Robbar

তোমার হিংসা, আমার জয়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 2, 2025 2:13 am
  • Updated:October 2, 2025 2:13 am  

একবার অধুনালুপ্ত ১১এ বাসে দেখেছিলাম লেডিজ সিটের উপর লেখা ছিল– ‘বিউটি ইজ টু বি সিন, নট টু বি টাচ্ড‌’। বছর কয়েক আগে একটি লরির পিছনে লেখা ছিল, ‘তোমার হিংসা, আমার জয়’। কথাটির অর্থ ঠিক কী? আমার নিজস্ব পাঠে মনে হয়, ‘হিংসা’-কে ব‌্যবহার করলে কোনও দিনই ‘প্রকৃত’ বিজয়ী হওয়া যায় না। বরং হিংসা প্রয়োগে যে মানুষটা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, শেষ পর্যন্ত তার যন্ত্রণাবিদীর্ণ মুখটাই জয়ী হয়। সে মুখ ব‌্যক্তির হতে পারে, উগ্র জাতীয়তাবাদ বা স্বৈরতন্ত্রের হাতে নির্যাতিত শ্রেণিগোষ্ঠী-জাতি বা বর্গ হতে পারে, হতে পারে নারী বা প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষ। বিদ‌্যালয় থেকে জাতিরাষ্ট্র, পরিবার থেকে গণপরিসর– কত কিসিমের হিংসায় আক্রান্ত এই মানবজীবন। কত মহামানব এর উল্টোদিকে গিয়ে ক্রমাগত স্বপ্ন দেখেছেন হিংসামুক্ত পৃথিবীর। তবে, সারা দুনিয়ায় আজ একনায়কের হুংকার, নানা প্রান্তে-প্রান্তিকতায় হিংসার অবাধ বিচরণ। বাস্তুচ্যুত মানুষ, বন্দি মানুষ, ধর্ষিত মানুষ, পদদলিত মানুষের দীর্ঘ দীর্ঘতর মিছিল। আদৌ কি সম্ভব ‘হিংসা’ নামক দানবের হাত থেকে মুক্তি?

অভীক মজুমদার

মাত্র কয়েক দিন আগে, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালের মঞ্চে পুরস্কার নিতে উঠে, অনুপর্ণা রায় উত্তেজনায়, আবেগে, আনন্দে– তবু প্রত‌্যয়ে, শোনাচ্ছিলেন কয়েকটি বাক‌্য। থেমে, থেমে। আর, প্রতিটি শব্দ, সমকালীনতার বিশ্বপটে তরঙ্গ তুলছিল। প‌্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়ানোর কাতর আহ্বান আর হাহাকার ছিল তাঁর গলায়। বলছিলেন, ‘প্রত্যেক শিশুর প্রাপ‌্য হল শান্তি, স্বাধীনতা, মুক্ত জীবন– প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্র কোনও ব‌্যতিক্রম নয়।’

ধ্বংসস্তূপ গাজা

আলাদা করে শিশুদের কথা বলছিলেন কেন? আমরা জানি, ২০২৫ সাল জুড়ে, ইজরায়েলের নির্মম মানবনিধন যজ্ঞে প‌্যালেস্টিনীয় শিশুরাও সমানভাবে আক্রান্ত। শিশু-হাসপাতালে বোমা, বেছে-বেছে শিশুদের উপর হামলা, স্কুলে ক্ষেপণাস্ত্র, মারাত্মকভাবে আহত এবং নিথর-নিহত কচিকাঁচাদের নিয়ে মা-বাবার বুকফাটা আর্তনাদ টিভির পর্দায় বারবার ফুটে উঠছিল। আমরা, অসাড় বিশ্ববাসী সেসব দেখছিলাম। শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন মনে পড়ে, ‘আমাদের পথ নেই কোনো/ আমাদের ঘর গেছে উড়ে।/ আমাদের শিশুদের শব/ ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে!’ মনে পড়ে, অমিতাভ দাশগুপ্তের কাব‌্যগ্রন্থের নাম– ‘মৃত শিশুদের জন‌্য টফি!’

………………………..

হিংসা আর হিংস্রতা– শুধু শিশু নয়, আবাল-বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেন মানবসভ‌্যতার এক নির্বিকল্প বাস্তব! আদি-মধ‌্য বা আধুনিক– সব যুগেই, তা বলে শিউরে উঠতে হয়, ‘সভ‌্যতা’ নির্মিত হয়েছে খুনোখুনি আর কত রকমের ‘হিংসা’ দিয়ে। ইলিয়াড-ওডিসি, রামায়ণ-মহাভারত থেকে আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার, এশিয়ার, কানাডার মহাকাব‌্য-পুরাণে লোককথায় অনবরত যুদ্ধ আর ধ্বংসের কাহিনি!

………………………..

এ এক আশ্চর্য অলাতচক্রে এ যুগের ঘূর্ণন। আমার এক মেধাবী বন্ধু আউশইৎজ জাদুঘর থেকে ফিরে বেশ কয়েক সপ্তাহ ঘুমোতে পারেনি। দক্ষিণ পোল‌্যান্ডের এই শহরেও সংরক্ষিত আছে গণহত‌্যার আগে ছেড়ে যাওয়া শত-শত বালক-বালিকার জুতো! সেই নৃশংস ইহুদি হননের ৮০-৮৫ বছর পরে ইহুদি রাষ্ট্রই আবার মেতে উঠেছে বীভৎস মৃত্যু-হত‌্যার উল্লাসে! ১৯৪২ সালে এক অনাথাশ্রমে, ওয়ারশ শহরে, জানুস কোরজ‌্যাক, শিশুদের দিয়ে অভিনয় করালেন রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। পরের দিন সবাই যাতে একটু কম অস্থিরতায় গ‌্যাস-চেম্বারে ঢুকতে পারে!

হিংসা আর হিংস্রতা– শুধু শিশু নয়, আবাল-বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেন মানবসভ‌্যতার এক নির্বিকল্প বাস্তব! আদি-মধ‌্য বা আধুনিক– সব যুগেই, তা বলে শিউরে উঠতে হয়, ‘সভ‌্যতা’ নির্মিত হয়েছে খুনোখুনি আর কত রকমের ‘হিংসা’ দিয়ে। ইলিয়াড-ওডিসি, রামায়ণ-মহাভারত থেকে আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার, এশিয়ার, কানাডার মহাকাব‌্য-পুরাণে লোককথায় অনবরত যুদ্ধ আর ধ্বংসের কাহিনি! শুধু যুদ্ধ অথবা ধ্বংসই নয়– ‘হিংসা’ তার বহুরূপে সম্মুখে আসে। কখনও তার নাম ‘গৃহস্থালির হিংসা’ কখনও ‘বিদ‌্যালয়ের হিংসা’, কখনও যন্ত্রণাদীর্ণ ‘র‌্যাগিং’, কখনও ‘পণ-যৌতুকের দাবি’ সংক্রান্ত হিংসা, নিম্নবর্ণের প্রতি ‘হিংসা’, নিম্নবর্গের প্রতি ‘হিংসা’, ‘রাষ্ট্রীয় হিংসা’, ‘ব‌্যক্তির হিংসা’– প্রকাশ্যে এবং গোপনে এমন বহু হিংসার কথা বলে যায় মানবসমাজ। ‘হিংসা’ প্রকৃতপক্ষে বলশালীর হাতিয়ার। তার প্রয়োগ ঘটে কম ক্ষমতাশালীর ওপর। শ্রেণি-লিঙ্গ-ধর্ম-জাতি-গাত্রবর্ণ থেকে রাজনীতি-অর্থনীতি-পেশাগত নানা ধরনের পরিচয়ে তার বিস্তার। দলিত কিশোরীর হাত-পা কেটে ধর্ষণ অথবা অত‌্যাচার কিংবা ধর্মীয় সংখ‌্যালঘু বা ভাষিক সংখ‌্যালঘুর নিশ্চিহ্নকরণ মানব ইতিহাসের অহরহ ঘটমানতা। উপনিবেশবাদ, তার পরবর্তী ‘কোকাকোলোনাইজেশন’, আদিমযুগের গোষ্ঠী সংঘর্ষ, চেঙ্গিস খান-নাদির শাহ-চণ্ডাশোক থেকে কংস-হিরণ‌্যকশিপু– কত বিচিত্র হিংসার কাহিনি! কখনও তা প্রত‌্যক্ষ, কখনও তা আড়ালে-আবডালে বহমান। এই যে দেশভাগ থেকে শরণার্থী, উদ্‌বাস্তু, গৃহহীন, খাদ‌্যহীন, বস্ত্রহীন মানুষের লক্ষ-কোটি মিছিল সেই কতযুগ ধরে– এসবের অন্তরালে নানা ‘পরিকল্পিত’ হিংসার ক্রূর অঙ্গুলিনির্দেশ! মনে হয় যেন, ‘হিংসা’ প্রকৃতপক্ষে শাশ্বত মানুষের এক অমোঘ প্রবৃত্তি।

হানা আরেন্ট (Hanna Arendt) তাঁর ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘হিংসা প্রসঙ্গে’ (On Violence) রচনাটিতে নানা ধরনের ‘হিংসা’ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ‘হিংসা’-র সঙ্গে বারবার যুক্ত হয়ে থাকে ‘ক্ষমতা’। ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে ছাত্র-অভ্যুত্থান এবং ইউরোপ জুড়ে তরুণ প্রজন্মের তীব্র ক্রোধ আর অসন্তোষ ছিল হানার ওই রচনার প্রেক্ষাপট। সেখানে হানা আমাদের মনে করিয়ে দেন, কনসেনট্রেশন ক‌্যাম্প, বন্দিশিবির-নিপীড়ন, দেশদখল, গোষ্ঠীনিকেশ– এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আসলে হাত ধরাধরি করে চলে ক্ষমতা আর হিংসা। ‘হাতিয়ার’ আর ‘যন্ত্র’ হল সেই অনিঃশেষ হিংসা প্রয়োগের মাধ‌্যম। চকিতে আমাদের মনে পড়বে, আন্দামান সেলুলার জেলের কথা, ব্রিটিশ শাসকের হাতে আদিবাসী কিংবা জনজাতি বিদ্রোহের নেতানেত্রীদের নিপীড়নের প্রসঙ্গ, মনে পড়বে যতীন দাসের জেলে মৃত্যু অথবা বিরসা মুন্ডার পরিণামের কথা। স্বাধীন ভারতেও তো গান্ধীহত‌্যা থেকে স্ট‌্যান স্বামীর প্রয়াণ– সবই হিংসা-কাঠামোর নানা অভিব‌্যক্তি। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণী-বিদ্বানদের ওপর পাকিস্তানি সৈন‌্যদলের বীভৎস অত‌্যাচারের বহু নথি আমরা দেখেছি। চিন থেকে সোভিয়েত, ইদি আমিন-পলপট-চাওসেস্কু থেকে সুহোর্তো বা কিম জংউন একই মুদ্রার বিবিধরূপ। হিরোশিমা-নাগাসাকির জনহনন কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধ সবই তো ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা আর হিংসার, অনিয়ন্ত্রিত যুগলবন্দি।

ধ্বংসস্তূপ হিরোশিমা

মহাকাব্যের কথা বলছিলাম। ভার্জিলের ‘ইনিড’ মহাকাব্যের গোড়ায় আছে পরাজিত ট্রয়ের নর-নারীদের উপর গ্রিক সৈনিকদের নৃশংস অত‌্যাচারের কথা। মনে পড়ে, অশ্বত্থামার গোপন হামলায় পঞ্চপাণ্ডবের পাঁচপুত্রের মুণ্ডচ্ছেদের কথা। শোনা যায়, উত্তর কোরিয়ার কিম জং নাকি কয়েক বছর আগে তাঁর মামার উপর রুষ্ট হয়ে, বুনো ক্ষুধার্ত কুকুরের পালের মুখে মামাকে ঠেলে দেন। ইতিহাসের এইসব শতক, সহস্রাব্দের ফাঁকে ফাঁকে রক্ত, শব, আর্তনাদ, প্রতাপ আর আধিপত্যের হুংকার! এর কি কোনও বিকল্প আছে? হানা আরেন্ট লিখছেন, ‘…হিংসা একমাত্র তখনই যৌক্তিক মনে হবে, যখন সে স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য নিয়েই পরিচালিত। ইতিহাস রচনা বিপ্লব, প্রগতি বা প্রতিক্রিয়ার কোনও মহৎ উদ্দেশ‌্য সাধনকেই হিংসা রূপ দিতে পারবে না।’ দীর্ঘমেয়াদি যে কোনও গঠনমূলক প্রকল্পনা সেজন‌্য একমাত্র অহিংসার সযত্ন নির্মাণেই সম্ভব। তাত্ত্বিকরা যেজন‌্য বারবার মানবজগৎ এবং সৃষ্টিশীলতা এই দুই অক্ষকে রাখেন ‘হিংসা’র উল্টোদিকে। গর্ভযন্ত্রণা থেকে শিশুর পবিত্র জন্মগ্রহণ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই যেমন হিংসা-বিবর্জিত– তেমনই এক বিকল্প পৃথিবীর সন্ধান ‘আধুনিক’ মানবসমাজকে করে যেতে হয় ভালোবাসার পরিমণ্ডলে।

কিম কি ডুক-এর ছবিতে বিকল্প পৃথিবীর সন্ধান

সেখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন গৌতম বুদ্ধ অথবা মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের একটি গল্প দিয়েই শুরু করছি। ১১-১২ বছরের বালক রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে হিমালয় পর্বতে যাওয়ার আগে শান্তিনিকেতনে আসেন। দেবেন্দ্রনাথের পরিচারক হরিশমালী তাঁকে রোমাঞ্চের লোভ দেখিয়ে ‘শিকার’-এ নিয়ে যান। এরপর একটি খরগোশকে অব‌্যর্থ লক্ষ্যে হত‌্যা করে, সেই মালী সেই মৃতদেহ নিয়ে কাছারি বাড়িতে ফেরেন। প্রভাতচন্দ্র গুপ্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বালককালে চিফ সাহেবের ভাঙা কুঠিতে খরগোশ শিকারের নিদারুণতা চিরকালের মতো আমার মনে মুদ্রিত হয়ে আছে।’ হিংসা বিষয়ে সেই প্রথম তাঁর অপ্রসন্নতা, প্রত‌্যাখ‌্যান। হয়তো এই হিংসা-রক্ত প্রাণীহত‌্যার অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি শিলাইদহের চরে পাখিশিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমেও প্রাণীদের প্রতি হিংসা তিনি কড়া অনুশাসন দিয়ে রোধ করেছিলেন। এই কবিই যে ‘নটীর পূজা’-য় ব‌্যবহার করবেন মহান বুদ্ধদেবের অনুষঙ্গে ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ গানটি, (১৯২৭)– সেকথা বলাই বাহুল‌্য। রবীন্দ্রনাথের খরগোশ হত‌্যার বিশ্রী স্মৃতি কি কোনওক্রমে তুলনীয় গৌতম বুদ্ধের আশ্রয়ে থাকা আহত পাখির সঙ্গে? দেবদত্তের তীরে আহত হাঁসের শুশ্রূষা করেছিলেন সিদ্ধার্থ। বিচারক বলেছিলেন, ‘পাখিটিকে যিনি প্রাণদান করেছেন, এই প্রাণী তাঁরই প্রাপ‌্য। যিনি বধ করতে উদ‌্যত তিনি তাকে পাওয়ার যোগ‌্য নন।’ এই দ্বন্দ্ব চিরকালীন। ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’– যাঁরা ভাবেন, তাঁরা স্বল্পমেয়াদি বধ‌্যভূমির স্বপ্ন দেখেন। জন্ম যেমন হিংসার বিরুদ্ধে ভালোবাসার জয়পতাকা তেমনই হিংসা আসলে মৃত্যুই উপাসনা, প্রকৃতির সুরে তার তাল মেলে না। সেজন‌্যই রবীন্দ্রনাথ, ‘রক্তকরবী’ নাটকে মকররাজের শান দেওয়া দাঁতের আর তার পীড়নে পঙ্গু যমপুরীর মানুষগুলিকে উদ্ভাসিত করলেন নন্দিনীর দুর্বার প্রেমের জোয়ারে। কিশোর, বিশু, ফাগুলাল, তন্দ্রা থেকে রাজা– সেই প্রেমের প্রবল উত্তাপে ভেঙে দিতে লাগল হিংসার দুর্গ। হিংসার দমবন্ধ পাতালপুরী। পৌষের গান, ফসলের গান, মাটির আঁচলে রোদের সোনার গান আসলে জন্মেরই উদ্‌যাপন। হিংসা বিরোধী এক পৃথিবীর স্বপ্ন!

ভাসিলি ভেরেশচাগিনের অ্যাপোথিওসিস

ফলে, অহিংসা, করুণা আর মৈত্রীর প্রচারক অনন্তপুণ্য মহামহিম বুদ্ধদেবের সেই অমূল‌্য উক্তি বহুবার রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করবেন। আবার, সেখানে সুপ্ত হয়ে থাকবে জন্মের তীব্র সৃষ্টিময়তা। এই দিয়েই ধাক্কা দেবে সে হত‌্যাশালার প্রতিটি ভিতকে। বুদ্ধদেবের সেই বাণীটি ছিল–

‘মাতা যথা নিজং পুত্তং
আয়ুপা একপুত্তমনুরক্‌খে
এবম্পি সর্ব্বভূতেষু
মানসং ভাবয়ে অপরিমাণং।
মেত্তঞ্চ সর্ব্বলোষ্কস্মিং
মানসং ভাবয়ে অপরিমাণং।
উদ্ধং অধো চ তিরিযঞ্চ
অসম্বাধং অবেরমসপত্তং।’

[মা যেমন একটিমাত্র পুত্রকে নিজের আয়ু দিয়ে রক্ষা করেন, সমস্ত প্রাণীতে সেই প্রকার অপরিমিত মানস রক্ষা করবে। ঊর্ধ্বে-অধোতে চারদিকে সমস্ত জগতের প্রতি বাধাহীন, হিংসাহীন, শত্রুতাহীন অপরিমিত মানস এবং মৈত্রী রক্ষা করবে।]

এদিকে ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ আর অন‌্যদিকে ‘চণ্ডালিকা’, ‘অচলায়তন’ থেকে ‘কথা ও কাহিনি’– বৌদ্ধ অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথের হৃদয়-স্পন্দনকেই বিম্বিত করেছে। তাঁর ‘বুদ্ধদেব’ প্রবন্ধের একটি বক্তব‌্য পেশ করি, ‘বাহুবলের সাহায্যে ক্রোধকে প্রতিহিংসাকে জয়ী করার দ্বারা শান্তি মেলে না, ক্ষমাই আনে শান্তি, একথা মানুষ আপন রাষ্ট্রনীতিতে সমাজনীতিতে যতদিন স্বীকার করতে না পারবে ততদিন অপরাধীর অপরাধ বেড়ে চলবে, রাষ্ট্রগত বিরোধের আগুন কিছুতে নিভবে না, জেলখানার দানবিক নিষ্ঠুরতায় এবং সেনানিবাসের সশস্ত্র ভ্রূকুটি বিক্ষেপে পৃথিবীর মর্মান্তিক পীড়া উত্তরোত্তর দুঃসহ হতে থাকবে– কোথাও এর শেষ পাওয়া যাবে না।’ ওই প্রবন্ধেই রবি ঠাকুরের স্পষ্ট বিবৃতি ছিল– ‘পাশবতার সাহায্যে মানুষের সিদ্ধিলাভের দুরাশা’ থেকে, দূরে থাকার পক্ষে। বুদ্ধদেব তাঁর এই উন্মেষের প্রধান মন্ত্রণাদাতা।

শিল্পী: ক্যাথে কোলভিৎস

মানুষের সিদ্ধিলাভের আশা তাহলে কোন পথে? যে পথে অহিংসা আর আত্মত‌্যাগ, বিশ্বাস আর হয়তো আত্মশক্তি! আর এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দেবেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। রেজাউল করীমের ভাষায়– ‘রাজনীতি ক্ষেত্রে হিংসাকে বর্জন করে গান্ধীজি স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অহিংসাকে একটা নূতন টেকনিক হিসাবে ব‌্যবহার করে এক অসির অস্ত্র আবিষ্কার করেন। এটা এমন একটা টেকনিক যা পরিপূর্ণভাবে ভারতের ঐতিহ‌্যসম্মত।’ করীম সাহেব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার মুহূর্তেও গান্ধীজির স্থিরচিত্ত সত‌্যাগ্রহের অপূর্ব অভিঘাত এবং জোর কতখানি। নোয়াখালি এবং বেলেঘাটায় কেমনভাবে সেই অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি করুণা আর সহানুভূতির আশ্চর্য উত্থান ঘটিয়েছিলেন স্বাধীনতার কালপর্বে। এক নির্ভীক অহিংসার বিকল্পকে সযত্নে গড়ে তুললেন গান্ধী। ভয়, বিদ্বেষ, ক্রূরতা আর দম্ভের পৃথিবী গড়ে তোলা আসলে, দীর্ঘমেয়াদে মানবিক কোনও বিকল্প হতেই পারে না।

মহাত্মা গান্ধী

গান্ধীজি সেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে চম্পারণে, সবরমতী আশ্রম থেকে বোম্বাইয়ের দরিদ্র মহল্লায়– অবিরাম পদপাত চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর ‘হায় রাম!’ আর্তনাদ সেই হিংসার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক অপরিমেয় প্রতিরোধ। বুলেটে রক্তাক্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু আসলে প্রতীকী। রক্ত আর দমনের বিরুদ্ধে শেষ শ্বাস পর্যন্ত লড়াই জারি রেখে গেলেন। আমরা অল্পবয়সে বাসের দেওয়ালে লেখা নানা ‘বাণী’ এবং ‘পরামর্শ’ দেখে তাদের রসবোধে এবং দার্শনিকতায় আলোড়িত হয়েছি। অনেক হাসাহাসিও করেছি বন্ধুদের নিয়ে।

একবার অধুনালুপ্ত ১১এ বাসে দেখেছিলাম লেডিজ সিটের উপর লেখা ছিল– ‘বিউটি ইজ টু বি সিন, নট টু বি টাচ্‌ড’। বছর কয়েক আগে একটি লরির পিছনে লেখা ছিল, ‘তোমার হিংসা, আমার জয়’। কথাটির অর্থ ঠিক কী? আমার নিজস্ব পাঠে মনে হয়, ‘হিংসা’-কে ব‌্যবহার করলে কোনও দিনই ‘প্রকৃত’ বিজয়ী হওয়া যায় না। বরং হিংসা প্রয়োগে যে মানুষটা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, শেষ পর্যন্ত তার যন্ত্রণাবিদীর্ণ মুখটাই জয়ী হয়। সে মুখ ব‌্যক্তির হতে পারে, উগ্র জাতীয়তাবাদ বা স্বৈরতন্ত্রের হাতে নির্যাতিত শ্রেণিগোষ্ঠী-জাতি বা বর্গ হতে পারে, হতে পারে নারী বা প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষ। বিদ‌্যালয় থেকে জাতিরাষ্ট্র, পরিবার থেকে গণপরিসর– কত কিসিমের হিংসায় আক্রান্ত এই মানবজীবন। কত মহামানব এর উল্টোদিকে গিয়ে ক্রমাগত স্বপ্ন দেখেছেন হিংসামুক্ত পৃথিবীর। তবে সারা দুনিয়ায় আজ একনায়কের হুংকার, নানা প্রান্তে-প্রান্তিকতায় হিংসার অবাধ বিচরণ। বাস্তুচ্যুত মানুষ, বন্দি মানুষ, ধর্ষিত মানুষ, পদদলিত মানুষের দীর্ঘ দীর্ঘতর মিছিল। আদৌ কি সম্ভব ‘হিংসা’ নামক দানবের হাত থেকে মুক্তি? অম্লান দত্ত লিখেছিলেন, ‘হিংসা, মিথ‌্যা আর অবিশ্বাসের সেই শক্তি নেই, যাকে ভিত্তি করে কোনও সমাজ দাঁড়াতে পারে। কাজেই হিংসা যেখানে সাময়িকভাবে সফল সেখানে তার সাফল‌্যজনিত প্রসারের বিপদ সম্বন্ধেই বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এই সতর্কবাণী উচ্চারণেই অহিংসা তত্ত্বের প্রথম মূল‌্য।’ হয়তো অহিংসার জয়ও এভাবেই সূচিত হয়।

ভিয়েতনামের যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের পোস্টার

বেশ কয়েক বছর আগে, তা হবে ১২-১৪ বছর, হাতিবাগান সর্ব্বজনীনের মণ্ডপে দেখেছিলাম এক অভিনব দুর্গামূর্তি। সেই প্রতিমার হাতে কোনও খড়্গ ছিল না। মহিষাসুর হত‌্যাও সেখানে ছিল সন্তর্পণে, অনুল্লিখিত। সেই আনন্দময়ী মূর্তি ছিল শুধু কল‌্যাণের প্রতিমা! হয়তো অন্তর্লীন হয়ে ইঙ্গিত ছিল হিংসামুক্ত পরিমণ্ডলের। গান্ধীজি বারবার বলতেন, সত‌্যরূপ উন্মোচিত হয় অহিংসা আর দয়ার মাধ‌্যমে। হিংসার একটা মাদকতা আছে। তবে তার বিপদ অনেক। হিংসা থেকে হিংসার বদ্ধ ঘূর্ণনে চলতে থাকে অতীত-বর্তমান-ভবিষ‌্যৎ। দস্যু রত্নাকর তো হিংসাকে প্রত‌্যাখ‌্যান করেই বাল্মীকি হতে পারল। দশমীতে তাই বেজে উঠুক হিংসা-বিসর্জনের ঢাক। শত-সহস্র লক্ষ-কোটি। দেশ-দেশান্তর, নদী-পর্বত সাতসমুদ্র, সব মহাদেশ জুড়ে।

প্রত্যেক শিশুর জন‌্য শান্তি, স্বাধীনতা আর মুক্ত দুনিয়া প্রয়োজন। ভাষণে যা বলেছেন অনুপূর্ণা রায়। অহিংসার সেই পৃথিবী কত দূরে? ভালোবাসা, কোন দেশে তুমি?

………………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন অভীক মজুমদার-এর অন্যান্য লেখা

………………………..