১৫১৭ সালেই ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস চার হাজার স্বর্ণমুদ্রায় কিনেছিলেন বিশ্বখ্যাত ছবিটি। যা মোটামুটি ৪ কেজি সোনার সমতুল্য। পরবর্তী সময়ে মোনালিসার মালিক হন নেপোলিয়ন। তাঁর মৃত্যুর পর ল্যুভর মিউজিয়মে রাখা হয় ছবিটি। ততদিনে তা ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বে কার্যতই অমূল্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিশ শতকে আচমকাই যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল মোনালিসা!
সারা পৃথিবীর মানুষ তার মুখ চেনে। তাকে ভালবাসতে হলে ছবি বোঝা বা না বোঝার কোনও শর্ত পেরিয়ে আসতে হয় না। সৃষ্টির ৭০০ বছর পরও মোনালিসার হাসি ও দৃষ্টির ম্যাজিক আচ্ছন্ন করে রেখেছে সবাইকে। অথচ এই ছবিই কিনা বারবার আক্রান্ত হয়েছে! পাথর থেকে চায়ের কাপ– কী না ছোড়া হয়েছে প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়মে রাখা মোনালিসার আসল পোর্ট্রেটের দিকে। তবে ভিনসেনজো পেরুজিয়া যা করেছিলেন, তেমন কিছু করার দুঃসাহস আর কেউ দেখাতে পারেননি। ইতালির ওই শখের চিত্রকর সোজা দ্য ভিঞ্চির মাস্টারপিসকে বগলদাবা করে চম্পট দিয়েছিলেন। দেওয়ালে ঝোলানো চারটি পেরেকের মাঝে শূন্যস্থান আবিষ্কার করে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা।
মোনালিসার দিকে একবার তাকালে আপনি যেদিকেই সরে যান, সে আপনার দিকেই তাকিয়ে থাকবে! একে বলে ‘মোনালিসা এফেক্ট’। যে কোনও পোর্ট্রেটেই এটা হয়। কিন্তু তবুও এই জাদু কী করে যেন মোনালিসার ‘পেটেন্ট’ হয়ে গিয়েছে। তার হাসি নিয়েও তো কত কথা। বিভিন্নভাবে তাকালে নাকি হাসির মাত্রা বদলে বদলে যায়! এহেন রহস্যময়ীকে সম্রাট নেপোলিয়ন তাঁর প্রাসাদের শয়নকক্ষে রাখবেন– এতে আর আশ্চর্য কী! বলা হয়, ১৫০৩ থেকে ১৫০৭ সালের মধ্যবর্তী কোনও সময়ে মোনালিসা এঁকেছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। কিন্তু ছবিটি শেষ হয় ১৫১৭ সালে! দীর্ঘ সময় ধরে এই ছবিটিকে নিখুঁত করার কাজ করে গিয়েছিলেন তিনি। মোনালিসার ভুবনজয়ী হাসিকে রহস্যে ভরিয়ে তুলতে সান্টা মারিয়া ন্যুওভা হাসপাতালের মর্গে গিয়ে মৃতের পেশি ও নার্ভকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ভিঞ্চি সাহেব!
১৫১৭ সালেই ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস চার হাজার স্বর্ণমুদ্রায় কিনেছিলেন বিশ্বখ্যাত ছবিটি। যা মোটামুটি ৪ কেজি সোনার সমতুল্য। পরবর্তী সময়ে মোনালিসার মালিক হন নেপোলিয়ন। তাঁর মৃত্যুর পর ল্যুভর মিউজিয়মে রাখা হয় ছবিটি। ততদিনে তা ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বে কার্যতই অমূল্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিশ শতকে আচমকাই যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল মোনালিসা। হায় হায় করে উঠল পৃথিবী! হয়তো আর কোনও দিনই রহস্যময়ীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এমনও ধারণা করতে লাগলেন সবাই। কেননা দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছিল বছর দুয়েক। কোনও কিনারা করা যায়নি ছবি চুরির।
কী করেই বা যাবে? সেই ছবি যে নিজের বাড়ির গোপন দেরাজে রেখে দিয়েছিলেন ভিনসেনজো পেরুজিয়া! কিন্তু ছবিটা তিনি এত সহজে চুরি করতে পেরেছিলেন কী করে? এর পিছনে মিউজিয়ামের ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই দায়ী করা হয়। পেরুজিয়া ওই মিউজিয়ামেরই একজন কর্মী ছিলেন। ২১ আগস্ট, ১৯১১। মিউজিয়ামের এক আলমারিতে সারারাত লুকিয়ে ছিলেন তিনি। তারপর সুযোগ বুঝে দেওয়াল থেকে ছবিটি পেড়ে ফেলেন। পরনের সাদা পোশাকের আড়ালে সেটা লুকিয়ে কর্মীদের ব্যবহারের সিঁড়ি দিয়ে সটান হেঁটে বেরিয়ে যান চতুর পেরুজিয়া। মিলিয়ে যান বাইরের ঘন কুয়াশায়। এমন এক কাণ্ড ঘটে গেল, অথচ হিন্দি ছবির মতো সবশেষে জানতে পারলেন নিরাপত্তারক্ষীরা! মোনালিসার খোঁজ কোনও দিনই পাওয়া যেত না, যদি না পেরুজিয়া সেটা বিক্রির মতলব আঁটতেন। অথচ মোনালিসার খোঁজে ফ্রান্সের সীমান্ত নাকি সাময়িকভাবে ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছিল! সন্দেহভাজনদের তালিকায় ছিলেন পাবলো পিকাসোও! তিনি ও তাঁর লেখক বন্ধু অ্যাপোলিনেয়ারকে রীতিমতো জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল। কিন্তু আসল অপরাধী ছিল সকলের নজরের বাইরে।
দেখতে দেখতে দু’বছর পেরিয়ে গিয়েছে। পেরুজিয়া ভেবেছিলেন, সব উত্তেজনা থিতিয়ে গিয়েছে। এবার বরং মোনালিসাকে বিক্রি করে দেওয়া যাক। আর এখানেই ভুল করে ফেলেন তিনি। ১৯১৩ সালের নভেম্বরে তিনি খবর পাঠান ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের বাসিন্দা এক আর্ট ডিলারকে। জানিয়ে দেন, ৫ লক্ষ লিরার বিনিময়ে ছবি বিক্রি করবেন। এরপর প্যারিস থেকে ট্রেনে ফ্লোরেন্সে পৌঁছে যখন তিনি আর্ট ডিলারকে ছবিটি দেখান, ভদ্রলোক প্রায় আঁতকে ওঠেন। তড়িঘড়ি খবর দেন সেখানকার উফিজি মিউজিয়ামের ডিরেক্টর জিওভানি পোগ্গিকে। তিনি দেখেই বুঝে যান, এটাই আসল মোনালিসা। ব্যস! বামাল গ্রেপ্তার পেরুজিয়া। তবে আদালতে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর এই চুরির নেপথ্যে রয়েছে নিখাদ দেশপ্রেম! যেহেতু মোনালিসা ইতালির শিল্পীর আঁকা, তাই সেটা সেদেশের সম্পত্তি। এমন ছবি ফ্রান্সে থাকবে, এটাই না-পসন্দ ছিল তাঁর। এমন ‘দেশভক্তি’র মোটিভের কারণেই অনেকের কাছে ‘জাতীয় বীর’ হয়ে ওঠেন চোর বাবাজি। সাজাও পান ১ বছর ১৫ দিনের। যদিও মুক্তি পেয়ে যান তারও কম সময়ে। মাত্র সাত মাসেই। তবে অনেকেরই মতে, ওসব দেশভক্তির গল্প বানিয়ে আসলে সাজা কমানোর চেষ্টাই করেছিলেন পেরুজিয়া। কেননা যদি সত্যিই ইতালির ‘জাতীয় সম্পত্তি’ ফ্রান্স থেকে ফেরানোই তাঁর উদ্দেশ্য হত, তাহলে কোনও মিউজিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন তিনি। মোটা অঙ্কের অর্থ পকেটে পুরতে চাইতেন না।
পরের বছর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মুক্তি পেয়ে ইতালির সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ‘দ্য ক্রাইম অফ দ্য সেঞ্চুরি’ করা পিয়েত্রো পেরুজিয়া। হ্যাঁ, এটাই ছিল তাঁর আসল নাম। যুদ্ধ থেকে ফিরে বাকি জীবনটা শিল্পী ও ডেকোরেটরের কাজ করলেও ইতিহাস তাঁকে ছবি আঁকিয়ে নয়, ছবি ‘চোর’ হিসেবেই মনে রেখেছে। এমন ছবি, যা দেখে সাত শতাব্দীতেও বিস্ময় ফুরয়নি মানুষের। আজও ‘জীবন্ত’ মোনালিসা। আর তাই আজও লোকের মুখে ফিরে ফিরে আসে পেরুজিয়ার নামও।