Robbar

পুরুষ মানেই সে শাসক আর নারী মানেই সে শোষিত, এই একপেশে সমীকরণ ‘লাপতা লেডিজ’ বিশ্বাস করে না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 9, 2024 8:26 pm
  • Updated:March 9, 2024 8:34 pm  

টিভিএফ-এর ওয়েবসিরিজ ‘পঞ্চায়েত’। সেখানে গ্রামের চরিত্রগুলো এমনভাবে কথা বলে, আচার-আচরণ করে, যা দর্শকদের ঠোঁটে হাসি এনে দেয় ঠিকই, কিন্তু এখানে এক ধরনের জোচ্চুরি লুকিয়ে থাকে। চরিত্রগুলোর বোকামো আমাদের হাসি উদ্রেগ করে। ক্রিয়েটররা এমনভাবে চরিত্রগুলোকে বানান, যাতে তাদের উজবুক কথাবার্তা, ভ্যানতারা আচরণ দেখে দর্শক হেসে লুটোপুটি খায়। ‘লাপতা লেডিজ’ সে-পথে একেবারেই হাটেনি। এখানে ন্যারেটিভের মধ্যে সচেতনভাবে এরকম কিছুই রাখা হয়নি। দর্শক হেসেছে গল্পের রকমফেরে।

সুমন সাহা

দিন আনি, দিন খাই আম-আদমি প্রতিনিয়ত লিঙ্গ বৈষম্য, পুরুষতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ের মুখোমুখি হলেও কিংবা সেসবে জেরবার হলেও, বঞ্চনার উপলব্ধি হয়তো অনেকেরই জীবনভর করে ওঠা হয় না। সমাজবিজ্ঞানের পাতায় কিংবা বড় বড় সেমিনারে অনেক কথাই গুরুগম্ভীরভাবে বলা হয়। সে-কথাই কিরণ রাও তাঁর নতুন ছবি ‘লাপতা লেডিজ’-এ বলেছেন সহজ ও অকৃত্রিমভাবে। যা দেখে গ্রামের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় না থাকা মানুষও যেমন সহমত হবেন, তেমনই শহুরে দামি গাড়িতে চড়া লোকজনও মিল খুঁজে পাবেন। উপরি পাওনা নিখাদ বিনোদন, যা সাম্প্রতিক ভারতীয় কমার্শিয়াল ছবিতে আর পাওয়াই যায় না, গেলেও গুচ্ছের এজেন্ডা-সমৃদ্ধ হয় সেসব। সেদিক থেকে ‘লাপতা লেডিজ’-এর মতো এজেন্ডাহীন নির্মল বিনোদন প্রায় বিরল। এ-ছবির এক মুখ্য চরিত্র, অজ স্টেশনে চা-জলখাবার বিক্রেতা মঞ্জু মাই মজার ছলে কত অনায়াসে বলে বসে, “ইয়ে দেশ মে লড়কি লোগ কে সাথ হাজারো সালো সে ইক ফিরোড (ফ্রড) চল রহা হ্যায়। উনকা নাম হ্যায় ‘ভালে ঘর কি বহু-বেটি’।” কিংবা ছবিতে প্রায় শেষের দিকে নিষ্পাপ ফুল যখন প্রশ্ন করে, ‘হাম লড়কিয়ো কো কাহে মওকা নহি দেতে হ্যায়, দাদি? কাহে হমকো ইতনা লাচার বনা দেতে হ্যায়?’, তখন উত্তরে মঞ্জু মাই জানায়, ‘ডর সে শায়দ। অউরত আনাজ উগা ভি সকতি হ্যায়, পাকা ভি সকতি হ্যায়। বাচ্চা পয়দা ভি কর সকতি হ্যায়, বড়া ভি কর সকতি হ্যায়। দেখনে যায় তো অউরতো কো মর্দো কি কৌনো খাস জরুরত ব্যায়সে হ্যায় নেহি। অউর ইয়ে বাত অগর অউরতো কো পতা চল গয়ি, তো মরদ বেচারা কা বাজা না বাজ যায় গা! আব সমঝি, কা ফিরোড (ফ্রড) চল রহা হ্যায়?’

