
উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম রাজ্য ভূপেন হাজারিকার পরে সেই অর্থে সর্বভারতীয় অসমীয়া আইকন হিসেবে পায়নি আর কাউকে। অথচ প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ মান্না দে, কিশোর কুমার থেকে অরিজিৎ সিং পর্যন্ত আইকনের ধারা বজায় রেখেছে। সেই অভাব প্রবল সমারোহে পূরণ করেছেন জুবিন গর্গ। সূত্র: বলিউড। ‘ইয়া আলি’ দিয়ে যে যাত্রার শুরু, ‘জানে কেয়া চাহে মন’, ‘জীনা কেয়া তেরে বিনা’, ‘দিল তু হি বাতা’ সে যাত্রার তুঙ্গ মুহূর্ত। এবং তারপরে মুম্বই ছেড়ে অসমে ফেরা। খ্যাতি, যশ পেরিয়ে শিকড়ের কাছে ফেরার এই সৎ সাহস শিল্পী হিসেবে তাঁর মুকুটে আরেক পালকের সংযোজন। শিকড়মুখিনতাই তাঁকে অসমের প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি করে তুলেছে।
রোমান দার্শনিক, রাষ্ট্রবিদ সিসেরো-র একটি কিংবদন্তি মন্তব্য প্রায়ই শোনা যায় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে– Vita enim mortuorum in memoria est posita vivorum। বাংলায় যার মানে দাঁড়ায়– মৃত মানুষের জীবন জীবিত মানুষের যাপনে এবং স্মৃতিতে ঠাঁই পায়। কথাটা কোনও অর্থেই ভুল নয়। ঘরের একজন মানুষ চলে গেলে বাকিরা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখেন স্মৃতিতে; ব্যবহৃত জিনিসপত্র, জামাকাপড়, বইয়ের পারিপাট্যে। আগের যুগের ফ্রেম-বাঁধানো ছবিই হোক বা অধুনা সোশাল মিডিয়ার গ্যালারি– অস্তিত্ব মোছে না। কবির ভাষাকে ধার করে বলতে পারি, মৃত্যুর পরেই অমরত্বের শুরু। যেমনটি হয়েছে জুবিন গর্গের ক্ষেত্রে। আরও শক্তিশালী, আরও উপস্থিত, আরও চাক্ষুষ। জুবিন স্রেফ শরীরবিহীন, কিন্তু অস্তিত্বহীন নন। এবারের জন্মদিন আক্ষরিক অর্থেই তাঁর নবজন্ম। প্রথম শুভক্ষণ।

আসলে উপমহাদেশীয় মনন এবং কল্পনা খাঁটি শিল্পীর এক ধারণা এঁকে রেখেছে আমাদের মনে। বাস্তবে সেই ধারণার সবথেকে কাছাকাছি আসতে পেরেছেন জুবিন গর্গ। প্রবল তেজে গড়েপিটেও নিয়েছেন সে ধারণার সীমা-পরিসীমা। কেমন ধারণা? এককথায় এক বেপরোয়া ব্যক্তিত্ব। শাসকের লালচোখকে থোড়াই কেয়ার করেন। জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন, অথচ ভালোবাসেন হৃদয়-অলিন্দের শেষ রোদটুকু দিয়ে। যাঁর প্রতিভা বহুমুখী; যেখানে হাত রাখেন সোনা ফলান, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। বৈশিষ্ট্যগুলো এমনই, আওড়ে গেলে আজকের জমানায় বেশ ‘ঠাট্টা’ মনে হতে পারে। গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় কিছু গ্রাম্ভারি শব্দশিরোপাও জুটতে পারে ভাবনার ‘অবাস্তবতা’র কারণে। কিন্তু জুবিনের সামগ্রিক জীবনে এই বৈশিষ্ট্যগুলোই জ্বলজ্বল করছে সারেগামা হয়ে। ধারণার এমন অনায়াস, স্বতঃস্ফূর্ত মূর্তায়ন আর কোনও উপমহাদেশীয় শিল্পী করতে পারেননি। চেষ্টা করে বড় জোর ‘ইমেজ’ নির্মিত হয়। জুবিন এরকম চেষ্টার ধারকাছ দিয়েও যাননি। তাঁর জীবন দৈনন্দিন বাস্তব এবং শৈল্পিক কল্পনার বিরলতম সমন্বয়। ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ড’-এ তাঁর অন্ত্যেষ্টিযাত্রা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অন্ত্যেষ্টিযাত্রা বলে স্বীকৃতি পেয়েছে এই কারণেই।
তবু প্রশ্ন উঠবে, কী করে মানুষের এত কাছাকাছি এলেন জুবিন? পশ্চিমবঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক। বর্তমান প্রতিবেদক যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ে, ২০০৬ সালের এক টিফিনবেলায় তারস্বরে কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ের ‘ইয়া আলি’ শুনে সেও গাইতে শুরু করে। আগে পরে কথা বানিয়ে ‘ইয়া আলি’ গাওয়াটা চলেছিল বেশ কিছু দিন। মাঝে মাঝে পাড়ার সিডি-ক্যাসেটের দোকানে গানটা বাজতে শোনা যেত। পরপর কয়েক বছরের মধ্যে মুক্তি পাবে ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’, ‘মন মানে না’, ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’, ‘প্রেম আমার’, ‘খোকাবাবু’, ‘পাগলু’, ‘অমানুষ’ ইত্যাদি বাংলা ছবি। টিভিতে, মাইকে, রিকশাওয়ালার আধাসুরেলা গলায় শোনা যাবে– ‘পিয়া রে পিয়া রে’, ‘মন মানে না’, ‘বোঝে না সে বোঝে না’, ‘প্রেম কী বুঝিনি’। মেগাস্টার দেবের উত্থানের নেপথ্যে জুবিনের কণ্ঠসম্পদের অবদান নিয়ে কুণ্ঠিত নন কেউই। মূলধারার বাণিজ্যিক মালমশলার বাইরেও তখন স্মৃতির ঝুলি ভরে নিচ্ছে একটা গোটা প্রজন্ম, তাদের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার যাত্রার সঙ্গে এই গানগুলি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। শূন্য দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রথম দশকের কিছুটা এগিয়ে যাদের বেড়ে ওঠা, জুবিন গর্গ তাদের স্কুলপালানো, প্রথম প্রেমের সরল উদযাপনের সঙ্গী। আবার প্রবল শাসকবিরোধী, সাহসী জুবিনকে দেখে এই প্রজন্মই অনুপ্রাণিত হয়েছে পূর্ণ যৌবনে। যাপনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে কাউকে অস্বীকার করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের ‘মিলেনিয়াল’ এবং ‘জেন জি’ প্রজন্মের কাছে জুবিন ‘কালচারাল মেমরি’। ইউটিউবে তাঁর ভিডিও-র কমেন্ট সেকশনে প্রমাণ মিলছে রোজ।

উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম রাজ্য ভূপেন হাজারিকার পরে সেই অর্থে সর্বভারতীয় অসমীয়া আইকন হিসেবে পায়নি আর কাউকে। অথচ প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ মান্না দে, কিশোর কুমার থেকে অরিজিৎ সিং পর্যন্ত আইকনের ধারা বজায় রেখেছে। সেই অভাব প্রবল সমারোহে পূরণ করেছেন জুবিন গর্গ। ‘ইয়া আলি’ দিয়ে যে যাত্রার শুরু, ‘জানে কেয়া চাহে মন’, ‘জীনা কেয়া তেরে বিনা’, ‘দিল তু হি বাতা’ সে যাত্রার তুঙ্গ মুহূর্ত। এবং তারপরে মুম্বই ছেড়ে অসমে ফেরা। খ্যাতি, যশ পেরিয়ে শিকড়ের কাছে ফেরার এই সৎ সাহস শিল্পী হিসেবে তাঁর মুকুটে আরেক পালকের সংযোজন। শিকড়মুখিনতাই তাঁকে অসমের প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি করে তুলেছে। শিল্পীর সামাজিক, রাজনৈতিক দায় ভোলেননি জুবিন। প্রতিকূল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় সগর্বে ধর্মহীন, জাতহীন বলে ঘোষণা করেছেন নিজেকে।
নিরাপত্তাপ্রিয়, সর্বতোষী শিল্পীমিছিলের কয়েক আলোকবর্ষ দূরে একা দাঁড়িয়ে থাকার সাহস জুবিনেরই ছিল। কলাগুরু আর্টিস্ট ফাউন্ডেশন, অনাথ শিশু, পশু-পাখির দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়ে আরও বেশি করে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে চেয়েছেন। পেরেছেন, বলাই বাহুল্য। শুধু গান, চলচ্চিত্র নিয়ে থাকলে কিছুই হেরফের হত না। কিন্তু বোধ এবং দায়ের কাছে মাঝে মাঝে মাথা নত করতে হয়; এই একটি জায়গাতেই সারা জীবন মাথা নুইয়ে থেকেছেন জুবিন।
