সারাদিন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর অফিসে একটা ডাক শোনা যায়– ‘নারানদা, চা দাও’। কিন্তু তাতে কী? নারানদার ইচ্ছে না হলে কাউকে চা দেবে না। মোটের ওপর লোকজন তা মেনেও নিয়েছে। নারানদার ঝাড় খেয়ে খালি হাতে ক্যান্টিন থেকে ফিরে আসা রোজের চেনা ছবি। তবুও নারানদার চা না খেলে কাজে মন বসে না। মাঝে কেউ বাইরে বেরিয়ে চা খেয়ে এলে নারানদার বিরক্তি আরও বেড়ে যায়। যেদিন কারও মনখারাপ দেখে, সেদিন তার একটা চা ফ্রি। এদিকে ক্যান্টিনের শাকিলাদির সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। সেই নারায়ণ নন্দীর সাক্ষাৎকার সংবাদ প্রতিদিন-এরই রোববার.ইন-এ। সাক্ষাৎকার নিলেন তিতাস রায় বর্মন। ছবি কৌশিক দত্ত। গ্রাফিক্স অর্ঘ্য চৌধুরী।
গত দু’দিন ধরে সংবাদ প্রতিদিন-এর ক্যান্টিনের চা-বিক্রেতা নারায়ণ নন্দী, চালু লব্জে ‘নারানদা’, সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে যে তার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে, খুব শিগগিরি বেরবে। যে এই কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, সে হল ক্যান্টিনের শাকিলাদি। নারায়ণদা তাতে রেগে কাঁই! প্রমাণ দিয়েই ছাড়বে। তাই মাঝে মাঝে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে ইন্টারভিউটা বের করার জন্য। আর আমরাও চেয়েছি, এই দিনটা তাড়াতাড়ি চলে আসুক। এদিকে ইন্টারভিউ নেব যখন বলেছিলাম, তখন সহজে রাজি হয়নি। এত ব্যস্ততার মধ্যে ওঁকে জ্বালাচ্ছি বলে চেঁচামেচি করেছে। অফিসের ছাদে উঠলেই নারায়ণদার এই চেঁচামেচি শোনা আমাদের অভ্যাস। শুধু চিৎকারই নয়, সঙ্গে চলে বকাবকি। আমরাও ছাড়ার মানুষ নই। ফলে এই অফিসের ছাদে কাকপক্ষী বসে না।
নারানদা, আজ বিশ্ব চা দিবস।
তাতে আমার কী? এখন চা খাবে কি না বলো।
ছাদে গিয়ে খাব। আপাতত তোমার সঙ্গে চা দিবস নিয়ে কিছু কথা বলব।
আচ্ছা বলো, তবে বেশি সময় নেই আমার হাতে। আজ ক্যান্টিনে আমি একা। সব আমাকে করতে হবে। সব এসে পড়বে এবার খেতে।
সেটা তো জানি। এই গোটা অফিসে সারাদিন ধরে একটাই কথা শোনা যায়, সেটা হল ‘নারানদা চা দাও’। কেমন লাগে সারাদিন তোমাকে নিয়ে এই হইচই দেখে?
দেখো দিদিভাই, তোমরা সারাদিন বসে বসে কাজ করো। একটু যদি চা না খাও, তাহলে মাথা কাজ করবে কী করে? আমি জানি সারাদিন ধরেই তোমাদের এই চা-টা লাগবে। তাই তো এত তাড়াহুড়ো করি। চা শেষ হলে তোমরা যা মুখ হাঁড়ি করো! তাই আমার ফ্লাস্কে চা শেষ হতে দিই না। আমার খুব ভালো লাগে সারাদিন তোমরা আমাকে ডাকো। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে সবাই যখন একসঙ্গে ডাকাডাকি করো। কাকে ছেড়ে কাকে দেব বলো দেখিনি! এক এক করে দিতে দিতে তো যাব, একটা সিস্টেমে চা দিই আমি। ততক্ষণে তোমরা হইহই শুরু করে দাও। সবার নাকি আগে চা চাই। তখন যায় মাথাটা গরম হয়ে। যেদিন কাজের চাপ বেশি, সেদিন আমাকে নিয়ে নাড়াচাড়া বেশি। তবে এই যে বললে আজ বিশ্ব চা দিবস। শুনে খুব মজা লাগল। এরকম হয় নাকি?
