২০১৬ থেকে ২০২২– এই ছ’-বছরের মধ্যে এদেশে গার্হস্থ্য হিংসার জনসংখ্যা সমাযোজিত হার বেড়েছে ১৬ শতাংশ, অথচ তা থেকে মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়ার হারে কোনও উন্নতি হয়নি। এ এক বিরাট সমস্যা! আরও বিচিত্র সমস্যা এই যে পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার প্রতিবেদন দেখাচ্ছে যে, এদেশের সমীক্ষাধীন ১৮টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১৪টির, অন্তত ৩০ শতাংশ মহিলাই স্বামীর হাতে প্রহারকে, সোহাগের অংশ হিসেবেই দেখে! একেই কি বলে মগজ ধোলাই? যা যন্তরমন্তরের ঘর ছাড়াই আত্মপ্রকাশ করে, দীর্ঘকাল ধরে বয়ে আনা পিতৃতন্ত্রের আউটকাম হিসাবে?
তখন ১৯৯০। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস’-এর প্রবন্ধটিতে অমর্ত্য সেনই প্রথম ব্যবহার করলেন শব্দবন্ধটি, ‘মিসিং উইমেন’।
তা ‘মিসিং উইমেন’ কারা? সেইসব মেয়ে, যাদের বেঁচে থাকার কথা ছিল, কিন্তু নেই। কেন নেই, কবে থেকে নেই, কতজন নেই– এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আরও দুই শতক পর দীর্ঘ আলোচনা করলেন আরেক নোবেলজয়ী গবেষক– এস্থার ডাফলো। ২০১২ সালের ওয়ার্ল্ড ডেভ্লেপমেন্ট ব্যাঙ্কের প্রতিবেদন ঘেঁটে, এম.আই.টি. থেকে একটি ওয়ার্কিং পেপার পাবলিশ করে বললেন, ফি বছরে বিশ্বে ‘মিসিং উওমেন’-এর সংখ্যা গড়পড়তা ৬০ লক্ষ! যার ২৩ শতাংশ জন্মানোর আগেই ভ্রুণহত্যার কারণে, ১০ শতাংশ অপুষ্টি ও পারিবারিক অবহেলাজনিত কারণে শৈশব পেরনোর আগেই, আর ২১ ও ৩৮ শতাংশ যথাক্রমে যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বে গার্হস্থ্য হিংসা, হত্যা, পারাবারিক নির্যাতন, অপুষ্টি, মাতৃত্বকালীন মৃত্যু-সহ নানাবিধ কারণে ‘মিসিং’।
ডাফলো বলছেন, শৈশব থেকে আমৃত্যু, মেয়েদের ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে থাকে সারা বিশ্বেই। তবে কিনা অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এমন ঘটনার ঘনঘটা অনেকটাই বেশি। তাই আফ্রিকা ও ভারত-সহ গোটা দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়াতেই মহিলাদের ওপর সার্বিক নির্যাতন, পশ্চিমি উন্নত দেশগুলির তুলনায় বেশি।
অস্বীকার করছি না যে, ভারতের মহিলা নাগরিক হিসেবে, এদেশের মেয়েদের এমন পশ্চাৎপদ অবস্থা ভয়ংকর হতাশাজনক। কিন্তু পাশাপাশি যখন শুনি যে, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা কিংবা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলির মেয়েরা আমাদের থেকে অপেক্ষাকৃত অনেকটাই ভালো আছেন, তখন একটা তীব্র স্বস্তিও কাজ করে। একটা আশার ঝিলিক কোথা থেকে কোথায় যেন খলবলিয়ে বলে যায়, ওরা ভালো আছে মানে তোমাদেরও ভবিষ্যতে ভালো থাকার একাটা চান্স আছে; তোমরাও ভালো থাকবে, আজ নইলে কাল– তখন ভূগোল সিলেবাসের রাজনৈতিক আর প্রাকৃতিক মানচিত্রের বাইরে, আমরা, গোটা বিশ্বের মেয়েরা– কেবল দু’টি গোলার্ধে বাস করি। একটায় ভালো থাকা মেয়েরা, আর আরেকটায় আমরা, পিছিয়ে থাকা দেশের কম ভালো থাকা মেয়েরা; যারা ওদের থেকে শিখে নেবে আগামী দিনের উওম্যান ইমান্সিপেশনের রেসিপি, ভালো থাকার সহজ পাঠ।
………………………………………………
পড়ুন মৌমিতা আলম-এর লেখা: আহু দরিয়াইরা নিজেরাই পারবেন নিজেদের খাঁচা ভাঙতে
………………………………………………
তা ভালো থাকার এমন একটি মনোহরী ভাবনায় সম্প্রতি জল ঢেলে দিল রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি প্রতিবেদন। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন নির্মূলকরণ-এর প্রকাশিত এই রিপোর্টটি বলছে যে, নারী নির্যাতনের আছে হরেক রকম এবং তা গোটা বিশ্বেই নাগাড়ে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সবথেকে অবাক করা কথা এই যে, ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে এবং পরিচিত মানুষদের হাতেই প্রতিদিন এ-বিশ্বের গড়ে ১৪০ জন মেয়ে খুন হন! খুনী কে? স্বামী, ভাই, পিতা, নিকটাত্মীয় কিংবা পরিবারের লোকজন, যাদের কাছে কথা ছিল সবথেকে নিরাপদ থাকার। এ-উলটপুরাণ বিশ্ব জুড়েই। তালিকার একেবারে শীর্ষে যেমন রয়েছে আফ্রিকা, তেমনই দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানেই রয়েছে যথাক্রমে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া। উন্নত আর অনুন্নত দেশ– নারী হিংসার প্রসঙ্গে সকল দেশ আর মহাদেশের বেড়া ভেঙে একাকার হয়ে যায়। তসলিমা ঠিকই লিখেছিলেন, ‘নো কান্ট্রি ফর উওম্যান’। মেয়েদের কোনও দেশ নেই।
তবু সুখের কথা এই যে, এই চরম পারিবারিক হিংসার বিষয়টিতে ইউরোপীয় দেশগুলি তুলনামূলকভাবে অনেকটাই ভালো অবস্থানে রয়েছে। শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই যেখানে স্বামী কিংবা পরিবারেরই কোনও সদস্যের হাতে খুন হয়েছেন আফ্রিকার ২১,৭০০ বালিকা ও মহিলা, সেখানে ইউরোপে সংখ্যাটা লক্ষে একজনের কম। আর এশিয়া রয়েছে চতুর্থ স্থানে। যদিও, তা কতটা আন্ডার রিপোর্টিংয়ের কারণে কিংবা উপযুক্ত তথ্য অধিগত না করতে পারার কারণে, তা বলা মুশকিল।
……………………………………..
পড়ুন শতাব্দী দাশ-এর লেখা: আসুন, রাতের দখল নিই
……………………………………..
এমনটা মনে হওয়ার কারণও আছে। ২০২১ সালে বিজ্ঞানী গুডসন এবং হেইজ ঠিক এই বিষয়টির ওপরেই একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ‘পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে নির্যাতিতার প্রতিবাদ ও সাহায্য চাওয়ার প্রবণতা’ শীর্ষক এই গবেষণাপত্রটি দেখায় যে, ভারত-সহ বিশ্বের নানা উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশ, যেখানে মেয়েদের এক বহুলাংশ এখনও আর্থিকভাবে পরনির্ভরশীল বা সামাজিক নিয়মানুবর্তীতায় আবদ্ধ, তারা সামাজিক লোকলজ্জা বা যে কোনও মূল্যে পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার দায়ের মতো ধ্রুপদী মূল্যবোধগুলির জাঁতাকলে এখনও বন্দি। ফলে পরিস্থিতি নেহাতই হাতের বাইরে না চলে যাওয়া অবধি, এসব দেশের মহিলারা মোটের ওপর পারিবারিক হিংসার ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে রাখাই দস্তুর মনে করেন।
ভারতের কথাই যদি বলি, ২০২২ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এদেশের মেয়েদের ওপর ঘটা বিবিধ নির্যাতনের ঘটনার প্রায় ৩২ শতাংশই ঘটে তাদের পরিবারের হাতে। গার্হস্থ্য নির্যাতনের ঘটনার শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। তারপর যথাক্রমে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৬ থেকে ২০২২– এই ছ’-বছরের মধ্যে এদেশে গার্হস্থ্য হিংসার জনসংখ্যা সমাযোজিত হার বেড়েছে ১৬ শতাংশ, অথচ তা থেকে মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়ার হারে কোনও উন্নতি হয়নি। এ এক বিরাট সমস্যা! আরও বিচিত্র সমস্যা এই যে পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার প্রতিবেদন দেখাচ্ছে যে, এদেশের সমীক্ষাধীন ১৮টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১৪টির, অন্তত ৩০ শতাংশ মহিলাই স্বামীর হাতে প্রহারকে, সোহাগের অংশ হিসেবেই দেখে! একেই কি বলে মগজ ধোলাই? যা যন্তরমন্তরের ঘর ছাড়াই আত্মপ্রকাশ করে, দীর্ঘকাল ধরে বয়ে আনা পিতৃতন্ত্রের আউটকাম হিসাবে?
অথচ ধারাবাহিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নারীশরীর ও মনের যে অপূরণীয় ক্ষতি করে, তা মেয়েরা শুধু আপন জীবনেই ভোগ করে না, দিয়ে যায় পরবর্তী প্রজন্মকেও। অপুষ্টি, অ্যানিমিয়া কিংবা নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যার হেরেডিটারি ট্রান্সফারের মধ্য দিয়ে তো বটেই, পাশাপাশি সনাতনী পিতৃতান্ত্রিক ভ্যালু সিস্টেমের ব্যাটন হস্তান্তরের মাধ্যমেও। যা তাদের আপন পরিবারের মধ্যেও নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে শেখায়। শেখায়, শত অত্যাচারেও ‘উঃ’ শব্দটুকুও করতে নেই। করলে, পরিবারের সম্মানহানি হয়।
এ-সকল নির্যাতনের ফসল নির্যাসই হল ‘মিসিং উইমেন’– যারা ‘উঃ’ বলার আগেই উধাও হয়ে গেছেন লিভিং হিউম্যান-এর ডেটাবেস থেকে। আজ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে, হয়তো তাদের মিসিং ডায়রির সহজ পাঠ লিখতেন এইভাবে;
কাল ছিল ডাল ভরে,
আজ ফুল গেছে ঝরে।
বল দেখি দেশবাসী,
হয় সে কেমন করে?
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………