১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঘোষণা করলেন এক অনন্য উদ্যোগ– লেস্টার থেকে রওনা হবে এক ট্রেন, যার গন্তব্য লিভারপুল ও নর্থ ওয়েলস, তারিখ ৪ আগস্ট, সময় ভোর ৫টা। প্রথম শ্রেণির টিকিট ১৫ শিলিং, দ্বিতীয় শ্রেণির ১০ শিলিং। এমন একটি সংগঠিত সফর, যেখানে সব ব্যবস্থা এক ছাদের তলায়– ট্রেনের আসন, থাকার জায়গা এবং সময়ানুগ পর্যটন। এই ঘোষণা সাড়া ফেলে দিল ব্রিটেনে। এমনকী টিকিটের চাহিদা এতটাই বেড়ে গেল যে, কেউ কেউ দ্বিগুণ দামে তা বিক্রি করতে শুরু করে দেয়।
টমাস কুক। ব্রিটেনের লেস্টার শহরে জন্মেছিলেন এই ধর্মপ্রাণ, দূরদর্শী মানুষ। তাঁর পরিচয় কেবল একজন মুদ্রক বা ধর্মীয় সভা-সংগঠক নয়, তিনি ছিলেন মানুষের অন্তরের সুপ্ত ভ্রমণতৃষ্ণার পথপ্রদর্শক। উনিশ শতকের সূচনালগ্নে, যখন ভ্রমণ ছিল ধনী ও অভিজাত শ্রেণির বিলাস, সাধারণ মানুষের পক্ষে যা এক স্বপ্নের মতোই অধরা, তখন কুক প্রথম উপলব্ধি করলেন, ভ্রমণ কেবল বিনোদন নয়, এটি শিক্ষার, সংযোগ ও মানসিক পরিশুদ্ধির মাধ্যম। তাই ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটেনের বুক চিরে শুরু করলেন এক নবযাত্রা– রেলের মাধ্যমে সংগঠিত ভ্রমণ, যা ইতিহাসে প্রথম পর্যটন সংস্থা প্রতিষ্ঠার সূচনা হিসেবে ধরা হয়।
১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঘোষণা করলেন এক অনন্য উদ্যোগ– লেস্টার থেকে রওনা হবে এক ট্রেন, যার গন্তব্য লিভারপুল ও নর্থ ওয়েলস, তারিখ ৪ আগস্ট, সময় ভোর ৫টা। প্রথম শ্রেণির টিকিট ১৫ শিলিং, দ্বিতীয় শ্রেণির ১০ শিলিং। এমন একটি সংগঠিত সফর, যেখানে সব ব্যবস্থা এক ছাদের তলায়– ট্রেনের আসন, থাকার জায়গা এবং সময়ানুগ পর্যটন। এই ঘোষণা সাড়া ফেলে দিল ব্রিটেনে। এমনকী টিকিটের চাহিদা এতটাই বেড়ে গেল যে, কেউ কেউ দ্বিগুণ দামে তা বিক্রি করতে শুরু করে দেয়। কুক তখনই বুঝলেন– ভবিষ্যৎ শুধু স্টেশনের টাইম টেবিলে নয়, মানুষের মনের ভেতরে গড়ে উঠছে নতুন এক ট্র্যাভেল রেনেসাঁ।
এই সাফল্যের হাত ধরে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্কটল্যান্ড ভ্রমণের আয়োজন করলেন। ২৫ জন সংগঠকের তত্ত্বাবধানে ৩৫০ জন যাত্রীকে নিয়ে সেই সফর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। এর ঠিক এক দশকের মধ্যেই তিনি মুদ্রণ ব্যবসা গুটিয়ে সম্পূর্ণভাবে ভ্রমণকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন ইউরোপ-ভ্রমণ। বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি ছুঁয়ে যাত্রা বিস্তৃত হতে থাকে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে।
এরপর আসে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ, এক ঐতিহাসিক বছর। ব্রিটেনের স্যর জোসেফ প্যাক্সটনের নেতৃত্বে ‘কমিটি অব ওয়াকিং মেন’ শ্রমিক শ্রেণির জন্য এক অভিনব প্রমোদভ্রমণের পরিকল্পনা করে। যাত্রাপথ প্যারিস, উদ্দেশ্য শুধু বিনোদন নয়, বরং ফরাসি ও ইংরেজ শ্রমিকদের মধ্যে মৈত্রীর এক সেতু গড়ে তোলা। সমস্ত ভ্রমণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় টমাস কুককে।
১৭ মে ১৮৬১, সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে লন্ডন ব্রিজ স্টেশন থেকে রওনা দেয় এক বিশেষ ট্রেন, যেখানে ১৭০০ শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার সদস্যরা প্যারিসের দিকে যাত্রা করেন। ৬ দিনের সফরের জন্য প্রতিজনের খরচ ধরা হয় মাত্র ৪৬ শিলিং, যার মধ্যে ছিল যাতায়াত, থাকা-খাওয়া এবং অন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত আয়োজন।
এই প্যাকেজ ভ্রমণ ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। প্রাথমিকভাবে অনেকেই এই ভেবে ভয়ে ছিলেন যে, এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে গিয়ে যদি বিশৃঙ্খলা তৈরি করে! কিন্তু সকল শঙ্কাকে মিথ্যে প্রমাণ করে, এই ভ্রমণ হয়ে ওঠে এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সাফল্যের নিদর্শন। ইংরেজ শ্রমিকরা ফরাসিদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হন। অপরদিকে, ফরাসি শ্রমিকরা তাদের আত্মীয়সম সমাজবন্ধু খুঁজে পান এই সফরের মাধ্যমে।
এরপর কুক নিয়মিতভাবে শুরু করেন ইউরোপের নানা দেশে প্যাকেজ টুর। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনে অফিস স্থাপন করে ব্রিটেন থেকে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশের উদ্দেশে নির্ধারিত সময়সূচি ও খরচের প্যাকেজ চালু করেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাকেজ। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত তাঁর ব্যবসা বিস্তৃত হয়। প্রায় ২৫ বছর ধরে টমাস কুক ছিলেন একচ্ছত্র পর্যটন সম্রাট, যাঁর কল্পনায় গড়ে উঠেছিল ভ্রমণের নয়া রাজ্য।
আর আজ, যখন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে আমরা দাঁড়িয়ে, পেছনে প্যান্ডেমিকের কালো ছায়া ফেলে রেখে পৃথিবী আবার নতুন করে গতি পাচ্ছে, তখন প্যাকেজ টুর আবারও হয়ে উঠেছে মানুষের আত্মিক আশ্রয়। বিশেষ করে পুজোর সময়, যখন বাঙালির মন চায় খোলা হাওয়ায় মুক্তির স্বাদ নিতে, পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়তে সমুদ্রের কিনারে, পাহাড়ের কোলে, নদীর ধারে তখন এই সংগঠিত ভ্রমণই হয়ে ওঠে নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু সেই সঙ্গে থাকে এক দুঃখও, পুজোর ছুটির ঠিক আগে সব ট্রেনের টিকিট শেষ, ফ্লাইটে বিশাল দাম, হোটেলের রুম বুক হয়ে গেছে মাসখানেক আগেই। ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হয়ে ওঠে না অনেকের। তখন বুকের ভিতর জমে ওঠে এক মেঘলা আক্ষেপ, তারা কি বলে ওঠেন, ‘টমাস কুক যদি আজ থাকতেন, হয়তো আগেভাগে একখানা নিশ্চিত প্যাকেজে বুকিং করিয়ে দিতে পারতেন!’
এই আক্ষেপই প্রমাণ করে, যা শুরু হয়েছিল ১৮৬১-র ব্রিটেনে শ্রমিকদের ছোট্ট এক প্রমোদযাত্রা দিয়ে, তা আজ এক গ্লোবাল বাস্তবতা। কুক আজ নেই, কিন্তু তাঁর ভাবনা, তাঁর সূচনা করা পথ আজও রয়ে গেছে আমাদের প্রতিদিনের ভ্রমণচর্চার ভিতর। অ্যাপে বুক করা হোক বা এজেন্সিতে গিয়ে, একটা সুর আজও বাজে– ‘সফর যেন নির্ভার ও নির্ভয় হয়, স্বপ্ন যেন হাতের নাগালে থাকে।’
তাই টমাস কুকের সেই গল্প, রেলগাড়ির হুইসেলের মধ্যে আজও জেগে আছে। আমাদের পুজোর ছুটির ভিড়ে, বুকিং অ্যাপে ক্লিক করার উন্মাদনায়, আর শেষ মুহূর্তে টিকিট না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভিতরেও যেন ইতিহাস বারবার বলে, ‘ভ্রমণ কেবল পথ নয়, সময়ের কাঁধে ভর দিয়ে নিয়ে চলে ইতিহাসের ছায়াপথ।’
………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………………..