গল্পের প্রবাহে ছেলে বা মেয়েটি এখানে নিজেরাই সব সিদ্ধান্ত নেয়, কাউকে কম বেশি মনে হয়নি। দিলওয়ালের কাজলের মতো নায়িকাকে অপেক্ষা করতে হয়নি যে, কখন ট্রেন স্টেশনে বাবা হাতটা ছাড়বে আর প্রেমিক হাতটা ধরে নেবে। এই হাত বদলের গল্প এখানে উহ্য, ব্যক্তিগত প্রেমের সম্পর্কে বন্ধু বা পিতা পরামর্শ দিচ্ছে বটে, কিন্তু তারা ‘নীতিপুলিশি’ করছে না, অভিসন্ধিও সেটা নয়। সব মিলিয়ে আজকের নাগরিক যুবসমাজ অনেকাংশে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারে বাণী ও কৃষের সঙ্গে। আজকের ক্যারিয়ার, সোশ্যাল মিডিয়া, ক্রিকেট, ক্যাফের প্রজন্ম এক টুকরো আমিকে দেখছে ‘সাইয়ারা’তে। তবে সবটা অবশ্যই তার প্রতিচ্ছবি নয়। পপুলার কালচার, জনপ্রিয় সিনেমা, সাহিত্য, গান আমাদের অনেক সময় দেখাতে চায়, যা আমরা গভীরভাবে অন্বেষণ করে চলেছি। যেটা আমার ডিসায়ার বা আকাঙ্ক্ষা, যেভাবে আমি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই, সেই ‘গ্র্যান্ড জেসচার’ দেখতে ভালো লাগে আমাদের; হোক না তা কাল্পনিক।
বর্ধমানের রাজকন্যার প্রেমে পড়েছিল এক দক্ষিণী রাজকুমার। ঘোড়ার পিঠে চড়ে সে লুকিয়ে দেখা করেছিল প্রাসাদে। তাকে সাহায্য করেছিল অন্দরমহলেরই এক পরিচারিক– হীরা মালিনী। রাজকন্যাকে আলতা, সুগন্ধি, ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার সময় সে সযত্নে নিয়ে যেত প্রেমের বার্তা। ভালোবাসা, যৌনতা, বিরহ, মানভঞ্জন, অভিমান; ক্রমশ গল্প এগয়। তাদের সম্পর্কের কথা রটে যাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত মিলন হয় নায়ক-নায়িকার।
গল্পটা কি খুব চেনা লাগছে? অভিসার, অভিমান, মিলন, এ তো পদাবলি সাহিত্যের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের অনুকরণ! তারা যদিও রাজার সন্তান ছিলেন না। কিন্তু প্রেমের পর্বগুলো? কথা হচ্ছে বিদ্যাসুন্দরের। প্রেম, বিরহ, কামনা, সব মিলিয়ে চেনা ছকের গল্প, যা মধ্যযুগের বাংলার নারীপুরুষ শুনতে অভ্যস্ত। অতি পরিচিত প্লট হলেও, এই গল্প কিন্তু এখনকার ভাষায় যাকে বলে, সুপারহিট। এতই তার জনপ্রিয়তা যে ভারতচন্দ্রের লেখার দু’-শতক পরেও তাকে ঘিরে নাটক, বই, গান, কবিতা, কিছুই আটকানো যাচ্ছে না। সকলে বিদ্যাসুন্দরের গল্পই শুনতে চায়। এতে কোন ব্রিটিশ ‘কুরুচি’ বলে দাগিয়ে দিল আর কোন শিক্ষিত বাবু মুখ ব্যাঁকালো– তাতে পাত্তা দিতে নারাজ যাত্রাপ্রেমীরা!
এমনই প্রেমের গল্প, অতি সাধারণ, চেনাজানা চরিত্র, কিন্তু আমরা গিলি গোগ্রাসে। এখন অবশ্য যাত্রা বা কবিগান নয়, গত শতকের মাঝামাঝি থেকে সিনেমা বলে এক মাধ্যম আমাদের স্বপ্ন দেখায়, কাঁদায়, হাসায় আর সংযোগ তৈরি করে সারা ভূ-ভারতে। প্রেমের সিনেমার ধারা হিন্দিতে শুরু হয়েছে সেই কবে থেকে আর বাংলায় দেখা উত্তম-সুচিত্রা জুটি। যদিও অভিযোগ রয়েছে যে বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে পিরিয়ড ড্রামা বা জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্র বাজারে নাকি বেশি গ্রহণযোগ্য।
স্বদেশপ্রীতির ভাষ্য বদলে গিয়েছে এখন, তারই ছাপ চলচ্চিত্রে আর এমনই দুর্দিনে নাকি ‘সাইয়ারা’ নামে একটি সিনেমা রীতিমতো গণ হিস্টিরিয়া তৈরি করেছে সারা দেশে। বিশেষত বয়ঃসন্ধিদের মধ্যে। কেউ কাদঁছে গলা ছেড়ে, কেউ বা ফুঁপিয়ে! কিন্তু কেন? কী এমন আছে এই সিনেমায়? খানিক কৌতূহলবশত দেখে ফেললাম। মাথায় চলতে থাকল পাল্প আর পপুলারের ট্রোপ! নিজের যাবতীয় প্রিকনসিভড নোশন বা পূর্ব-কল্পিত ধারণা কিছুক্ষণের জন্য ত্যাগ করে মনে হল, খুব সাধারণভাবে যদি একটা গল্প হিসেবে সিনেমাটি অনুধাবনের চেষ্টা করি? এখানে ফিল্ম ক্রিটিসিজম, সংলাপের গভীরতা, আলো কীভাবে পড়ছে সেটে, এইসব ভাবার একেবারেই অবকাশ নেই। ফিল্ম রিভিউ হিসেবে এই লেখা না পড়লেই ভালো। বরঞ্চ যদি খুঁজে দেখি যে পপুলারিটির পরিমাপক হিসেবে ঠিক কী কাজ করছে এখানে? এই জনপ্রিয়তা কি আসলে নিজেকে খানিক আরশিতে দেখতে চাওয়ার বাসনা, নাকি যা আমি আদতে অনুভব করতে চাই, তার খণ্ডাংশ রুপোলি পর্দায় দেখে আসক্ত হয়ে পড়া? ভালোবাসার ছবি আগেও হয়েছে, তাহলে এই সিনেমা নতুন কী দিল দর্শককে?
একটু বিশদে বলি, ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’ বা ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া’ দিয়ে যে প্রেমের ছবির ট্রেন্ড শুরু হয়েছে হিন্দিতে, তারই উত্তরসূরি এই সিনেমা, এমনটা ঠিক নাও হতে পারে। প্রথমেই যেটা বলার, তা হল গল্পের বিভিন্ন জায়গায় ভীষণ প্রাসঙ্গিক কিছু কথাবার্তা। হয়তো খুব ছোট রেফারেন্স বা উল্লেখ, তবুও সাইয়ারা-র গল্প যে ২০২৫ এ দাঁড়িয়ে লেখা হয়েছে, এটা স্পষ্ট।
ছোট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন নায়িকার নাম বাণী, সে একটি খ্যাতনামা নিউজপেপারে কাজ করতে এসেছে, হিন্দি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা তার। সেখানে জয়েন করার পরেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে– ‘তোমার সোশ্যাল মিডিয়াতে কত ফলোয়ার?’ যা না থাকলে আজকালকার দিনে রেডিওতে কাজ, ইন্টারভিউয়ার বা ফিল্ম ক্রিটিসিস্ট, সকলেরই একটু অসুবিধা হবে বইকি। আজকের ১৮-২০ বছরের ছেলেমেয়েরা এই চিত্রের সঙ্গে নিজেকে সহজে মানিয়ে নিতে পারে, সত্যিই তো এখন রেডিও জকিদেরও ‘স্ক্রিন প্রেজেন্স’ খুব দরকারি।
গল্পে নায়ক-নায়িকার মা-বাবার চরিত্রও বেশ চিত্তাকর্ষক। তারা সেনসিটিভ, অতিরিক্ত নীতিপুলিশি বা দিলওয়ালের অমরেশ পুরীর মতো নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় না। সময় তো বদলেছে, এখন প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের মধ্যে পারিবারিক অসম্মতি ছাড়াও রয়েছে হাজারও নতুন দৃষ্টিকোণ। আটের দশকের শেষে যে নিরাপত্তা বেষ্টনী কাজ করত, তা ক্রমশ শিথিল হয়েছে, মেট্রোপলিটন সিটির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন অতি দ্রুত। নারী-পুরুষের প্রেমের পরিণতিতে এখন পরিবারের অসম্মান বা সম্মতির প্রশ্ন ছাড়াও যেটা ভাবায়, তা হল উভয়ের ক্যারিয়ার। কে কোথায় থাকবে? বিয়ে হয়ে গেলেও একই শহরে একসঙ্গে থেকে উপার্জন করা সম্ভব তো? মহানগরে আরতি বলেছিল যে, এই শহর, এত বড়, কেউই কি চাকরি পাব না আমরা? তার স্বামী ছিল অপটিমিস্টিক, সেই আশা আমরা আর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই না। নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে এখন আছে ডেডলাইন, সোশ্যাল মিডিয়া, কনজিউমারিজম এবং লিঙ্গসাম্য ধরে রাখার ব্যাকুল চেষ্টা। তবে এই সব সমীকরণ নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
সাইয়ারাও নাগরিক প্রেক্ষাপটেই লেখা। তাই গল্পে আমরা দেখি যে, যখন প্রেমিক-প্রেমিকা ঘুরতে যায় ( তথাকথিত ‘ভ্যাকেশন’ নয়, বরঞ্চ আগেকার দিনে অসুস্থ হলে ‘হাওয়া বদল’ হিসেবে বিবেচিত, খানিক তেমনই দেখানো হয়েছে গল্পে) সেটি হয় বাবা মায়ের সম্মতিতেই। এখানে নয়ের দশকের সিনেমাগুলোর মতো পারিবারিক অশান্তি অন্তরায় নয়। আরও ভালো লাগে যে, পুরো গল্পে বাণী ও কৃষের প্রেম ছাড়া আর প্রায় কোনও অ্যাঙ্গেলই নেই। অসুস্থতা আছে, অ্যালজেইমার আছে, নায়কের বিখ্যাত গায়ক হওয়ার স্বপ্ন আছে বটে, কিন্তু সবই ঘুরে-ফিরে তাদের প্রেমের উত্থান-পতনের ন্যারেটিভ। তাতে সিনেমার শেষ ভাগ অবধি দেখে যেতে কোনও অসুবিধা হয় না দর্শকের। মনের মিল হলে, যদি মনে হয় সামনের মানুষটি সত্যিই আমাকে ভালো রাখবে বা আমাকে সম্মান করবে, তাহলে তাকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ না নিয়ে লড়ে যাওয়া, এটাই মোদ্দা কথা। সেখানে যদি পুরুষকে পাঁচটা কনসার্টে উপার্জনের মোহ ছেড়ে প্রিয় নারীর পাশে বসে থাকতে হয়, তাকে সেবা শুশ্রূষা করে, ওষুধ, ঘুম বা বাকি প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে দেখাশোনা করতে হয়, তাহলে অসুবিধা নেই। এখানে কিন্তু নায়কের, যে কোনও মর্মে, প্রিয় মানুষটির পাশে থেকে যাওয়াকে গ্লোরিফাই করা হয়েছে। সেই পাশে থাকাটা যেমন আজকের দিনে বিরল, তেমন লিঙ্গরাজনীতির তথাকথিত ভাবধারায় পুরুষের কাছ থেকে এই ‘লাভ অ্যান্ড ওয়ার্মথ’ আশা করার মধ্যেও একটা মৌলিকতা আছে গল্পের। যে আন্তরিকতা আমরা আর সচরাচর প্রত্যাশা করি না রুপোলি পর্দায়।
হিংসা বা রক্তারক্তির দৃশ্য যে একেবারে নেই তা নয়– কিন্তু দু’-একটি জায়গা ছাড়া তা বিশেষ প্রভাব ফেলেনি গল্পে। অনেক দিন পর একটি মূলধারার হিন্দি সিনেমা চোখে পড়ল, যেখানে স্টকিং নেই, মিসোজেনিক কথাবার্তা নেই, জেন্ডার স্টিরিওটাইপ একদম নেই তা নয়, তবে বলিউডের ধারা অনুযায়ী অনেকটাই সংযত।
গল্পের প্রবাহে ছেলে বা মেয়েটি এখানে নিজেরাই সব সিদ্ধান্ত নেয়, কাউকে কম বেশি মনে হয়নি। দিলওয়ালের কাজলের মতো নায়িকাকে অপেক্ষা করতে হয়নি যে, কখন ট্রেন স্টেশনে বাবা হাতটা ছাড়বে আর প্রেমিক হাতটা ধরে নেবে। এই হাত বদলের গল্প এখানে উহ্য, ব্যক্তিগত প্রেমের সম্পর্কে বন্ধু বা পিতা পরামর্শ দিচ্ছে বটে, কিন্তু তারা ‘নীতিপুলিশি’ করছে না, অভিসন্ধিও সেটা নয়। সব মিলিয়ে আজকের নাগরিক যুবসমাজ অনেকাংশে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারে বাণী ও কৃষের সঙ্গে। গল্পে দেখানো হয়েছে যে নায়কের মন খারাপ হলে, তার অ্যাগ্রেশন বা ক্ষোভ প্রকাশ করার জায়গা হচ্ছে ক্রিকেট প্র্যাকটিসের মাঠ। ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুল, সেখানেই কোহলি-ভক্ত নায়ক অটোমেটেড মেশিন থেকে বেরিয়ে আসা খেলার বলে ছয় হাঁকায়, ওটাই তার খানিক বিরাম। প্রেমিকাকেও নিয়ে যায় সেখানে– এইসব দৃশ্যই আমাদের অনেকের প্রাত্যহিক জীবনের খণ্ডাংশ। যে নদীঘাট, শাল-তমালের বনে প্রেম, বিরহের গান শুনে মধ্যযুগীয় নারী-পুরুষ মনে করত, এই প্রেম তো আসলে আমারই গাথা। তেমনই আজকের ক্যারিয়ার, সোশ্যাল মিডিয়া, ক্রিকেট, ক্যাফের প্রজন্ম এক টুকরো আমিকে দেখছে ‘সাইয়ারা’তে। তবে সবটা অবশ্যই তার প্রতিচ্ছবি নয়।
পপুলার কালচার, জনপ্রিয় সিনেমা, সাহিত্য, গান আমাদের অনেক সময় দেখাতে চায়, যা আমরা গভীরভাবে অন্বেষণ করে চলেছি। যেটা আমার ডিসায়ার বা আকাঙ্ক্ষা, যেভাবে আমি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই, সেই ‘গ্র্যান্ড জেসচার’ দেখতে ভালো লাগে আমাদের; হোক না তা কাল্পনিক। তাই ‘সাইয়ারা’ হচ্ছে সেই প্রেমের খোঁজ, যা আমরা আসল জীবনে হয়তো পাব না, কিন্তু গল্পে দেখতে ক্ষতি কী?
…………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
…………………………