নারী রাতে বেরবে না, ফাঁকা স্থানে যাবে না, নিজেকে ঢেকে রাখবে– পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এমন নানা বিধান দিত। তাই যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েরা বললেন: চলো রাত দখল করে দেখাই। শুরু হল ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট মুভমেন্ট।’ তাঁরা দল গড়লেন। ঘুরে বেড়ালেন মধ্যরাতের রাজপথে, গলিতে, বন্দরে। গান গাইলেন। চিৎকার করে স্লোগান আওড়ালেন। রাতের প্রেক্ষাপটে মেয়েমানুষ দেখতে যে চোখ অভ্যস্ত নয়, তাদের সুঅভ্যাস করাতে চাইছিলেন তাঁরা। বোঝাচ্ছিলেন, ‘আমার মর্জি, আমি বেরিয়েছি। তার মানে আমি ভোগ্য নই।’
পোর্টালে লেখার সুযোগটি ব্যবহার করে ভণিতাহীন একটি ঘোষণা দিতে চাই। আসুন রাতের দখল নিই। রাতের কলকাতা শাসন করার জন্য শতখানেক নারী হলেই চলবে আমাদের। আপনি কি আগ্রহী? আপনি স্বাগত।
ধর্ষণ হোক বা যৌননিগ্রহ, তা ঘটার পর দায় ও দোষ নেবে কে? মেয়েরাই? ‘রাতের বেলা বেরনো উচিত হয়নি’ হল দায় চাপানোর একটি ধরন মাত্র৷ এই প্রবণতার আরও প্রকারভেদ আছে। আরও নানা কারণে নারী ধর্ষিত হয়– এরকম কথা, আমাদের দেশের মতো, সাতের দশকের যুক্তরাষ্ট্রেও মনে করা হত। কেউ বলতেন, কারণটি পোশাক। কেউ বলতেন, নারীর চরিত্র। কেউ বলতেন, অকুস্থলে লোক চলাচল কম ছিল, অতএব…
নারী রাতে বেরবে না, ফাঁকা স্থানে যাবে না, নিজেকে ঢেকে রাখবে– পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এমন নানা বিধান দিত। তাই মেয়েরা বললেন: চলো রাত দখল করে দেখাই। শুরু হল ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট মুভমেন্ট।’ তাঁরা দল গড়লেন। ঘুরে বেড়ালেন মধ্যরাতের রাজপথে, গলিতে, বন্দরে। গান গাইলেন। চিৎকার করে স্লোগান আওড়ালেন। রাতের প্রেক্ষাপটে মেয়েমানুষ দেখতে যে চোখ অভ্যস্ত নয়, তাদের সুঅভ্যাস করাতে চাইছিলেন তাঁরা। বোঝাচ্ছিলেন, ‘আমার মর্জি, আমি বেরিয়েছি। তার মানে আমি ভোগ্য নই।’ এর পরে একটা দশক জুড়ে ধর্ষণ সংস্কৃতি (রেপ কালচার) এবং ধর্ষিতাকে দোষারোপের সংস্কৃতি (ভিক্টিম ব্লেমিং)-এর বিরুদ্ধে নানা আন্দোলন ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ ব্যানারের তলাতেই অনুষ্ঠিত হত।
আর জি কর মেডিকাল কলেজে একজন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ডাক্তার ধর্ষিত হয়ে মারা গিয়েছেন। তিনি ‘অন কল ডিউটি’-তে ছিলেন। অর্থাৎ, সেসময় তাঁর কাজে আসার দায় কর্তৃপক্ষের। অবশ্য শোনা গিয়েছে, তিনি তার আগের ৩৬ ঘণ্টাও টানা ডিউটি করেছেন, যেটা আবার শ্রম-আইন বিরোধী হলেও, ডাক্তারি পড়ুয়ার জীবনের অঙ্গ। এ বিষয়ে যে কোনও ডাক্তারি পড়ুয়া বা ডাক্তারের থেকে খোঁজ নিলেই তা জানা যায়। সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
কিন্তু কোনওমতে রাতের খাবার খেয়ে, বাড়িতে ফোন সেরে, সেই মেয়ে অন-কল অবস্থায়, রোগীস্বার্থে সংযত ও প্রস্তুত অবস্থায়, সেমিনার রুমে পড়াশোনা করার ফাঁকে, ধর্ষিত হলেন, খুন হলেন। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে, শ্বাসরোধ করে, চোখ থেকে রক্ত বের করে, হত্যা হয়েছে। হত্যা করার আগে যৌন নির্যাতনও যে হয়েছে, তার ছাপ স্পষ্ট। আর তার পরে পরেই সোশাল মিডিয়ায় উঠে এল ছাত্রদের হাতে লেখা এক পোস্টার, যার বাংলা অর্থ হল:
‘অধ্যক্ষ বলেছেন, রাতে মেয়েটির একা থাকা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। অধ্যক্ষর লজ্জা হোক।’
এ কি সত্যি? যদি একথা তিনি বলে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তিনি শুধু অধ্যক্ষ হিসেবে নয়, ডাক্তার হিসেবেও অযোগ্য। এহেন অসংবেদনশীলতা নিয়ে সেবাকার্য করা উচিত নয় তাঁর। এ যদি সত্যি হয়, তবে তিনি কি অব্যাহতি নেওয়ার কথা ভাববেন?
আর একটা পদক্ষেপের কথা আমরা ভাবতে পারি। জানি না এ উদ্যোগ আগে নেওয়া হয়েছে কি না। কিন্তু আমরা শুরু করতে পারি। আইনে ‘ক্রিমিনাল ডিফেমেশন’ বলে একটি ধারা হয়। পাড়ার জ্যাঠা থেকে শুরু করে বিশ্বজনীন মরাল মাসিমা– যে কোনও কারও দ্বারা ধর্ষিতার ভিক্টিম ব্লেমিং দেখলেই আমরা সেই ধারায় মামলা করতে পারি। তাতে তারা কি শাস্তি পাবে? এখনই হয়তো পাবে না৷ আইনের ফাঁক গলে বেরবে। কিন্তু ভোগান্তি হবে। এরপর মুখ ফস্কে কিছু বলে ফেলার আগে ভাববে, যা বলছে তা বলার এক্তিয়ার আছে কি না।
…………………………………………
পড়ুন রণিতা চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা
………………………………………….
ধরা যাক, কোনও মেয়ের যদি ‘ডিউটি’ না থাকে? যদি সে হাওয়া খেতে বেরয়? তাহলেও সে দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়। প্রাথমিকভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্তৃপক্ষ, যারা ক্যাম্পাসে বা হাসপাতালে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেনি।
একইভাবে ধর্ষণের সময় ঘড়ির কাঁটা কোন সংখ্যার গায়ে লেগে ছিল, তার ওপর ভিত্তি করে কোনও মেয়েকে সোজাসুজি বা আকারে ইঙ্গিতে দায়ী করা যাবে না।
যদি মেয়ে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পথে ধর্ষিত হয়, তাহলেও দায় তার নয়। যদি প্রেমিকই তাকে ধর্ষণ করে, তবু দায় তার নয়। যদি সে ডাক্তার হয়, দায় তার নয়। যদি সে শ্রমিক হয়, দায় তার নয়। যদি সে যৌনকর্মী হয়? তবুও তার অসম্মতিতে তার প্রতি যৌন নিগ্রহের দায় কোনওমতে তার নয়।
এইবার আরও কিছু কথা বলার থাকে। অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আগেও নানা দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন এবং সে অপরাধে ট্রান্সফারও হয়েছিল তাঁর। অনেকে বলছেন, তাঁর থেকে এই অসংবেদনা প্রত্যাশিত। বিনীতভাবে বলি, তিনি দুর্নীতিপরায়ণ হতে পারেন, কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তা বলার জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার দরকার পড়ে না।
রাতে যৌন নিগ্রহ ঘটলে, অভিযোগ জানাতে গেলে, এখনও পুলিশ স্বয়ং একথা বলে। দায়িত্ব সহকারে জানাতে চাই যে, বক্তা হিসেবে মঞ্চ ভাগ করে নিতে গিয়ে, পুলিশের উচ্চপদস্থ এক নারী অফিসারের মুখ থেকেও এটা শুনেছি যে, ‘দায়িত্বশীল হোন। রাতে বেরবেন না। নির্ভয়া মনে আছে?’
তিনি কিন্তু কঠোর অফিসার হিসেবেই পরিচিত তাঁর এলাকায়। তিনি হয়তো দুর্নীতিপরায়ণ নন। তিনিও জানেন না, কতটা তিনি বলতে পারেন। সাবধান করতে চাইলেও, কীভাবে বড়জোর তা করতে পারেন। ‘রাতে বেরোলে সাবধানে বেরোবেন’ আর ‘রাতে বেরোবেন না। দায়িত্বশীল হোন।’ এ দু’টি কথার সার এক, অথচ ভঙ্গিতে অনেক তফাত। ২০১৩ সালে ভার্মা কমিশনের সুপারিশে ধর্ষণ আইন সংশোধন হয়েছিল ২০১২ সালে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর। তারপর শুনেছিলাম, পুলিশের বিস্তর ওয়ার্কশপ হয়েছিল, ধর্ষিতাকে কী বলা যাবে না, তার সঙ্গে কী আচরণ করা যাবে না, তার বদলে কী বলতে বা করতে হবে, এসব নিয়ে। সেসব কী মাঠে মারা গেল? সাইবার থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়ে, ‘ছবি কেন পাবলিক করেছিলেন?’– এই প্রশ্নটি শোনেননি কোন অভিযোগকারী?
মন্ত্রী, পুলিশ, অধ্যক্ষ নিজের দায় ঝেড়ে ফেলতে সাধারণত সেই ভাষায় কথা বলেন, যে ভাষা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। তাই আমাদের অন্তরেও অধ্যক্ষসাহেব লুকিয়ে আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। ডাক্তারের খুনী-ধর্ষকের সঠিক শনাক্তকরণ ও বিচার চাই। সেই সঙ্গে বোধোদয়ও চাই। শুধু ধর্ষক আর অধ্যক্ষের অপরায়ন করে যেন আমরাও না দায় ঝেড়ে ফেলি।
মধ্যরাত শাসন করার কথা উঠলে প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ কবির মগজেও চার যুবক ভিড় করে। মেয়েরা কবে দখল নেবে মধ্যরাতের? অফিস করে আসুন, কাজ সেরে আসুন। আসুন রাত হাঁটি। রাত দেখি। রাত বাঁচি। দুয়েকদিন আপনার পুরুষসঙ্গী পড়াক সন্তানকে। রাঁধুক বাড়ুক। আপনি সংঘবদ্ধ হোন ও রাতের অধিকার নিন। টেক ব্যাক দ্য নাইট। রাতের কলকাতা, রাতের দিল্লি, রাতের মুম্বই– রাত সুন্দর। কিংবা রাত ভয়ানক, কিন্তু আসুন, তাকে সুন্দর বানাই।