
কঙ্কালের সরু হাড় দেখে ইরাবতী কার্বে শনাক্ত করলেন এটি একজন মহিলার। বাংলোয় ফিরে ডায়েরিতে সেই নারী-কঙ্কালের কথা ভেবে লিখলেন, ‘কে ও? ও কি আসলে আমি?’ আসলে তিনি সব সময় প্রাচীন কঙ্কালের সামাজিক অবস্থান জানতে চেষ্টা করতেন; রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন। সাল ১৯৪৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি। স্বাধীনতার তিন বছর আগে লাজগঞ্জের বালিয়াড়িতে খুঁজে পাওয়া গেল পুরুষের বিধ্বস্ত খুলি আর এক নারীর আস্ত কঙ্কাল– উপমহাদেশের প্রাচীন প্রস্তরযুগের আদিম নৃতাত্ত্বিক নমুনা। নেতৃত্বে ভারতের প্রথম মহিলা নৃতাত্ত্বিক– ইরাবতী।
প্রকৃতি অকৃপণ। মানুষের কাছে বুক উজাড় করা তার দান। কিন্তু উন্নয়ন বাধা হয়ে দাঁড়াল। প্রকৃতিকে করায়ত্ত করতে কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হল বিপুল ক্ষমতা। এরা বৃহৎ পুঁজির মালিক, সীমাহীন লোভে যারা অন্ধ। সেই উন্নয়নের প্রকরণে এল নদীকে বাঁধার প্রকল্প। নদীর ইতিহাস আমাদের জানায়, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে হাজার হাজার নদী পর্বতগহ্বর থেকে বেরিয়ে, পথে জলধারা, অরণ্য, মানুষ, প্রাণীকুলকে সঙ্গে নিয়ে বয়ে এসেছে লক্ষ বছর ধরে, পুঁজির উদগ্র লোভে এখন তাদের দুই-তৃতীয়াংশের প্রবাহ রুদ্ধ। নদীবাঁধে পৃথিবীর যতটা ভূখণ্ড প্লাবিত হয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ডের পাঁচ গুণ, এবং যত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তা প্রায় সাড়ে আট কোটি।
………………………………………….
পড়ুন দেবাশিস গুপ্তর লেখা: শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের ছবি
………………………………………….
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, মহারাষ্ট্রের কোয়েনা নদীতে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা। সলিলসমাধি হবে বহু গ্রামের। ১৯৬৫ সালের জুলাই থেকে ১৯৬৭-র জানুয়ারি মাস। শুরু হল নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা। যারা ঘরবাড়ি, খেত-জমি হারাল– সবাই যে অখুশি এমন নয়, কারণ প্রায় প্রত্যেকে সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। দেখা গেল, তরুণ প্রজন্ম বেশ আনন্দিত। একসঙ্গে এত টাকা তারা আগে কখনও পায়নি। কিন্তু সেই টাকার বেশিরভাগই চলে গেল জুয়া আর মদে। আর যাদের সরকারি কর্তারা ভবিতব্য বোঝাতে পারেননি, শেষ মুহূর্ত অবধি যারা ভিটেমাটি আঁকড়ে ছিল, জল বাড়তে প্রাণ বাঁচাতে একবস্ত্রে পালিয়ে এল, উপযুক্ত নথিপত্রের অভাবে তাদের ক্ষতিপূরণ অনেকটাই কম।

যে গ্রামগুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সরকারি পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল, সেখানে দেখা গেল নতুন গ্রামগুলিও সরকার থেকে তৈরি হয়েছে পুরনো নিয়মেই। ভালো জায়গায় উঁচু জাতের ঘরবাড়ি, অনেকটা ব্যবধান রেখে নিচু জাতের। প্রকাশিত হল ক্ষেত্রসমীক্ষালব্ধ ফলাফল ‘A Survey of the People displaced through the Koyena Dam’। সাল ১৯৬৯। উন্নয়নের ফলে মানুষ যে কীভাবে ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়, তার প্রথম দলিল এল ভারতের প্রথম মহিলা নৃতত্ত্ববিদের হাত ধরে, যিনি হলেন ইরাবতী কার্বে।