বাকি রইল অকালমৃত্যু; সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে ‘জাস্টিফ ফর জুবিন’ শ্লোগান লিখন, অসম সরকারের সাবধানী পা-ফেলা ইতিমধ্যেই ইতিহাস। গায়ক গান বাঁধেন, সুর করেন, গান। জুবিন গর্গের গোটা জীবনটাই গানের মতো। ইচ্ছেমতো কথা বেঁধেছেন, ছন্দ-লয়ের এদিক ওদিক করেছেন। পরম যত্নে সুর দিয়ে গেয়েছেন। শিল্প যখন পেশা ছাড়িয়ে জীবনের নানাদিকে ছাপ ফেলে, মানুষ তা গ্রহণ না করে পারে না। গান ‘একাকী গায়কের’ নয়, ‘গাহিতে হবে দুইজনে’; এই যৌথতার সূত্রটি কোনও দিন বিস্মৃত হননি তিনি।

একুশ শতকের পুরুষ কণ্ঠের প্রধান আকর্ষণ– টেনর কোয়ালিটি। বিশ শতকে ছিল ব্যারিটোনের ভরাট কদর। একুশ শতকের আধুনিক মননের কাছে চড়া, পাতলা কণ্ঠস্বরের আদর বেশি। বিজ্ঞান বলে টেনর কণ্ঠে আবেগ, রোম্যান্টিসিজম ফোটে সবচেয়ে ভালো। জুবিনের সুরেলা, চাঁচাছোলা গলা তাই ঘরে ঘরে আদৃত হতে মোটেই সময় নেয়নি। তথ্য বলছে অসমীয়া, বাংলা-সহ প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষায় ৪০ হাজারের কাছাকাছি গান গিয়েছেন জুবিন। জনমানুষ তথা জনমানসে জুবিন উজ্জ্বলতর। নিছক গায়ক, পরিচালকের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলা মানুষ। শাসকের ভ্রষ্টাচার হোক, যাবতীয় অসাম্য হোক, পরিবেশ রক্ষা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সপক্ষে সোচ্চারে আওয়াজ তোলার মানুষ। অসমের আদিবাসী ও উপজাতিদের উদ্দেশ্যে তৈরি সেইসব গান এখন নতুন করে নিউজ ফিডে ঘুরে ঘুরে আসছে। আজকের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ভাইরাল’।
জুবিনই একমাত্র শিল্পী, যিনি রাখঢাক না রেখে সিস্টেম বদলের কথা বলতেন। কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চার হতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। সেসব কথা ইতিহাস নয়, বর্তমান। রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে এমন ঢেউ আর কোনও শিল্পীই তুলতে পারেননি। এই অনন্যতা তাঁকে অমরত্ব দিয়ে দিয়েছে। আগামী অসম নির্বাচনেও ‘জুবিন ফ্যাক্টর’ প্রভাব বিস্তার করবে– সেই সম্ভাবনা কোনওভাবেই অস্বীকার করতে পারছেন না শাসকগোষ্ঠী। আদর্শ শিল্পী বলতে যা বুঝে এসেছি সবাই, জুবিন গর্গ ঠিক তাই। শিল্পীর জীবনে বিতর্ক থাকবে, জলটুকু বাদ দিয়ে না-হয় খাঁটি দুধটাই নেওয়া যাক। ক্ষতি নেই তাতে।

কথায় বলে, প্রেমের গান কখনও পুরনো হয় না। বারবার ফিরে আসে বিদ্রোহের গানও। আজ থেকে বহু প্রজন্ম পরে এমনিও জুবিনের মায়াবী গলায় গানগুলি বেজে চলবে। কিন্তু তার বাইরে এপার-ওপার মেলোনোর দায়িত্বটুকু আমাদের। আমাদের গ্রহণে এখন যে আবেগ, উচ্ছ্বাস রয়েছে, কালের নিয়মে তা থিতিয়ে পড়তে বাধ্য। সেই শান্ত প্রেক্ষিতে নতুন করে মূল্যায়ন হবে জুবিনের, অংশ নেবে একটা গোটা প্রজন্ম। তথ্য হিসেবে তো আছেনই, তখন জুবিন গর্গ ‘সত্য’ হয়ে উঠবেন।
আশা করতে দোষ কী?
………………………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন অর্করূপ গঙ্গোপাধ্যায়-এর অন্যান্য লেখা
………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved