
আঁকার ঘরে তখন নিস্তব্ধতা। শুধু শোনা যায় পেনসিলের খসখস শব্দ। সেই শব্দের কেন্দ্রে বসে আছেন এক নারী ঘণ্টার পর ঘণ্টা– নীরব, কিন্তু উপস্থিতিতে গভীর। তাঁর শরীরেই শিল্পীরা খুঁজে ফেরেন অনুপাত, আলো, ছায়া। যখন শরীর হয়ে ওঠে শিল্পের ভাষা তখন লজ্জা মুছে যায়, থেকে যায় শুধু রেখা। সেই রেখার মধ্যে বাস করে এক নীরব আত্মত্যাগ। তাঁরা হলেন সেই অচেনা মানুষ, যাঁদের ছায়ায় গড়ে ওঠে শিল্পের আলো। কিন্তু এই নারী, যিনি অন্যদের শিল্পের অংশ হয়ে ওঠেন প্রতিদিন, তাঁদের নিজের জীবনের ছবিটা কে আঁকে? আর্ট কলেজের ফিগার মডেল, যাঁর শরীর থেকেই গড়ে ওঠে শিল্পের পাঠ। কিন্তু ক্যানভাসের বাইরে, সমাজে তাঁকে চেনা হয় না প্রায়ই। তাঁর কথাই আজ শোনা দরকার।
দিদি, এই লেখাটার সঙ্গে আপনার আসল নাম আর ছবি কি ব্যবহার করতে পারি? আপনার আপত্তি থাকলে বলতে পারেন।
না, আপত্তির কী আছে? এটা তো আমার জীবিকা, এর মধ্যে তো কোনও অসততা নেই, তাই লুকনোরও কিছু নেই।
আমি এর আগেও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা আপত্তি করেছিলেন… তাই বলছিলাম, আপনার মতো সপাটে কেউ এমন করে বলেননি।
দেখুন, অনেক আগে, ছোটবেলায় হয়তো আপত্তি করতাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে শিখেছি আমি সৎভাবে আমার সংসার চালানোর জন্য এই জীবিকায় এসেছি। আর্ট কলেজের প্রফেসর থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী এবং এখন যাঁরা নামীদামি শিল্পী হয়েছেন– প্রত্যেকে আমাকে ভালোবাসেন, সম্মান করেন। এমনকী, অনেকের এগজিবিশনের ওপেনিংয়েও আমায় ডাকেন। এখন আস্তে আস্তে আমার লজ্জা, জড়তা কেটে গিয়েছে। হ্যাঁ, হয়তো অভাব আছে, কিন্তু আমার কাজ নিয়ে আর কোনও কুণ্ঠা নেই।
আপনি কতদিন এই পেশায় আছেন?
তা প্রায় ৫২ বছর। ১১ -১২ বছর বয়স থেকে, আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, এখন আমার বয়স ৬৪।

এত অল্পবয়সে এই পেশায় কীভাবে এলেন?
আমরা খুব গরিব ছিলাম। বাবা গাইঘাটা স্কুলে পড়াতেন। আমরা ছিলাম ৬ বোন, ১ ভাই। এক দিদির বিয়ে হয়েছিল কলকাতায় খিদিরপুরে। স্কুলের ছুটিতে দিদির বাড়িতে এসেছি। জামাইবাবু কাজ করত মিউজিয়মে। তো দিদি একদিন বলল, ‘তুই জামাইবাবুকে ভাত পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবি?’ আমি যেতাম। খাবার পৌঁছে পাশেই আর্ট কলেজের মাঠে ছোটাছুটি দৌড়োদৌড়ি করতাম, কখনও পুকুর ধারে গাছের নিচে বসে থাকতাম। তা এরকম একদিন বসে আছি, তখন আর্ট কলেজের একজন মাস্টারমশাই (পরে নাম জেনেছি– অশেষবাবু) এসে বললেন, ‘এই, কাজ করবি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম কী কাজ? উনি বললেন, ‘শুধু বসে থাকবি, চার টাকা পাবি।’ তখনকার দিনে চার টাকা মানে অনেক! জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ? উনি বললেন, ‘যতক্ষণ ক্লাস চলে, ১১টা থেকে ৪টে পর্যন্ত।’ অভাব তো ছিলই। আমি রাজি হয়ে গেলাম। সেই শুরু। কখনও বসতাম, কখনও দাঁড়িয়ে থাকতে হত। আবার খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম, স্যররা টিফিন খাওয়াতেন। তখন আরও একজন দিদিও ওই কলেজে ছিল, একই কাজ করত। দু’জনে মিলেই কাজ করতাম। স্যর বলে দিতেন কবে কবে যেতে হবে। তখন একটা ছোট প্যান্ট পরে থাকলেও হত। এরকম ভাবে মাস দুয়েক কাজ করলাম। তারপর আমার এক দিদিকে এই কাজের কথা বললাম। দিদি বলল, ‘আমিও করব’। তো আমরা দুই বোন মিলে ৩-৪ বছর এই কাজটা করতে থাকলাম। তারপর দিদি একটা ছেলে দেখে আমার বিয়ে দিয়ে দিল। আমি এই কাজটা ছেড়ে সংসার করতে গেলাম। দিদি কাজটা করছিল।
আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
দুই ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।
আপনার স্বামী?
