সেসময়ে দূরদর্শনই ছিল আমাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। আমরা মুখিয়ে থাকতুম ‘দেশ’ রাগে সারা ভারতের প্রথিতযশা সংগীতজ্ঞদের নিয়ে তৈরি সেই চলচ্চিত্র দেখার জন্য– যতবার তা প্রচারিত হয়েছে ততবারই তা আমাদের মনোযোগ টেনে রাখত। সেই ফিল্মে এক বছর পঞ্চাশের মানুষকে দেখা যেত গাছের ডালে হেলান দিয়ে বাঁশের বাঁশি থেকে বের করে আনছেন আশ্চর্য সুরের জাদু। ১৯৯২ সালে কলকাতার এক নাগরিক কবিয়াল যখন আমাদের শোনালেন যে আরও অনেক চাওয়ার মধ্যে ‘চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত তানে’ও তিনি তোমাকেই চান, তখন সে গানের কথা যৌবনের প্রান্তে দাঁড়ানো আমাদেরও চাওয়া হয়ে উঠেছিল।
প্রচ্ছদের ছবি: রঘু রাই
পালোয়ানের পুত্র হিসেবে তাঁর হয়ে ওঠার কথা ছিল কুস্তিগির, অন্তত বাবার তাই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো সুরে যে মজে, তাকে কী দিয়ে টেনে রাখবে কুস্তির আখড়া? মাত্র চার বছর বয়সে হঠাৎ মাতৃহারা হয় যে শিশু, তার ভেতরে গুঁড়ি মেরে বেড়ে ওঠে শূন্যতা। বাবার প্রখর নিয়মানুবর্তিতায় হাঁপিয়ে ওঠে সে, কিন্তু মুক্তি পায় সুরে। এলাহাবাদে তাদের প্রতিবেশী ছিলেন পণ্ডিত রাজা রাম। বাবার অলক্ষ্যে রাজা রামের কাছেই তার তালিম শুরু মাত্র ন’ বছর বয়সে। শুরুটা হয়েছিল গান দিয়ে। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখা গেল গলায় নয়, বাঁশিই হবে তার আশ্রয়।
ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর অদম্য টান। যে-কোনও ধরনের গান, বাজনা তিনি শুনতেন নিবিড় মনোযোগে। একবার রেডিয়োতে বারাণসীর সংগীতগুণী পণ্ডিত ভোলানাথ প্রসন্নের বাঁশি শুনে এতই বিমোহিত হয়েছিলেন যে তৎক্ষণাৎ সোজা রেডিয়ো স্টেশনে গিয়ে হাজির হন ভোলানাথের কাছে। অকৃতদার ভোলানাথও সেই ন’ বছরের শিশুকে সাদরে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। ভোলানাথই তাঁর প্রথম বাঁশি শিক্ষার গুরু।
সেসময়ে এলাহাবাদে নিয়মিত বসত উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর। হিন্দুস্থানী সংগীতের রথী-মহারথীরা আসতেন সেখানে– গোয়ালিয়র, পাতিয়ালা, রামপুর, মাইহার, জয়পুর, আগ্রা, বেনারসের রাজসভার গায়ক-বাদকেরা তাঁদের সম্ভার নিয়ে হাজির হতেন। গোয়ালিয়র ঘরানার বিখ্যাত গায়ক পণ্ডিত বিষ্ণুদিগম্বর পালুসকর গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয় স্থাপন করে নানা জায়গায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরের আয়োজন করতে থাকেন– সাধারণ মানুষকে উচ্চাঙ্গ সংগীত শোনার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া তাঁর একটা মূল উদ্দেশ্য ছিল। শুধু পণ্ডিত বা ওস্তাদ তৈরি নয়, সাধারণ মানুষের যাতে উচ্চাঙ্গ সংগীত শোনার কান তৈরি হয় সে ব্যাপারে তাঁর এই উদ্যোগ একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রায় একই সময়ে পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডেও হিন্দুস্থানী সংগীতের প্রচার, প্রসার এবং রক্ষণাবেক্ষণে উদ্যোগী হন– ১৯২৬-এ লখনউতে মরিস কলেজ অফ মিউজিক স্থাপিত হলে ভাতখণ্ডে তার পাঠক্রম তৈরি করেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের গণতন্ত্রীকরণে এই উদ্যোগগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভারত জুড়ে নানা জায়গায় আয়োজিত হতে থাকে উচ্চাঙ্গ সংগীতের বড় বড় আসর।
এলাহাবাদে প্রয়াগ সংগীত সমিতি আয়োজিত এরকম আসরেই ছোট্ট হরিপ্রসাদ (Hariprasad Chaurasia) একে একে শুনেছেন, দেখেছেন আলাউদ্দিন খান, রবিশঙ্কর, আলি আকবর খান, অন্নপূর্ণা দেবী, আমির খান, দত্তাত্রেয় বিষ্ণু পালুসকর, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, বেগম আখতার, পান্নালাল ঘোষ, ভীমসেন যোশী, রাম নারায়ণ, আল্লা রাখা, শামতা প্রসাদ, কিষেণ মহারাজ, বিলায়েত খান, ডাগর ভাইদের মতো বিভিন্ন ঘরানার দিক্পাল শিল্পীদের। এই দেখা আর শোনা তাঁকে তৈরি করেছে ভবিষ্যতের শিল্পী হিসেবে। এলাহাবাদে যে হোটেলে আলাউদ্দিন খান এসে থাকতেন সেখানেই একদিন হরিপ্রসাদ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। আলাউদ্দিন হরিপ্রসাদকে মাইহারে তাঁর কাছে গিয়ে শেখার কথা বললে হরিপ্রসাদ তাঁর পিতার অমতের কথা বলেন। আলাউদ্দিন তাঁকে বলেছিলেন যে আদৌ যদি হরিপ্রসাদ কখনও যেতে পারেন, তিনি না থাকলেও তাঁর কন্যা অন্নপূর্ণার কাছে তিনি শিখবেন। হরিপ্রসাদ যে অন্নপূর্ণার শিষ্যত্বে বৃত হবেন একদিন সে সম্ভাবনা তখন ভবিষ্যতের গর্ভে।
ভোলানাথের কাছে শিক্ষা চলতে চলতেই হরিপ্রসাদ শিশুশিল্পী হিসেবে রেডিয়োতে প্রথম আনুষ্ঠানে রাগ সারং বাজিয়ে পরিচিত হন, খবরের কাগজে তাঁর নাম ছাপা হয়– ছেলের কৃতিত্বে আনন্দিত বাবা ছেদিলাল তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন কুস্তির আখড়া ছেড়ে সংগীতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে। ১৯৫৩ সালে হরিপ্রসাদের বয়স তখন মাত্রই ১৫ বছর। গুরু ভোলানাথের আগ্রহে হরিপ্রসাদ রেডিয়োতে অডিশন দিয়ে পাশ করেন– পরীক্ষক ছিলেন পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর। এই রেডিয়োতেই হরিপ্রসাদ বংশীবাদক হিসেবে তাঁর প্রথম চাকরি শুরু করবেন ১৫০ টাকা মাস মাইনেয়, কটকে। এই কটক রেডিয়োর চাকরিই হরিপ্রসাদকে শিল্পী হিসেবে পরিণত হওয়ার সুযোগ দিল– সারা ভারতের বিখ্যাত সব শিল্পীকে কাছ থেকে দেখা এবং শোনার এক সুবর্ণ সুযোগ তাঁকে দিয়েছিল এই চাকরি।
কটকের পরে বোম্বে রেডিয়োতে যোগ দিলেন ১৯৬২-তে। বোম্বেতে এসেই তাঁর রুপোলি জগতের সঙ্গে তৈরি হল অচ্ছেদ্য বন্ধন– এই বন্ধন তাঁকে এনে দেবে জনপ্রিয়তার ভিন্নতর এক মাত্রা। একের পর এক ছবিতে তিনি হয়ে ওঠেন শচীন দেব বর্মন, মদন মোহন, আনন্দ বক্সীদের ভরসার জায়গা; লতা মঙ্গেশকরের গানে বাঁশিতে হরিপ্রসাদ, সেতারে রাইস খান– এই ছিল চেনা ছবি। সেই ছোটবেলায় একবার বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলেন বোম্বেতে সিনেমায় যোগ দেবেন বলে। সেবারে ঢুকতেই পারননি রাজ কাপুরের স্টুডিয়োতে। আর এখন হরিপ্রসাদ রাজ কাপুরের প্রতিটি ছবির অবিসংবাদী অংশ। এর আগে ১৯৫৮-তে দিল্লিতে যুব উৎসবে পরিচয় হয় সমবয়সী সন্তুর বাদক শিবকুমার শর্মার সঙ্গে। বোম্বেতে এসে সেই পরিচয় গভীর সখ্যে পরিণত হল। ১৯৬৮ সালে সন্তুরে শিবকুমার শর্মা আর গিটারে ব্রিজভূষণ কাবরার সঙ্গে ইতিহাস তৈরি করে ফেলা লং প্লে অ্যালবাম ‘কল অফ দ্য ভ্যালি’-তে যে হরিপ্রসাদও বাঁশি নিয়ে যোগ দেবেন সে তো শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র– এখনও পর্যন্ত এই রেকর্ড সর্বোচ্চ বিক্রিত লং-প্লে অ্যালবাম। পরে শিব-হরি যুগল ১৯৮১ (‘সিলসিলা’) থেকে ১৯৯৩ (‘ডর’) পর্যন্ত আটটি হিন্দি ছবিতে সুরারোপ করে সিনেমা সংগীতের ঐতিহ্যে একটা নতুন যুগ তৈরি করবেন।
শত ব্যস্ততার মাঝেও বোম্বেতে অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে সংগীতের পাঠ নিয়েছেন, অন্নপূর্ণার সমস্ত নির্দেশ মেনে নিয়ে– সংগীতে নিবেদিতপ্রাণ না হলে এত খ্যাতি আর স্বীকৃতি সত্ত্বেও এই সময় তিনি বের করে নিতেন না। নানা গুরুর থেকে শিখেও তিনি তৈরি করে নিয়েছেন তাঁর নিজস্ব স্টাইল, খুঁজে নিয়েছেন রাগ রূপায়ণের নিজের তরিকা। ইংল্যান্ড, জাপান, আমেরিকা, হল্যান্ড, চিন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন-সহ সারা পৃথিবী যেমন ঘুরেছেন ভারতীয় সংগীতের একজন প্রথম সারির প্রতিনিধি হয়ে, তেমনই জর্জ হ্যারিসন, ইয়ান অ্যান্ডারসন, লুইস ব্যাংকস, জাঁ পিয়ের রামপল, জন ম্যাকলফলিন-এর মতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংগীতজ্ঞদের সঙ্গে বিনিময় করেছেন সাংগীতিক অভিজ্ঞতা। পূর্ব-পশ্চিমের দেওয়া-নেওয়ায় তৈরি হয়েছে নানা অ্যালবাম। নিজের অজস্র অ্যালবামের পাশাপাশি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ-সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট পেয়েছেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও অগণিত– ভ্রাতুষ্পুত্র রাকেশ চৌরাশিয়া, দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায় তাঁর শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে চলছেন।
গত শতাব্দীর নবম দশকের শেষ বছরে (১৯৮৯) স্বাধীনতা দিবসে দূরদর্শন প্রচার করে একটা সাড়ে তেরো মিনিটের ফিল্ম– ‘দেশ’ রাগে সারা ভারতের প্রথিতযশা সংগীতজ্ঞদের নিয়ে তৈরি সে চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য ছিল সংগীতের মাধ্যমে জাতীয় সংহতির বার্তা প্রচার করা। সেসময়ে দূরদর্শনই ছিল আমাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। আমরা মুখিয়ে থাকতুম সেই চলচ্চিত্র দেখার জন্য– যতবার তা প্রচারিত হয়েছে ততবারই তা আমাদের মনোযোগ টেনে রাখত। সেই ফিল্মে এক বছর পঞ্চাশের মানুষকে দেখা যেত গাছের ডালে হেলান দিয়ে বাঁশের বাঁশি থেকে বের করে আনছেন আশ্চর্য সুরের জাদু। ১৯৯২ সালে কলকাতার এক নাগরিক কবিয়াল যখন আমাদের শোনালেন যে আরও অনেক চাওয়ার মধ্যে ‘চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত তানে’ও তিনি তোমাকেই চান, তখন সে গানের কথা যৌবনের প্রান্তে দাঁড়ানো আমাদেরও চাওয়া হয়ে উঠেছিল। বাঁশি মানেই তখন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া– এক এবং অদ্বিতীয় নাম তখন ঘরে ঘরে। এর মানে এই নয় যে ভারতে বাঁশিতে আর কেউ কখনও এমন সুরের জাদু বুনতে পারেননি, কিন্তু বাঁশি নিয়ে এমন সর্বব্যাপী উপস্থিতি, এমন জনপ্রিয়তা তাঁর আগে কেউ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। পান্নালাল ঘোষ, দেবেন্দ্র মুর্ডেশ্বর, ভোলানাথ প্রসন্ন, জি এস সচদেব, বিজয় রাঘব রাও, গৌর গোস্বামী, অলোকনাথ দে, নিত্যানন্দ হলদিপুর, রনু মজুমদার-সহ অসংখ্য নামের লম্বা তালিকা আমাদের সামনে থাকলেও, হরিপ্রসাদ এক এবং অদ্বিতীয় তাঁর বহুমুখী উপস্থিতি নিয়ে। সিনেমার গান থেকে বিজ্ঞাপন, উচ্চাঙ্গ সংগীতের গম্ভীর আসর থেকে জনপ্রিয় বাজারসফল সুর সৃষ্টিতে হরিপ্রসাদ তাঁর স্বাক্ষর রেখেছেন।
আজ পয়লা জুলাই ৮৭ পূর্ণ করলেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া। ১৯৩৮-এর জাতক আজ পরিণত, সমাহিত। বয়স তাঁকে অশক্ত করেছে, কিন্তু সংগীতের জন্য যে জিজ্ঞাসা নিয়ে নেহাত শিশু বয়েসে তিনি ঘর ছেড়ে বোম্বেতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, সেই জিজ্ঞাসা আজও ধরা পড়ে তাঁর নিমগ্নতায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে। এই ২০২৫-এ গত ১৫ জানুয়ারি রাজ্য সরকারের উদ্যোগে যে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসেছিল কলকাতায়, তাতেও তিনি দীর্ঘ সময় বাজিয়েছেন সমস্ত শারীরিক বাধাকে উপেক্ষা করে। সংগীতের প্রতি এই দায়বদ্ধতা তাঁকে চলমান রাখবে আরও কয়েকটা বছর– এটা আমাদের আশা। হরিপ্রসাদের কথা ধার করেই বলি– তিনি শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বাজান না, নিজের আনন্দকে বাড়িয়ে নিতেই তাঁর শ্রোতাদের সামনে অক্লান্ত উপস্থিতি আজও। আশা করি ছোটোবেলায় বাবা ছেদিলাল পালোয়ানের তত্ত্বাবধানে কঠোর শরীরচর্চা তাঁর যে বনিয়াদ তৈরি করে দিয়েছিল সেটাই তাঁকে সক্রিয় রাখবে আগামী আরও কয়েকটা বছর। তাঁর সংগীতময় শততম জন্মদিনেও তিনি সুরের অনন্ত দ্রাঘিমাকে আমাদের শ্রবণ অভিজ্ঞতায় ধরে দেবেন– সেই আশায়, আসুন, আমরা সকলে বাঁচি।
বিদায় স্মিভ স্মিথ। আপনি চ্যাম্পিয়ন থেকে গেলেন আত্মবিশ্বাসে। লেগস্পিনার হিসেবে ক্রিকেটীয় দুনিয়ায় এসে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটারদের তালিকায় আপনার নাম থেকে গেল। একজন লেগস্পিনার থেকে অসামান্য এক ব্যাটার হয়ে ওঠাও একটা অপূর্ব লেগস্পিনর সঙ্গে তুলনীয়, যা আপনি জীবনের সঙ্গে করলেন।