দিওয়ালির রাত, ভ্রমর ও অমল গ্রামে গিয়েছে আতশবাজি দেখতে। বাড়ি ফেরার পথে, তারা একসুরে গায়: ‘সুন্দর, হে সুন্দর…’। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই গানের চিত্রায়ণ; যেমন, ব্যাকগ্রাউন্ডে রোশনাই, সামনে ভ্রমর ও অমল হাঁটছে ও গান গাইছে। সাধারণভাবে বাংলা ছবিতে রবীন্দ্র সংগীতের এই ধাঁচের গানের চিত্রায়ণ বিরল। আমার বক্তব্য, এর ফলে নির্মিত হয়ে এক আশ্চর্য গতিময়তা ও ইরোটিক চার্জ। গানের শেষে (মিড্-শট), ঘরে ফেরার আগে অমল বলে: ‘দেখো তো আমার মুখে সিগারেটের গন্ধ আছে কি না?’ কাট-টু, ভ্রমরের ক্লোজ-আপ, সে অমল দিকে চেয়ে; তীব্র প্রেমের চাহনি, ঠোঁট কাঁপছে। অমল বলে: ‘কী হল…? তাহলে চলো, ফেরা যাক।’
২০২৪ ছিল চিত্র-পরিচালক অরুন্ধতী দেবীর জন্মশতবার্ষিকী। এই লেখায়, চিত্র-পরিচালক হিসাবে তাঁর ভাবনা অন্বেষণ করার চেষ্টা করছি কারণ, মেয়েদের কাজকে সহজেই ভুলে যাওয়া যায় বা ভুলে থাকা চলে; তাঁদের অভিপ্রায়কে বিশেষ জরুরি বিষয় বলে মনে করা হয় না। যেন কাজগুলি তিনি করেনইনি বা ঘটনাগুলো ঘটেইনি, এবং তাঁর ইচ্ছেগুলোও বাতিল। কর্পূরের মতো উবে যায় কষ্টিপাথরে চিহ্নিত চিত্রগুলি। যেমন অরুন্ধতী দেবীর নির্মিত একাধিক ছবি– ‘মেঘ ও রৌদ্র’ (১৯৬৯) ও ‘পোদিপিসির বর্মী বাক্স’ (১৯৭২), অথবা, মঞ্জু দে পরিচালিত ‘অভিশপ্ত চম্বল’ (১৯৬৭) এবং ‘শজারুর কাঁটা ’(১৯৭৪) খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ এই একই সময়ের প্রচুর নামজাদা ছবি অনায়াসে অনলাইন পাওয়া যায়, তার রেস্টোরেশন হয়, এবং বড় পর্দায় দেখা যায়। অরুন্ধতী দেবী অথবা মঞ্জু দে নির্মিত ছয় ও সাতের সময়ের ছবিগুলি কীভাবে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল, তা আমার সঠিক জানা নেই। কিন্তু যে ছবিটি টিকে গেল– ‘ছুটি’ (১৯৬৭)– অরুন্ধতী দেবীর সেই কাজটি ফিরে দেখতে চাই। প্রশ্ন হল: Is there any self-reflective female gaze? অর্থাৎ, মেয়েদের নিজেকে দেখার চোখ কি ভিন্ন? তা কি আত্ম-বিশ্লেষণ করতে সক্ষম? হলে, তা কীরকম?
আশ্চর্য এক ছবি ‘ছুটি’, শুরু হয়ে গির্জার ঘণ্টার ক্লোজ-শট দিয়ে। তারপর একটি গির্জার শট ও পরপর তিনটি লম্বা প্যান। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় ছবির স্থান, পরিবেশ ও পরিসর। শোনা যায় ভ্রমরের (নন্দিনী মালিয়া) কথা, দেখা যায় তাদের বাড়ি, ঘর, পাহাড়ি অঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপ; শোনা বা বোঝা যায় তার ছেলেবেলার কথা, ভয়ের ও সংশয়ের। এবং তার বাবা ও মৃত মায়ের কথা, আয়ার কথা, বোন ও নতুন মায়ের কথা। কিন্তু, আমি বলতে চাইছি ছবির অনন্য আখ্যান শৈলীর কথা: পরিচালক ছবির যে ধীরগতি নির্মাণ করেছেন ও শটের ভিতর যে সময় প্রতিবাহিত হয়, সেই সিনেম্যাটিক স্টাইলের কথা, ও সময় বা টাইমের চলনের কথা। তাছাড়া, বলতে চাই ছবির থিমের কথাও: মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কি ভালোবাসা যায়? যে শরীর বেড়ে ওঠার আগেই ক্ষয়ে যাচ্ছে, সেই শরীর কী চায়? কী চাইতে পারে, যা চাওয়া যায়? এবং সেই কথা আখ্যান হয়ে ওঠে কোন প্রক্রিয়ায়?
……………………………….
এই ধীম লয়ের প্রয়োগ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, একই বছরে নির্মিত, সত্যজিত রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ বা তপন সিনহার ‘হাটে বাজারে’ (রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত) থেকে অনেকটা পৃথক। ‘ছুটি’ ছবিতে শার্প কাটস, ক্লিয়ার ট্রানজিশনস, স্মার্ট ফিগারেশনস (sharp cuts, clear transitions, smart figurations)– তেমন কিছুই নেই। রয়েছে দুপুরবেলার এক স্থিরতা; কিছুটা অনুমান করে বলা চলে যে– যেন একধরনের মেয়েদের শান্ত সময় (time experience) ছবির লয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।
………………………………
যেমন, শুরুর দিকে, ভ্রমরের বর্ণনার সঙ্গে দেখা যায় ফুলের শট, শোনা যায় শিশুর হাসি ও কান্না; তাছাড়া, যে সময়ে সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তার ভিজ্যুয়াল ন্যারেশন লক্ষণীয়। দেখা যায় ৯ সেকেন্ড দৈর্ঘের কালো ফ্রেম ও শোনা যায় ট্রেনের কর্কশ শব্দ। এই শৈলীর, অথবা, এই ধীর গতির বা ‘স্লোনেস অফ সিনেমা’ (slowness of cinema), যা আজকের দিনে বহুচর্চিত বিষয়– তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি কারণ, এই শৈলী অরুন্ধতী দেবীর সময়েও বিরল। জনপ্রিয় ছবিতে তো বটেই। এই ধীম লয়ের প্রয়োগ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, একই বছরে নির্মিত, সত্যজিত রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ বা তপন সিনহার ‘হাটে বাজারে’ (রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত) থেকে অনেকটা পৃথক। ‘ছুটি’ ছবিতে শার্প কাটস, ক্লিয়ার ট্রানজিশনস, স্মার্ট ফিগারেশনস (sharp cuts, clear transitions, smart figurations)– তেমন কিছুই নেই। রয়েছে দুপুরবেলার এক স্থিরতা; কিছুটা অনুমান করে বলা চলে যে– যেন একধরনের মেয়েদের শান্ত সময় (time experience) ছবির লয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।
………………………………
পড়ুন সোহিনী দাশগুপ্ত-র লেখা: আদরে সোহাগে কেঁপে ওঠা মেয়ের খোঁজ রাখে না বনবন করে ঘুরতে থাকা এ পৃথিবী
………………………………
তবে, এই মন্দগতি, কোনও ‘মেয়েলি’ মন্থরতা নয়; বরং, একধরনের পলিটিকাল চয়েস বলা চলে, যা পুঁজিবাদী গতির বিপরীত তালে বিচরণ করে। এই ছবি দেখতে দেখতে মনে হয় যেন এ গল্পের অনেকটা বাকি বা অসম্পূর্ণ; অনেকটা বলা হয়নি, অথবা অনেকটা বলা যাবে না বা যায় না, বোধহয়, দরকারও নেই– like a secret history of gender, queerness, feminine desires and drives. এক বিস্তীর্ণ, প্রগাঢ় ও অব্যক্ত ইতিহাস, যা এই ছবির শরীরে এবং ভ্রমরের চোখে লেগে রয়েছে।
ছবির গোড়ার দিকে, এদের পরিচিত এক তরুণ, অমল (মৃণাল মুখোপাধ্যায়), ‘ছুটি’ কাটাতে উপস্থিত হয়, এবং ভ্রমর ও তার বোনের (কৃষ্ণা) সঙ্গে গড়ে ওঠে তার সখ্যতা। ধীরে ধীরে অনুভব করা যায় যে মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে কিশোরী ভ্রমর কেন গেয়ে ওঠে: ‘আমার জীবন নদীর ওপারে, এসে দাঁড়ায়-ও বধূ হে…’ I অমলের ছুটি, ভ্রমরের ছুটি, হয়ে ওঠে মেয়েদের সাধ, আশা, আকাঙ্ক্ষা ও দ্বিধার এক চমকপ্রদ এবং একক আখ্যান। একটি বিশেষ সিকোয়েন্সের কথা বলি: দিওয়ালির রাত, ভ্রমর ও অমল গ্রামে গিয়েছে আতশবাজি দেখতে। বাড়ি ফেরার পথে, তারা একসুরে গায়: ‘সুন্দর, হে সুন্দর…’। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই গানের চিত্রায়ণ; যেমন, ব্যাকগ্রাউন্ডে রোশনাই, সামনে ভ্রমর ও অমল হাঁটছে ও গান গাইছে। সাধারণভাবে বাংলা ছবিতে রবীন্দ্র সংগীতের এই ধাঁচের গানের চিত্রায়ণ বিরল। আমার বক্তব্য, এর ফলে নির্মিত হয়ে এক আশ্চর্য গতিময়তা ও ইরোটিক চার্জ। গানের শেষে (মিড্-শট), ঘরে ফেরার আগে অমল বলে: ‘দেখো তো আমার মুখে সিগারেটের গন্ধ আছে কি না?’ কাট-টু, ভ্রমরের ক্লোজ-আপ, সে অমল দিকে চেয়ে; তীব্র প্রেমের চাহনি, ঠোঁট কাঁপছে। অমল বলে: ‘কী হল…? তাহলে চলো, ফেরা যাক।’
পরের দৃশ্যে ভ্রমরের বোন এসে জানায়: ‘লীলার শাদি হবে।’ তারপর দেখা যায়, শুরুর বিষণ্ণ ল্যান্ডস্ক্যাপ নতুন রূপ পেয়েছে; সেই বিস্তর প্রান্তরে ছোট্ট ভ্রমর ঘুরে ও নেচে বেড়াচ্ছে, তার মনে পড়ছে দু’টি শব্ধ– ‘দেখো তো… দেখো তো’। ল্যান্ডস্ক্যাপ, মিউজিক, মুভমেন্টের দ্বারা এই দেড় মিনিটের দৃশ্যে এবং দৃশ্যের শেষে ভ্রমরের উচ্চারিত অস্পষ্ট দু’টি শব্দ– ‘দেখো তো’, বাংলা ছবির ইতিহাসে এ এক অদ্ভুত দৃষ্টান্ত। লুইকেমিয়ায় আক্রান্ত, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ভ্রমর ভালোবাসতে চায়, বাঁচতে চায়, ভীষণভাবে চায়। এমন চাওয়া হয়তো ছিল ‘পথের পাঁচালী’র (১৯৫৫) দুর্গার। সে বন্ধুর বিয়েতে আকুল হয়ে চেয়ে থাকে, চুরি করে, লোভীর মতো চেটে খায়, এবং বৃষ্টিতে ভেজে– যেন সারা ব্রহ্মাণ্ডের অভিলাষ তার দেহে সঞ্চারিত হয়েছে।
এই শরীর দিয়ে বাঁচতে চাওয়া, তার তীব্রতা, ‘ছুটি’-তে প্রকট হয়ে ওঠে। খ্রিস্টমাসের পর ভ্রমরের অসুস্থতা যখন আরও বেড়ে যায় এবং তার ব্যাধি নির্ণয় হয়, তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু তার আগে, পড়ন্ত বেলায়, ভ্রমর উদাত্ত কণ্ঠে গায়: ‘হাত ধরে তুমি নিয়ে চলে সখা….’। অমল তাকে জিজ্ঞেস করে: ‘ভ্রমর, তোমার এ সখাটি কে?’ ভ্রমর: ‘কেন? ভগবান।’ অমল: ‘ভগবান…?’ ভ্রমর: ‘তুমিও…’। দু’টি শিলুয়েটেড ফিগার ছায়ার মতো মিশে যায়।
এরপর, হাসপাতালে যাওয়ার আগে ভ্রমর ও অমলের শেষ কথোপকথন মারাত্মক। শালবনের মাঝে, পাতার ডিজাইনের শাড়ি পরে ভ্রমরকে অনেকটা বড় দেখায়। সে বলে: ‘আমার কি অসুখ করেছে তুমি জানো?’ তাদের কথার মাঝে অমল চিৎকার করে বলে: ‘তুমি ফিরে না এলে দেখো, দেখো, আমি কী করি’। এর উত্তরে ভ্রমর এক অদ্ভুত স্বরে বলে: ‘আমি… আমি, ফিরব না কেন? বললে না, আমি হাসপাতাল থেকে ফিরব না কেন? ওখানে কে আছে আমার?’ ভ্রমরের এই স্পষ্ট শরীরী অনুভূতি, কৈশোরের চাহিদা, ভালোবাসার উপলব্ধি, বেঁচে থাকার ইচ্ছে– সবটাই মিলেমিশে যায়।
শেষ শটে তার চোখের বিগ ক্লোজ-আপ ও ব্যাকগ্রাউন্ড ‘সুন্দর ও সুন্দর’-এর সুর, ও তার সোজা তাকিয়ে প্রশ্ন জানান দেয় মেয়েদের যৌগিক সুখ-অসুখের কথা। ফ্রয়েডের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ‘eros and thanatos’ (১৯২০), বা সেক্স ড্রাইভ (life force/will to live) ও ডেথ-ড্রাইভ (self-annihilation/destruction)-এর দ্বিধা ছাড়িয়ে, ভ্রমর বা ভ্রমররা বাঁচতে চায়, এবং সেই বেঁচে থাকার কেন্দ্রে রয়েছে রক্ত-মাংস-মজ্জা দিয়ে তৈরি একটি শরীর। সম্প্রতি, ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’ (২০১৪) বা ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ (২০২৪)-এর মতো ছবিতে মেয়েদের সাধ দেখা যায়। যেমন, ‘অল উই ইমাজিন…’-এর একটি দৃশ্যে প্রভা এক ছায়া-মানুষের পাঠানো রাইস কুকারকে আলিঙ্গন করে, যেন হারিয়ে যাওয়া মানুষটির শরীরের উষ্ণতা সে অনুভব করছে। অনেকটা ঠিক ভ্রমরের মতো সে যেন শরীরের ঘ্রাণ ছুঁতে চায়। সংক্ষেপে, ‘ছুটি’র মতো ছবি বারংবার মনে করিয়ে দেয় যে, শরীর ক্ষয়ে গেলেও, তার সাধ, ইচ্ছে, সুখ, স্পর্শ, গন্ধ চিরন্তন।