আমার স্বামী ভালো ছিল না, খুব অত্যাচার করত। কীভাবে যে কাটাতাম তখন… তো সে একদিন ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়ে মাথায় ডিফেক্ট হয়ে গেল, তারপর কোথায় যে চলে গেল… আমি অথৈ জলে! তিনটে ছেলেমেয়ে নিয়ে কী যে করি। আবার আমি কাজ শুরু করলাম। তখন কলেজের বাইরে অনেক স্কুলেও ডাকত, যেতাম। অনেক ফোটোগ্রাফারের সঙ্গেও কাজ করেছি। আমার বয়স তখন কম, সবাই তখন ওই হয় না… ‘লুটে নিতে চায়’, তখন প্রচুর কাজ পেতাম। আমার তখন একটাই চিন্তা– ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষ করতে হবে। এরকম কাজ করতে করতে কাগজে দেখলাম ‘ট্যুরিস্ট সেবা আয়া’… মানে অসুস্থ মানুষরা যখন ভেলোরে বা অন্য কোথাও চিকিৎসার জন্য যেত, তখন আমি সঙ্গে যেতাম সেবার জন্য। আমি ২০-২৫বার ভেলোরেই গিয়েছি রোগীর সঙ্গে। এছাড়া অনেক বয়স্ক মানুষের অনেক সঙ্গে তীর্থস্থানেও গিয়েছি। এইভাবে অমরনাথ, চারধাম এরকম অনেক জায়গায় আমার ঘোরাও হয়ে গিয়েছে। টাকাও পেতাম, ঘোরাও হত। এইভাবে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। মেয়ে ১২ ক্লাস পাশ করার পরে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিল। তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ওকে ভর্তি করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার পক্ষে ওই খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। তাই ওকে নার্সিং ট্রেনিংয়ে ভর্তি করে দিলাম। পাশ করার পর একটা গরিব ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দিলাম। তারপর দুই ছেলের বিয়ে দিলাম। এখন আর ট্যুরিস্টদের সঙ্গে যাই না।

দুই ছেলে আপনার। তারা কী করে? আপনাকে সাহায্য করে না?
বড় ছেলে আমাকে দেখে না। বিয়ের পর আলাদা হয়ে গিয়েছে। আর ছোট ছেলে প্লাস্টিক কারখানায় মেশিন চালায়। সামান্য আয়। ওর দুটো বাচ্চা। ও নিজেও অসুস্থ। আমরা দু’জনে মিলেই কোনওরকমে চালাই।
তাহলে এখন আপনার আয় মূলত আর্ট কলেজ থেকেই?
হ্যাঁ, এছাড়া অ্যাকাডেমিতে যাই, কিছু প্রাইভেট কাজ করি, কোনও কোনও শিল্পী ডাকলে তাদের কাছেও যাই। বেলঘরিয়া পর্যন্ত যাই। ৬৪ বছর বয়স হয়ে গেল। এখন আর বেশি পেরে উঠি না। আমারও হাই সুগার আছে, থাইরয়েডের সমস্যা আছে। হাঁটু ফুলে যাচ্ছে, পা সরু হয়ে যাচ্ছে। কতদিন আর টানতে পারব, জানি না।
এখন আপনি প্রতি সিটিং এ কত পান?
