
জয়ব্রতর ছবিতে ম্যাকগাফিন কুড়ি কোটি টাকার একটা কল্পনাপ্রসূত ‘ঐতিহাসিক’ ওয়াইন বটল, যার নাম তাঁরা দুষ্টুমি করেই রেখেছেন ‘ম্যাকগাফিন’। জোসেফ স্তালিনকে উপহার দেওয়ার জন্য আমেরিকার ওয়াইনরিতে তৈরি এবং শিপমেন্টের সময়ে জাপানি আক্রমণে সলিলসমাহিত, স্কটিশ সিংহের খাঁচার মতোই যা অ্যাবসার্ড ও অনৈতিহাসিক। গুগল জানাচ্ছে স্তালিন ভালোবাসতেন নানাধরনের জর্জিয়ান ওয়াইন, বিশেষত খোয়াঞ্চকারা, যা তিনি ইয়ালতা কনফারেন্স চলাকালীন চার্চিল এবং রুজভেল্টকেও খাইয়ে ছেড়েছিলেন। অপরপক্ষে রুজভেল্টের স্তালিনকে যুদ্ধ চলাকালে বা শেষে ক্রেট-ক্রেট বা ব্যারেল-ব্যারেল আমেরিকান ওয়াইন উপহার দেওয়া বিষয়ে গুগল বাবাজি সম্পূর্ণ নিরুত্তর, ফলে ধরে নেওয়ায় বাধা নেই যে এটি পুরোপুরি জয়ব্রতদের কল্পনা ও দুষ্টুমির ফসল। আগেই বলেছি, ওয়াইনের ‘ম্যাকগাফিন’ নামটিও এ কথার সাক্ষ্য দেয়।
কম বয়সে কবিতা লিখতে গিয়ে এক বা একাধিক অগ্রজ কবির প্রভাবে প্রভাবিত কে না হয়েছে? কোনও বিশেষ শব্দ, কোনও বিশেষ উপমা-রূপক-চিত্রকল্প ব্যবহারের লোভ সংবরণ করাও হয়েছে দুঃসাধ্য। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও দেখা যায় অতীতের খ্যাতনামা শিল্পীদের কাজ কপি করে হাত পাকাচ্ছে তরুণ শিল্পীখ্যাতি-প্রত্যাশী। সিনেমার ব্যাপারে তবে এর ব্যতিক্রম কেন হবে? নবীন ছবি-করিয়ে যদি তাঁর প্রথম সিনেমায় প্রিয় পরিচালকের থেকে অনুপ্রেরণা পান, একাধিক বিখ্যাত ছবির শট ধরে ধরে এন্তার কপি-পেস্ট করেন, এমনকী সে কথা ঠারেঠোরে নিজের থেকে সিনেমার মধ্যেই অথবা ক্রেডিটে স্বীকারও করে নেন তবে আর কী বা বলার থাকতে পারে?
কথাগুলো উঠল এদানি বিভিন্ন বিতর্কের মূলে থাকা সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের কতিপয় ছাত্রের তৈরি একটি থ্রিলার ছবিকে ঘিরে, যার নাম তাঁরা দিয়েছেন ‘দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’। ছবিটি কেমন, ছবিতে স্বকীয়তার দুধ আর অনুপ্রেরণার জলের মিশেলের অনুপাত কত কিংবা প্রথাগত বাংলা ছবির ধারাবাহিকতায় এ ছবির স্থানাঙ্ক নির্ণয়– বর্তমান লেখার উদ্দেশ্য সে সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা নয়, ইতোমধ্যে ফেসবুক-সহ অন্যান্য সমাজ মাধ্যমে তা বহুল চর্চিত ও আলোচিত। কেউ কথা বলছেন না এমন একটা প্রসঙ্গের অবতারণাই আজ আমাদের উদ্দিষ্ট।

কলেজবেলায় সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনায় প্রথম পড়ি ‘চেখভের বন্দুক’-এর কথা। রুশি কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার আন্তন চেখভ মনে করতেন গল্প-উপন্যাস বা নাটকে কোনও বস্তু, ব্যক্তি বা বিষয়ের অবতারণা বা উল্লেখ করা হলে তা কখনও অহেতুক হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। সেই বস্তু, ব্যক্তি বা বিষয়টিকে প্লটের সংকট মুহূর্তে, কাহিনির মোড় ঘোরাতে অথবা আখ্যানকে পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হবে। যেমন কোনও গল্প বা নাটকের শুরুর দিকে যদি কোনও বন্দুকের উল্লেখ বা দৃশ্যায়ন থাকে তবে ক্লাইম্যাক্সে সেই বিশেষ বন্দুকটিই হয়ে উঠবে বিশিষ্ট একটি প্লট ডিভাইস, এ বিশেষ ন্যারেটিভ প্রিন্সিপলকেই সাহিত্যের পরিভাষায় নাম দেওয়া হয়েছে ‘চেখভের বন্দুক’।
এর ঠিক বিপ্রতীপে আছে ‘ম্যাকগাফিন’-এর ধারণা। কথিত আছে, স্কটিশ হাইল্যান্ডে সিংহ ধরার জন্য যে ফাঁদ, তারই নাম ‘ম্যাকগাফিন’। তবে কি না স্কটল্যান্ডে কোনও সিংহই নেই, কোনওদিন ছিল না। সুতরাং অনুপস্থিত সিংহের জন্য অনাবশ্যক খাঁচার ডন কিহোতে-সুলভ ব্যবস্থাপনার অ্যাবসার্ডিটিই ম্যাকগাফিনকে করে তুলেছে প্লটের একটি চমকপ্রদ প্রকরণ।
ম্যাকগাফিন হল এমন কোনও বস্তু, ঘটনা বা লক্ষ্য, যা কি না কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে চলে; অথবা চরিত্রগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ নানা কাণ্ডকারখানা ঘটাতে প্রাণিত করে, অথচ কাহিনির মূল বয়ানে যার প্রকৃত প্রস্তাবে কোনও গুরুত্ব বা প্রাসঙ্গিকতাই নেই। অর্থাৎ, কাহিনির চরিত্ররা ম্যাকগাফিনটিকে ধাওয়া করে বা রক্ষা করে কিংবা চুরি করে, এভাবেই কাহিনি গতি পায়, অথচ যেহেতু তা শেষ পর্যন্ত মূল প্লটের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক তাই ম্যকগাফিনটি এমনকী বদলে গেলেও আখ্যানটি, তার পরিণতি– অক্ষুণ্ণ ও অপরিবর্তিত থাকে।

আমাদের আলোচ্য ছবির পরিচালক জয়ব্রত দাস, আর তাঁর ওপর প্রভূত প্রভাব বিস্তারকারী দুই অগ্রজ পরিচালক হলেন যথাক্রমে আলফ্রেড হিচকক এবং কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনো। ম্যাকগাফিনের ধারণা ও ব্যবহারকে জনপ্রিয় করেছিলেন প্রথম জন। শোনা যায় হিচককের চিত্রনাট্যকার অ্যাঙ্গাস ম্যাকফেইল এই ধারণার উদ্গাতা এবং হিচকক অন্তত দশ-বারোটি ছবিতে প্লট ডিভাইস হিসেবে ম্যাকগাফিন ব্যবহার করে বিষয়টিকে ফিল্মস্কুল পড়ুয়াদের সিলেবাসে ঢুকিয়ে তবে ছেড়েছেন।
উদাহরণ দিই। ‘সাইকো’ ছবিতে ম্যারিয়ন ক্রেনের চুরি করা টাকা হল ম্যাকগাফিন। এমনিতে মূল কাহিনির সঙ্গে ওই টাকার কোনও যোগ না থাকলেও ওই টাকা নিয়ে পালাতে গিয়েই সে নরম্যান বেটস্-এর খপ্পরে পড়ে ও খুন হয়। একইভাবে ‘দ্য লেডি ভ্যানিশেস’ ছবিতে সংগীতের নোটেশনে লুকনো সাঙ্কেতিক বার্তা, ‘রেবেকা’-য় রেবেকার উইল, ‘মি. অ্যান্ড মিসেস স্মিথ’-এর গয়নাটি, ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’-এ একটা বাড়তি চাবি, ‘ভার্টিগো’-য় মৃতা এক রমণীর নেকলেস– হিচককের ম্যাকগাফিনের লিস্ট রীতিমতো লম্বা। আর দ্বিতীয়জন, অর্থাৎ ট্যারান্টিনোর সবচেয়ে বিখ্যাত ম্যাকগাফিনটি অবশ্যই ‘পাল্প ফিকশন’-এ মার্সেলাস ওয়েলেসের ব্রিফকেস, যার লক কম্বিনেশন নম্বর কি না আবার ৬৬৬, ডেভিলস্ নাম্বার। গোটা ছবির যাবতীয় কাহিনি ও অ্যাকশন গতি পায় ওই ব্রিফকেসটিকে ঘিরেই, অথচ তার ভেতরে কী আছে তা গোটা ছবিতে না-বলা থেকে যায়। জয়ব্রতর ছবিতে ম্যাকগাফিন কুড়ি কোটি টাকার একটা কল্পনাপ্রসূত ‘ঐতিহাসিক’ ওয়াইন বটল, যার নাম তাঁরা দুষ্টুমি করেই রেখেছেন ‘ম্যাকগাফিন’। জোসেফ স্তালিনকে উপহার দেওয়ার জন্য আমেরিকার ওয়াইনরিতে তৈরি এবং শিপমেন্টের সময়ে জাপানি আক্রমণে সলিলসমাহিত, স্কটিশ সিংহের খাঁচার মতোই যা অ্যাবসার্ড ও অনৈতিহাসিক। গুগল জানাচ্ছে স্তালিন ভালোবাসতেন নানাধরনের জর্জিয়ান ওয়াইন, বিশেষত খোয়াঞ্চকারা, যা তিনি ইয়ালতা কনফারেন্স চলাকালীন চার্চিল এবং রুজভেল্টকেও খাইয়ে ছেড়েছিলেন। অপরপক্ষে রুজভেল্টের স্তালিনকে যুদ্ধ চলাকালে বা শেষে ক্রেট-ক্রেট বা ব্যারেল-ব্যারেল আমেরিকান ওয়াইন উপহার দেওয়া বিষয়ে গুগল বাবাজি সম্পূর্ণ নিরুত্তর, ফলে ধরে নেওয়ায় বাধা নেই যে এটি পুরোপুরি জয়ব্রতদের কল্পনা ও দুষ্টুমির ফসল। আগেই বলেছি, ওয়াইনের ‘ম্যাকগাফিন’ নামটিও এ কথার সাক্ষ্য দেয়।

এই ছবিতে প্রায় সমস্ত চরিত্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয় মদের বোতলটিকে ঘিরে। তবে সার্থক ম্যাকগাফিনের মতোই প্রকৃতপক্ষে বোতলটা অপ্রাসঙ্গিক; বোতলের জায়গায় হিরে, পেইন্টিং বা ‘দ্য মেক্সিকান’ ছবির পিস্তলটা– যা খুশি তা-ই থাকলেও কাহিনির গঠন বা পরিণতি অপরিবর্তিতই থাকত। ছবিটার ট্র্যাজেক্টরি আর প্লট যে আসলে কিছুটা ‘রিজার্ভার ডগস্’, কিছুটা ‘পাল্প ফিকশন’ আর কিছুটা ‘হেটফুল এইট’-এর মিশেলে তৈরি একটা ওয়ান-লাইনার মাত্র, সেকথা পোস্টার দেখেই আন্দাজ করা যায়, আর দেখার পর তো কোনও সন্দেহই থাকে না। তবে কাহিনি বা প্লট তো এ ছবির ইউএসপি নয়, ফর্ম আর ফাস্ট পেসিং সেই দায়িত্ব নিয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফার এবং বিশেষত এডিটর এ বিষয়ে সাধুবাদ পাবেন। জুতোর ফিতের মতো সরু বাজেটে এমন সিদ্ধি অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়। আর এখানে যে ভায়োলেন্স আর গ্রোটেস্কের উদ্যাপন আছে তাকে সচেতন প্রয়াস বলেই মানতে হবে, তার সুর কখনও কখনও বেশ চড়া তারে বাঁধা থাকলেও তাকে আপতিক মনে হয়নি। তাছাড়া ম্যাকগাফিনের নাম ‘ম্যাকগাফিন’ রাখবার মধ্যে যে একটা রেলা আছে, সে কথা মানতেই হবে।
চেখভের বন্দুক দিয়ে কথা শুরু হয়েছিল, এই ছবিতেও অন্তত দু’বার তার চমৎকার ব্যবহার আছে। এক, রুদ্রনীল-অভিনীত দীনবন্ধু মিত্রের ডান-বাম গোলানোর অভ্যেস আর দুই, বোতলের প্রকৃত মালিক জ্যোতিষ্কর কাটা আঙুল। দু’টি বিষয়েরই উল্লেখ অথবা দৃশ্যায়ন ছবির শুরুতে বা মাঝে এক বা একাধিকবার করা হয়েছে এবং ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে এই দুটো বিষয়ই সিনেমার আখ্যানকে যথাযথ পরিণতি দিয়েছে। জ্যোতিষ্কর পুরো এপিসোডটা অ্যানিমেশনে দেখানো এই কারণেই এত জরুরি ছিল, না হলে খাবারের খোঁজে বারবার ঘরে ঢুকে পড়া পাগল আর জ্যোতিষ্ক যে অভিন্ন ব্যক্তি– তা দর্শক জেনে যেত এবং অন্তিমে যে পোয়েটিক অথচ অ্যাবসার্ড কাইন্ড অফ জাস্টিসের ব্যঞ্জনায় ছবি শেষ হয়, তা ঘটতে পারত না। এখানেও ‘কিল বিল’ ছবির ও’রেন ইশি-র ফ্ল্যাশব্যাক এপিসোডের অ্যানিমেশনের সঙ্গে মিল আছে। তবে এক্ষেত্রেও তা শিল্পসম্মত হয়েছে, জোর করে চাপানো মনে হয়নি।

এ ছবি শেষ অবধি কেমন, নির্দেশনা-চিত্রগ্রহণ-সম্পাদনা-
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved