Robbar

বিধাতার চিত্রনাট্যকে শোধরানোর চেষ্টা করেননি গদার

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 3, 2025 4:57 pm
  • Updated:December 3, 2025 4:57 pm  

গদার হিচককের প্রশংসক ছিলেন, কিন্তু ত্রুফো যেভাবে হিচককের সঙ্গে চলচ্চিত্র নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, কখনও একমত হয়ে কখনও তর্ক করে– যা অনুলিখিত হয়েছে বিখ্যাত ‘হিচকক/ত্রুফো’ বইতে– তা গদারের পক্ষে সম্ভব হত না। গদার আর হিচককের দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পার্থক্য অত্যন্ত রূঢ়ভাবে প্রকাশিত। তরুণ গদার হিচককের ক্লাসিকাল অ্যপ্রোচের কাছে যতটুকু শেখার শিখেছিলেন– ব্যস্, ঐ পর্যন্তই।

অনমিত্র বিশ্বাস

গদার আত্মহত্যা করলেন। আমি তখনও ক্রমিক-ভাবে গদারের শেষ দশকের ছবিগুলো দেখবার ও বুঝবার চেষ্টা করছি। ‘হেইল মেরি’র মতো দুষ্প্রাপ্য ছবি খুঁজবার চেষ্টা করেছি, বিভ্রান্ত হয়ে গিয়ে বারবার রি-প্লে করে ‘নৎরে মিউজিক’ দেখেছি; সত্যজিৎ রায় গদারের যে অধ্যায়টার ছবি পছন্দ করেননি, তা ভালো লাগবার কী কী কারণ থাকতে পারে সেই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করে ক্যাফে-সুদ্ধ লোককে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছি। আমার মনে হয়েছিল, গদারের স্বেচ্ছামৃত্যুতে তাঁর কারুশিল্পের মঞ্চে একটা সোনালি আলোর উৎস হঠাৎ নিবে গিয়ে পুরোটাকে ধূসর করে দিল।

জ্যঁ লুক গদার

আলফ্রেড হিচককের ‘স্ট্রেঞ্জারস্ অন আ ট্রেন’ দেখে মুগ্ধ যে গদার লিখেছিলেন, ‘এ কাহিনি কলিযুগের সেই মানুষের পরিস্থিতির, যাকে দেবতাদের সাহায্য ছাড়াই ভবিতব্যকে অতিক্রম করতে হবে।’

অমিত রায় না-হয় কথার মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করতে পারেননি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯-এর একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ। এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা এমন করে পরিস্ফূট করা উচিত যা কোনো বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে।…’ এ-কথা অবশ্য হিচ্‌ককও বলেছেন– সংলাপ যদি প্রবাহকে ভারাক্রান্ত করে তোলে, তা চিত্রনাট্যকারের অপদার্থতা। গদার তাঁর শেষ জীবনে এই ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা ঋষির কথাকে সার্থক করে ভাষার সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে মানুষে-মানুষে সংযোগ খুঁজতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন– Adieu to Language। সেই খোঁজ শেষ হয়নি, হঠাৎ তার মাঝপথে যতিচিহ্ন টেনে দিলেন গদার; গদারের পথ ধরে ছায়াচিত্রের বিবর্তন অনুসরণ করা নিরর্থক হয়ে পড়ল। ওই পথের শেষে যেন পরিণতি-হীনতার আবছায়া।

আলফ্রেড হিচকক

‘জুল এৎ জিম’-এ ত্রুফোর চেয়ে গদারের বৈশিষ্ট্যই বেশি। কিন্তু ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফোর বাকি ছবিগুলো দেখলে ফরাসি চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গের দুই স্থপতির দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য স্পষ্ট হয়।

প্রতিষ্ঠানের প্রতি ত্রুফোর অবিচল শ্রদ্ধা– নতুন ধরনের ছবি, নতুন প্রযুক্তিতে দৃশ্যগ্রহণ করেও প্রথাগত স্টুডিও শুটিং, স্টারডম আর নির্ভেজাল বিনোদন-মার্কা কাহিনির প্রতি ত্রুফোর বিদ্বেষ ছিল না। ত্রুফোর চিন্তাধারাও তাঁর ন্যারেশনের আর ক্যামেরার মতো ধীর, স্থির আর দৃঢ়। অন্যদিকে গদার ভাঙনের জয়গানেই মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। ছয়ের দশকে তিনি ট্রলি আর ক্যামেরা স্ট্যান্ডকে দিলেন বিদায় করে, সাতের দশকে দেখা গেল অডিয়েন্সও তাঁকে আর বড়-একটা বিব্রত করছে না। ’৮০-তে নৈতিকতার ভার আর কাহিনিক্রমের দায় তিনি ঘাড় থেকে নামালেন, ’৯০-য়ে অভিনেতাও তাঁর কাছে অবান্তর হয়ে পড়ল, আর একবিংশ শতাব্দীতে সংলগ্ন ভাষা। গদার বন্যার মতো দুই কুল ভাঙতে ভাঙতে গেছেন– পথে পলিমাটির যা গড়েছেন তার ওপর নতুন ক্রাফটের বীজবপন সম্ভব হয়েছে। তাই বলে গদার যা-যা ভেঙেছেন, তার সব যে বর্জনীয় ছিল তা হয়তো নয়। ‌গদারের ক্রাফট্ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় মন্তব্য করেছিলেন, সিনেমা মানুষের হাতের কাজ– ত্রুটি-বিচ্যুতি, কবিতা কিংবা ম্যুরালের মতোই তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে। ক্যামেরা যদি সামান্য কাঁপে তো কাঁপুক, আলো যদি এক-আধবার নায়কের মুখ থেকে সরে যায় তাতেও বিশেষ ক্ষতি নেই। ওই পুঙ্খানুপুঙ্খতা আর্টের উপাদান নয়। গদার এইটা বুঝে সব কিছুকে সহজ করে দিয়েছেন। যত্নশীল অযত্নে গদার নিজের স্বাক্ষর তৈরি করেছেন। বিপ্লবের পরে বিপ্লবের যেটুকু প্রয়োজনীয়তা বাকি থাকে, গদারের প্রয়োজনীয়তা আজ ঠিক তাই।

ত্রুফো

গদার হিচককের প্রশংসক ছিলেন, কিন্তু ত্রুফো যেভাবে হিচককের সঙ্গে চলচ্চিত্র নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, কখনও একমত হয়ে কখনও তর্ক করে– যা অনুলিখিত হয়েছে বিখ্যাত ‘হিচকক/ত্রুফো’ বইতে– তা গদারের পক্ষে সম্ভব হত না। গদার আর হিচককের দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পার্থক্য অত্যন্ত রূঢ়ভাবে প্রকাশিত। তরুণ গদার হিচককের ক্লাসিকাল অ্যপ্রোচের কাছে যতটুকু শেখার শিখেছিলেন– ব্যস্, ঐ পর্যন্তই।

‘হেইল মেরি’ বা ‘প্রিনম কার্মেন’-এর মতো ছবিকে দেখি কাহিনিই ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। তার পরে ‘লেটার টু জেইন’ বা ‘‍অ্যালিমানি অ্যানি ৯০ নিউফ জিরো’তে দেখি কাহিনি বলে কিছু নেই। শুধুই কথা। তারপর এক সময়ে কথাও নেই– বিমূর্ত অনুভূতিকে নিয়ে কারবার করতে শিখে গেছেন এক অতি উচ্চাঙ্গের রূপদক্ষ। মাটির পৃথিবীর চেয়ে অনেক উপরে বুঝি।

‘হেইল মেরি’ ছবির পোস্টার

তার আগে– যখন গদার গল্প-বলিয়ে ছিলেন– তিনি ইরেস্‌পন্সিব্‌লের মতো পরিণতি-হীন কাহিনি শুনিয়ে দর্শককে নিরাশ করেছেন, বিনা অনুতাপে।