হ্যাঁ, হয় তো। তুমি আজ ক’কাপ চা খেলে এই উপলক্ষে?
সেই সকালে একবার। সারাদিনে আর খাই না তেমন। তবে কখনও কখনও চোখ লেগে গেলে এক কাপ খেয়ে নিই। তোমাদের মতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাই না।
তোমার নিজের বানানো চা খেতে কেমন লাগে?
মন্দ না। আমি তো ভালোই চা বানাই আজকাল। তবে দিনের প্রতিবারের চা-ই যে আমি বানাই, তা নয়। আমার সময় না থাকলে অন্যরাও বানায়। তবে জানবে যে চা-টা খেয়ে মন ভালো হয়েছে, সে চা-টা আমারই বানানো। কারণ আমার বানানো চা-তে আলাদা দরদ আছে। আমি দরদ দিয়ে চা বানাই। একটু সময় নিয়ে চা বানাই। দুধটা বেশি জাল দিই, চা পাতা-টা নির্দিষ্ট সময়ে দিই। ঠিকমতো ফোটাই। সবাই অত সময় নিয়ে চা বানায় না।
এমনভাবে চা বানানো শিখলে কবে? কবে থেকে চা বানাচ্ছ?
আরে, সে তো তিন বছর হল। এই অফিসে আসার আগে আমি কখনও চা বিক্রি করিনি। ঘরে যতটুকু চা বানাতে হয়, ততটুকুই। কিন্তু সে চা একেবারে আলাদা। আমি তো অন্য কাজ করতাম। এখানে এসেই আমার চা বানানো শুরু। তোমরাই আমার বানানো চায়ের প্রথম খরিদ্দার। তা, চা খেয়ে কেমন বুঝছ? খারাপ বানাই নাকি?
রাগ করো না, কখনও কখনও খারাপও বানাও।
দেখো, সবসময় সমান দরদ থাকে না। কখনও দরদেও কমতি পড়ে। তবে দিনের প্রথম চা-টা দরদ দিয়ে বানাই।
এই যে বললে, তুমি এখানে কাজ করার আগে অন্য কাজ করতে, সে ব্যাপারে কিছু বলো।
আমি ক্যালকাটা গার্লস স্কুলে গাড়ির হেল্পার ছিলাম। বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া-আসা করতাম। মাস ভিত্তিতে কাজ ছিল। কিন্তু লকডাউনে সে কাজ গেল। বাড়ি ফিরে গেছিলাম সেসময়ে। লেড কারখানায় কাজ শুরু করেছিলাম। তবে তেমন নয় কাজটা। গাড়িতে শুতাম, গাড়িতেই খেতাম। কীভাবে কাজ জোগাড় করব ভাবছিলাম। তখনই মিন্টু আমাকে বলল, কলকাতা যেতে ওর সঙ্গে, ও কাজ দেবে। থাকা-খাওয়াও দেবে। মাইনের কোনও কথা হয়নি। আমি আর কিছু না ভেবে ব্যাগ গুছিয়ে চলে এসেছিলাম। জানতামও না যে আমাকে এবার চা-ওয়ালা হয়ে উঠতে হবে। তবে আগাগোড়া আমার চায়ের নেশা ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম কোন চা-টা খেতে ভালো লাগে। ক্লাবঘরেও আগে চা বানাতাম দশ-পনেরো জনের জন্য। সেই অভ্যাসটাই এখানে কাজে লেগে গেল।
এখানে কতবার চা বানাও তুমি?
সে আর কী বলব। সকাল ৬টায় নিজের জন্য চা বানাই। তারপর মর্নিং ডিউটি যাদের থাকে, তাদের জন্য ৮টায় চা বসাই। লাল চা করি তখন। আদা তেজপাতা দিয়ে। ৯টায় টিফিন আর চা দিই। তারপর ১১টায় একতলার সবাই চলে আসে। ওদের চা দিই। তারপর মাঝে একটু গ্যাপ। সবাই ভাত-টাত খেয়ে নেয়। তারপর ৩টে চা বসাই। চারটেয় চা দিতেই হয়। ওই সময় সবচেয়ে বেশি চাহিদা। তারপর ৬টায় একবার চা বসাই। ৮টা একবার। তারপর রাত ৯টায় আমার স্পেশাল ঝাল চা। এই চা-টা সবাইকে দিই না। এই চায়ের আমার আলাদা কাস্টমার।
আমাদেরও একটু রেসিপিটা বলো। কীভাবে বানাও।
জলে তেজপাতা, লবঙ্গ, আদা, গোলমরিচ। তারপর চা আর অল্প চিনি।
তোমার সব কাস্টমাররাই তো তোমার চেনা। চায়ের দোকান বা চায়ের ফেরিওয়ালা যাঁরা, তাঁদের থেকে তোমার কাজটা কতটা আলাদা বলে মনে হয়।
দেখো, আমি জানি কার কোন চা-টা খেতে ভালো লাগে, আমি জানি কার কখন চা লাগবে। এক সপ্তাহও লাগেনি এটা জেনে নিতে। এই অফিসে ২০০ জন কাজ করলে আমি ১৮০ জনের নাম জানি। চারতলা অফিসের প্রতিটা ঘরে আমার যাতায়াত। কেউ লিকার চা খায়, কেউ চিনি ছাড়া লিকার, কেউ দুধ চা, কেউ কম চিনির দুধ চা, চিনি ছাড়া দুধ চা। সব মাথায় আছে। আমিই এই অফিসের একমাত্র লোক যে সবাইকে চেনে। আমাকেও অবশ্য সবাই চেনে। সেই জন্যই কাজটা ছাড়তে পারছি না।
হ্যাঁ, তুমি তো মাঝে রাগ করে চলে যাবে বলেছিলে।
ভেবেছিলাম তো চলে যাব। আর চাকরি করব না। এবার যা করার নিজে করব। টোটো চালাব ভেবেছিলাম। নিজের মতো থাকব। কেউ আমার মালিক থাকবে না। কিন্তু যেতে তো পারলাম না সবাইকে ছেড়ে। যতবার বাড়ি গেছি, সন্ধে হয়ে গেলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই অফিসটা টানে তখন। মনে হয় ওখানে দিদিভাইরা, দাদাভাইরা আছে। দু’-চারদিন বাড়িতে ভালো লাগে। এর বেশি হলেই মন টানে।
দিনে কত টাকা আয় হয়?
দিনে আমি গড়ে ৬০০ টাকা মতো তুলি। মাসে ১৮০০০ টাকা মতো।
তুমি যদি একা এই কাজটা করতে এত টাকা নিজের তুলতে পারতে।
আমি একা কাজ করলে টাকার কথা ভাবতাম না। আমি বিস্কুট রাখতাম সঙ্গে, সিগারেট রাখতাম। আমি অন্যভাবে ব্যবসাটা করতাম।
এই অফিসে সবচেয়ে বেশি চা কে খায়?
শঙ্করদা। সারাদিন চা খেয়ে যাচ্ছে। বলি, বয়স হচ্ছে এত চা খেও না। শোনে না কথা।
এই যে চা খেয়ে সবাই তো সঙ্গে সঙ্গে টাকা দেয় না। তুমিও টাকা চাও না।
রেগুলার যারা চা খায়, তাদের একটা কোটা আছে। তুমি যেমন চারটে খাও মোটের ওপর। সব হিসেব আমার কাছে থাকে। কিন্তু কোনও চিন্তা নেই। সবাই টাকা দিয়ে দেবে একদিন না একদিন। কেউ টাকার কথা ভুলে গেলেও আমি চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দেবে। আজ কেউ টাকা না দিলে পরদিন ডবল টাকা দিয়ে দেব। যেদিন ৫০০ টাকার সেল হয়, পরদিন ৭০০ টাকা উঠে যায়। অরিত্রদা যেমন, একেবারে মাসের শেষে টাকা দেয়। পুরো হিসেব থাকে। রাগ কখন হয় বলো তো? যখন এই জিপে করতে চাও তোমরা। এই এক নতুন শুরু হয়েছে। কথায় কথায় জিপে। পরিষ্কার বলে রাখছি, চায়ের টাকা আমার ক্যাশেই চাই। ওই টাকাটা দিয়ে আমাকে বাজারে যেতে হয়।
এই অফিসে তো তুমি বিখ্যাত চায়ের জন্য। অন্য কোথাও চা বানানোর কাজ পেলে যাবে?
