Robbar

আমার প্রথম দেখা একজন পারফর্মার, যিনি ভীষণ প্রাকৃতিক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 21, 2025 11:26 am
  • Updated:February 21, 2025 11:26 am  

প্রতুলদার গানে প্রয়োজন নেই কোনও অলংকারের, গাছের মতোই স্পষ্ট, সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত, সহজ, সুন্দর যে গান একটা মঞ্চে একা একটা মানুষ দাঁড়িয়ে তাঁর নিজস্ব ইচ্ছা-অনুভূতিতে ভরপুর এতটাই মাতোয়ারা যে গোটা মঞ্চ আলোকিত থাকলেও ফোকাসে তাঁকে ছাড়া আর বাকি অংশটুকু গোচরে আসে না। তাঁর দিকেই নিবিষ্ট হয়ে যায় মন, একটা গোটা স্পেসকে গিলে খেয়ে ফেলছে মাঝারি উচ্চতার, রোগাসোগা একটা মানুষ, যাঁর কণ্ঠ কোনওভাবেই কারও সঙ্গে মেলে না। আমি যতটুকু দেশ বিদেশের গান-বাজনা শুনতে পেরেছি আজ পর্যন্ত– প্রতুলদা পৃথিবীতে একটাই।

প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক

শিলাজিৎ

১৯৯০ বা ’৯১ হবে, মৌলালি যুবকেন্দ্রে কল্যাণ সেন বরাটের কল্যাণে আমার একটা গান গাওয়ার মওকা এসেছিল। ছোট্ট অডিটোরিয়াম, খুব বেশি হলে দুশো-আড়াইশো শ্রোতা। ভোলাদা– অর্থাৎ ভোলানাথ ভট্টাচার্যের সুপারিশে সুযোগ পেয়ে হাজির হয়েছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার লাল রঙের টি-শার্টে লেখা ছিল ‘বেশ করেছি’। তখন, এখনকার মতো বুকে বাংলা লেখা নিয়ে ঘোরার মতো লোক কমই ছিল। ফলে নজরে পড়েছিল লোকের। অপেক্ষা করছিলাম কখন আমার ডাক পড়ে। মঞ্চে একের পর এক প্রথিতযশা শিল্পীদের ওঠানামা। দুরু দুরু বুক নিয়ে তাঁদের গান গ্রহণ করছি, আর ভাবছি এবার বোধহয় আমার ডাক পড়ল বলে! সত্যিই আমার মনে নেই সেদিন কারা কারা গান গেয়েছিলেন, কিন্তু সবাই যন্ত্রানুষঙ্গ সমেত গান গেয়েছিলেন, ভালোই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ হিসেব গেল বদলে।

Stream Rumi Ahmed | Listen to pratul mukhopadhyay playlist online for free on SoundCloud

একটা মানুষকে দেখলাম মঞ্চে উঠলেন আর বাকি মিউজিশিয়ানরা মঞ্চ দিলেন ছেড়ে। আমি প্রথম দেখলাম একটা মানুষ একাই গান গাইছেন নিজের খেয়ালে, আর তাঁর সে খেয়াল যেন বিঘ্নিত না হয়, তাই একাই পরিবেশন করছেন তাঁর গান, যা তাঁরই গান, তাঁরই তাল, তাঁরই সুর, তাঁরই ভঙ্গি, তাঁরই পরিবেশনা– একান্ত একার। নিজের শুধু নয়, একলা পথ চলার উপায় খুঁজে নেওয়া একটা মানুষ, নিজের সাংগীতিক ভাবের সঙ্গে অন্য কারও সঙ্গতে তাঁর যে অনীহা, তা যেন ঠিকরে বেরচ্ছিল। কে সঙ্গত করবে ঢেউয়ের সঙ্গে, যার কোনও ঠিক নেই, ঠিকানা নেই? কে সঙ্গত করতে পারে মেঘের আচমকা আনাগোনার সঙ্গে?

…………………………………….

আমরা গান গাইতে গেলে ভাবতে থাকি– কোথায় গাইব, কী কী টেকনোলজিকাল সুবিধে পাব, অ্যাকস্টিক কীরকম যেখানে পারফর্ম করব, কত মানুষ থাকবে, কীভাবে পৌঁছব তাদের কাছে। প্রতুলদার কাছে এসব কিছুই ম্যাটার করেনি।

………………………………………

আমার প্রথম দেখা একজন পারফর্মার, যিনি নদীর স্রোতের মতোই প্রাকৃতিক, ভীষণ প্রাকৃতিক। তাঁর গানে প্রয়োজন নেই কোনও অলংকারের, গাছের মতোই স্পষ্ট, সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত, সহজ, সুন্দর যে গান, একটা মঞ্চে একা একটা মানুষ দাঁড়িয়ে তাঁর নিজস্ব ইচ্ছা-অনুভূতিতে ভরপুর এতটাই মাতোয়ারা যে, গোটা মঞ্চ আলোকিত থাকলেও ফোকাসে তাঁকে ছাড়া আর বাকি অংশটুকু গোচরে আসে না। তাঁর দিকেই নিবিষ্ট হয়ে যায় মন, একটা গোটা স্পেসকে গিলে খেয়ে ফেলছে মাঝারি উচ্চতার, রোগাসোগা একটা মানুষ, যাঁর কণ্ঠ কোনওভাবেই কারও সঙ্গে মেলে না। আলাদা, ভীষণ আলাদা, কঠোরভাবে আলাদা সে যে যা-ই বলুক যে ভাবেই ব্যাখ্যা করুক, তাঁর অন্য টিম্বারকে নিয়ে মজা করুক– কণ্ঠ, দর্শন, গান নিয়ে ভাবনা– গানের শরীর নিয়ে ভাবনা অপ্রতুল শুধু নয়– আমি যতটুকু দেশ বিদেশের গান-বাজনা শুনতে পেরেছি আজ পর্যন্ত– প্রতুলদা পৃথিবীতে একটাই মনে হয়েছে। আর এই ‘আলাদাত্ব’ তাঁর কেবলমাত্র এই একা গান গাওয়ার প্রেজেন্টেশনে নয়, তার বীজ বোধহয় লুকিয়ে আছে আরও গভীরে।

আমরা গান গাইতে গেলে ভাবতে থাকি– কোথায় গাইব, কী কী টেকনোলজিকাল সুবিধে পাব, অ্যাকস্টিক কীরকম যেখানে পারফর্ম করব, কত মানুষ থাকবে, কীভাবে পৌঁছব তাদের কাছে। প্রতুলদার কাছে এসব কিছুই ম্যাটার করেনি, কে থাকল না থাকল ভীষণ গোপনে চলতে থাকা রসায়ন যে কোনও জায়গায় যে কোনও ভিড়ে-সাংঘাতিক কোলাহলের মধ্যেও নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার না করার অঙ্গীকার– প্রতুলদার দর্শন, এটা আমার মনে হয়।

যতবার প্রতুলদাকে মঞ্চে দেখেছি– ততবার নিজের বিশ্বাসে চিড় ধরেছে, দেখে মনে হয়েছে এই মানুষটার মতো আনকম্প্রোমাইজিং হতে পারলে বর্তে যেতাম। কী সাংঘাতিক বিশ্বাস তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি! নিজেকে কতটা স্বাভাবিক, কতটা প্রাকৃতিক ভাবতে পারলে তবে একটা মানুষ একলা চলতে পারে, হতাশায় নয়, দুঃখে নয়, যন্ত্রণায় নয়, নিজের ইচ্ছেয় নিজেকে পাখির মতো স্বাধীন স্বাভাবিক ভাবার ক্ষমতার জোরে।

মিটিং, মিছিল, জনসভা বা ধোপদুরস্ত আসর– হাওড়ার ব্রিজের কোলাহলে হোক বা একা নিজস্ব শান্তিতে, প্রতুলদা সাবলীল শুধু নয়, আত্মমগ্ন একটা সন্ন্যাসীর মতোই বেপরোয়া। বয়ে গেল তাঁর, পাখির কি কিছু আসে যায় তার যখন প্রাণ উথলে ওঠে কিছু বলার জন্য? সে ডাকে, প্রতুলদাও ডাকতেন।

কোথাও গান গাইতে বললে সব গায়কই সঙ্গত খোঁজে, কোনও না কোনও একটা সুর বা তালের সঙ্গত। অন্ততপক্ষে আর কিছু পাক না পাক– একটু নিস্তব্ধতা সংযোগ করতে হয়। প্রতুলদার এসবের প্রয়োজন হত না। আশপাশের কোলাহল মানার, কাউকে তোয়াক্কা করার প্রয়োজন পড়েনি। হাটে, মাঠে, ঘাটে, মিটিংয়ে, মিছিলে কোলাহলের মধ্যে তাঁর গান ঠিকরে বেরোত। সব সময়ই গান হয়ে ঘুরে বেড়াত।

এতটা গানকে গভীরে নেওয়ার চেষ্টা, সুর-তালকে শরীরের গোপনে গোপনে আপসহীনভাবে পোষ মানানোর চেষ্টা– এ যেন গানের সন্ন্যাসী। কিন্তু সেই গাম্ভীর্য ছিল না তাঁর রসিকতায়, আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘শিলা আমাদের শ্রোতাদেরও শেখা উচিত বুঝলি, এক জায়গায় গান গাইতে গেছি বুঝলি– একজন সামনের সারিতে বসা ভদ্রলোককে বলেছি তাল মেলাতে, তিনি পরে গ্রিনরুমে এসে আমাকে বললেন, আমি প্রেসিডেন্ট; আপনি আমাকে হাততালি দিতে বলছেন? ভাব তুই, দর্শক যদি প্রেসিডেন্ট হয়ে যায় কী মুশকিল গানের।’

Renowned Bengali Singer Pratul Mukhopadhyay Dies At 82

প্রথম আলাপে আমাকে প্রতুলদা বলেছিল, তুমি ‘ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা’ বললে কেন?’ আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলাম, একটু আমতা করতে করতেই, বললেন, “তোমার ‘ঘুম পেয়েছে অফিস যা’ বলা উচিত ছিল। বাঙালি তো ওখানেই ঘুমোয়” বলেই কারও অপেক্ষায় না থেকে নিজেই হো হো করে নিজের ঠাট্টাতেই হেসে উঠলেন প্রতুলদা। সে হাসি যাঁরা দেখেছেন সামনে থেকে, তাঁরা নিশ্চয়ই এখন দেখতে পারছেন প্রতুলদা হাসছেন, ওই শিশুসুলভ হাসিটাই ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে।

চোখের সামনে প্রতুলদা বলতে অনেক কিছুই ভেসে আসে, নানা মুদ্রা, নানা ভঙ্গি, নানা মুহূর্ত, কারও কারও মন গান গায়, কারও গলা গান গায়, কারও হৃদয়, কারও মাথা গান গায়, প্রতুলদার সারা শরীরটা ছিল গান। এক শরীর গান। এ পৃথিবীতে এরকম একজনই কি না জানতে ভালো করে গুগল করতে হবে, কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় এরকম শিল্পী অপ্রতুল।