পানাহির ছবির সূক্ষ্ম রাজনীতিবোধ এইখানেই দাঁড়িয়ে আছে। একটা সময় এই পাঁচজনের মনে একটা সন্দেহ জাগে, এই কি সেই লোক যাকে তারা হত্যা করতে চায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে? এর চেয়েও আরও বড় একটা প্রশ্নের সম্মুখীন তারা হয়– আসলে এই জিঘাংসা ‘ন্যায়বিচার’ নাকি প্রতিহিংসা মাত্র? এইখানে পানাহি আমাদের একটা নৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। ইরানের ছবি তার কঠিনতম চ্যালেঞ্জের মুখেও এই নৈতিকতার প্রশ্নকে ভোলে না। কিয়ারোস্তামি ভুলতেন না। পানাহিও ভোলেননি। এখানেই পানাহির জয়।
পুরস্কার জাফর পানাহি অনেক পেয়েছেন। ইউরোপ এবং এশিয়ার প্রায় সবক’টি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র উৎসব তাঁর কোনও না কোনও ফিল্মের জন্য তাঁকে বিশেষ সম্মান বা সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছে। তবে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দে’ওর পাওয়ার অর্থ আলাদা। ধরে নেওয়া হয় পৃথিবীতে সমান্তরাল চলচ্চিত্রের জগতে সবচেয়ে বড় সম্মান কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দে’ওর। জাফর পানাহি এই পুরস্কারের দাবিদার অনেকদিন থেকেই, এ বিষয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। বার্লিন এবং ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ সম্মান তিনি পেয়েছেন বেশ কয়েকবার। কান চলচ্চিত্র উৎসবেও পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার। এবার পেলেন পাম দে’ওর, তাঁর সাম্প্রতিকতম ছবির জন্য, যে ছবির নাম ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান এক্সিডেন্ট’।
রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু তাঁকে বেশ কয়েকবার কারান্তরালে পাঠিয়েছে। এই কারাগারের অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিয়েছে তাঁর সাম্প্রতিকতম ছবির গল্প। একদা তাঁর প্রথম বড় ছবি ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ নিয়ে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছিলেন তরুণ পানাহি। তবে আজ আর জাফর পানাহি তরুণ চলচ্চিত্রকার নেই। তিনি প্রৌঢ়। রাষ্ট্রের সঙ্গে কেবল চলচ্চিত্র বানানোর অধিকারের জন্য, শিল্পীর স্বাধীনতার জন্য অনেক যুদ্ধ, অনেক আইনি লড়াই তিনি লড়েছেন শেষ তিন দশকে। তিনবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। এই লড়াই তাঁকে ক্লান্ত করেছে কখনও কখনও। ‘ক্লোজড কার্টেন’ নির্মাণের পূর্বে কিছুদিন অবসাদ, এমনকী আত্মহত্যার চিন্তা, তাঁকে গ্রাস করছিল। কিন্তু ক্লান্তিতে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ জাফর পানাহি বোধহয় নন। সবচেয়ে বড় কথা অনেকবার তাঁকে রাষ্ট্র সুযোগ দিয়েছে ইরান থেকে পালিয়ে গিয়ে ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার কোনও দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে। কিন্তু জাফর পানাহি সিদ্ধান্ত করেছেন তিনি ইরানের মাটি ছাড়বেন না। যে মাটি, যে শহর, যে নিসর্গ, যে মানুষ, যে লড়াই, যে বঞ্চনা তাঁর ক্যামেরাকে ভাষা দিয়েছে, তাকে তিনি পরিত্যাগ করবেন না। আমরা জানি না, হয়তো কোনও দিন জাফার পানাহিকেও (Jafar Panahi) ভিনদেশে চলে যেতে হবে আরও অনেক ইরানি চলচ্চিত্রকারের মতো। যেমন মহসেন মাকবাল্বাফ চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, যেমন বাহমান গোবাদি চলে গেছেন। যেমন সম্প্রতি চলে গেছেন মহম্মদ রোসুলফ। কিন্তু আপাতত জাফর পানাহি ঘোষণা করেছেন ইরানের মাটিতে পা রেখেই তিনি লড়াই চালাবেন, ছবি বানাবেন। সেই লড়াই সারা পৃথিবীর স্বীকৃতি আর একবার পেল কানের পাম দে’ওরের মাধ্যমে।
