Robbar

শরতে উপেক্ষিত: বাগবাজারের শাশ্বত প্রতিমার চোখ আঁকেন, অথচ লোকচক্ষুর আড়ালে শিল্পী ‘খোকাদা’!

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 18, 2025 8:11 pm
  • Updated:September 18, 2025 8:11 pm  

মূর্তি গড়ছেন, চোখ আঁকছেন– ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। বাগবাজার সর্বজনীনের দুর্গা মাতৃপ্রতিমার যে চিরায়ত চোখ, ‘বাংলা’ চোখ– তা তাঁরই আঁকা। বহু মানুষের ভিড়, বহু মানুষের আশা, ভক্তির আয়ু বাড়ে এই প্রতিমার চোখের দিকে তাকিয়েই। কিন্তু এত আলো-শব্দ-উৎসব– কোনওকিছুই চেনায় না সেই শিল্পীকে, যিনি দীর্ঘকাল ধরে চোখ এঁকে চলেছেন এই দুর্গাপ্রতিমার। তিনি খোকাদা। ৭৫ ছুঁইছুঁই। খানিক বিরক্ত। ঘনঘন বিড়ি খাচ্ছেন আর এই সাংস্কৃতিক কলকাতার উপেক্ষার বুদ্বুদ ফাটিয়ে দিচ্ছেন। রইল তাঁর সঙ্গে ছোট্ট আড্ডা। কথালাপে অরিঞ্জয় বোস  

অরিঞ্জয় বোস

চোখ আঁকা বললেই এই কলকাতায় আপনার কথাই মনে পড়ে এখন। জানতে চাই শুরু কী করে করলেন? 

তখন আমার ওই ১৮-১৯ বয়স। মাটির কাজ করতে করতে একদিন শুরু করেছিলাম চোখ আঁকা। প্রথমেই দুর্গার চোখ দিইনি। বাহন, সাইড পুতুল, তারপরে মূল প্রতিমা। একদিনে তো হয়নি! বহুদিন ধরে চেষ্টা করেছি। আমার গুরু রামচন্দ্র পালের সান্নিধ্যে প্রত্যেক দিন শিখেছি। খুব বড় শিল্পী ছিলেন। এখন কেউ কি মনে রেখেছে তাঁকে? প্রত্যেক মুহূর্তে ভেবেছি, কীভাবে আমি কাজটা করতে পারি। ভালো না বাসলে এই কাজে করতে পারতাম না কোনও দিনও।

গুরুর দেওয়া থালা তুলি এখনও ব্যবহার করেন খোকা

খুব সূক্ষ্ম কাজ তো এটা। ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই? তখন কী বলতেন আপনার গুরু? 

কত যে ভুল করেছি। মুছে ফেলেছি। সরিয়ে দিয়েছি। সাদা রং দিয়ে প্রলেপ চড়িয়ে আবার এঁকেছি। গুরু বলতেন, ‘ওটা ভুল হয়েছে মুছে ফেল। আবার নতুন করে কর।’ গুরু প্রতিবার আমায় দেখিয়ে দিতেন। ভুল তো সবার হয়। গুরু বলতেন, ‘নিজে দেখে বল তো, ভুলটা কোথায়?’ আসলে, নিজেই নিজের ভুলকে দেখা আর সেটাকে আবার ঠিক করার অভ্যাস আমার গুরু আমায় করিয়ে দিয়েছিলেন।

যাঁর চোখ আঁকছেন, তাঁর তৃতীয় নয়ন আছে, এই ব্যাপারটা কেমন লাগে?

ছোটবেলা থেকেই দেখছি মায়ের তিনটে চোখ। তৃতীয় নয়ন রয়েছে। আমাকে অনেক ছোটরা জিজ্ঞেস করে, কেন তিনটে চোখ? কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকেই জানতাম, আমার মায়ের তিনটেই চোখ। (খানিক বিরক্ত হয়ে) আমি তো ওদের ঠিক করে বলে-বুঝিয়ে দিতে পারি না!

চোখ আঁকার সময় কী মাথায় রাখেন?

যা আসে আসুক, মাথাটা আগে ঠান্ডা রাখতে হবে। সব মন প্রাণ এক জায়গায় থিতু। তা না হলে কোনও দিন ওই চোখের টান আসবে না কিছুতেই। নির্ভুল চোখ আঁকা তখন সহজ হয়ে যায়। চারিদিকে যত হল্লাহাটি হোক, আমার কানে যেন কিছু না আসে। এক মনে কাজটা করে যেতে হয়। একটা কথা বলি,  বিড়ি ধরালে না, কাজটা বেশি ভালো হয়। মনটা তাড়াতাড়ি বসে (হাসি)।

ছবি: অরিঞ্জয় বোস

আঁকার আগের আর পরের অনুভূতি কী?

আসলে অনুভূতি ভিন্ন। একটা কথা বলি, যে যেখানকার মা, তিনি যেন সেই জায়গার মতো করে রূপ নিয়ে নেন। আমি চোখ লিখে দিলাম (কুমোরটুলি চোখ আঁকাকে, চোখ লেখা বলে), কিন্তু পরে গিয়ে দেখি কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। ভাবি, আরে, আমিই তো চোখ দিলাম, বদলে গেল কী করে! ঠাকুরদালানের মা ঠিক যেমন হন, দেখি, তেমনই আছেন।

সে অর্থে প্রতিমা, যখন দেখতে পান না, চক্ষুহীন, তাকে আপনি চোখ দেন, এটা ভেবেছেন কখনও?

এভাবে ভেবে দেখিনি কিন্তু ভালো হলে, ভালোই লাগে তখন। আমার চোখে মা জ্যান্ত হলে, ভক্তি পেলে, আমার কাজটাই তো দাম পেল।

সাবেকি দুর্গার চোখ মানেই বাগবাজার সর্বজনীন, আর সেই চোখ মানেই তো খোকা পাল!

এখন অনেকে আছেন! তাঁরা আঁকবেন। আমাকে আর দরকার কীসের? ওই চোখ আমি তৈরি করেছি। আমার নামটাই কেউ জানল না। নতুন লোকজন দেখি না, কে কতদূর চোখ দিতে পারে! এখনও গোটা কুমোরটুলিতে বাংলা চোখ দিতে আমার ডাক পড়ে। কিন্তু আমি যেদিন থেকে চোখ দিচ্ছি, ভালো, খারাপ যা হোক, যে টান দিয়ে যাচ্ছি– চোখ আঁকার সময় ওই টান আর কেউ দিতে পারবেন না!

ছবি: শুভ্ররূপ বন্দ্যোপাধ্য়ায়

বাগবাজারের মুখ কী আপনার চোখের টানে পরিবর্তন হয়েছে?

আগের চেয়ে খানিকটা বদল বলে মনে হয়েছে। ৪০ বছর এই কাজ করছি। আমি যবে থেকে চোখ লিখছি, আজও এক টান, একভাবে চোখ দিয়ে যাচ্ছি। আমার আগে অন্যরকম ছিল, আমার পরেও এই চোখ আর থাকবে না।

দুর্গাপুজোর বাইরে, এমনি সময় কী করেন?

কাজ আর পরের পুজোর অপেক্ষা করেই সময় কেটে যায়! তাছাড়া, সারা বছর কত পুজো! একবার এর ঘর, একবার তার ঘরে ঠাকুর বানাতে বানাতেই বছর ঘুরে যায়। সারা বছরই তো ঠাকুর গড়েই চলি।

এই পেশায় পরবর্তী প্রজন্ম কি আসবে?

ইচ্ছে থাকলে আসবে।  দেখুন– এই কাজ ফাঁকিবাজিতে হয় না। পরিশ্রম করতে হয়। আর সেই সব যদি করতে পারে, কেন আসবে না! আলবাত আসবে। কাজ শিখলে, ইচ্ছা থাকলেই অবশ্য পারবে।

আপনি তৈরি করছেন? শিষ্য আছে?

তৈরি হচ্ছে কেউ কেউ। যাঁরা ছোটবেলা থেকে আমার সঙ্গে কাজ করে। কথা শোনে। আমার কাজ, কাজটা শিখিয়ে যাওয়া, আমি সেটাই করে যাব।

……………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর অন্যান্য লেখা

……………………….