জীবশ্রেষ্ঠ তোমরাই ক্রমে বন্ধু হারাও, তারপর একদিন বিটকেল র্যাকেট কিনে এনে বন্ধ ঘরে ঢুকে একাকী লন টেনিস লন টেনিস খেলো। ভাবো, আমাদের দু’-চারটেকে মেরে বুঝি বিরাট শায়েস্তা করলে! আসলে ওই বন্ধ ঘরে তুমি নিজেই একা, আরও একা হতে থাকো। আজ বিশ্ব মশা দিবসে মশার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন শ্রীমচ্ছরচ্চন্দ্র, ওরফে সুস্নাত চৌধুরী।
বেশি বুঝে গেলে যে সমস্যাই হয়, তা ভাই তোমাদের দেখলে টের পাই। এই নাকি উন্নততম প্রাণীর ছিরি! ছোবল নয়, তোমাদের ছবি করে দিতে আমাদের এক পিস চুমুই যথেষ্ট। দিনের ঠিক সময়ে ছোট্ট একটা দংশন— আর গন্তব্য জীবন-মৃত্যুর জংশন! অমন দশাসই ব্রেন নিয়েও আমাদের মশাসই চেহারার সঙ্গে শেষমেশ এঁটে উঠতে পারলে কি? তবু দ্যাখো, তোমাদের বাড়ফট্টাই ফুরোয় না!
অন্যকে হ্যাটা করতেও তোমরা চৌখশ। সেই কবে বলেছিলে, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল!’ হেব্বি হিউমার হচ্ছে, এমন একটা ভাব নিয়ে দুম করে বলে বসলে, ‘মশা মারতে কামান দাগা!’ খুব যেন আমাদের হেয় করা হল! তারপর? আজ ঘরে ঘরে পুরকর্মী পাঠিয়ে সেই যত্রতত্র জমা জলেরই তল মাপছ বাছারা। পাড়ায় পাড়ায় পুরসভার লোক পাঠিয়ে মশকরোধী রাসায়নিকের কামান চালাতেই বাধ্য হচ্ছ। তাহলে? কীসের এত দেমাক!
এই তো মোটে কয়েক লক্ষ বছরের জীবন তোমাদের। আর আমরা? মনে করে দ্যাখো, তোমাদের জুরাসিক উদ্যানে ডাইনোদার ডিএনএ-টি কীভাবে উদ্ধার হয়েছিল? সেই যুগেও বহাল তবিয়তে ছিলাম। আজও দিব্যি আছি। ইয়াব্বড় ডাইনো কিন্তু হাওয়া হয়ে গিয়েছে। তোমরাও বা আর ক’দিন? আমরা কিন্তু থেকে যাব। যত ছোটই ঠাওরাও, আমাদের বিনাশ করার সাধ্য কারও নেই। পুরাণে ওই রক্তবীজ না কী যেন আছে তোমাদের, আমরাও হলাম কতকটা ওই গরিবের রক্তবীজ।
কেউ কেউ অবশ্য আদর করে ‘রক্তবতী’ বলেও অতীতে ডেকেছেন। তুচ্ছ প্রতিপন্ন করেননি, বরং প্রয়োজনে আপনি-আজ্ঞে করেই গুরুমশাদের প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। প্রতিটি মানুষের জীবনেই যে একটি করে ‘মশা-প্রভু’ থাকে, তা-ও খোলসা করতে ভোলেননি। বিশ্বাস হচ্ছে না? নমুনা চাই? তোমাদের মতো বাগাড়ম্বর না করে সংক্ষেপকৃত সংস্করণ থেকেই সাঁটে তুলে দিচ্ছি–
মশা বললেন, ‘তুমি কোন মশার সম্পত্তি?’ এ-কথা শুনে কঙ্কাবতী তো অবাক! তখন মশা বুঝিয়ে বললেন, মশারা কে কার রক্ত খাবে ঠিক করে মানুষদের ভাগাভাগি করে নেয়। এখন কঙ্কাবতী কোন মশার সম্পত্তি সেটা জানা দরকার। নইলে পরের সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপের অধিকার তো থাকতে পারে না।
আমাদের এই নীতিবোধ, সমষ্টির প্রতি সমানাধিকারের দিকটিও তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় হে! তা নইলে রোনাল্ড রস্ থেকে ঘনশ্যাম ডস্– এমনসব মহামহিম বস্ কি আর যুগে যুগে আমাদের পিনপিনে ডানায় জুড়ে থাকতে চান! অথচ তোমরা, আজকের নাদান মানুষের ছা, কী র্যালাটাই না করো! সন্ধের মুখে মাঠেঘাটে তোমাদের মাথার উপরে আমরা যখন চক্কর কাটি, সুউচ্চ মোবাইল টাওয়ার নির্মাণ করি, তোমরা তখন বেয়াক্কেলের মতো অন্য বন্ধুর মুখের কাছে অশ্লীল স্বরে ‘চু-উ-উ’ ডেকে আসো। বিবাদ না বাড়িয়ে আমরাও বাধ্যত এ মাথা থেকে ও মাথা উড়ে গিয়ে জুড়ে বসি। কিন্তু জোট ভাঙি না– একত্রে যাই, সমষ্টিগতভাবে। অথচ জীবশ্রেষ্ঠ তোমরাই ক্রমে বন্ধু হারাও, তারপর একদিন বিটকেল র্যাকেট কিনে এনে বন্ধ ঘরে ঢুকে একাকী লন টেনিস লন টেনিস খেলো। ভাবো, আমাদের দু’-চারটেকে মেরে বুঝি বিরাট শায়েস্তা করলে! আসলে ওই বন্ধ ঘরে তুমি নিজেই একা, আরও একা হতে থাকো।
তবে কি না, এসব গূঢ় কথা তোমাদের শুনিয়ে লাভ নেই। ‘ডেঙ্গু’ না ‘ডেঙ্গি’– বানান কী লিখবে, সেটুকু ঠিক করতেই যা ল্যাজেগোবরে দশা! যদিও তোমাদের ল্যাজ ও গোবর ঠিক কোনখানে থাকে, আমরা জানি না। জানি না তো জানি না, তাই বলে সবজান্তা সাজতে পারব না। তোমাদের ব্যাকরণ বইয়ের মতো নিজের নামটিকেও সন্ধিবিচ্ছেদ করে ‘শ্রীমৎ শরচ্চন্দ্র’ পণ্ডিত ঠাওরে নেব, এমন মনুষ্যসম বেয়াকুব আমরা নই। গুড মর্নিং, আপাতত আসি। রাতে দেখা হবে খন– কানে কানে গানে গানে। মশারি, মসকুইটো রিপেলেন্ট, খেলনা র্যাকেট– ঢাল-তলোয়ার আর যা যা পারো, নিয়ে রেডি থেকো।