কখনও না। চা বানালে আমি শুধু এই অফিসেই বানাব। আর কোথাও না। চায়ের দোকানও করব না। রোজ রোজ চেনা লোককে চা খাওয়ানোর একটা আনন্দ আছে।
রোজ চা বানাতে বানাতে কি তোমার চায়ের নেশা কমেছে না বেড়েছে?
কমেছে। চা দিতে দিতে নিজের চা খাওয়া হয় না। তবে তোমরা ছাদে আড্ডা মারছ চা খেতে খেতে, আমি তোমাদের দেখাদেখি তোমার সঙ্গে চা খেয়ে নিলাম। আমার চা খাওয়াটা খামখেয়ালি।
আমরা আড্ডা মারতে মারতে যখন বেশি চা চাই, দাও না কেন?
অত চা খাওয়া ভালো নয় দিদিভাই। শরীর খারাপ করবে। চাইলেও দেব না তখন।
এই যে সারাদিন অফিসেই আছ তুমি, বাইরে তেমন বেরনো হয় না। কী মনে হয়?
এসব কথা রাতে শুয়ে মনে হয়। বালিশে মাথা দিলেই এসব চিন্তা আসে। তবে তোমরাও তো আমার মতোই সারাদিন অফিসেই রয়েছে। কাগজের অফিস তো খালি হয় না। তাই খারাপ লাগে না। লোক পেয়ে যাই। অফিসে যে একা থাকে, তার সঙ্গে একটু গল্প করে আসি। যাতে তার মনটা ভালো হয়ে যায়। আমি একদম চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরি না। এই অফিসে যাতে সবাই আনন্দে থাকে, সেটার ব্যবস্থা করি।
তোমার কোন দোকানের চা সবচেয়ে প্রিয়?
তাহলে তো বলতে হয় শিমুরালি স্টেশনের কথা। এই স্টেশনের প্রথম দোকানটা ছেড়ে দিয়ে দ্বিতীয় দোকানটায় যাবে। ভোর চারটেতেও চা পাবে ওখানে। যখন ইচ্ছে হয়, তখনই স্টেশন চলে আসি। আমার বাড়ি থেকে একদম কাছে। ওই দোকানে একটা একটা করে চা বানায়। লম্বা গ্লাসগুলোতে আগে চিনি দেয়, তারপর চা দেয়, তারপর গরম জল। বাড়ি যাওয়ার সময় দু’কাপ খেয়ে তবে বাড়ি যাব।
চা বেচে কিন্তু আজকাল প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়। তোমারও সম্ভাবনা আছে।
বাজে কথা বলো না তো! চা-ওয়ালা প্রধানমন্ত্রী হলে আগে গরিব লোককে দেখত। আমি প্রধানমন্ত্রী হলে তো আগে ফুটপাথের লোকজনের ব্যবস্থা করতাম। তা কি কেউ করল?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন শিয়ালদহ স্টেশনের চা-ফেরিওয়ালা শঙ্কর চক্রবর্তী-র সাক্ষাৎকার: পানীয়র দৌড়ে জলতেষ্টা প্রথম, আর চা-তেষ্টা দ্বিতীয়
পড়ুন ময়দানের চা-বিক্রেতা কামেশ্বর যাদব-এর সাক্ষাৎকার: চা দিবসে কি ছুটি মিলবে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..