সাল ১৯৪৪। গুজরাতের লাজগঞ্জ এলাকার মরুভূমিতে খোঁড়া হয়েছে ১৬ বাই ৬ ফুটের দু’টি লম্বা গর্ত। পুণের ডেকান কলেজ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতত্ত্ববিদদের একটি দল এসেছে এই মরুভূমিতে। দলের নেতৃত্বে দু’জন। একজন প্রত্ন-ইতিহাসবিদ হাসমুখ ধীরাজলাল সঙ্কলিয়া। অন্যজন নৃতত্ত্বের অধ্যাপক একজন মহিলা– যিনি সারাক্ষণই ভিন্ন যন্ত্রপাতিতে হাড়গোড় পরিষ্কার করেন, মাপজোক করে কাগজ-পেনসিলে অঙ্ক কষেন।

গত কয়েক দিন দুই গর্তে প্রবল ব্যস্ততা। গর্ত খুঁড়ে প্রথমে পাওয়া গেল কুকুরের হাড়, তারপর আস্ত একটা মাথার খুলি। খুলির একপাশ প্রায় বিধ্বস্ত, ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন। অনুমান, যুদ্ধে আহত হয়ে মারা যাওয়ার পর দেহ সমাধি দেওয়া হয়েছিল এখানে। অন্য গর্তে পাওয়া গেল ছোট্ট এক মানুষের কঙ্কাল। কয়েক শতকের প্রাচীনতায় ধূলিধূসরিত হলেও অটুট। মহিলা নৃতাত্ত্বিক কঙ্কালের সরু হাড় দেখে শনাক্ত করলেন এটি একজন মহিলা। সম্ভবত লোকটিকে কবর দেওয়ার সময় তার সম্পত্তিও এখানে পুঁতে দিয়েছিল ওর গোষ্ঠীর লোকেরা– পোষা কুকুর আর তার বউ। দুইয়ের মধ্যে কোনও তফাত নেই। আসল চিন্তাটা মাথায় এল বাংলোয় ফিরে ডায়েরি লিখতে লিখতে। সেই নারী-কঙ্কালের কথা ভেবে তিনি লিখলেন, ‘কে ও? ও কি আসলে আমি?’ আসলে তিনি সব সময় প্রাচীন কঙ্কালটির সামাজিক অবস্থান জানতে চেষ্টা করতেন; রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন। সাল ১৯৪৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি। স্বাধীনতার তিন বছর আগে লাজগঞ্জের বালিয়াড়িতে খুঁজে পাওয়া গেল পুরুষের বিধ্বস্ত খুলি আর এক নারীর আস্ত কঙ্কাল– উপমহাদেশের প্রাচীন প্রস্তরযুগের আদিম নৃতাত্ত্বিক নমুনা। নেতৃত্বে ভারতের প্রথম মহিলা নৃতাত্ত্বিক– ইরাবতী।

নদীর নাম ইরাবতী। মায়ানমারের সবচেয়ে বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ নদী। উত্তরে মাইটিকিনা থেকে কাচিন, মান্দালয়, সাগাইং, বাগো হয়ে দক্ষিণে আন্দামান সাগর পর্যন্ত যার বিস্তার। স্থানীয় মানুষরা ইরাবতী বলে না, বলে ‘ইয়াবতী’। স্থানীয় ভাষায় ‘ইয়া’ মানে বড়, ‘বতী’ মানে নদী। চার ছেলের পর এক মেয়ে, বাবা গণেশহরি কর্মকার তাই আদর করে নদীর নামে একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছেন ইরাবতী।
১৫ ডিসেম্বর। সাল ১৯০৫। মায়ানমারের মিয়াংগানে ইরাবতীর জন্ম। বাবা গণেশহরি কর্মকার ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। মাইটিকিনার ডাকসাইটে ‘ব্রিটিশ কটন কোম্পানি’র পদস্থ কর্মী। গতানুগতিক ভাবধারায় না হেঁটে গণেশহরি কর্মকার মেয়েকে ভর্তি করলেন পুণের আবাসিক স্কুলে। ইরাবতীর বয়স তখন সাত বছর।
ইরাবতীর জীবন অন্য খাতে বইল। সহপাঠীদের দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ ইরাবতী প্রায়ই পার্কে বসে গল্পের বই পড়ে। তেমনই একদিন তাঁর স্বাক্ষাৎ হল সহপাঠিনী শকুন্তলার বাবা আর পি পরাঞ্জপের সঙ্গে। ফার্গুসন কলেজের অধ্যক্ষ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কে প্রথম শ্রেণির স্নাতক, বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সারা পুণে শহর তাঁকে চেনে। নিজের মেয়ের সহপাঠিনীকে তিনি নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। জাতপাত বিরোধী, ঘোর নাস্তিক আর পি পরাঞ্জপে ইরাবতী আর শকুন্তলাকে ডাইনিং টেবিলে জেন অস্টেন, ডিকেন্স, শেক্সপিয়র জোরে জোরে পড়তে বলেন।

