Robbar

রাষ্ট্র শকুনের মতো, শিকার করে না, মৃত্যুর অপেক্ষা করে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 6, 2025 4:40 pm
  • Updated:September 6, 2025 6:27 pm  
similarities between vulture and fascist states by Utsa Sarmin

স্বাধীন ভারতে কোভিড-১৯ মহামারির সময়, যখন লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন তখন রাষ্ট্র এবং উচ্চবিত্ত সমাজ নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দিনের পর দিন খাবার, যানবাহন না পেয়ে এবং রাজনৈতিক উদাসীনতার ফলে প্রায় ২০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এই মহামারি, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর যেমন এক চরম চাপ সৃষ্টি করেছিল, তেমনই তা রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা, নীতিগত ভুল এবং শ্রেণিবৈষম্যের একটি মুখোশ উন্মোচন করেছিল। রাজনৈতিক এবং ওষুধ ব্যবসায়ীদের জুলুমে দেশ শকুনের খাদ্যে রূপান্তরিত হয়েছিল। ভুক্তভোগীরা বেশিরভাগই ছিলেন প্রান্তিক।

গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক

উৎসা সারমিন

১৯৯৩ সালে দক্ষিণ সুদানে দুর্ভিক্ষের সময় চিত্র সাংবাদিক কেভিন কার্টারের তোলা ছবিটি এখনও আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া এক কঙ্কালসার শিশু ও তার মৃত্যুর অপেক্ষায় কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শকুন। প্রাণ গেলেই ছোঁ মেরে মৃত শরীরটিকে খাদ্যে পরিণত করবে।

আজ বিশ্ব শকুন দিবসে মনে পড়ে যায় ছবিটা। তার সঙ্গে মনে পড়ে গাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের কথা, যাঁরা আজ দু’-বছরের যুদ্ধ এবং হিংস্রতার তীব্র প্রকটের পর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছেন।

চিত্র সাংবাদিক কেভিন কার্টারের তোলা সেই ছবি

কার্টারের ছবিটি শুধু খিদে বা মৃত্যু নয়, প্রকাশ করে এক মর্মান্তিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক সত্য। মৃত্যুর পূর্বাভাস এবং দুনিয়ার নীরব নিষ্ক্রিয়তা। শকুনটি শুধুই একটি পাখি না, সে একটি প্রতীক। আমাদের উদাসীনতা, সরকার, কূটনীতি, মানবিকতার ব্যর্থতা এবং আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তার। শকুন যেখানে হাজির, সেখানে বোঝা যায় যে, বাঁচানোর আর উপায় নেই।

২০২৩-এর অক্টোবরে শুরু হয়েছিল ইজরায়েলের নির্মম পীড়ন ও অবরোধ। গত দু’-বছরে বহু বিশেষজ্ঞ, সাধারণ মানুষ এবং সমাজকর্মী বারবার বিভিন্ন দেশের সরকার এবং বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাদের সতর্ক করে গেছেন আসন্ন দুর্ভিক্ষ নিয়ে। তাঁরা বলেছিলেন– খাবার, ওষুধ এবং জ্বালানি গাজার মানুষের কাছে পৌঁছতে দেওয়া না হলে, শুধু যুদ্ধ নয়, খিদে হবে এই সংঘর্ষের নীরব অস্ত্র।

ফলে গেছে সেই সতর্কবাণী। আজ প্রায় দু’-বছর পর জাতিসংঘের ‘Integrated Food Security Phase Classification’ (IPC) গাজাতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। মানুষের তৈরি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। ২০০৪-এ IPC গঠনের পর মাত্র চারবার ঘোষিত হয় এরকম দুর্ভিক্ষের। এতটাই তার ভয়াবহতা! গাজাতে এখন প্রায় পাঁচ লক্ষেরও বেশি লোক এই মনুষ্য-সৃষ্ট আকালের কবলে। সেপ্টেম্বরেই নাকি এই সংখ্যা বেড়ে ছয় লাখের ওপর হয়ে যাবে। ইজরায়েল তো বটেই, এমনকী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার নিষ্ক্রিয় ব্যবহার এত মানুষকে মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার মধ্যে শকুনের ছায়া চোখে পড়ে। একটি কৃত্রিম, সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হিংস্রতার ছায়া। দুর্ভিক্ষ, খাদ্যের সংকট, কখনওই পুরোপুরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি রাজনৈতিক, কাঠামোগত ও সামাজিক ব্যর্থতার ফলাফল।

গাজায় দুর্ভিক্ষের এটাই চেনা দৃশ্য

আজ গাজা ছাড়াও সুদানেও দেখা গেছে দুর্ভিক্ষ। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হয় সুদানের গৃহযুদ্ধ। ইজরায়েলের মতো সুদানের সৈন্যবাহিনী আটকে দিয়েছে মানবিক সাহায্য। খাবার, ওষুধ পৌছতে পারছে না মানুষের কাছে। ‘World Food Programme’-এর মতে, সুদানের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা, প্রায় দুই কোটি মানুষ চরম খাদ্যের সংকটে ভুগছে। এছাড়া আফ্রিকার দক্ষিণ সুদান, মালি ও দক্ষিণ আমেরিকার হাইতিতেও এখন দুর্ভিক্ষময় অবস্থা।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে শকুন কারা? কেবল সেই পক্ষ যারা অস্ত্র ছোঁড়ে, নাকি তারাও যারা চুপ করে দেখে? যারা জানে কী ঘটছে, তবু পদক্ষেপ নেয় না? শকুন নিজে কখনও শিকার করে না, কিন্তু মৃত্যুর সময় আবির্ভূত হয়। অপেক্ষা করে, চক্কর কাটে, এবং শরীর একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেলে নেমে আসে।

ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, ফ্যাসিবাদী সরকার ও দমনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ঠিক সেই শকুনের মতো আচরণ করেছে। নিজে হত্যা না করে, মৃত্যুকে নিশ্চিত করা, অপেক্ষা করা নিঃশেষ হওয়ার জন্য। খাদ্য সরবরাহ আটকে, চিকিৎসা ব্যাহত করে, অবরোধ তৈরি করে ধীরে ধীরে এক জনগোষ্ঠীকে দুর্বল করে তোলে আধুনিক কালের শকুনি ফ্যাসিবাদ। এখানে মানুষের প্রাণের মূল্য নেই। মৌলিক অধিকারেরও কোনও জায়গাও বেঁচে থাকে না।

শিল্পী: জয়নুল আবেদিন

ব্রিটিশ শাসনের সময় কুখ্যাত সেই ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের ফল আমরা, বাঙালিরা, এখনো শরীরে বহন করি। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের আদেশে ভারতের খাবার পাচার করা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যদি ইউরোপের খাবার কম পড়ে, সেই ভয়ে। বাংলায় তাই তৈরি হয় এক দুর্ভিক্ষের হাহাকার। জাতিবৈশিষ্ট্যবাদী চার্চিল পছন্দ করতেন না ভারতীয়দের। বাঙালিদের মৃত্যুও নাড়া দেয়নি পৃথিবীকে।

তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ছবি। সূত্র: ইন্টারনেট

স্বাধীন ভারতে কোভিড-১৯ মহামারির সময়, যখন লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন তখন রাষ্ট্র এবং উচ্চবিত্ত সমাজ নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দিনের পর দিন খাবার, যানবাহন না পেয়ে এবং রাজনৈতিক উদাসীনতার ফলে প্রায় ২০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এই মহামারি, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর যেমন এক চরম চাপ সৃষ্টি করেছিল, তেমনই তা রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা, নীতিগত ভুল এবং শ্রেণিবৈষম্যের একটি মুখোশ উন্মোচন করেছিল। রাজনৈতিক এবং ওষুধ ব্যবসায়ীদের জুলুমে দেশ শকুনের খাদ্যে রূপান্তরিত হয়েছিল। ভুক্তভোগীরা বেশিরভাগই ছিলেন প্রান্তিক।

কোভিডের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে ফেরা। সূত্র: ইন্টারনেট

শকুন ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে নেয়। লাশকে নিজের খাদ্যে পরিণত করে সে পরিবেশে ভারসাম্য আনে। মৃতদেহ পচে রোগজীবাণুতে পরিণত হয় না শকুনের জন্য। আমাদের রাষ্ট্রীয় এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও অনেকটা সেইরকমভাবেই কাজ করে। তারা যাদের মনে করে সমাজের জীবাণু, প্রাথমিকভাবে নিম্নশ্রেণির এবং প্রান্তিক মানুষদের, তাঁদের ঠেলে দেয় মৃত্যুর দোরগোড়ায়। সমাজ পরিষ্কার করার জন্য। প্রান্তিক মানুষদের শরীর ও তাঁদের জীবনাচরণের মধ্যে মৃত্যুর আভাস খুঁজে পায় কট্টর শাসক সম্প্রদায়। দেশে, পৃথিবীতে যাতে শুধু উচ্চবর্ণের, উচ্চশ্রেণির মানুষ থাকে, তারই প্রচেষ্টায় নিম্নবর্ণ ও নিম্নবিত্ত মানুষের ওপর শকুনরূপী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

শকুনতন্ত্রের আর এক বৈশিষ্ট্য আকাশ থেকে নজর রাখা। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিচে নেমে আসা। আজকের সোশাল মিডিয়ার যুগে ৬-৭ ইঞ্চির পর্দায় ঘাড় নিচু করে উদাসীনভাবে মানুষের কষ্ট দেখা এবং ঠিক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আঙ্গুল টিপে দুর্ভোগকে কনটেন্টে রূপান্তর করে বাহবা কুড়িয়ে নেওয়া, এসবই পাখি-সুলভ আচরণ।

বিশ্বে দুর্ভিক্ষ বাড়ছে, খাদ্য এবং চিকিৎসা হয়ে উঠছে সুবিধাবাদীদের হাতিয়ার। খাদ্যের ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার আজ প্রায় নিঃস্ব। তাই আজকের শকুন শুধু মৃত্যুর পরে আসে না, সে আসলে এই প্রক্রিয়ারই অংশ, যেটা মৃত্যুকে সম্ভব করে তোলে, তরান্বিত করে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো নিজেরা শিকার করে না, কিন্তু অবাঞ্ছিত মানুষকে ভাগাড়ে ঠেলে দিয়ে মৃত্যুর পর্যবেক্ষণ করে, তার আশায় বসে থাকে এবং মৃত্যু নিশ্চিত হলে তবেই নেমে আসে লাভের উৎসব আয়োজনে হিসেবের ভাগ নিতে।

বিশ্ব শকুন দিবসে তাই শুধু পাখিদের কথা নয়, আলোচনায় আসা দরকার সেই আজকের শকুনতন্ত্রের তথা ফ্যাসিবাদের, একনায়কতন্ত্রের উৎপীড়নের কথা। যারা কেবল শাসক সম্প্রদায়ের লাভ খোঁজে, এবং নাগরিকের মৃত্যুকে স্বাভাবিক করে তোলে। রাষ্ট্র যখন মৃত্যুকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য, কর্পোরেট যখন মুনাফার দিকে তাকিয়ে মনুষ্যত্ব ত্যাগ করে, কিংবা সমাজ যখন বারবার ট্র্যাজেডিকে বিনোদনের মতো গ্রহণ করে, তখনই শকুনের ছায়া আমাদের ওপর এসে পড়ে সমাপ্তির অপেক্ষায়।

…………………….

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

…………………….