১০০০ টাকা। আর শুধু মুখ হলে ৮৫০। কিন্তু আমাদের টাকা আর বাড়েনি, অনেক দিন এই টাকাতেই চলছে। এই টাকাও আমরা নিয়মিত পাই না। এই সবে চার বছরের টাকা একসঙ্গে পেলাম।
তাহলে এতদিন চলল কী করে!
ওই যে বললাম, এখানে ওখানে কাজ করে। চেনাশোনা লোকজনের কাছে ৫০, ১০০, ২০০ টাকা চেয়েচিন্তে। আমাকে সবাই ভালোবাসে, কেউ না করে না, কিছু না কিছু দেয়।
আপনার প্রথম দিনের কাজের অভিজ্ঞতা মনে আছে? সেই প্রথম দিনের অনুভূতি?
তখন তো খুব ছোট ছিলাম। অত কিছু বুঝতাম না। তবে খুব খুব লজ্জা করছিল। একটু ভয়ও করছিল। সবাই তাকিয়ে আছে, একটা অন্যরকম অনুভূতি। কিন্তু ওরা আঁকছিল, কেউ বিচার করছিল না। বুঝতে পারছিলাম, শরীর এখানে আর শরীর নেই, শুধু ফর্ম আর লাইন। ম্যাডামরা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতেন, সাহস জোগাতেন, উৎসাহ দিতেন।
আপনি কী কাজ করেন সেটা কি সবাই জানত?
সবাই জানে না, জানতও না। যখন ছোট ছিলাম তখন তো নিজে থেকে জানানোর প্রশ্নই ওঠে না। এখন অনেকে জানে। আমারও বলতে কোনও কুণ্ঠা নেই। তবে সবাই হয়তো বলবে না। আমি তো আপনার সঙ্গে পরিষ্কার কথা বলছি। সবার সঙ্গে হয়তো এভাবে এত খোলামেলা কথা বলি না। এতটা বয়স হয়ে গেল, এখন আর লুকিয়ে কী হবে? আমি চাইতাম, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। বড় ছেলে মাধ্যমিক পাশ, ছোট ছেলে আর মেয়ে ১২ ক্লাস অবধি পড়াশোনা করেছে। এই কাজ করেই তো ওদের বড় করেছি। এটা সত্যি কথাই, আমাদের সমাজে এই কাজটা নিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। ওরা বোঝে না, শিল্পের দৃষ্টিতে যেভাবে শরীর দেখা হয় সেটা অন্যরকম। আমি এখন আর লজ্জা পাই না, বরং গর্ব বোধ করি।

একেকটা সিটিং কতক্ষণ ধরে চলে?
সাধারণত ১ ঘণ্টা। কখনও ঘণ্টা দুয়েক। মাঝখানে একটু বিশ্রাম।
কলেজেও তাই?
না, কলেজে ১১টা থেকে ৪টে। মাঝখানে বিশ্রাম নিতে হয়।
এতক্ষণ টানা চুপচাপ বসে থাকাও তো মুশকিল!
হুম, মাঝেমাঝে ঘুমিয়েও পড়ি। কী করব?
এই কাজটা করতে করতে কখনও কোনও অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে?
না, কখনওই না। স্যর-ম্যাডামরা ভালোবাসেন, ছাত্রছাত্রীরা সম্মান করে। কোথাও কোনও অসুবিধে হয়নি কখনও।
ছাত্রছাত্রীরা আপনাকে কীভাবে দেখে?
প্রথম প্রথম ওদের একটু কৌতূহল থাকে, তারপর যখন ধীরে ধীরে পেশাদার হয়ে ওঠে তখন ওদের চোখে আমি একটা ‘চরিত্র’ হয়ে উঠি।
আপনার কি মনে হয় আপনি নিজেও শিল্পের একটা অংশ?
হ্যাঁ, মনে তো হয়। তবে শিল্পীরা যে খ্যাতি, সম্মান, অর্থ পান আমরা তার ছিটেফোঁটাও পাই না। আমরা আড়ালেই থেকে যাই। অভাব আমাদের রোজকার সঙ্গী। আমি চাই সবাই বুঝতে শিখুক– আমরাও শিল্পের অংশ।
এই কাজ থেকে আপনি কী শিখেছেন?
নিজের শরীরকে নতুনভাবে চিনেছি। আগে যা নিয়ে লজ্জা ছিল, এখন সেখানে শান্তি আছে। শরীর মানে জীবন, জীবনের অনেক গল্প আছে, অনেক অভিজ্ঞতা আছে।
এই কাজে আর্থিক নিরাপত্তা কেমন? কলেজে রোজ কাজ থাকে?
বললাম না, আমাদের টাকা আটকিয়ে দিয়েছিল। আমরাও কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এখন আমরা চার বছরের টাকা পেয়েছি। আবার কাজ শুরু হবে।
রবীন্দ্রভারতী বা অন্য কলেজে গিয়ে কাজ করেন না?
আগে যেতাম, এখন আর পেরে উঠি না। অসুস্থ শরীরে এই বয়সে আর কত পারা যায়?
সরকার থেকে কোনও আর্থিক সাহায্য দেয় না?
হ্যাঁ, কিছুদিন ধরে শিল্পভাতা পাচ্ছি। মাসে ১৫০০ টাকা। সারা বাংলায় আমরা ১০ জন এই ভাতা পাই।
আপনাদের আর কোনও দাবিদাওয়া নেই?
না, আর কিছুই পাওয়া যাবে না। কী হবে দাবি করে? সরকারের কাছে পয়সা নেই। অনেকে অনেক কিছু লিখেছে, কিছুই হয়নি। তারপর আমাদের কলেজের পুরনো ছাত্র প্রদোষ পাল, উনি অনেক করেছেন। আমাদের চিঠিপত্র লিখে দেওয়া থেকে শুরু করে অনেক কিছু। কলেজে জল নেই, উনি গাড়ি পাঠিয়েছেন, কলেজে ময়লা জমেছে উনিই গাড়ি পাঠিয়েছেন। প্রদোষদার সঙ্গে একদিন গেলাম আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। আমি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘আমাদের ল্যাংটা হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, গায়ে একটা সুতোও থাকে না। তুমি জানো?’

মুখ্যমন্ত্রীকে ‘তুমি’ বললেন!
কী করব? বলে ফেলেছি। পাশ থেকে অনেকে ইশারায় ‘আপনি’ বলতে বলছিল। কিন্তু আমি নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। আমি কাঁদছিলাম….
তারপর কী হল?
তারপর উনি চিঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। তারপর অফিসে গিয়ে আমাদের সব কাগজপত্র চেয়ে পাঠালেন। আমরা সব জমা দিলাম। তার কিছুদিন পর শিল্পভাতা চালু হল। আর বড়জোর বছর দুয়েক কাজ করতে পারব। তারপর যে ক’টা দিন বেঁচে থাকব ওই ভাতাটুকুই সম্বল।
আপনি কি চান নতুন মেয়েরা এই পেশায় আসুক?
চাইব না কেন! এখন তো আমরা ৫-৬জন অচল বুড়ি এই কাজ করছি। আমরাই বা আর কতদিন? তবে যারা আসবে তাদের জেনে রাখা ভালো বছরের পর বছর হয়তো বিনা টাকায় কাজ করতে হতে পারে। কবে টাকা পাওয়া যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তারপরও যে পুরো টাকাই হাতে পাবে এমনও নয়। সে অনেক কাহিনি।
আপনারা যদি কাজ ছেড়ে দেন আর নতুন কেউ যদি না আসে তাহলে কীভাবে চলবে?
সে কলেজ বুঝে নেবে। প্রিন্সিপাল তো চাইছেই মডেল বন্ধ করে দিতে। ওই অ্যান্টিক মূর্তি দিয়ে কাজ চালাবে বলছে।
কিন্তু তাতে তো প্রাণ থাকবে না!
না থাকুক। কী আর করা যাবে? এই অবস্থায় আমাদের মধ্যেও কি আর প্রাণ আছে! একটা কথা বলুন তো– ওই যে মূর্তিগুলো তৈরি হয়েছিল তার জন্যও তো আমাদের মতো কাউকে দরকার হয়েছিল?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved