মরক্কোর ডিফেন্ডার নাইহোলা বেঞ্জামিন যখন প্রথম হিজাবি খেলোয়াড় হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাচ্ছেন, তখন ঠিক কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরেই ইরানে মেয়েদের হিজাবের ফাঁস আরও শ্বাসরোধকারী হয়ে উঠছে। একদিকে যেমন নাইহোলার এই পদক্ষেপ আরও বহু মুসলমান মেয়েদের জন্য আন্তর্জাতিক খেলার দরজা খুলে দিল, তেমনই মনে রাখতে হবে এই বিশ্বের বহু মেয়ের কাছেই হিজাব ‘চয়েস’ নয়। লিখছেন ঝিলম রায়।
জান, জিন্দেগি, আজাদি। নারী, জীবন, মুক্তি। গত বছর ছেলেদের কাতার বিশ্বকাপে ময়দান কেঁপে উঠেছিল এই স্লোগানে। যখন কাতারের শ্রমিকদের লাশের ওপর বানানো স্টেডিয়ামে ফিফার চোখরাঙানিতে নানা দেশ নতি স্বীকার করে প্রতিবাদী আর্ম ব্যান্ড পরতেও ভীত হয়েছিল, তখন রাষ্ট্রের রোষানল উপেক্ষা করেই ইরানের ফুটবল টিম একজোট হয়ে রাষ্ট্রীয় সংগীতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল মাহসা আমিনের মৃত্যুর প্রতিবাদে উত্তাল হওয়া সহনাগরিকদের সংহতিতে। ময়দান জুড়ে মাহসা আমিনের ছবি বুকে নিয়ে তাদের সমর্থনে হাতে হাত রেখেছিল ইরানি মেয়েরা। একইসঙ্গে নজর কেড়েছিল লাল-সবুজ জার্সির মরক্কো। একটুর জন্য কাপ অধরা থেকে গেলেও ময়দানে পায়ে বল নিয়ে, ম্যাচ শেষে প্যালেস্তাইনের সংহতিতে ইজরায়েলি দখলদারির বিরোধিতায় বিশ্ববাসীর দিল জিতে নিয়েছিল আফ্রিকার এই সিংহ দল। গোটা বিশ্ব থমকে সাক্ষী রেখেছিল সেই প্রত্যয়ের। মেসি ম্যাজিকের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছিল এই সমস্ত প্রতিরোধী মুহূর্তগুলো।
আরও পড়ুন: হিংসার অভিমুখ শেষমেশ নারী নির্যাতনের দিকে
বছর ঘুরতেই অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে আবারও ফিফা বিশ্বকাপ। এবারে খেলা মেয়েদের। তবে এবারেও ইতিহাসের পাতায় মরক্কো। প্রসঙ্গ হিজাব। ফিফার সাত বছরের ব্যান উঠে যাওয়ার পর, এই প্রথম হিজাব পরে আন্তর্জাতিক ময়দানে নামলেন নাইহোলা বেঞ্জামিন। মরক্কোর ডিফেন্ডার। অবশ্য হিজাব ও ফুটবলের সমীকরণ অত সহজে করে ফেলা যায় না। ২০০৫-এ ফিফার আন্তর্জাতিক ময়দানে হিজাব, পাগড়ি জাতীয় সমস্ত রকম ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক মাথা ঢাকার পোশাককে বিপজ্জনক ঠাওরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা থেকে আজ মরক্কোর নাইহোলা হিজাব পরে খেলতে নামার অন্তরালে আছে সাত বছরের এক জটিল ইতিহাস। তাতে যেমন রয়েছে ৯/১১ পরবর্তী ইউরোপীয়, মার্কিন আধিপত্যের, সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ছড়ানো বিশ্বব্যাপী মুসলমান বিদ্বেষের নানা জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ, তেমনই রয়েছে ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে যুঝে পায়ে বল নিয়ে দুনিয়া মাত করার স্বপ্ন দেখা হাজারো মেয়েদের লড়াইয়ের গল্প। ২০০৭-এ ক্যানাডার অন্টারিওর খেলোয়াড় আসমহান মন্সৌর হিজাব পরে খেলতে নামতে গেলে রেফারি তাকে হিজাব খুলে মাঠে নামতে নির্দেশ দেন। আসমহনের টিম প্রতিবাদে সেই প্রতিযোগিতা প্রত্যাহার করে। ২০১১-তে একইভাবে অলিম্পিক থেকে বিতাড়িত হতে হয় ইরানের মেয়েদের ফুটবল দলকে। ফিফার এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের নেপথ্যে যদিও রয়েছে পুঁজি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা হিসেবনিকেশ। সাম্প্রতিককালে জর্ডনের প্রিন্স ফিফায় এশিয়ার প্রতিনিধি হওয়ার পর থেকেই এই হিজাব ব্যান কীভাবে বিশ্বের বহু মুসলমান মেয়েদের ফুটবল খেলা থেকে দূরে রাখছে, তাই নিয়ে চর্চা শুরু হয়। ‘লেট আস প্লে’ নামক একটি ক্যাম্পেইনও শুরু হয় আন্তর্জাতিক মহলে। একই সঙ্গে নানা নামকরা স্পোর্টস কোম্পানি-ও হিজাব সমেত জার্সি বানাতে শুরু করে।
আরও পড়ুন: ‘মেয়ে চাই?’ আর ‘মেয়ে কই!’ শহরের দেওয়াললিখন যেন মেয়েদেরই ভাগ্যলিপি
মজার ব্যাপার হল, মেয়েদের ফুটবল খেলা ও জার্সির ইতিহাসও জটিল। শোনা যায়, বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন শ্রমজীবী মেয়েদের ফ্যাক্টরিতে যোগদানের হাত ধরেই কর্মক্ষমতা বাড়াতে ও ফিটনেস বজায় রাখতে শুরু হয়েছিল মেয়েদের ফুটবল খেলার চল। যুদ্ধ শেষে, মেয়েদের যখন আবারও ঘরে ফেরার পালা হল, তখন অনেক মেয়েই ফুটবলের টানে সেই নির্দেশ অমান্য করে খেলতে থাকল। তখন অবশ্য মেয়েদের খেলার কোনওই গুরুত্ব ছিল না। পুরুষদের ফেলে যাওয়া জার্সি গায়ে চাপিয়েই খেলে যেত ফুটবল পাগল এই মেয়েরা। সেই জামা না ছিল তাদের মাপের, না ছিল আজকালকার ‘কিট’-এর মতো অত্যাধুনিক ডিজাইন। সেই বেখাপ্পা বাতিল ঢলঢল জামা গায়ে, প্রায় কোনও পরিকাঠামো ছাড়াই অবশ্য ততদিনে পায়ে বল নিয়েই দুনিয়া কাঁপাতে শুরু করেছে মেয়েরা। দু’বছর আগে ফিফার এই নিয়ম পরিবর্তন ও এই বিশ্বকাপে নাইহোলা বেঞ্জামিনের হিজাব পরে মাঠে নামা আসলে মেয়েদের খেলা ও পোশাকের এই জটিল রাজনীতিরই শরিক।
মাহশা আমিনি-র মৃত্যুর প্রতিবাদে উত্তাল ইরান
নাইহোলা যখন প্রথম হিজাবি খেলোয়াড় হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাচ্ছেন, তখন ঠিক কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরেই ইরানে মেয়েদের হিজাবের ফাঁস আরও শ্বাসরোধকারী হয়ে উঠছে। বাধ্যতামূলক হিজাবের আইন অমান্য করলেই নীতিপুলিশের তত্ত্বাবধানে ‘পুনর্শিক্ষা’ ব্যবস্থা হয়েছে এবং তা অগ্রাহ্য করলে তাদের উচিত শিক্ষা দিতে আরও কঠিন সাজার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একদিকে যেমন নাইহোলার এই পদক্ষেপ আরও বহু মুসলমান মেয়েদের জন্য আন্তর্জাতিক খেলার দরজা খুলে দিল, তেমনই মনে রাখতে হবে এই বিশ্বের বহু মেয়ের কাছেই হিজাব আসলে ‘চয়েস’ নয়, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, পারিবারিক পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে রোজকার বোঝাপড়ার, সমঝোতার এক নজির মাত্র। সেই বোঝাপড়ার হাত ধরেই কখনও তা হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চিহ্ন; আবার কখনও মেয়েদের লড়াইয়ের স্রোত পেরেছে এই পোশাক পুড়িয়ে নিজের মুক্তি পথ এঁকে নিতে। নাইহোলা, আসমহান কিংবা ইরানের মাহসা আমিনির ছবি বুকে প্রতিরোধের ঝড় তোলা মেয়েদের দলের প্রত্যয় আসলে বুঝিয়ে দেয় লড়াইটা কেবলমাত্র একটি পোশাকের পরা না-পরা নিয়ে নয়, লড়াইটা মেয়েদের স্বতন্ত্রতায় হস্তক্ষেপের, মেয়েদের খেলায় ধর্ম, রাষ্ট্র, পুঁজির নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধেও। এবং এই দখলদারির, এই দাদাগিরির, এই শোষণমূলক ব্যবস্থা উৎখাত না করলে মেয়েদের ‘চয়েস’ নির্ণয় করা মুশকিল।
যখন আমরা, তথা সকল ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনমানস ঠিক করব কোন ধরনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আমরা নেব, কিংবা জড়বৎ বাঁচা থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে এসে, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে প্রচার করা বন্ধ করব, তখন-ই আমাদের এই জড়বৎ অস্তিত্ব, অপরের শর্তে তৈরি করা জগৎ থেকে মুক্ত পাব।