১৯২২-এ স্কুলের পড়া শেষ করে ফার্গুসেন কলেজে ইরাবতী দর্শনে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। স্নাতক হন ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। এরপর দক্ষিণা ফেলোশিপ পেয়ে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের জি এস ঘুরের অধীনে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘The Chitpavan Brahmins—An Ethnic Study’। ১৯২৮-এ তিনি এমএ পাশ করেন।
মেয়ের এত লেখাপড়া বাবা গণেশহরির পছন্দ নয়, তিনি অচিরে ইরুর বিয়ে দিতে চান। পরাঞ্জপের আত্মীয় দণ্ডকেশবের মেজ ছেলে ড. দিনকর দণ্ড কার্বের সঙ্গে ইরাবতীর বিয়ে হয়। দিনকর ছিলেন ডেকান কলেজের রসায়নের অধ্যাপক। দণ্ডকেশব কার্বে মহারাষ্ট্রের পুণে, নাগপুর, সাতারার অসহায় বালবিধবাদের শোচনীয় অবস্থা দেখে তাদের জন্য স্কুল করেছেন। বারবার বলেন, ‘বিয়ে নয়, পড়াশোনা করো। নিজের পায়ে দাঁড়াও।’ ১৯৫৮ সালে দণ্ডকেশবের শতবর্ষে ভারত সরকার তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। মরাঠিদের কাছে তিনি আজও মহর্ষি কার্বে।

দিনকর জৈব রসায়ন নিয়ে জার্মানিতে পিএইচডি করেছিলেন। ইরাবতীও নৃতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য জার্মানিতে স্কলারশিপ পেলেন। কিন্তু নারীশিক্ষার পুরোধা দণ্ডকেশব কার্বে উচ্চশিক্ষার জন্য পুত্রবধূকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেননি। বিদেশে পড়তে যাওয়া ব্যয়সাপেক্ষ। তা ছাড়া ইরাবতী নিজের যোগ্যতার নিরিখে যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ পেতে পারেন। এই যুক্তিতে তিনি ইরাবতীর জার্মান যাওয়ার বিরোধিতা করেন। কিন্তু দিনকর ইরাবতীকে জার্মানিতে পড়ানোর ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। নিজের উদ্যোগে ইরাবতীকে জার্মানিতে পড়ানোর খরচ জোগাড় করেন। জীবরাজ মেহেতার কাছে টাকা ধার নিয়ে দিনকর কার্বে স্ত্রীকে বার্লিনগামী জাহাজে তুলে দিলেন।

সাল ১৯২৮। ইরাবতী একাই জার্মানি আসেন। ভর্তি হন বার্লিনের ‘কাইজার উইলহেলম ইনস্টিটিউট অব অ্যানথ্রোপোলজি’তে। গবেষণা শুরু করেন অধ্যাপক ইউজিন ফিসারের অধীনে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘Human Heredity and Eugenics’। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.ফিল ডিগ্রি প্রদান করে।

