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
শুভঙ্কর দে
শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আমি চিনতাম। চিনতাম, তাঁর অবয়বে– সখ্য গড়ে ওঠেনি। বাবার সঙ্গে তাঁর দস্তুরমতো যোগাযোগ ছিল। আসা-যাওয়া লেগে থাকত। আমি সেইসব শোনা গল্পে, শক্তির চেনা-অচেনা কিংবদন্তিগুলি আশ্রয় করেই তাঁকে চিনতে শুরু করেছিলাম। তখন আমি ছোট। অটোগ্রাফ খাতায় স্বাভাবিকভাবেই শক্তির সই সংগ্রহে ছিল আমার। আজ জানি, বুঝি, সেই সই কতটা মহার্ঘ্য!
সাত-আট দশক নাগাদ শক্তি চট্টোপাধ্যায় আসতেন শ্যামাচরণ দে-র গলি দিয়ে ঢুকে– দে’জ-এর পুরনো কাউন্টারে, এখন যেখানে ‘দে বুক স্টোর’। অনেক সময় আসতেন একেবারে নিরালম্ব সুস্থ অবস্থায়, আবার কখনও আকণ্ঠ মদ্যপান করে। কবিতা আওড়াতে আওড়াতেই গলিতে ঢুকে পড়তেন তিনি। আর ওঁর আসা মানেই নানা রকম গল্পের স্রোতে খানিকক্ষণ ভেসে যাওয়া।
একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল পয়লা বৈশাখের সময়। সদ্য সদ্য ‘থাম্বস আপ’ এসে পড়েছে বাজারে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে বাবা জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কী খাবেন? কী আনাব আপনার জন্য?’ শক্তি মুঠো থেকে বুড়ো আঙুল বের করে দেখালেন। বললেন, ‘এটা জানো কী?’ বাবা বললেন, ‘না। জানি না তো!’ শক্তি বললেন, ‘তুমি আমার জন্য একটা থাম্বস আপ এনে দাও।’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে থাম্বস আপ বোঝানোর ছবিও রয়েছে আমাদের কাছে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘থাম্বস আপ’
আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। অনন্ত রঙিন। কাজে-কর্মে, কবিতায়, বেঁচে থাকায়। বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে থাকতেন কার্তিক জানা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন দেখাশোনা করতেন ‘ভারবি’, তখন কাজ দিয়েছিলেন তাঁকে। বলেছিলেন, ‘চ, তুই ভারবিতে কাজ করবি।’ পরে ‘ভারবি’ ছেড়ে দিলেন যখন, কার্তিক জানাকেও এনেছিলেন তাঁর সঙ্গে করে দে’জ-এ কাজের জন্য।
দে’জ থেকে ‘যুগলবন্দী’ নাম দিয়ে শক্তি ও সুনীলের কবিতা একমলাটে প্রকাশিত হয়েছিল। দু’দিকে দুটো আলাদা আলাদা ভূমিকা ছিল সুনীল ও শক্তির। তাঁরা নিজেদের কবিতা বাছাই করে দিয়েছিলেন। এই বই প্রতি বইমেলায় বিক্রি হত কয়েকশো কপি করে। হাতে হাতে ঘুরতে দেখতাম সেই বই। ওই ‘যুগলবন্দী’ শব্দটা পছন্দসই হওয়ায়– প্রেমিক-প্রেমিকা, বা বন্ধুদের উপহার দেওয়ার চল হয়েছিল বেশ। পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যসংগ্রহ চারখণ্ডে প্রকাশ করি আমরা। প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’ তো বটেই, ছিল দারুণ কিছু ভ্রমণকাহিনিও– যা অনেকটাই কম পঠিত বলে মনে হয় এখনও। স্বপন মজুমদারের সহযোগিতায় ঘটেছিল এই পুরো কাজটাই। তিনিই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, এমনকী, শঙ্খ ঘোষের সঙ্গেও যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন।
দে’জ-এর প্রকাশনায় যখন আমি যুক্ত হই, তখন ‘ছড়াসংগ্রহ’ নামের একটা সিরিজ বের করতে শুরু করি। তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায় জীবিত নেই। মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে আমি এ প্রস্তাব দিয়েছিলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছড়ার জন্য। খুব যত্ন নিয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়।
এমনও হয়েছে, যে দে’জ-এর এই সংস্কৃত কলেজের উল্টোদিকের যে কাউন্টার, সেই রাস্তায় ট্যাক্সি থেকে নেমে শক্তি চট্টোপাধ্যায় হাঁক মারতেন– ‘সুধাংশু, সুধাংশু’। ভোরবেলায় কিংবা রাত্রিবেলায়– যে কোনও সময়েই এসে পড়তে পারতেন শক্তি। বাবাকে কখনও বলতেন, ‘ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে, তুই টাকাটা মিটিয়ে দে।’ কখনও তাঁকে বাড়িতে গিয়ে ছেড়েও দিয়ে এসেছে বাবা। সম্পর্ক ছিল এতটাই আন্তরিক।
প্রকাশকের কাঁধে ছিল লেখকের আন্তরিক হাত। সুধাংশুশেখর দে ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়
কোভিডের আগে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে একটা ছোট্ট বক্তব্য নেব বলে। সৌমিত্রবাবু সে আলাপে শক্তি সম্পর্কেও নিজের মনে হওয়া একটুকরো বলেছিলেন। বলেছিলেন এই যে, ‘অপু জানো, আমার মতে, জীবননান্দ দাশের পরে, বাংলায় যদি কোনও শক্তিশালী কবি এসে থাকেন– তাহলে তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’
বাবাকে লেখা একটা চিঠিতে শক্তি লিখেছেন–
সুধাংশু
তোমাকে ফোনে কিছুতেই পাচ্ছি না। নেরুদার কিছু পাণ্ডুলিপি পাঠালাম তাপসের হাতে। আরো তৈরি করছি। বইমেলায় বের করার জন্য তাড়া করো না। আস্তেধীরে বেরুবে। দুই বাংলার একালের ছড়ার পাণ্ডুলিপি পাঠালাম। সেকালের ছড়াও তৈরি করছি। তাপসকে আমার যা বই তোমার কাছে আছে, তা এককপি করে দিয়ে দেবে।
ভালবাসাসহ শক্তিদা
১১-১-১৯৮৮
এটা সকলেই জানেন যে, নেরুদার যে বইয়ের কথা শক্তি লিখেছেন এই চিঠিতে, তা প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে কখনও কোনওভাবে ‘দুই বাংলার একালের ছড়া’র পাণ্ডুলিপির হদিশ পাইনি। কিন্তু তিনি লিখেছেন, মানে এ কাজ শুরু হয়েছিল অবশ্যই। পাঠক ও প্রকাশক হিসেবে এ আমাদের মস্ত না-পাওয়ার একটি।
ফোটোগ্রাফগুলি লেখক সূত্রে প্রাপ্ত।
প্রচ্ছদের শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্কেচ: অর্ঘ্য চৌধুরী
শুধু ঘরের ভেতরটা নয়, বো-ব্যারাকের বাইরেটাও ছিল আমাদের পরিবার
বো-ব্যারাকের জীবন, কীরকম ছিল তাঁদের অতীত? কতটা বদলেছে তাঁদের বেঁচে থাকা? ক্রিসমাসেরই বা কতটা বদল? স্মৃতির সিন্দুক খুললেন এরল ভ্যানগার্ড। বো-স্ট্রিটের অন্যতম স্মৃতির ধারক-বাহক।
জাল ছবি তৈরির ডেরাগুলো খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ের সংবাদমাধ্যম থেকে যা জানা গেল, তাতে ভারতের নকল শিল্পের রাজধানী নাকি কলকাতা এবং পরবর্তীকালে সরে গিয়ে দিল্লি আর মুম্বই!
আত্মীয়তা, সংহতি, বন্ধুত্বের রাজনীতিকেই ভয় করে শাসক। তাই জনমানসে কারাগার, কারাজীবনকে বরাবর এক অপরাধ সম্পৃক্ত বিপজ্জনক পরিসর হিসেবে চিহ্নিত করতে লাগে। বন্দিদের অপরাধ প্রমাণের আগেই তাঁদের অপরাধী করে তুলতে লাগে, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই সাজা চলতে থাকে। মেয়েদের রাজনৈতিক সত্তাকে অস্বীকার করলেও, মেয়েদের রাজদ্রোহিতা তাই শাস্তিযোগ্য।
সেমিস্টারের সামনে এসে মেস তার ঢিলেঢালা আলখাল্লা খুলে রাখত। যাকে বলে মালকোঁচা বেঁধে দৌড়ের মতো আমরা ম্যাট্রিক্সের পাতায় পাতায় চলতাম। ডালে ডালে এগিয়ে আসত সেমিস্টার।