এত সহজ-সাবলীল কথাকে ন্যারেটিভের সঙ্গে মসৃণভাবে মিশিয়ে কিরণ রাও ও তাঁর টিম পরিবেশন করেছেন যে, দেখে চমক লাগতে বাধ্য। আজকের অত্যাধুনিক ফিল্মমেকিংয়ের যুগে এরকম ওল্ড-স্কুল, অথচ সমস্ত আঙ্গিকে সুঠাম কাজের দেখা মেলা ভার।

পরিচালক কিরণ রাও

 

গল্পের প্রেক্ষাপট ভীষণ সাধারণ। দীপক নামের এক গোবেচারা ছেলে ভিনগ্রাম থেকে ফুল নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিজের গ্রামে নিয়ে আসে। এই আনন্দ উৎসবে গোটা মহল্লা উচ্ছ্বসিত, অথচ নববধূ ঘোমটা তুলতে দেখা যায়, এ তো ফুল নয়, অন্য কেউ! যে-ট্রেনে চেপে বউ এনেছে দীপক, সে-ট্রেনেই বউ বদলে গিয়েছে ভুলবশত! বউ ভেবে যাকে এতদূর সঙ্গে করে নিয়ে এল, সে অন্য কারও বউ!

শুরু হয় বউ খোঁজার পালা। কিন্তু ঘোমটায় ঢাকা বউয়ের ফটো দেখে না তো পুলিশ ঠিকভাবে সাহায্য করতে পারে, আর না তো পাড়া-প্রতিবেশী। ওদিকে ফুল স্টেশন থেকে নেমে বরকে খুঁজে পায় না। মায়ের কাছে ছোট্টবেলা থেকে সংসারের কাজই সে কেবল শিখেছে। কীভাবে পথ চিনে বাড়ি ফিরতে হয়, তা আর ফুলের শিখে ওঠা হয়নি। স্টেশনে দোকানদার মঞ্জু মাই, নকল ভিখারি আব্দুল আর মঞ্জু মাইয়ের দোকানে কাজ করা ছোটুর সঙ্গে ফুলের পরিচয় হয়। শুরুতে ফুলের স্বামীর প্রতি অমলিন ভালোবাসা দেখে মঞ্জু মাই ভর্ৎসনা করলেও, ক্রমশ ফুলকে আপন করে নিতেও দেরি হয় না তার।

এদিকে বউ বদলের জেরে দীপকের বাড়িতে এসে ওঠা পুষ্পাকে ঘিরে ঘনাতে থাকে সন্দেহের মেঘ। থানার দারোগা ও দর্শক, উভয়েরই সন্দেহ– এ-মেয়ে নির্ঘাত ডাকাত দলের সদস্য, বিয়ে করে দামি গয়না নিয়ে চম্পট দেওয়াই এর কাজ। এমন জমজমাট ন্যারেটিভ ধরে সিনেমা এগোতে থাকে আর দর্শককে ভাসিয়ে নিয়ে চলে এক অবাক দুনিয়ায়, ম্যাজিকের জগতে।

Laapataa Ladies | Laapataa Ladies: The first poster and release date of Kiran Rao's upcoming film out ahead of its TIFF premiere - Telegraph India

ছবিতে ছোটু চরিত্রটি একবার বলে, ‘ইয়ে দুনিয়া বহত হি আজিব হ্যায়। ইহা জো জয়সা দিখতা হ্যায়, ব্যয়সা হোতা নহি হ্যায়। অউর জয়সা হোতা হ্যায়, ব্যয়সা দিখতা নহি।’ এ-ছবির চিত্রনাট্যও তেমনই। যা দেখি– শেষে দেখা যায়, তা অন্য কিছু। ছিল বিড়াল, হয়ে গেল রুমাল। আদতে রুমালই ছিল যে! বিড়ালের অস্তিত্বই ছিল না। আমরাই বিড়াল ভেবে নিয়েছিলাম অকারণে। কেউ তো বলেইনি যে, ওই দেখো বিড়াল। আমরাই মনগড়া ভেবে নিই। যেভাবে স্রোতের বিপক্ষে হাঁটা মেয়েদের আমরা হ্যাটা করি, অবদমিত করি, কালো দাগে দাগিয়ে দিয়ে তিরতিরে মজা পাই। যেভাবে মঞ্জু মাইয়ের নিজস্ব উপার্জনে জীবন চালানো মদ্যপ বর রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে বউকে মারধর করত আর বাধা দিলে বলত, এই মার ভালোবাসার অন্য নাম। যেভাবে যুগের পর যুগ ধরে পর্দা অথবা ঘোমটায় মেয়েদের মুড়ে ফেলার স্বার্থসমৃদ্ধ বচনও ওই বিড়ালের মতোই আমরা ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিয়েছি।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

ঠুনকো নারীবাদ নিয়েও ছবিটা মাথা ঘামায় না। পরিবর্তে আমাদের চেনাজানা জগতটাকেই মজার ছলে পর্দায় মেলে ধরে। সুশীল নাগরিকরা পপকর্ন চিবোতে চিবোতে, কমেডিতে হাসতে হাসতে আচমকাই চমকে ওঠে, ‘আরে, এমনটা তো আমরাই আকছার করে থাকি! ফিল্মমেকার তো আমাদের মানসিকতা নিয়েই ব্যঙ্গ করছেন।’ ভাবতে না ভাবতেই স্ক্রিনে এসে যায় মজার টানটান কোনও মুহূর্ত, আবার দর্শক ভাবনা পাশে ঠেলে পপকর্নে ডুবে যায়। এমনভাবে ছবির সঙ্গে দর্শকদের মিশিয়ে দিতে পারা সহজ কাজ নয় মোটেই।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

কিরণ যুগ যুগ ধরে চলা এই জালিয়াতিগুলোই বড় পর্দায় সাধারণ জনগণের নিজস্ব ভাষায় বলেছেন। ফলাফল? সিনেমাহল জুড়ে বিশেষ মুহূর্তগুলোতে তোলপাড় করা হাততালি, সিটির বন্যা। আর ছবির শেষে চোখজুড়ে একপশলা বৃষ্টিপাত, ঠোঁটজুড়ে নরম হাসি। স্যাটায়ারের মোড়কে সামাজিক বার্তাও যে কীভাবে দর্শকের মন ছোঁয়ার উপযোগী করে বানানো যেতে পারে, ‘লাপতা লেডিজ’ তার প্রমাণ।

সহজ কথা বলাটা এত সহজও ছিল না। কিরণ রাও এর আগে ২০১০ সালে ‘ধোবি ঘাট’ বানিয়েছিলেন। সে-ছবি বড় ব্যক্তিগত ছিল। বোম্বে শহরের অদেখা দিক আর এমন কিছু মানুষের গল্প তিনি তাতে বলেছিলেন, যাদের কথা বদলে যাওয়া শহরটা থেকে বাইরে বের হতে পারে না। সময়ের হেরফেরে শহর বদলায়, বোম্বে ক্রমশ মুম্বই হয়ে ওঠে। মানুষকে তাদের স্মৃতি, মনখারাপ, অনির্ণেয় দুঃখ, সুখের রকমারি মুহূর্ত সব পার করে এগিয়ে যেতে হয়। এগিয়ে চলাই নিয়তি। সে-ছবিতে অরুণ (আমির খান), সাই (মোনিকা ডোগরা), মুন্না (প্রতীক বব্বর) সকলে এগোয়। আর কেউ কেউ, খুব নিষ্পাপ কেউ, যাদের চোখে অনেক স্বপ্ন, অথচ মনও যাদের খুব নরম, তারা আর এগোতে পারে না। যেমন ইয়াসমিন নূর (কৃতি মলহোত্রা)। ফুরিয়ে যায় অল্প সময়ে। কংক্রিটের শহর তার মতো মানুষদের গিলে খায়।

‘ধোবি ঘাট’-এ ফিল্মের নানা ফর্ম নিয়ে কিরণ পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। ভিডিওগ্রাফি, রঙিন পেইন্টিং, সাদা-কালো ফটোগ্রাফে এক টুকরো অচেনা বোম্বে শহর রয়ে গেছে। কিরণের নিজস্ব অভিজ্ঞতা এ-ছবিতে মিশে আছে। যেহেতু অনেক ব্যক্তিগত ছবিটা, তাই সর্বস্তরের দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এরকম ফিল্মমেকাররা সাধারণত তাঁদের দ্বিতীয় কাজে চেনা রাস্তা ধরেই এগিয়ে থাকেন, অন্তত ইতিহাস তাই বলে। কিরণ তা করেননি। ১৩ বছর অপেক্ষার পর যে-ছবিটা নিয়ে এলেন, তা ‘ধোবি ঘাট’ বা এইগোত্রীয় ছবির থেকে একেবারে উল্টোপ্রান্তে দাঁড়ানো। ‘লাপতা লেডিজ’ পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল ফিল্ম, যেখানে সব কিছুই বিশুদ্ধ। যথাযথ শট, মন্তাজ, হাস্যকৌতূক, গানের ব্যবহার, বক্তব্য রাখার ভঙ্গি, অভিনয়, পরিচালনা, স্ক্রিন-প্লে থেকে শুরু করে ফিল্মের অন্যান্য আনুষঙ্গিক দিক, সব দিক থেকেই এতটুকুও ফাঁকি নেই।

ছবির গল্প এক বাঙালি ছেলের লেখা, নাম তার বিপ্লব গোস্বামী। একদা একটি চিত্রনাট্য লিখে চিত্রনাট্য লেখার এক জাতীয় প্রতিযোগিতায় জমা দেন, সেখানে পুরস্কৃত হয় তাঁর লেখা। আমির খানের মনে ধরে, পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রোডাকশন হাউজ বিপ্লবের কাছ থেকে কপিরাইট কিনে নেয়। এরপর চলে স্ক্রিন-প্লে নিয়ে স্নেহা দেশাইয়ের নিরন্তর ঘষামাজা। বিপ্লবের স্ক্রিন-প্লে ছিল অনেক বেশি গুরুগম্ভীর, ডার্ক টোনের। স্নেহা তাতে যোগ করেন কমেডি ও স্যাটায়ারের স্পর্শ। ডায়ালগে আনেন তরতাজা ভাব। তবে কেবল স্ক্রিন-প্লে চমৎকার হলেই হল না, যোগ্য সঙ্গত চাই চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনার। এই দুই কাজে দুই জহুরিকে বেছে নিয়েছেন কিরণ– যথাক্রমে বিকাশ নৌলাখা (দশ কাহানিয়া, ব্রহ্মাস্ত্র) এবং জবিন মার্চেন্ট (মনোরমা সিক্স ফিট আন্ডার, এনএইচ১০, কড়বি হাওয়া, শ্যু বক্স, জুইগেটো ইত্যাদি)। এছাড়াও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগটি হল এ-ছবির সংগীত। সমগ্র ন্যারেটিভকে বুনেছে সংগীতই, যে বিভাগে রাম সম্পত চমৎকার কাজ করেছেন। গানের সংখ্যা মাত্র চারটি, অথচ চারটি গানই এত শ্রুতিমধুর ও মুহূর্ত অনুযায়ী যথাযথ যে, গোটা অ্যালবামটিই বছরের শ্রেষ্ঠ ফিল্ম অ্যালবামের দাবিদার, এখন থেকেই।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আরও পড়ুন: ভাঙা ঘরের গোপাল আর চন্দ্রিলের ‘আটপৌরে’ ছবি

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

তবে সবকিছুর ওপরে আছে এই ছবির তিন তরুণ তুর্কী, যাদের অপরিচিত মুখ ও নজরকাড়া অভিনয় সবথেকে বেশি বাজিমাত করেছে। স্পর্শ শ্রীবাস্তবের সারল্য, প্রতিভা রান্তার সোজাসাপ্টা ম্যানারিজম আর নীতাংশী গোয়েলের ফুলের মতোই নিষ্পাপ চোখের ভাষা– একদম শেষ অবধি দর্শকদের সিটে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে। এরা একদমই আনকোরা, অথচ এতটুকু অতি-অভিনয় দোষে দুষ্ট নয়। অভিজ্ঞদের মধ্যে রবি কিষাণ এখানে নিঃসন্দেহে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়টি করেছেন। থানার দারোগার চরিত্রে যে যথার্থতা ও আগল নিয়ে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি, তা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। আর আছেন ছায়া কদম। মঞ্জু মাইয়ের চরিত্রটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম মনে রাখার মতো চরিত্র। নারী স্বাধীনতা, লিঙ্গ সমতা নিয়ে অনেক বড় বড় বুলির মাঝে এই চরিত্রটি নিজের দাপটে জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছে, ভাগ্য ও সমাজ-নির্মিত জোচ্চুরির হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়নি। ছায়া কদম একদম অভিনয় না করেই পরপর ছক্কা মেরে গিয়েছেন। বাকিদের মধ্যে গীতা অগ্রবাল শর্মা, রচনা গুপ্তা থেকে শুরু করে অন্য যেকোনও ছোট-বড় চরিত্রে অভিনয় করা প্রত্যেক অভিনয়কর্মীই সুনিপুণ নির্বাচন।

Laapataa Ladies Movie Review: Kiran Rao's Masterpiece

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোনও নিষ্পাপ ও দুর্বল মনের মানুষ মাত্রেই পুরুষতন্ত্রের শিকার। এই ব্যবস্থায় আমাদের শেখানোই হয়নি যে, বিভিন্ন সম্পর্কের ভিড়ে বন্ধুত্ব বলেও একটা সম্পর্ক থাকতে পারে, যেখানে লিঙ্গ নির্বিশেষে যে-কেউ বন্ধু হতে পারে। পুরুষ মানেই সে শাসক আর নারী মানেই সে শোষিত– এই একপেশে ও ভুলে ভরা সমীকরণ কিন্তু ‘লাপতা লেডিজ’-এর আলোচ্য বিষয় নয়।

ঠুনকো নারীবাদ নিয়েও ছবিটা মাথা ঘামায় না। পরিবর্তে আমাদের চেনাজানা জগৎটাকেই মজার ছলে পর্দায় মেলে ধরে। সুশীল নাগরিকরা পপকর্ন চিবোতে চিবোতে, কমেডিতে হাসতে হাসতে আচমকাই চমকে ওঠে, ‘আরে, এমনটা তো আমরাই আকছার করে থাকি! ফিল্মমেকার তো আমাদের মানসিকতা নিয়েই ব্যঙ্গ করছেন।’ ভাবতে না ভাবতেই স্ক্রিনে এসে যায় মজার টানটান কোনও মুহূর্ত, আবার দর্শক ভাবনা পাশে ঠেলে পপকর্নে ডুবে যায়। এমনভাবে ছবির সঙ্গে দর্শকদের মিশিয়ে দিতে পারা সহজ কাজ নয় মোটেই। অন্তত আজকের এই ওটিটি যুগে। শেষ চার-পাঁচ বছর ধরে মানুষের ধৈর্যশক্তি যেমন কমেছে, তেমনি ওটিটির রাজত্ব বেড়েছে। নামীদামি ফিল্মমেকাররাও তাঁদের নতুন ছবি বানাচ্ছেন ওটিটি ফরম্যাটে উপযোগী করে।

সিনেমাহলে এখন কেবল ‘অ্যানিমেল’-এর মতো উগ্র মেল শভিনিস্টিক ছবির রমরমা। দর্শক চাইছেই না সময় খরচ করে হলে গিয়ে ভালো ছবি দেখতে। সবার এখন এক মানসিকতা, আর তো দিনকয়েক বাদেই ওটিটিতে চলে আসবে, তখনই কেটেকুটে দেখে নেব যা দেখার। এরকম কঠিন সময়ে বড় পর্দার জন্য ছবি বানানোর বিকল্পগুলো ক্রমশ কমে আসছে। সেখানে ‘লাপতা লেডিজ’-এর মতো কাজ মনভরানো দমকা হাওয়ার মতো। ওটিটি টেমপ্লেটে বানানো ছবি নয়, বড়পর্দার ম্যাজিক এতে অক্ষুণ্ণ থেকেছে। ছবি শেষে দর্শক একবুক আনন্দ নিয়ে হল থেকে বের হতে বাধ্য। ক’জন পারে আজকাল?

গ্রামবাংলার সরল জীবনযাপন নিয়ে সাম্প্রতিক কাজগুলোর নিরিখেও, ‘লাপতা লেডিজ’ অনেকটাই আলাদা। ইদানীং এক ধরনের প্রবণতা দেখা যায়– সাধারণ মানুষজনের সারল্যকে কমেডির স্বার্থে ব্যবহার করা। হাতের কাছেই আছে উজ্জ্বল উদাহরণ। টিভিএফ-এর ওয়েবসিরিজ ‘পঞ্চায়েত’। সেখানে গ্রামের চরিত্রগুলো এমনভাবে কথা বলে, আচার-আচরণ করে, যা দর্শকদের ঠোঁটে হাসি এনে দেয় ঠিকই, কিন্তু এখানে এক ধরনের জোচ্চুরি লুকিয়ে থাকে। চরিত্রগুলোর বোকামো আমাদের হাসি উদ্রেক করে। ক্রিয়েটররা এমনভাবে চরিত্রগুলোকে বানান, যাতে তাদের উজবুক কথাবার্তা, ভ্যানতারা আচরণ দেখে দর্শক হেসে লুটোপুটি খায়। ‘লাপতা লেডিজ’ সে-পথে একেবারেই হাঁটেনি। এখানে ন্যারেটিভের মধ্যে সচেতনভাবে এরকম কিছুই রাখা হয়নি। দর্শক হেসেছে গল্পের রকমফেরে। গ্রামের সাধারণ মানুষজন এই চরিত্রগুলো, এরা কেউ এজেন্ডা হয়ে ধরা দেয়নি। তাদের গল্প তারা নিজেদের মতো করেই বলেছে। এটা খুব সূক্ষ্ম একটি বিষয়, যেদিক থেকেও ‘লাপতা লেডিজ’ অত্যন্ত সফল।