ডক্টরেট করার পর দেশে ফিরে আসেন ইরাবতী। বোম্বের শ্রীমতী নাথিভাই দামোদর থ্যাকারসে (এসএনডিটি) মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে। শুধুমাত্র ভারত নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এটি প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়। ইরাবতী ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত এখানে কাজ করেন। এরপর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পুণের ডেকান কলেজে রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। কর্মজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যাপনা করেন। পুণের বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নৃতত্ত্ব বিভাগ শুরু করেছিলেন। ডেকান কলেজের সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন বেশ কিছু বছর। ১৯৫১-’৫২-তে তিনি ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’ থেকে আমন্ত্রণ পান। এখানে থাকাকালীন তিনি তাঁর প্রথম বই ‘Kinship Organization in India’-র খসড়া প্রস্তুত করেন। ১৯৫৯-’৬০-এ তিনি বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন।
নৃতত্ত্বের গবেষণায় কে কোন জাত, কোন জাতের সঙ্গে মিল– এসব জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হত। সাধারণ মানুষ জিজ্ঞাসা করত, ‘কেন রক্ত নিচ্ছেন? সরকারি লোক বুঝি? আচ্ছা, আমার কি হাঁপানি হতে পারে, বাবু? মা ওই রোগে খুব ভুগতেন।’ ইরাবতী ছোট্ট একটি ইংরেজি পুস্তিকা ধরিয়ে দিতেন যাতে লেখা থাকত রক্ত কী কাজে লাগবে। মাহার গ্রামে একজন একদিন খুব মুখ ঝামটা দিল, ‘এসব কী? আমাদের ভাষায় কিছু থাকলে দিন, তা হলে তো বুঝব।’ এই ঘটনার পর ‘Kinship Organization in India’ এবং ‘Hindu Society: An Interpretation’-এর মতো নৃতাত্ত্বিক গবেষণা ছাড়া তাঁর যাবতীয় নিবন্ধ মারাঠি ভাষাতেই লিখেছেন ইরাবতী।

অধ্যাপক ছাড়াও ইরাবতী ছিলেন একজন খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক। তাঁর গবেষণা এবং লেখায় বারবার তিনি প্রশ্ন তুলেছেন জাতপাত, পারিবারিক সম্পর্ক, ধর্ম, পুরাণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে। তাঁর লেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই ‘Yuganta: the End of an Epoch’। টানা কয়েক দশক ধরে দেশি-ভিনদেশি পণ্ডিতদের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে ছয়ের দশকে পুণের ভান্ডারকর ইনস্টিটিউট থেকে বিষ্ণু সীতারাম সুকথনকরের সম্পাদনায় বেরতে থাকে মহাভারতের মান্য সংস্করণ। সেটি পাঠ করেই ইরাবতী লেখেন তাঁর বিখ্যাত ‘যুগান্ত’। নৃতত্ত্ব থেকে মনস্তত্ত্ব, সব মিলিয়ে অসাধারণ মহাভারতীয় বৈদগ্ধের প্রকাশ ঘটেছে এই বইয়ের ১০টি প্রবন্ধে। ‘যুগান্ত’র জন্য ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারাঠি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। মহারাষ্ট্রের প্রথম লেখিকা হিসেবে এই সম্মান পান তিনি। এই গ্রন্থে মহাভারতের কুন্তী, গান্ধারী, ভীষ্ম প্রমুখ প্রধান প্রধান চরিত্রকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরে সেই আলোয় তাদের উপস্থাপিত করেছেন তিনি। আমেরিকায় পড়াতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধে তিনি নিজেই ইংরেজি ভাষায় ‘যুগান্ত’ অনুবাদ করেছিলেন। দুর্ভাগ্য, ‘যুগান্ত’ ছাড়া বেশিরভাগ বই-ই অন্য কোনও ভারতীয় বা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়নি।

এছাড়াও ইরাবতী কার্বের লেখা কিছু উল্লেখযোগ্য বই– ‘ভূভারা’, ‘আমচি সংস্কৃতি’, ‘পরিপূর্তি’, ‘The Bhils of West Khandesh’, ‘Maharashtra: Land and its People’। মহারাষ্ট্রের দুই অন্ত্যজ জাতি মাহার ও ধাঙড়দের নিয়েও কাজ করেছিলেন ইরাবতী। ইরাবতী মাহারদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মহারাষ্ট্র মানে জানেন?’ উত্তর এসেছিল, ‘হ্যাঁ, মাহারেরা যেখানে থাকে, যত দূরে থাকে, সেটাই মহারাষ্ট্র।’ মহারাষ্ট্রের এই সংজ্ঞা এখনও অনেক মানুষ জানেন না। তখনই গবেষকরা এক মাহারকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার জাত কী?’ উত্তর আসে, ‘হরিজন’। টিমের এক গবেষক ছাত্র তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন, ‘বলুন না, মাহার। আমি নিজেও আপনাদের মতো মাহার। সেটাই আমাদের পরিচয়। খামোকা হরিজন-টরিজন বলেন কেন?’ নৃতত্ত্বের ছাত্রদের এইভাবেই উদ্বুদ্ধ করেছেন ইরাবতী কার্বে। পরবর্তী প্রজন্মকে প্রেরণা দিয়ে নতুন গবেষণার দিশা দেখিয়েছেন।
ইরাবতী কার্বে অসমের গারো পাহাড়ে ক্ষেত্রসমীক্ষায় গিয়েছেন। এক সন্ধ্যায় বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইরাবতী দেখেন যে, দূরে জঙ্গলে আগুন। স্থানীয় মানুষ জানাল এখানে এভাবেই জঙ্গল পুড়িয়ে চাষ হয়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, পশুপাখিরা? নির্লিপ্ত উত্তর এল, ‘কেউ কেউ মারা যায়, অনেকে বেঁচেও যায়।’ তাঁর মনে হল সভ্যতা তা হলে এই রকম! সবাই কৃষ্ণ আর অর্জুনের মতো খাণ্ডববনের অধিবাসীদের আগুনে পুড়িয়ে, জলে ডুবিয়ে তৈরি করবে নিজস্ব ইন্দ্রপ্রস্থ? ‘The Beginning of the End’ নিবন্ধে কৃষ্ণ আর অর্জুন– এই দুই মহাভারতীয় চরিত্রকে তিনি তুলনা করেছিলেন এ যুগের অন্যতম যুদ্ধবাজ মানুষের সঙ্গে– ‘খাণ্ডবদহনে এই দুই ধর্মযোদ্ধার ন্যায়নীতির কোনও বালাই ছিল না। তক্ষক নাগ কোনও ক্রমে বেঁচে যায়, কিন্তু হিটলার যেভাবে একটি জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন, কৃষ্ণার্জুনও সেভাবে ওই অরণ্যের সব অধিবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন।’ শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুন– মহাভারতের এই দুই নায়ককে নাকচ করে দিয়েছিল তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।

ইরাবতী নারী স্বাধীনতার পক্ষপাতী। এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির অগ্রদূত। পুণের রাস্তায় স্কুটার চালিয়ে যাতায়াত করতেন তিনি। পাঁচের দশকে কোনও মহিলা স্কুটার যাতায়াত করবে, তা ছিল অকল্পনীয়। আমাদের দেশে একটা সময় মহিলারা স্বামীদের নাম ধরে ডাকা দূরে থাক, তাদের নামও মুখে উচ্চারণ করত না! সেই সময়, স্বামীকে তিনি ‘দিনু’ বলে ডাকতেন আর দিনকর তাঁকে ‘ইরু’ বলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষতান্ত্রিকতার শেকল ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। শিক্ষা ও গবেষণার জগতে এক স্বতন্ত্র স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। নৃতত্ত্বের মতো একটা বিষয়, যেখানে মহিলাদের উৎসাহ ছিল নগণ্য, সেই বিষয়ে তিনি নিজস্ব ভাবনাচিন্তার মাধ্যমে গবেষণা করেছেন। পাশাপাশি অনুপ্রাণিত করলেন আরও অনেক নারীকে। খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি তুলে ধরেছেন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির সমাজতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক বীক্ষণ। অধ্যাপক ইরাবতী প্রেরণা দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের। দিশা দেখালেন নতুন গবেষণার। শুধু মৃত মানুষের হাড় পর্যবেক্ষণই নয়, জীবন্ত মানুষের জাতপাত বা অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সরব হওয়াও ছিল তাঁর নৃতত্ত্বচর্চার অঙ্গ।

ইরাবতী যে সময় বড় হয়ে উঠেছেন, সেই সময় নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের সমানাধিকারের দাবি নিয়ে লড়াই শুরু করেছেন। ইরাবতী বলেছিলেন, অধিকারের জন্য যদি লড়াই করতেই হয়, তাহলে সমান অধিকারের জন্য কেন করবে? লড়াই হোক আরও বেশি কিছুর জন্য। তিনি বলেছিলেন, ‘Ladies, while fighting with men for rights, why fight for only equal right. Always fight for more right.’ এই সততা ও দৃঢ়তাই ইরাবতী কার্বের অন্তর্ভূমি, যার টানে তাঁর হাত নেমে আসে পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে। আমরা প্রদীপ্ত হই।
………………………………………………………………
রোববার.ইন-এর আরও লেখা পড়ুন নিচের ক্লিক করে
প্রয়াত অভিনেতা কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিলিখন
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved