ছবির মতো সাজানো ঘর। দেওয়াল জুড়ে অজস্র ফ্রেমবন্দি ছবির সমাহার। যেন তারা কথা বলছে একে অপরের সঙ্গে। কিংবা ধরে রেখেছে ফেলে আসা এক সোনালি অতীতকে। সেই ফ্রেমের মধ্যে প্রাঞ্জল উপস্থিতিতে কোথাও ধরা দিচ্ছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কোথাও আবার পণ্ডিত রবিশঙ্কর। কোথাও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কোথাও আবার উস্তাদ আলি আকবর খাঁ। সেই ছবির কোলাজে যোগসূত্র একটাই? এক সদাহাস্যময় মানবী। তিনি হাসছেন। অনাবিল সেই হাসি। এককথায় ভুবনমোহিনী। সুর তাঁর বাধ্যগত। গান তাঁর সাধনা। তিনি যেন সাক্ষাৎ বাগেশ্বরী। তিনি হৈমন্তী শুক্লা। রবিবার, ১৮ আগস্ট, রোববার.ইন-এর জন্মদিন উপলক্ষে একান্ত আলাপচারিতায় ধরা দিলেন বাংলার এই গীতিরত্ন, নিজের বাসভবনে। সেই আড্ডা সুমধুর হয়ে উঠল অভিন্নহৃদয় বন্ধু রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে তাঁর কথালাপে। তারই নির্বাচিত অংশ থাকল রোববার.ইন-এর পাঠকদের জন্য।
হৈমন্তী, প্রথমেই যেটা তোমার কাছে জানতে চাইব, সেটা হচ্ছে তুমি বিয়ে করোনি কেন?
এই রে, প্রথমেই এই প্রশ্ন!
হ্যাঁ, প্রথমেই। বলো তো, ব্যাপারটা ঠিক কী?
আরে না, না, তেমন কোনও কারণ নয়…
তুমি বিয়ে কেন করোনি, আগেও একবার তোমায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তুমি তখন আমাকে উত্তর দিয়েছিলে যে, গানকে তুমি এতটাই ভালোবাসো, গানের জন্য সব ভালোবাসা দিয়ে দিলে, তাই তুমি বিয়ে করোনি। কিন্তু আসল সত্যিটা কী? বলো তো? আজ কিন্তু বলতেই হবে।
‘আসল সত্য’ বলে গোপনীয় কিছু নেই এর মধ্যে। আমি ছোটবেলা থেকেই সারদেশ্বরী আশ্রমে পড়তাম। বাবা ওখানে আমাকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, ক্লাস টু-তে। তখন থেকেই টুকটুক করে গান গাইতাম। এমন হয়েছে– পড়া করে নিয়ে যায়নি। দিদিমণি ডাক দিলেন, ‘অ্যাই, পড়া করিসনি?’ আমি তো কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে দাঁড়াতাম। শাস্তি কী ছিল জানো? দিদিরা বলত, ‘গান কর তো, একটা গান কর।’ আমি তখন মন খুলে গান গাইতাম। দিদিরা খুশি হয়ে যেত। আমাকে একশোয় একশো দিয়ে দিত। এই প্রশ্রয়গুলো তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি। স্কুলটা ছিল গৌরীমায়ের আশ্রম। তিনি মা সারদার শিষ্যা ছিলেন, তাঁর কাছে আমরা পড়াশোনা শিখেছি।
তাহলে কি ছোটবেলা থেকে এটাই তোমার মনে হত, বিয়ে করাটা অন্যায়?
না, অন্যায় নয়, আবার সন্ন্যাসিনীর ভাবও নয়। আসলে ছোটবেলা থেকে বাবা বলতেন– ‘মা, বিয়ে-থা করিস না, গান গেয়ে যা।’ এই কথাটাই মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।
আমার কাছে কিন্তু একটা অন্য খবর আছে।
কী খবর?
তুমি দেখলে সবাই তোমাকে বিয়ে করতে চায়, তুমি শেষমেশ কাকে বিয়ে করবে! এত খুঁতখুঁত করে লাভ নেই, আবার কাউকে হতাশ করেও লাভ নেই। তাই তুমি কাউকেই বিয়ে করলে না। ঠিক কি না?
(হেসে) এটা খানিকটা ঠিকই বলেছ। আমাকেও তো অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তুমি কাউকে ভালোবাসোনি?’ আমি হয়তো বেসেছি। কিন্তু বিয়ে করে তার সঙ্গে সংসার করব, এই চিন্তাটা মনের মধ্যে কখনও আসেনি।
সংসার করতে চাইলে তো ভালোবাসলে হবে না। সেখানে ভালোবাসা থাকে না। বিয়েতেও থাকে না। তুমি একদম ঠিক কাজই করেছ হৈমন্তী। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, যখন তোমার কাছে একজন রবিশঙ্কর আসেন, কিংবা যখন একজন হেমন্ত (মুখোপাধ্যায়) আসেন, তখন তো একটা ভালোবাসা তৈরি হয়, একটা ভালোবাসার মুহূর্ত তৈরি হয়?
হ্যাঁ, মুহূর্তের ভালোবাসা তো তৈরি হয়। আমার ক্ষেত্রেও তা হয়েছিল। তবে হেমন্তদার আমাকে ভালোবাসাটা একদমই আলাদা। সেটা সন্তানস্নেহে ভালোবাসা। যেভাবে তিনি রাণুকে ভালোবাসতেন, আমাকেও সেরকমই ভালোবাসতেন। প্রথম যেদিন হেমন্তদার সঙ্গে দেখা হল, এখনও মনে আছে। প্রথম দর্শনেই কী বলেছিলেন জানো? ‘এই তোর গলাটা তো ভারী মিষ্টি। একদিন আমার বাড়ি চলে আয়।’ তারপর গেলাম হেমন্তদার বাড়ি। আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। একসঙ্গে কত ফাংশনে ডুয়েট গেয়েছি। প্রথম যে গানটা হেমন্তদার সঙ্গে ফাংশনে গেয়েছিলাম, সেটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। হেমন্তদার সুরে বাংলা গান। ‘বাঘিনী’ ছবির গান ছিল, ‘যদিও রজনী পোহালো তবু…’। এরকম অনেক বাংলা গান হেমন্তদার সঙ্গে গেয়েছি। পরে একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল হেমন্তদার সঙ্গে। গানের জন্য শুধু নয়, কোনও কোনও দিন তেমন কাজের চাপ না থাকলে বা হরতাল হলে, তখন হরতাল হতও খুব, তো সেই সময় হেমন্তদা বলত, ‘হ্যাঁ রে, কী করবি কাল? পারলে সক্কাল সক্কাল চলে আসিস।’ আমি তখন থাকতাম বাগবাজারে, সেখান থেকে চলে যেতাম হেমন্তদার বাড়ি। কত কিছু শিখেছি হেমন্তদার কাছে, বলে শেষ করা যাবে না। হেমন্তদা ছিলেন এক প্রতিভাধর ব্যক্তি। ওঁকে নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। যখন উনি যে গানটা গাইতেন, মনে হত, এই গান ওঁর চেয়ে ভালো আর কেউ গাইতে পারবে না। ঈশ্বরপ্রদত্ত এই ক্ষমতা তো সকলের হয় না।
হৈমন্তী, তুমি তো ছোটবেলা থেকেই গান শিখেছ। কিন্তু গানকে প্রফেশন হিসেবে ভাবতে শুরু করলে কখন থেকে?
ছোটবেলা থেকেই আমার গানের নেশা ছিল। মেয়েরা ছোটবেলায় পুতুল খেলে। পুতুলের বিয়ে দেয়, এসব। আমি কী করতাম, পুতুলের হাতে দেশলাই কাঠি দিয়ে মাইক ধরিয়ে দিতাম। এটাই আমার কাছে খেলা ছিল। বাবা দূর থেকে আমার কাণ্ডকারখানা দেখতেন, আর হাসতেন। আর আমার মনে হত, হাজার হাজার লোক বোধহয় বসে আছে, আর আমি ওই পুতুলকে সামনে রেখে গান গাইতাম। যেন শ্রোতারা সব গান শুনছে পুতুলের, মন দিয়ে।
তার মানে ছোটবেলা থেকেই একটা গানের পরিবেশ, কল্পিত প্রেক্ষাপট তুমি তৈরি করে নিয়েছিলে?
হ্যাঁ। একদমই তাই।
আচ্ছা, শিল্পী হিসেবে তোমার প্রথম পাবলিক অনুষ্ঠান কবে করেছিলে, মনে আছে?
প্রথম আমি অনুষ্ঠান করি ১৯৬৪-এ। খেয়াল-ঠুংরির অনুষ্ঠান। রেডিও-তে করেছিলাম সেটা। আমার বাবা হরিহর শুক্লা, তিনি ক্ল্যাসিকাল জগতের মানুষ হলেও গানের কোনও একটা ঘরানাতে আটকে থাকা পছন্দ করতেন না। বলতেন, সবরকমের গান গাইতে হবে। বাউলও গাইবে, কীর্তনও গাইবে, ভজনও গাইবে, তেমনই খেয়াল-ঠুংরিও গাইতে হবে। কিন্তু যখন যে গান গাইবে, তখন সেই গানটার জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে তুলবে।
এতগুলো যে গানের ঘরানার কথা বললে, তার তো আলাদা আলাদা গুরু হয়। তুমিও কি সেভাবে তালিম নিয়েছ?
বাবা-ই আমার গুরু ছিলেন। বাবার কাছেই শিখতাম। পরবর্তীকালে হেমন্তদার কাছে গিয়ে কিছুটা শিখেছি। অনেক কিছুই শুনে শুনে আমি গাইতাম। আমি যে অথেন্টিক্যালি শিখে গান করেছি, তা কিন্তু নয়। আমার বাবাও অনেক গান জানতেন। বাবা যেভাবে শেখাতেন, আমি সেভাবেই শিখেছি। সত্যি বলতে, আমার জীবনে প্রথম পুরুষ হচ্ছে আমার বাবা। খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন। বাবার সঙ্গে আমার খুব ভাবও ছিল। মেয়ের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্বও একটু বেশি ছিল। মা রাগারাগিও করতেন আমায় এত প্রশ্রয় দিতেন বলে। তো বাবা আমায় বলেছিলেন, আমি তোকে কিছু দিতে না পারি মা, এই তানপুরাটা দিয়ে যাব। দিয়ে গিয়েও ছিলেন। আমি একটা সময় বাড়ি ছেড়ে চলেও গিয়েছিলাম। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেটা ভাবতেও পারি না। এখান থেকে চলে গিয়ে উঠেছিলাম বন্ধুর বাড়িতে। আসলে সংসারের নানা কাজে এত জড়িয়ে পড়ছিলাম যে, গান গাওয়াই হয়ে উঠছিল না। ভাবলাম এভাবে তো হবে না। কত সম্বল নিয়ে বেড়িয়ে ছিলাম, জানো? মাত্র চার আনা। বাবাকে বলে রেখেছিলাম আগের দিন। তুমি আমায় বারণ কোরো না যেতে। বাবা না করেননি। শুধু বলেছিলেন, যেখানেই যাস, যা কিছুই করিস, দেখিস আমার মাথাটা যেন হেঁট না হয়। সেকথা আমি রাখতে পেরেছি। এটাই তাঁর মেয়ে হিসেবে আমার গর্ব।
হৈমন্তী, তুমি গায়িকা হিসেবে তোমার বাবা ছাড়া আর কার কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছ?