ইরানের ছবিতে জাফর পানাহি (Jafar Panahi) নিশ্চিতভাবেই আব্বাস কিয়ারোস্তামির সবচেয়ে কাছের ছাত্র। তাঁর ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ এবং ‘ক্রিমসান গোল্ড’-এর মতো জগৎবিখ্যাত ছবির চিত্রনাট্য রচনায় কিয়ারোস্তামির বিশেষ অবদান ছিল; এবং অবশ্যই জাফর পানাহির চলচ্চিত্রভাষায় কিয়ারোস্তামির প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু এসব কিছুর পরেও বলতে হয় পানাহি তাঁর নিজের যাত্রাপথ চিহ্নিত করে নিতে পেরেছেন, যা তাঁর গুরুর পথের থেকে বেশ কিছুটা স্বতন্ত্র। পানাহির চলচ্চিত্র ভাষা ক্রমাগত রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। যা তাঁকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে। আব্বাস কিয়ারোস্তামির সঙ্গে ২০০৯-’১০ সালে একটা বিষয়ে কিঞ্চিত মতবিরোধ উপস্থিত হয় পানাহি এবং বাহমান গোবাদির। কিয়ারোস্তামি চলচ্চিত্রে সরাসরি রাজনৈতিক কথা বলার পক্ষপাতী ছিলেন না। অন্যদিকে পানাহি এবং গোবাদি বারবার রাজনৈতিক কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন এবং তাঁরা মনে করছিলেন ইরানে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ দরকার। গোবাদি কিছুদিনের মধ্যেই ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পানাহি কিন্তু কারাবরণের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েও দেশত্যাগ করতে অস্বীকার করেন।
অবশেষে তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চিত্রনাট্য লেখা নিষিদ্ধ হল। যখন তিনি গৃহবন্দি, তখন থেকে তাঁর ছবি যেন হয়ে উঠল আরও ধারালোভাবে রাজনৈতিক। পানাহি যেন এভাবে দেখতে শুরু করলেন যে কেবল কারান্তরালের বন্দিত্ব নয়, বন্দিত্বের আরও অনেক স্তর রয়েছে। তাঁর হালের ছবি ‘নো বেয়ার্স’ দেখলে সেকথা উপলব্ধি করা যায়। আমরা যদি ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’, ‘দিস ইজ নট এ ফিল্ম’ এবং ‘নো বেয়ার্স’ এই তিনটি ছবিকে পাশাপাশি রাখি, তাহলে বুঝব কীভাবে তাঁর চলচ্চিত্রের বিবর্তন হয়েছে। দেখতে পাব, পানাহির সরস বহতা নদীর মতো স্বচ্ছন্দ গতিশীল চলচ্চিত্রভাষার মধ্যে ভায়োলেন্স বা হিংসা উঠে আসছে। সেই ভায়োলেন্স কিন্তু কেবলমাত্র রাষ্ট্রের দ্বারা তৈরি করা ভায়োলেন্স নয়। বরং তা ক্রমে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিগত হিংসার ছাইচাপা স্তরগুলিকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। ‘তেহেরান ট্যাক্সি’-র অন্তিম শট, যেভাবে একটা ভায়োলেন্ট ইন্টারভেনশনে ক্যামেরাকে থামিয়ে দেয়, সেরকম ছেদবিন্দু আমরা আগে পানাহির ছবিতে দেখিনি। একেবারে সাম্প্রতিকতম ছবির আগের ছবি ‘নো বেয়ার্স’–এর মধ্যে আমরা দেখব কী ভয়ানক নির্দয়তা ও নির্মমতা একটা প্রাচীন মূল্যবোধ-যুক্ত গোষ্ঠী-সমাজের মধ্যে ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে। আর সেই হিংসার পাশাপাশি তার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলছে রাষ্ট্র, নিষেধাজ্ঞা ও কাঁটাতারের বেড়া। সেই ছবির শেষ দৃশ্যে যখন সমাজের বিধান না মেনে পালিয়ে যাওয়া প্রেমিক যুগলের পড়ে থাকা নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত শরীরের পাশ দিয়ে ধীরে পানাহির গাড়ি চলে যায়, তখন বোঝা যায় কী আগ্রাসী হিংস্রতা লুকিয়ে আছে সমাজের আপাত স্বাভাবিকতার আড়ালে!
প্রিজন বা কারাগার জাফর পানাহির ছবিতে এসেছে বেশ কয়েকবার। ‘দ্য সার্কেল’-এর চারটি মেয়ে যারা বাড়ি থেকে পালিয়েছিল তারা শেষপর্যন্ত একই জেলখানায় এসে বন্দি হয়। পানাহির ‘অফসাইড’ ছবিতেও জেলখানা একটু অন্যভাবে আছে। পুরুষের সজ্জায় যে মেয়েরা ফুটবল স্টেডিয়ামে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল, তাদের ধরে আটকে রাখা হয় এক অস্থায়ী কারাগারে। আর ‘দিস ইজ নট এ ফিল্ম’ এমন একটা কারাগারের ছবি, যে কারাগার আসলে গৃহবন্দি পানাহির নিজ গৃহ। সাম্প্রতিক ইরানের দিকে তাকালে আমরা দেখব বিগত পাঁচ বছর যাবৎ যে তীব্র নারী আন্দোলন, হিজাব-বিরোধী প্রতিরোধ দানা বেঁধেছে– তার সূত্র ধরে একের পর এক প্রতিবাদী মেয়েদের কুখ্যাত এভেন প্রিজনে বন্দি করেছে রাষ্ট্র। এই বিদ্রোহ দমনের নিষ্ঠুর বাসনা নিয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বৈরাচারী রাষ্ট্র আটকে রেখেছে বহু মানবাধিকার কর্মী এবং রাজনৈতিক কর্মীকে। অনেককে কারাগারেই হত্যা করা হয়েছে। অনেককে বিচারের নামে প্রহসন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আসলে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে, যেন গোটা দেশটাই একটা কারাগার হয়ে উঠেছে।
ফলে এটা খুব স্বাভাবিক সম্ভাবনা ছিল যে জাফর পানাহি ওই কুখ্যাত এভিন প্রিজনের অনুষঙ্গ কোনও না কোনওভাবে তাঁর ছবিতে নিয়ে আসবেন। ‘ইট ওয়াস জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ পাঁচজন লোকের কথা বলবে, যে পাঁচজন রাজনৈতিক বন্দি একসময় একটি লোককে খুঁজে পায়, যাকে দেখে তাদের মনে হয় এই সেই লোক, যে জেলখানায় তাদের ওপর অত্যাচার করেছিল। তারা লোকটিকে অপহরণ করে এবং ঠিক করে তাকে একটি নির্জন মরুপ্রান্তরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে। তাহলে পানাহির এই ছবি কি একটি রিভেঞ্জ ড্রামা? না, পানাহির ছবির সূক্ষ্ম রাজনীতিবোধ এইখানেই দাঁড়িয়ে আছে। একটা সময় এই পাঁচজনের মনে একটা সন্দেহ জাগে, এই কি সেই লোক যাকে তারা হত্যা করতে চায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে? এর চেয়েও আরও বড় একটা প্রশ্নের সম্মুখীন তারা হয়– আসলে এই জিঘাংসা ‘ন্যায়বিচার’ নাকি প্রতিহিংসা মাত্র? এইখানে পানাহি আমাদের একটা নৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। ইরানের ছবি তার কঠিনতম চ্যালেঞ্জের মুখেও এই নৈতিকতার প্রশ্নকে ভোলে না। কিয়ারোস্তামি ভুলতেন না। পানাহিও ভোলেননি। এখানেই পানাহির জয়। ছবিটাকে বৃহত্তর অর্থে ধরলে, একটা বড় প্রশ্নের মুখে তিনি আমাদের ফেলে দেন ‘মৃত্যুদণ্ড’ আসলে ন্যায়বিচার নাকি কেবলই (রাষ্ট্রের) প্রতিহিংসা?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved