Robbar

অট্টহাসির প্রেমে পড়ুন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 5, 2024 4:47 pm
  • Updated:May 5, 2024 9:31 pm  

সংবাদপত্রে ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’য় কোনও মানুষ প্রবল হাসছেন, এমন ছবি দিয়ে যদি বলা যেত– মানুষটিকে পাওয়া গিয়েছে, অট্টহাসিটিকে পাওয়া যাচ্ছে না, তারিখ…, সাল…, খুঁজে দিলে নগদ ৫০০০ টাকা পুরস্কার, তার পরেও কি খুঁজে পাওয়া যেত তাকে? কী ওষুধ খাওয়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে? স্ট্যান্ড আপ কমেডি? শিবরাম চক্রবর্তী? তারাপদ রায়? সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়? চন্দ্রিল ভট্টাচার্য? লাফিং গ্যাস? নির্বাচনী ইস্তাহার? রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের স্পিচ?

প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস

সম্বিত বসু

হাসি আর অট্টহাসি এক পেটেরই ভাই। পেট-ফাটা হাসিতেই ওদের জন্ম। যদিও দু’-ভাইয়ের একজনই জলে-স্থলে-বনতলে হেবি নাম কামিয়েছে– সে হল হাসি। বাড়ির ছোটটি। ওদের এক বোন আছে, ডাকনাম মুচকি, ভালো নাম মৃদু। সে-ও বেশ নামকরা। এছাড়াও কাছ-দূর সম্পর্কের অনেক আত্মীয়-হাসি রয়েছে। সে যাই হোক, আজ হাসি আর অট্টহাসি নিয়েই কথা বলব। মূলত ‘অট্টহাসি’ নিয়ে। কারণ সে-ই বেচারা তেমন কিছু করে উঠতে পারল না। বলা ভালো, করে উঠতে দেওয়া হল না। অনেক কাল অভিমানী বেপাত্তা। সংবাদপত্রে ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’য় কোনও মানুষ প্রবল হাসছেন, এমন ছবি দিয়ে যদি বলা যেত– মানুষটিকে পাওয়া গিয়েছে, অট্টহাসিটিকে পাওয়া যাচ্ছে না, তারিখ…, সাল…, খুঁজে দিলে নগদ ৫০০০ টাকা পুরস্কার, তার পরেও কি খুঁজে পাওয়া যেত তাকে? কী ওষুধ খাওয়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে? স্ট্যান্ড আপ কমেডি? শিবরাম চক্রবর্তী? তারাপদ রায়? সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়? চন্দ্রিল ভট্টাচার্য? লাফিং গ্যাস? নির্বাচনী ইস্তাহার? রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের স্পিচ?

অট্টহাসি কাউকে ছেড়ে যেতেই পারে, ফিরেও আসতে পারে নিশ্চয়ই। এ কি ‘গল্প হলেও সত্যি’র রবি ঘোষ নাকি? সে বাসা বদল করে। টিকিয়ে রাখে নিজেকে। অট্টহাসিবিরুদ্ধ কোনও টিকা নেই ভাগ্যিস! মানুষের যে ৩২ পাটি দাঁত আছে, তা নিশ্চয়ই প্রথম কোনও অট্টহাসির দরুনই আবিষ্কার হয়েছিল। রোজই দাঁত মাজার সময় তাই নীরবে, স্লো-মোশনে অট্টহাসি প্র্যাকটিস করা হয়। কীভাবে যেন, হাসি নির্মল আর অট্টহাসি নির্মম– এইরকম একটা বোকাসোকা আখ্যানে বিশ্বাস করে নিয়েছে মানুষ।

Mogambo khush hua: This is why movie villains have an evil laugh

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

কিন্তু কখন আবার দু’পাশে কথা হত, মিশে যেত? যখন টিটুমাসি আসত। টিটুমাসি যে আসত, তা কাউকে না জানিয়েই। তখন যা জলভাতের মতোই ছিল, আজ জগদ্বিখ্যাত সারপ্রাইজে এসে ঠেকেছে। কিন্তু আসামাত্র বড়দাদুর দিক তো বটেই, সারাপাড়াই জেনে যেত। প্রযত্নে: টিটুমাসির অ-মাইক হাসি। দাদুদের মধ্যে যতই ঠোকাঠুকি লেগে থাক, মেয়েরা এলে অন্তত একবার এসপার-ওসপার হবেই। দিদা বলত, ‘টিটু এসেছে, যাই দেখে আসি।’ বড়দাদু বলত, ‘যাবে? চলো।’

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

উত্তম না সৌমিত্র বাঙালির সেরা রোম্যান্টিক হিরো কে? কিছু প্রশ্নের উত্তর অধরাই থাক - Two Icon of Bengali Cinema Uttam Kumar and Soumitra Chatterjee and their never ending Saga of love ...

দুই ভাইকে লড়িয়ে দিয়ে কী যে লাভ হয়েছে কে জানে! বায়োস্কোপ দেখুন– হাসত হিরো-হিরোইন, আর অট্টহাসি চাপিয়ে দেওয়া হত ডাহা ভিলেনের ওপর। ভিলেনের যে কোনও বেহায়া কাজ, তা হিরোকে ক্যালানো হোক কি নায়িকাকে অপহরণ– সবেরই আগে, সে ওই নকল হা-হা-হা-হা-হা হেসে খামোকা সময় নষ্ট করত। আজকাল সিনেমা-সিরিজ এমন বাস্তবের বড়ি খেয়েছে, যে অট্টহাসি আর রোল পায় না। কিন্তু অট্টহাসি মানেই যে ভিলেন– এলেন, দেখলেন, হাসলেন, মার খেলেন, ব্যাপারটা চিরকালই এমন ছিল না মোটে। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ খুললে দেখা যাবে, ‘অট্ট অট্ট হাসে দেবী’– কোট করছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবী অর্থে চণ্ডী। তালে? ‘বাল্মিকী প্রতিভা’র ‘কালী কালী কালী বলো রে’-তে রবীন্দ্রনাথ লট্ট পট্ট কেশের সঙ্গে কীসের মিল দিতেন যদি অট্ট অট্ট হাসি না থাকত? আচ্ছা, দু’জনেরই প্রলয়ঙ্কারী মেজাজ রয়েছে, এই তো? কিন্তু কোথায় দেবী আর কোথায় ভিলেন? বেশ, বাঙালির জন্য কবির বর্ম থাক, রবীন্দ্রনাথ থেকেই ধার করি আবার– ‘পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি/ হল আমার সাথের সাথি–/ অট্ট হাসে ধায় কোথা সে, বারণ না মানে॥’ হল তো? হাসির চেয়ে যা বেশি, তা আসলে বিস্ময় সঞ্চারী, তাকে ভয়ানক করে তুলতে হবে কেন? এই বিস্ময়ের মধ্যেও তো আকর্ষণ আছে, ওই বিপুল হাসিতে যে আলো ছড়িয়ে পড়ে, তাতে তো ৪৫ ডিগ্রির রোদ নেই, রয়েছে সন্ধ্যানদীতে এলোমেলো শুয়ে পড়া সূর্যের শেষ আলো। তবুও এত স্টিরিওটাইপ করে দেওয়া হবে কেন, হ্যাঁ? হাসি আর অট্টহাসি যেহেতু ভাই-ভাই, সেক্ষেত্রে নেপোটিজমের ওপরও দায় চাপালে চলে না। শব্দকোষে এ-ও রয়েছে– ‘যাহা অন্যগৃহ অতিক্রম করে’। ভাবুন তো, হাসি কি দেওয়াল পেরেক নাকি যে সে বাড়ির সীমানা অতিক্রম করতে পারবে না!

The films and me: Impeccable imposter (Mahapurush from Kapurush O Mahapurush)

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আরও পড়ুন: জীবনকে যে ভয় পায় না সেই হাসতে পারে অট্টহাসি

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

সীমানা অতিক্রম করে অট্টহাসির অন্য পারে আসা যে জরুরি, তা বুঝেছিলাম অনেককাল আগে, যদিও খানিক ব্যক্তিগত, তাও বলি। জানবেন, জয়েন্ট ফ্যামিলি অনেক বেগড়বাইয়ের পর ভাঙবে ভাঙবে করেও যখন ভাঙে না, তখন একখানা দরজার এপাশে তোর, আর ওপাশে আমার– এই সূত্রে ভাগ হয়ে যায়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, জয়েন্টে সে ফ্যামিলি ফেল করেছে। লোকনিন্দে ও পরচর্চার ভয়েই বোধহয় কোনও এক বাঙালি ব্রেনে এই বাল্ব জ্বলেছিল। দু’দিক থেকে বাঘা সাইজের দুটো আলমারি এসে জুটেছিল সেই কমন দরজার মুখ আড়াল করে। দীর্ঘদিন কথাবার্তা নেই। মুখ দেখাদেখি নেই। দুটো আলমারির মাঝে দরজাখানা হয়তো কথা জমাতে থাকত। এ জিনিস হয়েছিল আমার ছোটদাদু ও বড়দাদুর মধ্যে।

কিন্তু কখন আবার দু’পাশে কথা হত, মিশে যেত? যখন টিটুমাসি আসত। টিটুমাসি যে আসত, তা কাউকে না জানিয়েই। তখন যা জলভাতের মতোই ছিল, আজ জগদ্বিখ্যাত সারপ্রাইজে এসে ঠেকেছে। কিন্তু আসামাত্র বড়দাদুর দিক তো বটেই, সারাপাড়াই জেনে যেত। প্রযত্নে: টিটুমাসির অ-মাইক হাসি। দাদুদের মধ্যে যতই ঠোকাঠুকি লেগে থাক, মেয়েরা এলে অন্তত একবার এসপার-ওসপার হবেই। দিদা বলত, ‘টিটু এসেছে, যাই দেখে আসি।’ বড়দাদু বলত, ‘যাবে? চলো।’ মামা-মামী-ছোটবোনও তার খানিকক্ষণ পর সেই পথেই। দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর, সেই আলমারি, দরজা, দেওয়াল, পারিবারিক ভাঙন– সব এক মওকায় সরিয়ে ফেলত সেই হা-হা রব। এবং অনেক দিন পর বাড়ির আরেকটা দিক দেখতে পাওয়া। রান্নাঘরের পাশে ছোটদিদার পান সাজার ঘর। ছোটদাদুর টেবিলে রাখা পাবলিক লাইব্রেরি থেকে আনা বই, লাইব্রেরি কার্ড দিয়েই মার্ক করে রাখা। লাল লম্বা বারান্দায় গোটা ১৬ মাছের একটা অ্যাকোয়ারিয়াম। আর ছাদের সিঁড়িটা? তার গা রুক্ষ, আর বড্ড উঁচু উঁচু। সেদিকে পা বাড়ালেই পইপই করে বলে দিত বড়রা– চটি পরে নিবি কিন্তু। কিন্তু ছোট পায়ে বড় চটি ছোট মুখে বড় কথার মতোই গোলমেলে! সিঁড়িতেই তো হোঁচট খেয়ে মরব ছাই! ফলে হাতের আঙুলে চটি গলিয়ে তরতর করে উঠে পড়া। এই সমস্ত কিছু– এই যে বাড়ির দরজা খুলে গেল। বারান্দায় উঠে এলাম। পানের সাজার গন্ধ পেলাম। অ্যাকোয়ারিয়ামের কাচে আঙুল দিয়ে মাছেদের দিক পরিবর্তন করলাম। ছাদে আরেকরকম আকাশ খুঁজে পেলাম। এত কিছু খুলে গেল মাত্র একখানা চাবিতেই? তা অট্টহাসি। টিটুমাসির। যখনই এসে পড়ত, খুলে ফেলত অসীম দূরত্বের জং-ধরা তালা। মাঝে মাঝে সেই দুটো আলমারিও সরে যেত বাড়ির অন্য অন্য জায়গায়। সেই আলমারি ও দেওয়াল দেখে মনে হত, ওদের বেশ মানিয়েছে। অট্টহাসি যে চিচিং ফাঁকের মতোই কিছু, বুঝতে পেরেছিলাম তখনই।

Joker The dark knight

সীমানা তো রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশ্বপাপ। ভাগ করায় তারা মিলখা সিংয়ের থেকেও দ্রুত। শুধু দেশের-রাজ্যের মানচিত্র না। আমার ভেতরেও, আমার মনের পাড়াতেও। এই বাজারে যে সীমানা মানে না, সীমানা অতিক্রম করে, তাকে সেলাম ঠুকুন। যে বাড়ি থেকে আওয়াজের উৎস, যান দেখি, আড্ডা মারুন। অট্টহাসতে শিখুন। অট্টকান্নার চাইতে অট্টহাসিতে কনসেনট্রেট করুন। লাফিং ক্লাবে অট্টহাসির যে খামোকা স্মরণসভা চলছে, দেখিয়ে দিন, সে ফিরছে বহাল তবিয়তে। হাসির প্রেমে তো মানুষ পড়েই। এবার অট্টহাসিরও প্রেমে পড়ুক। যে ছেলে অট্টহাসে, যে মেয়ে অট্টহাসে– উহাদের দেখা হোক শালিখঠাকুর।