ব্রিটিশ সরকার যে তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করতে বাধ্য হয়েছিল, সেটি শশীচন্দ্রের জীবনের একটি চূড়ান্ত ব্যঙ্গ-উপাখ্যানের মতো শোনালেও, এর গভীরে রয়েছে এক বিপ্লবী শ্রদ্ধা। কারণ এই উপাধি তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে। শাসকের বিরুদ্ধে কলম চালিয়ে, তাদের মুখোশ খুলে দেখিয়ে– তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়, ভিক্ষা করে নয়।
ধরুন, আপনার সামনে একটা দরজা। খুললেই ভবিষ্যতের আলো, সম্ভাবনার বিস্তার। আপনি দক্ষ, সৎ এবং প্রস্তুত ওই দরজা খোলার জন্যে। তবু হঠাৎ কেউ এসে আপনার জাত, বর্ণ, দেশজ পরিচয় তুলে ধরে সেই দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিল। বলল, “আপনি একজন ‘নেটিভ’। আপনি যোগ্য হলেও আদরযোগ্য নন।”
আপনি কি তখন মাথা নিচু করবেন? আপনি কী করবেন সেটা জানা নেই, তবে শশীচন্দ্র দত্ত করেননি। কে এই দত্তমশাই? তিনি কী করেছিলেন? তিনি মাথা উঁচু করে, কলমটাকে তীক্ষ্ণ করে তুলেছিলেন অস্ত্রের মতো। তিনি ব্রিটিশ সাহেবদের মুখের ওপর হেসে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার পথ আটকাতে পারো, কিন্তু আমার কলম নয়। তোমরা আমার পদোন্নতি আটকাতে পারো, কিন্তু আমার প্রতিবাদ না।’
তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম দিকের ‘মসিযোদ্ধা’, যাঁর কলম শুধু কালির টান নয়, ছিল ঘৃণার বিস্ফোরণ, ছিল আত্মমর্যাদার উল্কাপাত।
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ। জন্মস্থল রামবাগান। কলকাতার কাছেই। প্রায় ২০০ বছর আগে। বেশ কিছু পরে হিন্দু কলেজে আলোড়ন তুলবেন ইয়ং বেঙ্গলরা। তাঁর জন্মের সময় বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল দুই মতের দ্বন্দ্ব। একদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার ঢেউ, অন্যদিকে প্রাচ্য ঐতিহ্যের প্রবল আবেগ। আর এর মাঝেই জন্ম হয় তাঁর, যিনি দুই ধারার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, নিজের অভিজ্ঞতা ও বোধ থেকে এক তৃতীয় চিন্তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বাঙালির আত্মপরিচয় তখন আবছা আয়নায়– শশীচন্দ্র তাতে আনলেন ধারালো সংজ্ঞা।
হিন্দু কলেজ থেকে পাশ করে তিনি পা রাখেন এক অদৃশ্য লড়াইয়ের প্রাঙ্গণে। ইংরেজ আমলে সরকারি চাকরি। প্রথমে ট্রেজারিতে কেরানি হিসেবে যোগ দেন। ক্রমে দক্ষতায়, নিষ্ঠায়, সততায় উন্নীত হন হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের উপযুক্ত দাবিদার হিসেবে। কিন্তু পদে পদে ‘নেটিভ’ পরিচয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজদের বৈষম্য ও অহংকার।
শশীচন্দ্র দেখলেন, জলের উপর পাতার মতো ভাসছে ন্যায়বিচার, অথচ নিচে গহীন অন্যায়ের ঘূর্ণি। গভর্নর জর্জ ক্যাম্পবেল, যিনি ছিলেন ঔপনিবেশিক রাজার প্রতীক, কেবলমাত্র তাঁর ‘দেশজ’ পরিচয়ের কারণে উন্নতির পথ রুদ্ধ করে দিলেন। সেই আঘাত যেন শশীচন্দ্রের অন্তরে এক বিস্ফোরক আগ্নেয়গিরি জাগিয়ে তোলে। সেই মুহূর্তে শশীচন্দ্র বোঝেন– সিস্টেমটাই রুগ্ন আর রুগ্ন সিস্টেমে চাকরি নয়, দরকার যুদ্ধ।
