Robbar

হে বন্ধু, বিদায়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 17, 2025 4:52 pm
  • Updated:November 17, 2025 4:52 pm  

যে সোনা বাঁধানো বন্ধুত্ব হাজার বছর ধরে টিঁকে যায়, অজস্র মনোমালিন্য, অনেক কানভাঙানি, অন্যদের আড়াল-বিষোদ্গার ইত্যাদি সত্ত্বেও, যে বন্ধুত্ব ঝগড়া পরবর্তী নীরবতা থেকে আবার কাঁধে হাত রাখায় আসে, সেই বন্ধুত্ব নিকষ পাথরে সময়ের নিরিখে পরীক্ষিত ও অটুট। তবে, ভার্চুয়ালি কারও বন্ধু হওয়াও সহজ কাজ না। কেন-না, অলেখা চুক্তি, সামাজিক কনট্র‍্যাক্ট বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব মানে, তোমার নতুন জামার ছবি দেখে ঈর্ষা করা নয়, তোমার নতুন বাড়ি নতুন গাড়ির পোস্টে ‘হা হা’ হাসির ইমোজি দেওয়া নয়, তোমার খারাপ সময়ে ফেসবুকে কমেন্টের পরেও মেসেঞ্জারে বা ইনবক্সে এসে কথা বলা।

যশোধরা রায়চৌধুরী

এবার আমি বুঝতে পেরেছি কেন মাঝে মাঝে ঝড় আসে। সমাজমাধ্যমে সে কেন জলের মতো এইরকম ঘুরে ঘুরে একই কথা কয়। মাঝে মাঝে কয়, তবু, কয়। ক্যান কয়? ক্যান কয়?

–নাহ্, আর নয়, এবার ছোট করে আনবই।
–আজ মঙ্গলবার, পাড়ার জঙ্গল সাফ করার দিন।
–অব্যাহতি দিলাম, যান!
–যারা নেই, তাদের ‘নেই’ করে দেব!
–আজ আবার শুরু করেছি!

মহৎ সাসপেন্সযুক্ত বক্তব্য। কী, কেন, কবে, কোথায়– এই সব নিয়ে লোকে প্রশ্নাকুল হলে, সংক্ষিপ্ত উত্তর আসবে– ‘বন্ধুতালিকা ঝাড়াই-বাছাই করছি, ৫,০০০-এর লিমিটে অনেক বেনোজল ঢুকে গিয়েছে!’

বন্ধুবৃত্তে যারা কিছু কয় না, যারা চুপ, যারা লাইক অবধি দেয় না, কেবল দেখে চলে যায়, উঁকি ও টুকিতে থাকে, তাদের ধরে ধরে বাদ দেওয়ার উত্তম উদ্দেশ্য সাধন প্রয়োজন।

এই হল মোদ্দা কথাটি! আনফ্রেন্ড উৎসব। এই সেই, জিমি কিমেল প্রদত্ত ফরমুলার পরিপালন। কিমেল নাকি ২০১০ সাল নাগাদ বলেছিলেন, মাঝে মাঝে ঝাঁটপাট দেওয়া প্রয়োজন। আনফ্রেন্ডিং আসলে স্বাস্থ্যকর, কারণ, সোশাল মিডিয়ার বন্ধুতালিকাতেও গাদ জমতে পারে, দেওয়া উচিত নয় একে কোনওরূপ উৎসাহ। ‘লেস মিনিংফুল’ বা অল্প অর্থবহ যে-সব সম্পর্ক, তাদের অব্যাহতি দিলে বরং ছিপছিপে নির্মেদ এক বন্ধুতালিকা পাওয়া যেতে পারে।

জিমি কিমেল (ডান দিকে)

বন্ধু বানানোর হাতছানি নিয়ে আমরা ফেসবুকে এসেছি, একদা অর্কুটে ছিলাম। বন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে কিছু অবন্ধুও ডিজিটালি, ভার্চুয়ালি ‘বন্ধু’ হয়েছে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে মেদ জমল, অনর্থক বন্ধু বাড়ল। ব্রিটিশ অ্যান্থ্রোপোলজিস্ট, থুড়ি, নৃতত্ত্ববিদ অঙ্ক কষে বলেছিলেন, মানুষের মগজের নিওকর্টেক্স নাকি মাত্র ১৫০টি মতো ‘স্থায়ী সম্পর্ক’কে রেখে, বেছে নাইয়ে-ধুইয়ে বজায় রাখতে পারে। তার ভিতরেও ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকে জনা-পাঁচেক। একে বলা হয়, “ডানবার’স নাম্বার”। সমাজমাধ্যমে ‘ফ্রেন্ড’ নামকরণ যে বস্তুটিকে করা হয়েছে, সেটি আর বাস্তবের বন্ধু যে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়, এটাই এই তত্ত্ব-ঘাঁটা লোকেরা বলে থাকেন। ‘অর্থপূর্ণ সম্পর্ক’-এর মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়াও আত্মীয়, কদাচিৎ কুটুম্ব, অফিস-কলিগ বা পাড়াপড়শি থাকতে পারে, কিন্তু আগস্টের প্রথম রবিবারকে ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’ বা বন্ধুত্ব দিবসের তকমা দেওয়া হয়েছে যে আশায়, (যে আশায় আমরা আজকাল মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে ‘মাতৃত্ব দিবস’ ‘মানাই’!) সেই আশা খুবই বেদনার বালুচরময় বস্তুত। কেন-না অত অত বন্ধু, ফেসবুক নিয়মে ৫০০০, ওই বালুচরে দাঁড়ালে তা অচিরাত ধূলিসাৎ ও সমুদ্রবারিধারায় নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য!

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়, আমাদের বাবা-মায়ের অসংখ্য বন্ধু থাকত। মা প্রায়ই বলতেন, ‘আত্মীয়রাই সর্বনাশের গোড়া। বন্ধুরা নিরাপদ।’ বন্ধুরাই আসল লাইফলাইন, এ-কথা আমরাও বলি। আমরা বড় গলা করে ‘আমার স্বামী আমার বন্ধুও’ বা ‘আমার শাশুড়ি আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছেন’ ইত্যাদিও বলে থাকি এটাই প্রমাণ করার জন্য যে, বন্ধুত্ব আসলে বৈবাহিক বা কুটুম্ব সম্পর্কের চেয়েও ওপরে। তবু আমাদের প্রজন্মের অনেকেই দেখেছি, লোডশেডিং সন্ধেতে লণ্ঠন হাতে করে বন্ধুর বাড়ি গমন, দেখেছি হাসপাতালে অসুস্থদের বন্ধুদের পালা করে ডিউটি করতে আসা। আজ আর এসব দেখা যায় কি না জানি না। সমাজমাধ্যমের বন্ধু বিষয়টি এমন যে, কারও-র আত্মহত্যার পূর্ব রাত্রের মৃত্যু ইঙ্গিতময় আত্মকথা পোস্টে ভেসে এলে ‘দারুণ’ বা ‘বেশ লিখেছ’ বলা হয়।

মনে পড়ে যায় অনেক কিছুই। সেই অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। ভালুক এসে কান শুঁকে ফিসফিস করে বলেছিল না– বিপদের সময়ে যে পাশে থাকে না, সে প্রকৃত বন্ধু নয়? গাছে চাপা বন্ধুটিকে সে-দিন আনফ্রেন্ড করেছিল মাটিতে মড়া সেজে শুয়ে বেঁচে যাওয়া বন্ধুটি। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। এমনকী, কৌটিল্য না কে যেন বলেছিল, ‘রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ!’ লিস্টে আরও ঢের কিছু ছিল– দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে, ‘উৎসবে এবং ব্যসনে’ দিয়ে তালিকা শুরু। তা তো হবেই। দুটো পজিটিভ সিচুয়েশন দিয়ে চাণক্য শ্লোক মুখড়া করে নিল। তারপর অন্তরা সঞ্চারীতে বিস্তার নিয়ে এক্কেবারে ‘বুলস আই হিট করা’। উফ্ বাবা, সে যুগেও রাষ্ট্রবিপ্লব ছিল?

মোট কথা, বাস্তব বন্ধু হওয়া একটা ন্যাচারাল সিলেকশন এবং টাইম টেস্টিং বন্ধুত্বের এক ধরনের নিকষ। যে সোনা বাঁধানো বন্ধুত্ব হাজার বছর ধরে টিকে যায়, অজস্র মনোমালিন্য, অনেক কানভাঙানি, অন্যদের আড়াল-বিষোদ্গার ইত্যাদি সত্ত্বেও, যে বন্ধুত্ব ঝগড়া পরবর্তী নীরবতা থেকে আবার কাঁধে হাত রাখায় আসে, সেই বন্ধুত্ব নিকষ পাথরে সময়ের নিরিখে পরীক্ষিত ও অটুট। তবে, ভার্চুয়ালি কারও বন্ধু হওয়াও সহজ কাজ না। কেন-না, অলেখা চুক্তি, সামাজিক কনট্র‍্যাক্ট বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব মানে, তোমার নতুন জামার ছবি দেখে ঈর্ষা করা নয়, তোমার নতুন বাড়ি নতুন গাড়ির পোস্টে ‘হা হা’ হাসির ইমোজি দেওয়া নয়, তোমার খারাপ সময়ে ফেসবুকে কমেন্টের পরেও মেসেঞ্জারে বা ইনবক্সে এসে কথা বলা।

অজস্র উদাহরণ আছে, যেখানে আমার নিজেরই ভার্চুয়াল বন্ধুরা সোনাবাঁধানো আসল বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়েছেন। আমার কোভিড-জ্বরের সময়ে বাড়িতে পোর্টার অ্যাপ দিয়ে মুড়ি, চানাচুর পাঠিয়ে দিয়েছেন কেউ। কারও বা লকডাউনের সময়ের প্রবল নিরাশা ও ব্যবসা বন্ধের অনিশ্চয়তার মধ্যে, আমার হঠাৎ তার নীরবতা ‘চোখে পড়ে যায়’, তাকে মেসেঞ্জারে প্রশ্ন করি, ‘সব ঠিকঠাক আছে?’ সে উত্তর দেয়, ‘তোমার কথাটা আমাকে আবার স্বাভাবিকে ফিরিয়ে আনল, ভয়াবহ মন খারাপে ছিলাম।’ এই চাওয়া-পাওয়া ও দেওয়া-নেওয়ার অলিখিত খেলায় পরীক্ষিত, মিনিংফুল বন্ধুত্ব অর্জন করি। ভালোবাসা আর ভালোবাসিতে দেওয়া, দুই-ই দরকার। আমরা ভালবাসাকে একমুখী ভাবি, আসলে তা দ্বিমুখী। ফলে বলব, ‘আনফ্রেন্ড ডে’ বলে কিছু একটা থাকার প্রয়োজন আছে, খুবই আছে। বন্ধুত্বের সদর্থক মূল্যবিচার আমাদের ভাগ্যের ফেরে ঘটে যায়, কিন্তু যারা মূল্যহীন বন্ধু, নামেই বন্ধু, হিংসুটে আর কালো-কালো মনের লোক, তাদের একবার চিনে নিতে পারলে, আনফ্রেন্ড বা ব্লক করা স্বাস্থ্যকর, সুবিধাজনক তো বটেই, বেহদ্দ জরুরিও কখনও কখনও।

মধ্যরাতে সবুজ বাতি জ্বালা পুরুষ দাদাস্থানীয়রা ‘btw u look good in sari’ লিখলে, বা সূক্ষ্ম অঙ্ক মেনে নিকটত্ব-নিয়ম, যা যুগ যুগ ধরে রচিত হয়েছে, সেই কাছে আসার ও দূরে থাকার অলিখিত চুক্তিভঙ্গ করে একটা ‘ওইরকম ছবি দাও দেখি’ বা ‘অমুক ছবিতে তোমাকে বুড়ি বুড়ি লাগছে/ ছুঁড়ি ছুঁড়ি সেজেছ যদিও’ টাইপ কথাবার্তা বললে, তাকে সমূলে উৎপাটন করা জরুরি হয়ে দাঁড়ায় বইকি। এদের মতো চরিত্রদের মাঝে মাঝে দেখা পাওয়াই ভালো। বেশি প্রেম উপজিলে বলতে হয়, এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ তোমারে হৃদয়ে রাখিতে! ফলত দিলুম এই নে ব্লকিয়ে!

তবে হ্যাঁ, এই সে-দিন দেখা এক মিমে প্রত্যয় হয়েছে যে, বহুযুগ আগের সমাজে মানুষ একেকজনকে ধোপানাপিত বন্ধ করত আর সমাজমাধ্যমে রিপোর্ট করে দেয়, ব্লক করে দেয়। একদা পাড়ার দোকানে দেখা হলে টাকা ধার করে শোধ না দেওয়া এঁটুলিপোকা-বন্ধুকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে ফুটপাত বদল করে উল্টোপথে চলে যাওয়া ছিল একমাত্র অস্ত্র। অন্যজন তোমাকে ধাওয়া করতে করতে ‘অ্যাই, শোন শোন, আমাকে ১০টা টাকা ধার দে না রে’ বলতে বলতে বাড়ি অবধি আসতে পারত। সমাজমাধ্যমে অতটা সম্ভব নয়। ননস্টিক প্যান থেকে আলতোভাবে প্যানকেক তুলে ফেলার মতো অনায়াসে আনফ্রেন্ড ও ব্লক  করা যায়। এই দুই মহাস্ত্র সোশাল মিডিয়ায় যে বিপুল স্ফূর্তি দিয়েছে, নেগেটিভিটির এই উদযাপন যে সুখ দিয়েছে, উল্টোদিকে হাজারটা পজিটিভ কাজকম্মে, যথা ‘ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট’ করায়, ‘ফ্রে রিকু’ অ্যাক্সেপ্ট করায়, নিজে ছাইপাঁশ লিখে সেটা পড়ানোর জন্য যত্রতত্র বন্ধুদের ট্যাগ করায় বা ‘এভরিওয়ান’ ও ‘ফলোয়ারস’ লিখে লোকের চক্ষুগোচর হওয়ার সম্মিলিত সুখেও তার তুল্যমূল্য হল কই?

…………………………

রোববার.ইন-এ পড়ুন যশোধরা রায়চৌধুরী-র অন্যান্য লেখা

…………………………