বাবার কাছেই তো আমি ছোটবেলা থেকে গান শিখেছি। তার বাইরে গিয়ে সেভাবে ‘গুরু’ হিসেবে কেউ ছিল না। বাবা সবসময় গান গেয়ে যেতে বলতেন। শুদ্ধ ভাবে গাইতে বলতেন। আমি একবার গান গেয়ে এসে বাবাকে শোনাচ্ছিলাম। একটা জায়গায় সুরটা খুব ভালো মিলেছে, অনেক সময় সুর গড়িয়ে যায়, একটু সরে যায় আর কী। তো সেটা বাবাকে বলতেই যে, ‘বাবা, দেখ সুরটা কি ভালো লেগেছে না? উপরের সা-টা?’ শুনেই বাবা এমন করে উঠলেন, যেন কী সর্বনাশের কথা বলে ফেলেছি! খালি বলতে লাগলেন আমায়, ‘মা, কখনও একথা মুখে আনবি না। কখনও বলবি না। শপথ কর। নিজের গান শুনে নিজের ভালো লাগছে, একথা যেন কখনও আর তোর মুখে না শুনি।’ সেই কথা আজীবন মেনে চলেছি। সারা জীবনে এত গান গেয়েছি, অধিকাংশ গান জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর, যে আমি তৃপ্ত কি না? তাহলে বলব, না। আমি তৃপ্ত নই। আমার অনেক জনপ্রিয় গান, তা পরিপূর্ণ নয়। লোকেরা ভালো বলেছে, প্রশংসা করেছে, ঠিক আছে। কিন্তু এখনও যেন মনে হয়, আরও ভালো গাইতে পারতাম। আরও যেন ভালো হতে পারত গানটা। ঈশ্বর হয়তো এমনই, পুরোটা দেন না। কিছু বাকি রেখে দেন। বয়স যত বেড়েছে, সেই উপলব্ধি আরও দৃঢ় হয়েছে। আক্ষেপ করেছি, আরও ভালো যদি গাইতে পারতাম। আমার জীবনে প্রাপ্তি অনেক, তবু এই খারাপ লাগাটা এখনও কাজ করে। গান নিয়ে মন খুঁতখুঁত করে। তোমরা বাইরে থেকে হয়তো বুঝবে না। এই আক্ষেপ আছে বলেই হয়তো আজও গানকে ভালোবাসতে পারি। গানের মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পাই।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা তো বললে, আচ্ছা, রবিশঙ্করের সঙ্গে তোমার কীভাবে আলাপ হল?
রবিশঙ্করজিকে আমি ছোটবেলা থেকেই খুব ভালোবাসতাম। বাবাও খুব পছন্দ করতেন। যেখানে যেখানে ওঁর বাজনা হত, কিংবা কোনও অনুষ্ঠানে উনি সেতার বাজাতে বসলে আমিও ছুটে যেতাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে শুনতাম। কখনও সখনও চোখাচোখি হত বটে, কিন্তু আলাপ ছিল না। উনিও কথা বলতেন না, আমিও ওঁর সঙ্গে কথা বলার সাহস পেতাম না খুব একটা। তারপর কী হল, একদিন নিশীথ গাঙ্গুলি, লন্ডনে থাকতেন, তাঁর বাড়িতে রবিশঙ্করজি আমার গান শোনেন। নিশীথদার কথা বলায় মনে পড়ল, তিনিও কিন্তু আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। বিয়ে করার জন্য প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিলেন একদম। এদিকে নিজের মুখে সেকথা বলতে পারছেন না। শেষে রবিশঙ্করজিকে দিয়ে আমাকে তা বলেছিলেন। সে পরের কথা। নিশীথদার বাড়িতে আমি বহুবার গিয়েছি। অনেক গানও গেয়েছি। নিশীথদা আবার সেসব রেকর্ডও করে রেখেছিলেন। তো নিশীথদার কাছেই প্রথম আমার গানের রেকর্ড শোনেন রবিশঙ্করজি। শুনে এতটাই অবাক হন, যে নিশীথদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এ কে গাইছে? এই কণ্ঠ তো আমি আগে শুনিনি কখনও?’ নিশীথদাই তখন আমার সঙ্গে রবিশঙ্করজির যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিলেন। সেবার লন্ডন থেকে কলকাতায় ‘শান্তির ধ্বনি’ বলে একটা কনসার্টে যোগ দিতে এসেছিলেন রবিশঙ্করজি। এসেই আমাকে ফোন। আমার তো রবিশঙ্করজির গলা শুনেই হাত-পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছিল। ফোন করে বললেন, ‘হ্যালো, আমি রবিশঙ্কর বলছি। নিশীথের কাছে তোমার কথা খুব শুনেছি। তোমার গানও শুনেছি। আমি তোমার গুরুর মতো হই। তুমি একবার আসতে পারবে? আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে ‘শান্তির ধ্বনি’-তে অংশ নাও।’ সেখানে আরও অনেকে ছিল। শিপ্রা বসু, সমরেশ চৌধুরী ছিল, আমিও ছিলাম। আরও অনেকে অংশ নিয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। তারপর থেকেই রবিজির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারতাম, রবিজির আমাকে খুব ভালো লেগেছে। আমার গানের গলা, গান শুনে খুব প্রশংসা করতেন। আমি তো ধন্য হয়ে যেতাম। এত বড় মাপের মানুষ, তিনি আমার প্রশংসা করছেন, এসব ভেবে। তারপরে–
তারপরে তোমার রূপে মুগ্ধ হন, তাই তো? কণ্ঠের জাদুতে তো মজেই ছিলেন…
(হেসে) রূপে হয়েছিলেন কি না, জানি না। তবে গানে একটু মুগ্ধ হয়েছিলেন বোধহয়। কলকাতায় এলে নিজেই আমাকে ফোন করে ডেকে নিতেন এলগিন রোডে, ওঁর জাহাজবাড়িতে। সেখানে গান নিয়ে নানা কথা, কত গল্পগুজব হত। তার অনেক দিন পর, ১৯৮৭-র কথা বলছি। আমার হঠাৎ মনে হল, রবিজির সুরে বাংলা গান গাইব। দেখো, ক্লাসিক্যাল গান আমি শিখেছি, গেয়েছিও প্রচুর। কিন্তু বাংলা গানের প্রতি একটা আলাদা টান আমি সবসময় অনুভব করি। একটা মায়া কাজ করে। তো একদিন লালা শ্রীধরের বাড়ির সামনে রবিজির সঙ্গে দেখা। নানা কথার পর আমি ডাইরেক্ট রবিজিকে বললাম, দাদা, আপনি তো অনেক দিন বাংলায় কাজ করেননি, সেই ‘পথের পাঁচালি’-তে লাস্ট। আমার তাই খুব ইচ্ছে, আপনার সুরে আমি বাংলা গান গাইব। শুনে চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘সে কী করে হবে? আমি তো বিদেশে থাকি, কী করে পারব বলো, এ অসম্ভব।’ আমায় না করে দিয়ে বেরিয়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমারও জেদ চেপে গিয়েছিল। রবিজির পা ধরে বললাম, দাদা, একটা গান শোনাতে চাই আপনাকে? একটু শুনবেন? রবিজি অবাক হয়ে বললেন, ‘অ্যাঁ! এখন গান। কী গান শোনাবে?’ বললাম, আপনার সুরে গান বেঁধেছি। শুনবেন না? রবিজি আরও অবাক। বললেন, ‘কোথায় পেলে আমার সুর! শোনাও দেখি?’ গাইলাম– ‘আর যেন স্মৃতি ফিরে না আসে…’। রবিজি তো অবাক পুরো! বললেন, ‘এ গান তুমি কোথায় পেলে?’ বললাম, কেন, আপনার সুরেই তো হিন্দি ফিল্মে গান আছে– ‘হায়, ফির ইঁয়ে কিউ না আয়ে…’। আমি সেই গান পুলকদাকে (বন্দ্যোপাধ্যায়) দিয়ে এখানে বসিয়ে বাংলায় লিখিয়েছি। দু’লাইন শোনার পরই রবিজি চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘ভিতরে এসো।’ সেই শুরু। ওঁর খুব ভালো লেগেছিল আমার গান।
আমি শুনেছিলাম, একবার রেকর্ডিং শেষে চলে যাচ্ছিলেন রবিশঙ্কর, তোমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন। সেই দৃষ্টিপাতের কথা তোমার মনে আছে?
সে ঘটনাও মনে আছে। সেবার আমাদের রেকর্ডিং হয়েছিল ১০ দিন ধরে। শেষদিন রেকর্ডিং শুরুর আগে থেকেই বলে যাচ্ছিলেন, ‘হৈমন্তী, কাল থেকে দেখা হবে না।’ আসলে রেকর্ডিং শুরু হত দশটা থেকে। রবিশঙ্করজি একদম ঠিক টাইমে হাজির হয়ে যেতেন। শেষদিন রেকর্ডিংয়ের পর মনখারাপ করে বললেন, ‘কাল থেকে আর দশটার সময় দেখা হবে না।’ বলেই জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে। সেই আলিঙ্গনের মধ্যে ভীষণ একটা মায়া, একটা মোহ আমি অনুভব করেছিলাম।
এই যে আলিঙ্গনের অনুভব, তোমার কেমন অনুভূতি হচ্ছিল তখন?
আমার খারাপ লাগেনি মোটেই। অনেক সময় হয় না, কেউ কেউ জড়িয়ে ধরলে বিরক্তি লাগে। কিন্তু এক্ষেত্রে মোটেই তা নয়। আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেটা পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেই হয়তো। ওঁর কথাতেও আমার মনে হয়েছিল, উনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। যদিও কখনও সরাসরি বলেননি। একদিন শুধু বলেছিলেন, ‘তুমি আমার হয়ে থাক। আমার যত সৃষ্টি, তা তোমার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হোক।’ আমার একটা কথা কী ছিল জানো, তুমি হয়তো ভাববে, ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছি। রবিজিকে প্রত্যুত্তরে বলেছিলাম, ‘দাদা, আমি কারও স্ত্রী হয়ে থাকতে চাই না। আমি হরিহর শুক্লার মেয়ে হয়ে থাকতে চাই।’ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন রবিশঙ্কর, নিষ্পলক দৃষ্টিতে। শুধু ‘আচ্ছা’, এটুকু বলে চুপ করে গেলেন। তবে ভীষণ ভালোবাসতেন আমাকে। পণ্ডিতজির কথা বললে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। এটা শুধু আমার কথা বলছি না, পৃথিবীর সর্বত্র যাঁরা রবিশঙ্করজির সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরাই একথা বলবেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কটাও কি এতটা গভীর ছিল?
না, হেমন্তদার সঙ্গে সম্পর্কটা সম্পূর্ণ আলাদা। ওই যে প্রথম দিন দেখেই ডাক দিলেন, ‘আয়, এদিকে বস।’ যেন কতদিনের চেনা। যেন নিজের সন্তানকে কাছে ডাকছেন। হেমন্তদাও খুব স্নেহ করতেন। চাইতেন আমি ওঁর সঙ্গে গান করি। ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবিতে হেমন্তদাই জোর করে আমাকে দিয়ে গাইয়েছিলেন, ‘তোমার কাছে এ বর মাগি…’। আসলে সব গানে আমাকে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন হেমন্তদা।
আচ্ছা, হৈমন্তী একটা কথা বলো তো, তুমি সেই বাঙালি মেয়ে, যে কি না খুব একটা রবীন্দ্র সংগীত গাওনি, অথচ রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী না হয়েও তুমি যথেষ্ট জনপ্রিয়, এখনও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক শ্রোতাদের মনে। তা রবীন্দ্রনাথের গান তোমায় টানল না কেন? তুমি কেন গাইলে না রবীন্দ্রনাথের গান?
দু’-একটা ছবিতে হেমন্তদা গাইয়ে ছিলেন আমাকে দিয়ে রবীন্দ্র সংগীত। তাছাড়া কী জানো, রবীন্দ্র সংগীতের মধ্যে যেগুলো একটু ক্লাসিক্যাল ঘেঁষা সেগুলো আমি এখনও নিয়মিত গাই। একটা বাঙালি মেয়ে, সে রবীন্দ্র সংগীত গাইবে না, জানবে না, তা হয় নাকি! যেমন এই ২২ শ্রাবণে একজন আমায় অনুরোধ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান গাওয়ার জন্য। তখন আমি গাইলাম, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার…’। নিজের মতো করে গেয়েছি সেই গান। আসলে একটা নির্দিষ্ট স্টাইলে যে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার রীতি, সেটা আমার মোটেই ভালো লাগে না। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ সেটা আমার একদম পছন্দ নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে তো স্পষ্ট উচ্চারণ করতেন। কই তিনি তো চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করতেন না। যাঁরা নিজেদের রাবীন্দ্রিক দাবি করেন, তাঁরা তো স্বরলিপির বাইরে গাইতেই পারে না। যা ওখানে লেখা আছে, তাই গায়। আরে, স্বরলিপি জানলেই কি গান হয়!
দেবব্রত বিশ্বাস?
ও বাবা, নমস্য ব্যক্তি। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্তদা এঁরা অতুলনীয়। আমি দেবব্রত বিশ্বাসের এক ছাত্রীকে চিনি। বিভাদি বলে ডাকি, এখন তাঁর প্রায় নব্বই বছর বয়স। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্র সদনে স্টেজে গেয়েছিলাম, ‘তোমার কাছে এ বর মাগি…’। কী অপূর্ব গলা! দারুণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়ে ছিল শুনে।
আমি শুনেছি, গানের জন্য তুমি বাড়ি ছেড়ে ছিলে। কতটা কঠিন ছিল সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা? এভাবে একা একা লড়াই করা। কোনও পুরুষের সাহায্য না নিয়ে, খুব সহজ তো ছিল না তোমার পক্ষে?
একদমই ছিল না। কঠিন তো ছিলই। তবে অনেকেই সে সময় আমায় সাহায্য করেছে। তার মধ্যে পুরুষরাও ছিল। কিন্তু কী জানো, আমার সিদ্ধান্তের ওপর কোনও পুরুষ খবরদারি করবে, সেটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া গানের জগতে অনেক স্বনামধন্যর সঙ্গে তো কাজ করেছি। এই হেমন্তদাকেই দেখেছি অনাড়ম্বর জীবন কাটাতে। সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো থাকতেন। কোনও বাড়াবাড়ি নেই, খেতে বসে দেখতাম, একটা পদে দিব্যি খাওয়া-দাওয়া সেরে ফেলতেন হেমন্তদা। কোনও অভিযোগ ছিল না মুখে। বাড়তি কোনও চাকচিক্য ছিল না।
আর ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য?
ও রে বাবা! তাঁর কথা আর কী বলব। সে আরেক দারুণ মানুষ। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটা মজাদার ঘটনা বলি শোনো। উনি বৃহস্পতিবার করে মৌনব্রত পালন করতেন। কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। আমি জানতাম না। একদিন বিষ্যুদবার ওঁর বাড়ি গিয়েছি। দেখি, একটা ইজিচেয়ারে বসে আছেন। আর ওঁর ঘরে টিভি থাকত একটা ছোট আলমারির ওপরে। ঘাড় উঁচু করে টিভি দেখে যাচ্ছেন। আমায় দেখে তো চোখ বিস্ফারিত করে ইশারায় দেখালেন, বসো! আদেশ মতো বসলাম। তারপর ইশারায় চাকরকে বললেন, চা করতে। ওই অভিজ্ঞতা আমি জীবনে ভুলব না। আর চাকরকে ডাকা, সে আরেক কাণ্ড! স্ত্রীকে ইশারায় ডেকে বলতে চাইছেন চাকরকে ডাকো। ওঁর স্ত্রী বুঝতে পারছেন না কিছুতেই। কী হবে! ওঁর চাকরের নাম ছিল জগন্নাথ। তখন রেগে গিয়ে স্ত্রীকে ইশারায় কনুই দেখিয়ে বোঝাচ্ছেন ধনঞ্জয়দা, কনুই থেকে কাটা। শেষে বুঝতে পেরে ওঁর স্ত্রী হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। হাসতে হাসতে বলেন, ‘ও বলবে তো, তোমার জগন্নাথকে দরকার।’ আগে অনেক গাইয়েই কিন্তু সপ্তাহে এমন একটা দিন মৌন রাখতেন। আমি নিজেও এর উপকার টের পেয়েছি। গলার আরাম হয় তাতে। আমি নিজেই একটা সময় সরস্বতী পুজোর আগের দিন কথা বলতাম না একদম।
এখন বলো?