এই ক্ষত বুকে নিয়েই শশীচন্দ্র বুঝলেন অফিসের কেরানি নয়, চাই কলমের যোদ্ধা হওয়া। আর এই উপলব্ধি তাঁকে চাকরির পাট চুকিয়ে নতুন এক সংগ্রামের পথে নিয়ে যায়– সাংবাদিকতার রণক্ষেত্রে। তিনি চাকরি ছাড়লেন, মাথা নিচু করে নয়– কলম উঁচু করে।
একদিন যাঁর হাত কেরানির রেজিস্টারে নাম লিখত, আজ তাঁর সেই হাত ধরে কলমে বেরয় বিদ্রোহী আগুন। ‘মুখার্জীস ম্যাগাজিন’-এর পাতায় পাতায় তিনি ব্রিটিশ রাজপুরুষদের মুখোশ খুলে দিতে থাকেন। তাঁর লেখা ‘Reminiscence of a Clerk’s Life’ যেন একটা জ্বলন্ত দলিল– কীভাবে ব্রিটিশ অফিসাররা একজন সৎ কর্মচারীকেও পিষে ফেলে নোংরা পক্ষপাতের চক্রে। তারপর এল ‘Shankar: A Tale of the Indian Mutiny’– এই বইটি ছিল যেন রক্তমাখা ঝড়ের গান। তাঁর কলমে ধরা পড়ে, ‘রাজদ্রোহী’ তকমা দিয়ে কীভাবে ব্রিটিশ সৈন্যরা সাধারণ নারী-পুরুষদের হত্যা করেছে বেয়নেট দিয়ে, ধর্ষণ করেছে, লুট করেছে অলংকার, ছিঁড়ে নিয়েছে কানের দুল, কেটেছে নাক; আর সেইসব গহনা নিলামে বিক্রি করে দিয়েছে ‘সরকারি অনুমোদন’ নিয়ে। আর সেই ভয়াবহতার তারা নাম দিয়েছে ‘ন্যায়’। এর বিরুদ্ধে শশীচন্দ্রের কলম যেন এক দ্রোহের ডায়েরি– যার প্রতিটি বাক্যে আগুন, প্রতিটি শব্দে বিদ্রোহ।
শশীচন্দ্রের ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা ছিল পরিষ্কার, তীক্ষ্ণ এবং তীব্র। মধুসূদনের মতো ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসনের গভীর প্রভাব পড়েছিল তাঁর জীবনে। ইংরেজরাও জানতেন, এই মানুষটি অগ্নিশর্মা। অ্যাশলি ইডেন, আরস্কিন পেরি প্রমুখ ইংরেজ অফিসাররা তাঁর ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁকে তাঁরা ‘ভয়ংকর নেটিভ’ বলে মনে করতেন। তাঁর লেখা ‘Vision of Sumerie’ গ্রন্থ আরও এক সাহসী পদক্ষেপ, যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তঃসারশূন্য ভণ্ডামি। তবে তাঁর কলম কেবল বিদ্রোহী চেতনায় থেমে থাকেনি। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘Tales of Yore’ তাতে এক সাহিত্যিক সত্তার স্পষ্ট স্বাক্ষর। উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ– সবক্ষেত্রেই তাঁর কলম ছিল নিখুঁত এক ধারালো তরবারির মতো।
ব্রিটিশ সরকার যে তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করতে বাধ্য হয়েছিল, সেটি শশীচন্দ্রের জীবনের একটি চূড়ান্ত ব্যঙ্গ-উপাখ্যানের মতো শোনালেও, এর গভীরে রয়েছে এক বিপ্লবী শ্রদ্ধা। কারণ এই উপাধি তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে। শাসকের বিরুদ্ধে কলম চালিয়ে, তাদের মুখোশ খুলে দেখিয়ে– তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়, ভিক্ষা করে নয়। শশীচন্দ্র দত্তের জীবনের আরেকটি দিগন্ত আজও বিশেষ গুরুত্বে দীপ্তিমান, এ দেশের মানুষের মধ্যে সামরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করতেন, শৃঙ্খলা ও সাহসের অনুশীলন একদিন জাতিকে এনে দেবে মুক্তির পথ । এক আশ্চর্য দূরদর্শিতায় তিনি বলেছিলেন–
‘The occasion may arise when it will be of inestimable value to them.’
অর্থাৎ, এমন একটি সময় আসতে পারে, যখন এই সামরিক প্রশিক্ষণ অমূল্য হয়ে উঠবে জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে। এই উচ্চারণ কি নিছক ভবিষ্যদ্বাণী? না, তা ছিল এক জাতীয় বোধের আগ্নেয় আহ্বান– যেখানে পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন ভারতের এক পূর্ণ স্বপ্ন দোল খাচ্ছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে চাই প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, চাই শৃঙ্খলাবদ্ধ সাহসিকতা।
তাঁর সেই প্রগাঢ় চিন্তার প্রতিধ্বনি আমরা দেখি বহু বছর পর, ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর বজ্রনিনাদে। সেই বাহিনীতে ছিল না কেবল অস্ত্রধারী সৈনিকদের সমাবেশ– ছিল এক জাতির অন্তরাত্মা থেকে উঠে আসা আগ্নেয় শপথ, এক দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ।
এখন স্বাধীনতার ৭৮ বছরে যদি আমরা আবার ফিরে তাকাই সেদিকে দেখব কে ছিল সেই আগুন জ্বালানো মানুষটি? যাঁর চিৎকার মিশে ছিল নিস্তব্ধ রাত্রির স্তব্ধতায়? শশীচন্দ্র ছিলেন সেই বিস্মৃত সূর্যসন্তান, যাঁর চিন্তা ছিল ভবিষ্যতের ব্যাটালিয়নের শুদ্ধ মন্ত্র, যাঁর ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছিল একটি সাহসী স্বপ্নের রূপরেখা। তিনি শুধু কলমের সৈনিক ছিলেন না, ছিলেন অস্ত্রের প্রয়োজন বোঝা এক তীক্ষ্ণদৃষ্টি প্রণেতা।
এই কালে, যখন নির্ভীক সাংবাদিকতা নিয়ে কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, তখন শশীচন্দ্রের জীবন যেন এক প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেন জাগো, প্রশ্ন করো, প্রতিবাদ করো। তাঁর বলা সেই সতর্কতাবাণী আজও প্রাসঙ্গিক: ‘Some day a coalition might force England to leave India… তখন আধুনিক সমরবিদ্যায় শিক্ষিত ভারতীয়ের অতীব প্রয়োজন দেখা দেবে।’
আকাশে তারা অনেক– শশীচন্দ্র দত্ত তেমনই একটি তারা, যাঁর আলো হয়তো নীল আকাশে চোখে পড়ে না, কিন্তু ইতিহাসের অন্ধকার গুহায় পথ দেখায়। তাই নটিংহ্যাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির অ্যালেক্স টিকেল বিদেশি হয়েও যেভাবে শশীচন্দ্রের রচনা সংকলন করেছেন, আমরা তা পারিনি, চেষ্টাও করা হয়নি। অথচ তাঁর জীবন এক শিক্ষাপাঠ– কীভাবে আত্মমর্যাদা, সততা ও দেশপ্রেমকে এক সুতোয় বেঁধে জীবনের পরতে পরতে লেখা যায় এক সত্যনিষ্ঠ মহাকাব্য। সুবিখ্যাত রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র।
শশীচন্দ্র যেমন নিজের জীবনের দর্পণ ধরে দেখিয়েছেন, কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়, তেমনি আজকের ভারতবাসীকেও মনে করিয়ে দেন– সত্য, ন্যায়, ও সাহসের পথ কখনওই সহজ নয়, কিন্তু সেই পথেই হেঁটে আসে সত্যিকার স্বাধীনতা।
২০২৪ নির্বাচনে বিজেপি যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, তার পিছনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিডিয়া চ্যানেলগুলির বিপুল ভূমিকা ছিল। তাদের ওপর কীরকম কোপ পড়বে, সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ, রণবীর-সময়কে ঢাল করে, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা বাতিলের দাবিটিকে অস্ত্র করে আদপে দেশের সমস্ত ওটিটি, সোশাল মিডিয়ার ওপরে নজরদারি চালাবে সরকার।