বাঙালিদের অতি চকলেটপ্রীতির বয়স অবশ্য খুব কমও নয়। এখন দেখবেন সবেতেই চকলেট। চকলেট ফুচকা, চকলেট মোমো। কেউ ভাইরাল হবার তাগিদে বানিয়ে ফেলতেই পারেন চকলেট চাউমিন, চকলেট বিরিয়ানি, চকলেট পরোটা। সেই দিন দূর নেই যেদিন চকলেট খিচুড়ি খেতে বাঙালি লাইন দেবে! প্রসাদেও থাকবে চকলেট! বাঙালি মিষ্টির নাম সারা পৃথিবীতে চর্চিত। সেই মিষ্টিতেও ঢুকে পড়েছে চকলেট! আপনারা ভাবতেই পারেন আমি বুড়ো ভাম! অকারণে চকলেটকে খিস্তি করে যাচ্ছি। আসলে আমার বিরোধ চকলেটের সঙ্গে নয়। আমি চিমটি কাটছি এই চকলেট নিয়ে বাঙালি আদেখলাপনাকে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সত্তে পে সত্তা’ ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, নায়ক রবি-র (অমিতাভ বচ্চন) একটি মেয়েকে ভালো লাগে, যার নাম ইন্দু (হেমা মালিনী)। প্রেমের প্রথম পদক্ষেপে প্রেমিক যেমন তাঁর সম্ভাব্য প্রেমিকার জন্য উপহার নিয়ে যায়, রবিও ইন্দুর জন্য একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের চিরকুট এবং উপহার নিয়ে গিয়েছিল। সেই উপহার ছিল একটি বেশ বড় সাইজের তরমুজ! রবির যুক্তি ছিল খুবই স্পষ্ট। তরমুজ খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারি। তাই, সম্ভাব্য প্রেমিকার জন্য তরমুজই শ্রেষ্ঠ উপহার!
ইন্দু সেই চিরকুট মণ্ড পাকিয়ে ফেলে দেয়। আর তরমুজও ব্যালকনি থেকে নিচে ছুড়ে ফেলে বেচারি রবির সামনেই। পরে অবশ্য ইন্দুর বান্ধবী শীলার (সারিকা) পরামর্শ অনুযায়ী, রবি একটি ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হয়। ইন্দু খুশি হয়। পরে ইন্দু আর রবির প্রেম এবং বিবাহ হয়। আচ্ছা, কেউ যদি খাঁটি প্রেমিক হয়– তাহলেও কি তরমুজ নিয়ে গেলে লাথি, আর ফুল নিয়ে গেলে সাথী? এটা কোনও কথা হল!
এই ছবিটি ৪৩ বছর আগেকার। এখন যুগ অনেক পাল্টে গেলেও প্রেমিককে কিছু একটা নিয়ে যেতেই হয়। সেটা অবশ্যই চকলেট! কেন? বাঙালির কি মিষ্টির অভাব আছে? কোনও প্রেমিক যদি প্রেমিকার জন্য চকলেট না নিয়ে গিয়ে কয়েক পিস তৃপ্তিভোগ সন্দেশ বা কমলাভোগ নিয়ে যায়– তাহলে কি তার প্রেম গ্রহণযোগ্য হবে না!
আমাদের ক্লাসে ‘নিউটনের সূত্র’ বলে যেগুলি প্রচলিত ছিল– সেগুলির মধ্যে নিউটন মাত্র প্রথম তিনটেই লিখেছিলেন। বাকিগুলো লিখেছিল আমাদের ক্লাসের ফচকে ছেলেরা। তার মধ্যে একটা ছিল– ‘নিজের বউ অপেক্ষা অন্যের বউকে সবসময়ই বেশি সুন্দরী মনে হয়’। এই সূত্রের রেশ টেনে বলছি– বাঙালিদের নিজের অনেক কিছু থাকলেও, দেখবেন, অন্যের কিছু দেখে ‘আহা! উহু!’ করছে। বিশেষ করে সেটা যদি সাহেবদের জিনিস হয়। বাঙালি সম্পর্কে এমনিতেই বলা হয় ‘আত্মবিস্মৃত’। যে আত্মবিস্মৃত সে কি আত্মনির্ভর হতে পারবে?
……………………………………..
‘ইন্ডিয়া ন্যারেটিভ’-এ ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে অনুথি বিশাল লিখেছেন এক অনুমানের কথা। তা হল, ফ্রেঞ্চ লিকার চকলেট কি জলভরা সন্দেশ দ্বারা অনুপ্রাণিত? ফরাসিরা চন্দননগরে জলভরা সন্দেশের উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিল। এই সন্দেশ আবিষ্কারের ১০ বছর পর লিকার চকলেটের আবির্ভাব! আসলে বাঙালি ছেলেমেয়েদের কেউ চিনিয়ে দিচ্ছে না বাঙালিদের সংস্কৃতি। নিজের কালচারকে অস্বীকার করে কোনও দিনই কেউ যথার্থভাবে ‘গ্লোবাল’ হতে পারে না। বরং বাঙালিয়ানাকে ট্রোল করার টোল খুলেছে সবাই।
……………………………………..
কেউ বলতে পারেন– এই যে আপনি বড় বড় বাকতাল্লা মারছেন, আপনি নিজেও তো বাঙালি! একদম, আমি বাঙালি, তবে খাঁটি কি না, জানি না। আমার জন্ম চন্দননগরে। ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত অল্প দামে অত্যন্ত ভালো মিষ্টি, দই আর তেলেভাজা খেয়ে বড় হয়েছি। কিন্তু, ওই যে বললাম আত্মবিস্মৃত! সেই আমিই একবার আমেরিকায় একটা কনফারেন্সে গিয়ে বেজায় কেস খেয়েছিলাম। কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন সকালে গিয়ে দেখি কফি, স্ন্যাক্স ছাড়াও মিষ্টি রয়েছে। আমেরিকান রংবাহারি মিষ্টি। দেখেই আমার নোলা লকলক করে উঠল। আমি ভুলে গেলাম যে, আমি বাঙালি। আমি হাঘরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই মিষ্টির দিকে। বেশ রঙিন একটা মিষ্টি গপাৎ করে মুখে চালান করে বুঝলাম বিষ খেয়েছি! ওই জঘন্য স্বাদ আমি লেখায় প্রকাশ করতে অক্ষম। মালটা মুখ থেকে তক্ষুনি বের করে পাশের ডাস্টবিনে চালান করলাম। মহাপুরুষরা বলেন এক গালে থাবড়া খেলে আর একটা গাল বাড়িয়ে দাও। আমিও ভাবলাম, এত মিষ্টির মধ্যে একটা খারাপ হতেই পারে। আর একটা ট্রাই করা যাক। ইতিমধ্যে ওখানে বেশ কয়েকজন লোক জমেছে। আমার এক পরিচিত বন্ধু সেখানে উদয় হল। আমি যে মিষ্টিটা টেস্ট করেছিলাম সেইটা দেখিয়ে তাঁকে বললাম– ‘এই মিষ্টিটা ট্রাই কর, দারুণ।’ সে বলল, ‘মিষ্টি খাবে না।’
আমার দলে কাউকে পেলাম না। আমি অন্য একটা মিষ্টি মুখে দিলাম। এটি আরও মারাত্মক! ওখানে এত লোক জমে গিয়েছে যে, মুখ থেকে বের করে মিষ্টিটা ফেলতে পারছি না। এদিকে মুখের ভেতরে গলে দিয়ে সেই মিষ্টির বিষাক্ত স্বাদ আমার মাথায় গিয়ে আঘাত করছে। আমি বাথরুমে ছুটলাম। গিয়েই বেসিনে মুখ থেকে সামান্য ওয়াক (জোরে ওয়াক করলে মার্কিনীরা ফুড পয়জনিং-এর ভয় পেয়ে আমাকে চপারে চাপিয়ে গোপন ল্যাবে চালান করতে পারে) তুলে মিষ্টিটা বের করে মুক্তি পেলাম। আমাকে বেসিনে ওয়াক করতে দেখে আমার এক বাঙালি বন্ধু তার হিসি মাঝপথে থামিয়ে ছুটে এসেছে। সেই বন্ধুটি আমার কাছে আসল গপ্প শুনে বলল, ‘তুই চন্দননগরের ছেলে হয়েও আমেরিকায় এসে মিষ্টি খাচ্ছিস’! খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম এই মন্তব্য শুনে।
চকলেট ব্রিটিশদের হাত ধরে আমাদের দেশে ঢুকেছে। বাঙালিদের অতি চকলেটপ্রীতির বয়স অবশ্য খুব কমও নয়। এখন দেখবেন সবেতেই চকলেট। চকলেট ফুচকা, চকলেট মোমো। কেউ ভাইরাল হওয়ার তাগিদে বানিয়ে ফেলতেই পারেন চকলেট চাউমিন, চকলেট বিরিয়ানি, চকলেট পরোটা। সেই দিন দূর নেই যেদিন চকলেট খিচুড়ি খেতে বাঙালি লাইন দেবে! প্রসাদেও থাকবে চকলেট!
বাঙালি মিষ্টির নাম সারা পৃথিবীতে চর্চিত। সেই মিষ্টিতেও ঢুকে পড়েছে চকলেট! আপনারা ভাবতেই পারেন আমি বুড়ো ভাম! অকারণে চকলেটকে খিস্তি করে যাচ্ছি। আসলে আমার বিরোধ চকলেটের সঙ্গে নয়। আমি চিমটি কাটছি এই চকলেট নিয়ে বাঙালি আদেখলাপনাকে। ধরে নিন, আমাদের কোন মিষ্টি নেই। তাহলে যত খুশি চকলেট নিয়ে লাফান। কিন্তু, যেখানে আমাদের স্টকে এত ভালো ভালো মিষ্টি আছে, সঙ্গে হিস্ট্রি আছে– সেখানে চকলেট নিয়ে লাফালাফি মেনে নেওয়া যায় না। আচ্ছা ভেবে দেখুন তো, ফরাসি বা জাপানিদের যদি এত মিষ্টির সম্ভার থাকত তাঁরা কি সেসব ছেড়ে চকলেট চকলেট করে লাফাত, মিষ্টিতে চকলেট গুঁজে সেটাকে প্রোমোট করত? আমার মনে হয় না।
আমরা বাঙালিরা, নিজের কাছে ঘন গ্রেভি থাকলেও অন্যের ট্যালট্যালে ঝোল দেখে নাল ফেলি। আমাদের ভাষায় আজ ঢুকে পড়ছে হিন্দি। মাতৃভাষায় কথা বললে প্রেস্টিজ যাচ্ছে বড়লোকের বিটি-ব্যাটাদের! বাঙালি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও জাত নিজের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায় বলে মনে হয় না। বাঙালিরাই নিজেদের ভাষার, নিজেদের সংস্কৃতির মৃত্যু নিশ্চিত জেনে আগাম শ্রাদ্ধের আয়োজন করছে বারবার। মানে ওই যে দেখবেন কীসব বিতর্কসভার আয়োজন হয় মাঝেমাঝে, বাংলা ভাষা আর ক’দিন টিকবে, ডোডোপাখির নতুন নাম কি বাঙালি, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওগুলোই এলিট শ্রাদ্ধ! অথচ ভেবে দেখুন, সাহেবদের লিকার চকলেট বানানোর অনেক আগে চন্দননগরের সূর্যকুমার মোদক ১৮১৮ সালে বানিয়ে ফেলেছেন জলভরা সন্দেশ! আজ থেকে ২০০ বছর আগে সন্দেশের মোটা আস্তরণের ভেতর গোলাপ জল ধরে রাখার অসামান্য কারিগরির জন্ম কিন্তু এই বাঙালির মাথা থেকেই। তখন চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ।
‘ইন্ডিয়া ন্যারেটিভ’-এ ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে অনুথি বিশাল লিখেছেন এক অনুমানের কথা। যদিও এই অনুমানের কোনও ঐতিহাসিক প্রামাণ্য নথি নেই। সেই অনুমান হল, ফ্রেঞ্চ লিকার চকলেট কি জলভরা সন্দেশ দ্বারা অনুপ্রাণিত? ফরাসিরা চন্দননগরে জলভরা সন্দেশের উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিল। এই সন্দেশ আবিষ্কারের ১০ বছর পর লিকার চকলেটের আবির্ভাব! আসলে বাঙালি ছেলেমেয়েদের কেউ চিনিয়ে দিচ্ছে না বাঙালিদের সংস্কৃতি। নিজের কালচারকে অস্বীকার করে কোনও দিনই কেউ যথার্থভাবে ‘গ্লোবাল’ হতে পারে না। বরং বাঙালিয়ানাকে ট্রোল করার টোল খুলেছে সবাই।