‘ভিভ্রে সা ভিয়ে’ ছবিতে এক দেহোপজীবিনী ক্রমশ সাহিত্যের, কাব্যের, প্রেমের সংস্পর্শে আসে। অনাগত সুখের সম্ভাবনার তোরণদ্বারে হঠাৎ দুই উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্রের মাঝখানে পড়ে সে মরে গেল। যে মৃত্যুটা অহেতুক, অনর্থক, অযৌক্তিক। মাঝ-নাটকে এমন মৃত্যুর যবনিকা গদারের বহু ছবিতে– যেমন শট্-গুলো অপ্রত্যাশিত-ভাবে শেষ হয়ে যায় তীক্ষ্ণ ‘কাট্’-এ।

‘ভিভ্রে সা ভিয়ে’ ছবির পোস্টার

নারায়ণ সান্যালের ‘দণ্ডকশর্বরী’তে চয়ন সর্দারের কথা আছে। দুর্বোধ্য অসুখ থেকে সেরে ওঠে সেই গোণ্ড তরুণ, পাল্টি ঘরের প্রেমিকার সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক, একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে লেখক চয়ন সর্দারের উপাখ্যান শেষ করবেন। এমন সময়– খবর আসে, ভারতীয় সৈন্যের আগ্নেয়াস্ত্র আর দণ্ডকারণ্যের আদিবাসীদের তীর-ধনুকের সংঘাতের মধ্যে চয়নও ছিল। ড. পিল্লাই কম্প্রবক্ষে মর্গে যান, চয়নের মৃতদেহ দেখবার আশঙ্কা নিয়ে, লেখক কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। তাঁর মনে হয়, উদাসীন নাট্যকারের ‘কোনো সেন্স অফ প্রপোর্সন নেই। নাটকের এই অঙ্কে চয়নের এভাবে মরার কথা নয়। মরতে হলে সে অনেক আগেই মরতে পারত। লোহাণ্ডিগুডার ধুলোয় তাকে মেরে ফেলাটা হবে অতি চীপ স্টান্ট।’ তাই ঔপন্যাসিকের অধিকারে তিনি বিধাতার অলঙ্ঘ্য চিত্রনাট্য শুধরে দেবেন।

‘লেটার টু জেইন’ ছবির পোস্টার

গদার বিধাতার চিত্রনাট্যকে শোধরানোর কোথাও চেষ্টা করেননি– শেষ পর্যায়ের রবীন্দ্রনাথের মতো উপলব্ধি করে, ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে, সে পায় তোমার কাছে শান্তির অক্ষয় অধিকার।’ গদার অবশ্য শান্তি চাননি। তিনি ‘এই মাত্র! আর কিছু নয়’-কে ডিঙিয়ে যেতে চেয়েছেন। সুমনের ‘পাগল’ বিধাতার সঙ্গে সাপ-লুডো খেলছিল– আমরা সবাই খেলছি। গদার হেরে-যাওয়া খেলায় শেষ পর্যন্ত ‘ছায়ার সঙ্গে কুস্তি’ লড়েননি– বোর্ড উল্টে দিয়েছেন অতর্কিত ‘কাট্’-এ। আর, বেরসিক নেপথ্যচারীকে ভেংচি কেটে গদার কলিযুগের সেই মানুষের গল্প বলেছেন, যাকে দেবতাদের সাহায্য ছাড়াই ভাগ্যকে জয় করতে হবে।

‘প্রিনম কার্মেন’ ছবির পোস্টার

দুনিয়াদারির গোলকধাঁধার অধিকাংশ পথপ্রান্তে অতর্কিত যতিচিহ্ন অনতিক্রমণীয় সত্য। জীবন সেই চক্রব্যূহ, যার বহির্গমনের পথ কেবল কোনও দুর্লভ ভাগ্যবানের জানা থাকে। বাকিরা অন্ধ গলির মধ্যে ঘুরে-ঘুরে মরে। পথের শেষে পথরোধকারী বিধাতাই যদি একমাত্র পরিণতি, সেটাই গদারের সদর্প ঘোষণা, দেবতাদের প্রতি– বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়– ‘বন্দনার ছদ্মনামে নিষ্ঠুর বিদ্রূপ’।