বলি। তার কারণ আরও মজাদার। ভাগ্যচক্রে সরস্বতী পুজোর আগে একদিন আমার বাড়িতে স্বয়ং পণ্ডিত রবিশঙ্কর এসে হাজির! আমি চুপ থাকি কী করে! ভাবলাম, ধুর! সরস্বতীর বরপুত্র স্বয়ং আমার বাড়িতে হাজির, আর মৌন থেকে কী করব! সেই থেকে আর সরস্বতী পুজোর আগের দিন মৌনব্রত রাখি না। কী ভালো মানুষ ছিলেন পণ্ডিতজি, ভাবতে পারবে না! একবার সরস্বতী পুজোর দু’দিন আগে, সবে তখন রেকর্ডিং শেষ হয়েছে স্টুডিয়োতে। আমি বললাম, পণ্ডিতজি, পরশু বাড়িতে সরস্বতী পুজো হবে। যাবেন একবার? শুনেই বললেন, ‘না, না। আমি যাব না। তোমরা সব ফোটোগ্রাফার, রিপোর্টারকে বলে রাখ। ওরা গিয়ে ভিড় করে। আমার ভালো লাগে না। আমি যাব না।’ শুনে মনটা খারাপই হয়ে গেল। চুপচাপ রেকর্ড করে ফিরেও এলাম বাড়ি। ও মা, সরস্বতী পুজোর দিন সাতসকালে দেখি রবিজির ফোন। চেনা গলায় আমায় বললেন, ‘এ হেমন্তী, তোমার বাড়িতে তো আজ সরস্বতী পূজা। তা দুপুরে খিচুড়ি রান্না হবে?’ আমি তো হাতে স্বর্গ পেয়েছি যেন। বললাম, ‘হয়, হয় দাদা। খিচুড়ি হয়।’ শুনেই বললেন, ‘বেশ। আজ তবে লাঞ্চটা তোমার বাড়িতেই করব।’ এই ছিলেন পণ্ডিতজি। পুরো বাচ্চাদের মতো। মারা যাওয়ার ক’দিন আগের ঘটনা, এখান থেকে তখন আমেরিকায় গিয়েছিল তন্ময় (বোস)। সেই সময় আমাদের একটা রেকর্ড বেরিয়েছিল। সেটার সিডি তন্ময়কে দিয়ে বলেছিলাম পণ্ডিতজিকে পৌঁছে দিতে। সেটা হাতে পেয়েই আমায় ফোন, ‘হেমন্তী, আমি রবিশঙ্কর বলছি, ভাই।’ কী আন্তরিক সেই গলা, ভুলব না কখনও। আবার ওই রেকর্ডেই একটা গান ছিল, যেটা পণ্ডিতজি লিখেছিলেন। কিন্তু ভুলবশত সেটা বাকি গানের মতো গীতিকার পুলকদার নামে গিয়েছিল। সেটা দেখে কী অনুযোগ, ‘হেমন্তী, গানটা আমি লিখেছি, তোমরা কেন ভাই পুলকের নামে দিলে।’ বাচ্চাদের মতো করতে লাগলেন পুরো। আমি বোঝালাম শেষে, পরের বার ভুল শুধরে নেব। শুনে তবে নিশ্চিন্ত হলেন। অত বড় মাপের মানুষ, কিন্তু মনটা বাচ্চাদের মতো সরল পুরো।
অতীত নিয়ে তো অনেক কথাই হল। এই মুহূর্তে, বর্তমান সময়ে ইন্টারেস্টিং কী চোখে পড়ল, বলবে?
এখন আর ইন্টারেস্টিং ঘটনা কোথায় রঞ্জনদা! কিছুই তো আর চোখে পড়ে না, যা দেখে ভালো লাগবে। চারিদিকে যা কিছু ঘটছে দেখছি, শুনছি, সে সবে মনটাই খারাপ হয়ে যায়। এই পরিবেশে মানিয়ে নিচ্ছি, এটাই অনেক। কাউকে বুঝতে দিই না যে, আমি ভালো নেই। আমার তো সকলের সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগে। আমার চেয়ে অনেক ছোট, এই প্রজন্মের যারা, তাদের সঙ্গেও আমার কথাবার্তা হয়। মনে হয়, কত কাছের তারা আমার। বয়সের তফাতটা গল্প করতে করতেই ঘুচে যায় তখন। বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতেও আমার খুব ভালো লাগে।
তুমি এতদিন ধরে গান গাইছ। এই যে এখনকার গানের শ্রোতা, তাদের গান শোনার যে রুচি, তার সঙ্গে ৪০ বছর আগের বাঙালি, যারা তোমার গান শুনত, তার মধ্যে তো একটা তফাত তৈরি হয়ে গিয়েছে, সেই তফাতটা তুমি কীভাবে দেখো?
তফাত তো রয়েছে। সেটা মানতেই হবে। কিন্তু যে বাঙালিরা আমার গান শুনত, যেমন– ‘এ তো কান্না নয় আমার’, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’ কিংবা ‘এখনও সারেঙ্গীটা বাজছে…’– সেই গানগুলো এখনকার শ্রোতারাও শোনে। কিন্তু এখনকার গানগুলো কেন অতটা চলে না, বলতে পারো? এখনকার গানগুলো দেখবে ম্যাক্সিমাম দু’-মাস কি তিন মাস চলে, তারপর সবাই ভুলে যায়। কিন্তু আমি ১৯৭৫-এ গেয়েছিলাম উত্তম কুমারের সিনেমা ‘আমি সে ও সখা’-তে ‘এমন স্বপ্ন কখনও দেখিনি আমি’, সেই গান আজও যখন স্টেজে বসে গাই, দেখি, সবাই গলা মেলাচ্ছে। সেই গানের স্থায়িত্ব কী কারণে এতদিন পরেও অক্ষুণ্ণ, তা বলতে পারব না।
আমার কোথাও গিয়ে মনে হয়, তোমার যে গানের আবেদন, সেটা শ্রোতার মনে চিরস্থায়ীভাবে রয়ে গিয়েছে। দর্শক, শ্রোতা যাই বল, সেসব যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে গিয়েছে, মানসিকতা বদলে গিয়েছে। বাঙালির মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। উত্তম-সুচিত্রাকে তাদের আর ভালো লাগছে না। কিন্তু তোমার গানকে তারা আজও ভালোবাসছে। এই যে নিজের প্রাসঙ্গিকতা, তা বজায় রাখার নেপথ্যে কী কারণ আছে বলে তুমি মনে করো?
আসলে আমার যেটা ভালো লাগেনি, আমি সেই গান গাইনি কখনও। নিজের ভালো লাগার জায়গা থেকে গান গাওয়ার চেষ্টা করেছি। অর্ডিয়েন্সের সেটাই ভালো লেগেছে। তারা সেটাকে গ্রহণ করেছে। আমায় জনপ্রিয় হতে হবে, এই বাসনা আমার কখনও ছিল না। গানের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল, ভালোবাসা ছিল। আমার সৌভাগ্য, সেই সময়ের মিউজিক ডিরেক্টররা সেই মতো গানই আমাকে দিয়ে গাইয়েছেন। এখনকার প্রজন্মের মিউজিক ডিরেক্টরাও তেমন গানই আমাকে গাইতে বলেন, যা আমাকে মানায়। কিন্তু সেটা তখনই গাই, যদি সেটা আমার ভালো লাগে, তবেই।
কোন ধরনের গান তোমার ভালো লাগে?
ভালো গান হতে গেলে তাতে ভালো কথা থাকতে হবে। সুরের মধ্যে একটা জাদু দরকার, যেটা আমাকে প্রাণিত করবে গানটা গাইতে। আগে যারা গীতিকার ছিলেন তাদের লেখার মধ্যে একটা জাদু ছিল। সেটা এখন হারিয়ে গিয়েছে। এখনকার সুরকারদের কোনও মুনশিয়ানা আমি খুঁজে পাই না। খুব সোজা হয়ে গিয়েছে। এখনকার গান চটকদার, তাতে কোনও প্রাণ নেই। প্রাণ না থাকলে সংগীত হবে কী করে বলতে পারো?
তাহলে বাংলা গানের যে ভবিষ্যৎ, তা নিয়ে তুমি আশাবাদী নও?
একদমই নই। বাংলা গানের ভবিষ্যৎ মোটেই ভালো বলে মনে হয় না। হেমন্তদা, প্রতিমাদির (বন্দ্যোপাধ্যায়) মতো শিল্পীরা যে গান গেয়ে গিয়েছেন, সেগুলিই অক্ষুণ্ণ থাকবে। তবে এঁরা তো কেউ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন। যে একশো বছর, দেড়শো বছর ধরে অক্ষয়, অমর হয়ে থেকে যাবেন মানুষের হৃদয়ে। রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। আর দ্বিতীয়টি হবে না। আমি একবার একটা রবীন্দ্র সংগীতের অনুষ্ঠান সেরে ফেরার পথে ভাবছিলাম, এই মানুষটি কে ছিলেন, দেড়শো বছর হয়ে গেছে, আজও তাঁর গান সবাই শুনছে, গাইছে।
রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি গানেরই তো প্রায় ১২৫ বছর গড়ে বয়স। এবং রবীন্দ্রনাথ আমাদের মধ্যে নেই ঠিক ৮৩ বছর হল। তারপরেও এই যে প্রভাব, সেটা আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি একবার সত্যজিৎ রায়কে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কম্পোজার’ হিসেবে আপনি রবীন্দ্রনাথকে কোথায় রাখেন? সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘হি অ্যাস গুড অ্যাস বেঠোফেন’। আর মোৎসার্ট? সত্যজিতের উত্তর, ‘ওয়েল, মোৎসার্ট ইজ নেক্সট টু হিম।’ রবীন্দ্রনাথ কম্পোজার হিসেবে অসামান্য। বাণী ও সুরের এই অন্বয়, কোথাও দেখা যায় না।
সত্যিই তাই। ঠিক বলেছ, রঞ্জনদা। কিন্তু দেখবে, মাঝেমধ্যে কিছু শিল্পী আসে, তারা নাকি রাবীন্দ্রিক স্টাইলে গান গায়। চিবিয়ে চিবিয়ে ওই গান, মোটেই শুনতে ভালো লাগে না।
হৈমন্তী, ‘রাবীন্দ্রিক স্টাইল’ বলে কিছু নেই। ওটা আসলে রবীন্দ্রনাথকে ভাঙিয়ে খাওয়া। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শিখেছেন, যেমন সাহানা দেবী। তিনি কিন্তু মোটেই ওভাবে গাননি। সাহানা দেবীর ওপর দিলীপকুমার রায়ের প্রভাব ছিল। দিলীপকুমার অসামান্য শিল্পী, কিন্তু তাঁর গানও তো ওই স্টাইলাইজড করা। গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে গান।
রবীন্দ্রনাথের ‘এ পরবাসে রবে কে’ গানটা মনে আছে? গানটা যেন একটু টপ্পা স্টাইলে গাওয়া হয়। কিন্তু অন্য ভাবেও গাওয়া যায়, সেটাও শুনতে দারুণ লাগে। সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমায় কী সুন্দর ব্যবহার করেছেন গানটা, ভাবা যায় না। কে যেন গেয়েছেন? অমিয়া ঠাকুর বোধহয়। কী অসাধারণ গলা। গানটা যতবার শুনি, ততবার মনে হয়, কে বলে রবীন্দ্রনাথ ক্লাসিক্যাল জানতেন না? সব জানতেন ভদ্রলোক।
রবীন্দ্রনাথ শুধু ক্লাসিক্যাল জানতেন না, ক্ল্যাসিক্যালকে তিনি ভেঙেছেন, আবার নতুন করে গড়েছেন। এই ভাঙা-গড়ার খেলা তাঁর সৃষ্টির সর্বত্র জুড়ে রয়েছে। মুশকিল হল, আমরা এই বিনির্মাণ ধরতে পারি না।
আরেকটা জিনিস খেয়াল করে দেখবে। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে ওঁর গানের কথাগুলোর মধ্যে ঢুকতে হবে। তা অনুভব করতে না পারলে কিন্তু মুশকিল।
আচ্ছা, রবিশঙ্করের সেতার নিয়ে তো এত চর্চা হয়, ওঁর গানের গলা কেমন ছিল, একটু বলবে?
অসাধারণ। কী সুরেলা গলা! যখন গাইতেন, ওঁর সঙ্গে গলা মেলাতে কুণ্ঠা হত। আড়ষ্ট হয়ে যেতাম। কেউ যদি ঠিকঠাক সুর তুলতে না পারত, দু’-তিনবার বোঝানোর পরও যখন দেখতেন পারছে না, রেগে যেতেন। তখন চুপ করে থাকতেন। কথা বলতেন না আর। আলি আকবর খাঁ সাহেবও তাই। কিন্তু আলি আকবর খাঁ সাহেব পণ্ডিতজির তুলনায় অনেক শান্তশিষ্ট ছিলেন।
গুরু হিসেবে তুমিও কি রবিশঙ্করের মতো নাকি?
হ্যাঁ, আমিও বিরক্ত হয়ে যাই তাড়াতাড়ি। ওই জন্য বেশি ছাত্রছাত্রীদের শেখাই না। আমায় সন্ধ্যাদি (মুখোপাধ্যায়) একবার বলেছিলেন, ‘ওই, তুই এত গান শেখাস কেন রে?’ আমি বললাম, আসলে বাবার থেকে শিখেছি। বাবা শেখাতেন তো, তাই আমিও তাই করি। তো শুনে বললেন, ‘না, শেখাবি না। আলাদা আলাদা স্কেলে গান করলে গলা নষ্ট হয়ে যাবে।’ এখন আর শেখাতে ভালোও লাগে না।
কেন?
এখনকার ছেলেমেয়েদের শেখার ইচ্ছা খুব কম। এসেই আগে বলবে, দিদি অমুক চ্যানেলের ওই রিয়ালিটি শো-তে চান্স পাব তো? আমরা তো এসব ভাবতেই পারতাম না। এখন তাও দু’-এক আছে। তাদের শেখাই। বাবার ছাত্রীদের সন্তান কেউ কেউ। কেউ আবার আমার পরিচিত। শিখিয়ে তেমন মন ভরে না। যেমন বলি, সেভাবে করতে পারে না। মনটা তখন দমে যায়। আর কী বলব! ভালো করে শেখার মনোবৃত্তি নিয়ে কেউ আসে না। সবার লক্ষ্য ওই একটাই– রিয়ালিটি শো। তাই বলছি, বাংলা গানের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। অন্তত আমি দেখছি না।
আমার কোথাও মনে হয়, আজকাল যে গান লেখা হয়, তার কথাগুলো বড় সস্তা। যেন গদ্যরূপ গাওয়া হচ্ছে।
রঞ্জনদা, তুমি একথা বললে আমার পুলকদার কথা মনে পড়ে গেল। পুলকদা মারা যাওয়ার বেশকিছু দিন আগেও আমার এ ঘরে বসে গান লিখে গেছেন। কী চমৎকার সেসব গান। তো একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পুলকদা আগের মতো আর লেখেন না কেন? বলেছিলেন, ‘কলকাতার রসগোল্লা লেখার পর আমার ভালো কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না রে।’ পুলকদার চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখের জানো তো।
তাহলে হৈমন্তী, তুমি আধুনিক বাংলা গানের ভবিষ্যৎ দেখছ না, তাই তো?
না, কোনও ভবিষ্যৎ কিংবা ভালো কিছুই দেখছি না। অন্তর থেকে যে গান গাওয়া, সেটাই এখন নেই। এখন গান যারা গায়, তারা উপার্জনের কথা ভেবে গান গায়। গান তো সাধনা। অর্থের কথা ভাবলে সাধনায় উন্নতি কি সম্ভব? কখনওই নয়।