একজন বড় কবি যেমন তাঁর কিংবদন্তিকে উদযাপন করেন, তেমনই তাঁর সঙ্গে লড়াই করেন। কেননা তিনি জানেন কিংবদন্তি আসলে তাঁর ‘কিলার’, প্রকৃত কবি যিনি তিনি তাঁর কিংবদন্তিকে দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে তিনি বারবার কফিন থেকে উঠে আসেন। যিশু একবার উঠে এসেছিলেন। সেটাই কাফি। কিন্তু একজন কবিকে বারবার উঠে আসতে হয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে সেই জোর ও জাগরণ আছে, তিনি গিনসবার্গ ও জীবনানন্দের মতো বলতে পারেন, ‘আমাকে পড়ো, পড়ে দেখো, আমাকে নিয়ে রটানো কিংবদন্তীর ভেতর আমাকে পাবে না’।
সব মাছ-ই নোংরা খায়, ইলিশের নামে দোষ হয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সেই ইলিশ, যিনি নোংরা খেয়ে বাংলা কবিতাকে পবিত্র করে গেছেন। গরল পান করে সোনা লিখেছেন। তাঁর অক্ষরগুলো হাতে ছুঁলেই বোঝা যায় এগুলো অক্ষর নয়, এগুলো মোহর।
কবি ও তাঁর কিংবদন্তি নিয়ে একটা তথ্য সামনে আনা দরকার। একজন বড় মাপের কবি শুধু মোহর রচনা করেই বিখ্যাত হন না। তাঁর একটা কিংবদন্তি লাগে। যা তাঁকে ঘাড়ে করে নিয়ে যাবে এক দশক থেকে আরেক দশকে। যেমন অ্যালেন গিনসবার্গ, যেখানে কবিতা পড়েছেন সেখানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাঁরও একটা কিংবদন্তি দরকার ছিল, তিনি এই পৃথিবীর প্রথম ঘোষিত হোমোসেক্সুয়াল কবি। তিনি আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকার কলেজে কলেজে দিন এবং রাত দুটোই দখল করেছিলেন। এত বড় কিংবদন্তি আমেরিকা গত শতাব্দীতে আর পায়নি। বিনয় মজুমদার পাগল, তিনি গায়ত্রী স্পিভাকের প্রেমিক, থাকেন বনগাঁর উপকূলে। স্তালিন ফোন করলেন বরিস পাস্তারনাক-কে ,জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি ওসিপ মান্দেলস্তাম সম্পর্কে কী জানো?’ একটা ফোন কল মান্দেলস্তাম-কে পৃথিবী বিখ্যাত করে দিল, পাস্তেরনাক-কে নোবেল এনে দিল, স্তালিন-কে আরও কুখ্যাত করে দিল। একজন বড় কবি যেমন তাঁর কিংবদন্তিকে উদযাপন করেন, তেমনই তাঁর সঙ্গে লড়াই করেন। কেননা তিনি জানেন কিংবদন্তি আসলে তাঁর ‘কিলার’, প্রকৃত কবি যিনি তিনি তাঁর কিংবদন্তিকে দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে তিনি বারবার কফিন থেকে উঠে আসেন। যিশু একবার উঠে এসেছিলেন। সেটাই কাফি। কিন্তু একজন কবিকে বারবার উঠে আসতে হয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে সেই জোর ও জাগরণ আছে, তিনি গিনসবার্গ ও জীবনানন্দের মতো বলতে পারেন, ‘আমাকে পড়ো, পড়ে দেখো, আমাকে নিয়ে রটানো কিংবদন্তীর ভেতর আমাকে পাবে না’। বেগবাগানের পাঁইট কিংবা দেশপ্রিয়র ট্রাম কোনও কবিকে খুন করতে পারে না। তিনি ভরাট গলায় মনে করিয়ে দেন, ‘পদ্য খাইয়ে খাইয়ে আমাকে পদ্যপ করেছ’। এই লাইন ভারতবর্ষে দু’জন লিখেছেন– একজন মির্জা গালিব, অন্যজন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। দুশো বছর আগে গালিব লাইনটা লিখেছিলেন, ছাপতে দেননি, শক্তির হাতে দিয়ে জন্নত চলে গেছেন।
বাংলা কবিতাকে তিনি ‘হর্স পাওয়ার’ দিয়েছিলেন, ছন্দের বিনীত মুখটিকে তিনি থুতনি ধরে ওপরে তুললেন। গতি দিলেন মাত্রাবৃত্তে, আগুন ধরিয়ে দিলেন স্বরবৃত্তে। নিজে লাফ দিয়ে উঠে বসলেন ঘোড়ার পিঠে। বাংলা কবিতার পাঠক দেখতে পেলেন একটা আগুন লাগা ঘোড়া এগিয়ে আসছে, তার ওপর বসে আছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের পরে ছন্দ এত গতি পায়নি কারও হাতে, ছন্দ এত বল্গাহীন হতেও পারেনি শক্তির পরে। লাইনে লাইনে যত বিদ্যুৎ শক্তির কবিতায়, ততটাই তাপবিদ্যুৎ তাঁর ছন্দে। তাঁর হাত থেকে যে দু’-একটা মোহর পড়ে গিয়েছিল চাইবাসায়, কিংবা খালাসিটোলায় তাই কুড়িয়ে তার সন্ততিরা লিখে গেলেন। দ্বিতীয় কোনও সমতুল্য কবিতা লেখেনি কোনও ভারতীয় কবি, যেমন, ‘তীরে কী প্রচন্ড কলরব/ জলে ভেসে যায় কার শব/ কোথা ছিল বাড়ি/ রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় আমি স্বেচ্ছাচারী!’ নির্ভুল ছন্দে কবিতা লিখলেই বড় কবি হওয়া যায় না, বড়জোর ছন্দ-জানা কবি হওয়া যায়। শক্তি ছন্দের মৃত আত্মাকে ভেন্টিলেটর থেকে বের করে নিজের দাবনা কেটে রক্ত পান করিয়েছিলেন। নিজের রক্ত পান না করালে কবিতা নিজের হয় না। শক্তির কবিতায় এখনও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের তাজা রক্ত লেগে আছে। সেই রক্ত মোছাতে পারে একজন, তাঁর সতীর্থ, তাঁর নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি তাঁর বিপরীত মেরুর নাগরিক। তাঁর হাত কই? তিনিও তাঁর লেখার হাত নিয়ে ওপরে চলে গেছেন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোনও দায় ছিল না। তিনি ছিলেন মুক্তমন। এমন একটা সময় জুড়ে তিনি কবিতা লিখেছেন, যখন প্রতিটি কবির ওপর ‘দায়বদ্ধতা’ বলে একটা শব্দ ডেমোক্লিসের খড়্গের মতো ঝুলে থাকত।
শক্তি ওসব দায়বদ্ধতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, পিকাসোর স্টাইলে। দু’-ঘন্টা ধরে পিকাসোকে বোঝানো হয়েছিল কাকে দায়বদ্ধতা বলে, কাকেই বা বলে ‘সামাজিক বাস্তবতা’, পিকাসো হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ‘দায়বদ্ধ’, কিন্তু সে দায়বদ্ধ মানুষের গভীর সূক্ষ্ম অনুভূতিমালার কাছে। নারীর চোখের জলের কাছে, কাজলের কাছে, মানুষের উপচে পড়া হৃদয়ের কাছে– ‘চোখ দুটোতে কাজল ঢেলে, করমচা ফল করবো গুঁড়ো/ উড়াল দুপথ— আমার মায়ার দন্ড ছুটবে পাহাড়চুড়োয়।’ এই দু’-লাইন ব্যাখ্যা করতে যাবেন না, ব্যাখ্যা হল সেই ট্রেন, যা কবিতাকে দু’-খণ্ড করে চলে যায়। খারাপ কবিতা ব্যাখ্যা করা যায়, ভালো কবিতা ব্যাখ্যা করা যায় না। কী ব্যাখ্যা দেবেন এই কবিতার? ‘ভালবাসা সবই খায়– এঁটো পাতা, হেমন্তের খড়/ …সবই খায়, খায় না আমাকে/ এবং হাঁ করে রোজ আমারই সম্মুখে বসে থাকে।’ শক্তির কবিতায় হাহাকারের ভেতরেও একটা সিংহের না-পারার গর্জন থাকে। বিরহের ভেতরেও থাকে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে বাঘের চলে যাওয়া। তাঁর কবিতায় যে জঙ্গল, সে জঙ্গল ‘আরণ্যক’ নয়, সে জঙ্গল বিভূতিভূষণ নয়, সে জঙ্গল শহরকে মনে করিয়ে দেয়– তুমি একদিন আমার মতো ছিলে। জঙ্গল থাকলেও, শক্তি আসলে আগুনের কবি। তাঁর কবিতায় যত লাভাস্রোত দেখি, তা আর কারও কবিতায় দেখিনি। তাঁর লাভামুখ যখন যখন খুলে গেছে তখনই তাঁর কবিতায় উদগিরণ দেখা গেছে। কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে নয়, রাষ্ট্রের কাছে নয়, একমাত্র প্রেমের কাছেই ভিখিরি হওয়া যায়। কী বলতে চেয়েছিলেন শক্তি তাঁর ‘পছন্দ প্রাক্তন’-কে? ‘ইচ্ছে করে তার কাছে গিয়ে বলি, ভিখারি তোমাকে/ একদিন ভালবাসতো, আজ তার ভিক্ষাই মণীষা’।
………………………………….
পড়ুন বিদ্যুৎ ভট্টাচার্যের লেখা: অরুণদার একটা ক্লাসে থমকে গিয়েছিল আস্ত জঙ্গল কাটার ষড়যন্ত্র
………………………………….
পৃথিবীতে দু’-রকম কবিতা বিখ্যাত হয়, এক প্রতিবাদের কবিতা, দুই প্রেমের কবিতা। তৃতীয় একটা জায়গা আছে, ভক্তিরসের কবিতা, ‘ডিভিনিটি’, যা ইংল্যান্ডেও ছিল, যা তুলসীদাস-তুকারাম-কবীর হয়ে রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায় দখল করে আছে। বিহার-ইউপি-এমপি-দিল্লি-রাজস্থানে তুলসীদাসের লাইন অভাগী মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। সেই ভক্তিরসের কাছে কোনও আধুনিক কবি পৌঁছতে পারবে না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মনে হয় না, প্রতিবাদের কবিতাকে খুব একটা উঁচুদরের কাব্য বলে মনে করতেন। কিন্তু তাঁর দু’জন প্রিয় কবি, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর পাবলো নেরুদা। আমার মনে হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তিনি ভালোবাসতেন অসামান্য ছন্দের জন্য, আর পাবলো নেরুদাকে প্রেমের কবিতার জন্য। পাবলো নেরুদাই একমাত্র কবি, যিনি প্রেম ও প্রতিবাদ দু’-নৌকোতেই সফল। আমাকে একবার শক্তিদা নব্বই সালে বলেছিলেন, ‘এই যে ছেলে, এত প্রতিবাদ লেখ কেন? প্রেম লিখতে পারো না?’ আমি বলেছিলাম, ‘আমার ভেতরে যা আছে তাই তো লিখব, শক্তিদা’। আমার একমাথা কালো চুল নেড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘একদিন চলে এসো’। শক্তিদা বেঁচে থাকলে বলতাম, ‘দেখুন, বাংলা কবিতাকে দেখুন, এখন সবাই প্রতিবাদের কবিতা লিখছে, কেউ বাদ নেই। আমি গত চল্লিশ বছর ধরে লিখে এলাম প্রতিবাদ, কম ধমক খাইনি।’
……………………………………..
পড়ুন তিলোত্তমা মজুমদারের লেখা: কবিতার বারুদ আগুন
………………………………………
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ধারণা-ভূমিতে চিরন্তন কবিতার স্থান ছিল, তিনি কোনও সাম্প্রতিক ঘটনার কবি ছিলেন না। তাই জন্যই লিখেছিলেন, ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও’। এই একটা লাইন দু’-হাজার বছর আগেও লেখা হতে পারত, দু’-হাজার বছর পরেও লেখা যেতে পারে। এতটাই তিনি কাল অতিক্রমকারী কবি। শক্তি বনাম শক্তি সেখানেই হিরণ্ময় যেখানে শক্তি বারবার নিজের কিংবদন্তিকে হারিয়ে দিয়ে কফিন খুলে উঠে এসেছেন।
শেষে একটা কথা বলার ছিল। এখনও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভালো অনুবাদ হল না। এত বড় একজন আন্তর্জাতিক কবি, তাঁকে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন একজন উইলিয়াম রাদিচে কিংবা একজন ক্লিন্টন বিসিলি। একজন চলে গেলেন, একজন শিকাগোতে অস্ত গেছেন। আমি অপেক্ষা করে আছি নতুন এক অনুবাদকের জন্য, যিনি ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায় ইজ রিবর্ন’ বলে লিখতে পারবেন সেই অনুবাদের বই যেমন পেঙ্গুইন থেকে বেরিয়েছিল রাদিচের ‘গীতাঞ্জলি রিবর্ন’।
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।