দেখুন, স্বাদ ব্যক্তিগত বিষয়। কেউ বলতেই পারেন, যে আমার চকলেট ভালো লাগে, মিষ্টি খেতে ভালো লাগে না। কোনও প্রবলেম নেই। কিন্তু, যাঁরা মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন, তাঁরা আমাদের মিষ্টির যে বিরাট সম্ভার আছে, অবশ্যই টেস্ট করে দেখুন। কারন, এটা আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ। আমি নীতিপুলিশগিরি করছি না। আমি বলছি– ট্রাই করুন। বিষ তো নয়। খারাপ লাগলে খাবেন না।
প্রেমের সঙ্গে চকলেট জুড়ে দেওয়ার স্টিরিওটাইপ ভাবনা এবার পাল্টে দেওয়াই যায়। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে ছেলেরা খায়, আর মেয়েরা ভিড় করেন ফুচকার দোকানের সামনে। এই অবান্তর জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন আজকের যুগে মানায় না। তবে সময় পাল্টাচ্ছে। আমি কিছুদিন আগে বাবুবাগানের কাছে এক বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে দেখলাম দু’টি কলেজপড়ুয়া মেয়ে মিষ্টি খাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমি এবং আমার স্ত্রী দু’জনেই অবাক! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার গিন্নিও মিষ্টি খেতে অত্যন্ত ভালোবাসেন। একসময়ে আমার কোনও মূর্খামির জন্য তিনি রাগ করলে আমি চকলেট কিনে আনতাম। এখন মিষ্টি কিনে আনি। বিশ্বাস করুন, কাজ হয়। আপনারাও ট্রাই করে দেখুন।
তবে হ্যাঁ, একটু দেখে-শুনে কিনবেন। চকলেট পচা হয় না। কিন্তু, মিষ্টি পচা হতেই পারে! আর সাধারণত দেখা গিয়েছে মিষ্টির দোকানের লোকেদের ব্যবহার খুবই তেতো। ওইটুকু পেনাল্টি দিতে হবে। শুনুন বাঙালির কাছে যা মিষ্টির সম্ভার আছে, গোটা ভারতে পাবেন না। তাও মিষ্টির দোকানে কেন যে চকলেট সন্দেশ বানাচ্ছে– সে তারাই জানে! তবে বাবা-মায়েদের উচিত, ছেলেমেয়েদের যেমন সাহেবি পিৎজা-বার্গার, ফ্রুট অ্যান্ড নাট চকলেট চেনাচ্ছেন, তেমনই ল্যাংচা–চমচম–কমলাভোগ–মিহিদানা–রসমালাই–বৈকুণ্ঠভোগ–সীতাভোগ–জিলিপি–তৃপ্তিভোগ এগুলোও চিনিয়ে দেওয়ার। নিজের মাটিকে চেনা খুব জরুরি।
পুনশ্চ, যে কথাটা বলার জন্য অনেকেই ছটফট করছেন সেটা আমিই বলে দিচ্ছি। পকেটে চকলেট নিয়ে যাওয়া প্রেমিকের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক। পকেটে করে তো রসমালাই বা জিলিপি বা বোঁদে বা মিহিদানা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রেমিকা রাগ করলেই চট করে তাঁর সামনে একটা চকলেট হাজির করা যায়, কিন্তু কমলাভোগ হাজির করা মুশকিল। প্রেমিকার জন্য নিশ্চয়ই পকেটে করে গুজিয়া বা প্যাঁড়া নিয়ে যাবেন না। প্রেম করতে যাচ্ছেন, পুজো দিতে নয়। তাহলে উপায়? চকলেটটা স্টার্টার হিসেবে রাখুন আর মিষ্টিটা মেনকোর্স করে নিন। তাহলেই হবে।
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………….