Robbar

ছবি বিশ্বাসের মাহজং খেলার নেশা ধরিয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরীই

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 17, 2025 8:33 pm
  • Updated:June 20, 2025 2:31 pm  

বসন্তপঞ্চমীর এই পর্বে বসন্ত চৌধুরীর থিয়েটারের কথা। এসেছে খেলাধুলোর কথাও। মাহজং নামের এক আশ্চর্য চিনা খেলায় আসক্ত ছিলেন তিনি ও ছবি বিশ্বাস। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় থেকে শুরু করে বসন্ত চৌধুরীর কালানাক্রমিক থিয়েটার করার কথা রইল এই পর্বে। পর্ব শেষ হচ্ছে তাপস সেন-কে দিয়ে। আলো ক্রমে কমছে এই সময়ে যখন, তখন তাপস সেন আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন এই লেখায়।   

সঞ্জীত চৌধুরী

বাবার সঙ্গে প্রথম থিয়েটার দেখার স্মৃতি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’। তখন আমি সদ্য কিশোর। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি বলতাম, ‘ভানুজ্যাঠা’। সে নাটক দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলাম ভানুজ্যাঠাকে। ভানুজ্যাঠা খুশি হয়ে দাদা ও আমার জন্য নানা ‘রজনী’র টিকিট বরাদ্দ রাখতেন। তখন নাটকের ‘২৫ রজনী’, ‘৫০ রজনী’, ‘১০০ রজনী’র উত্তাল দিনকাল। ভানুজ্যাঠুর কাছ থেকে অনেক সময় স্পেশাল শো-র টিকিটও পেয়েছি।

মঞ্চের বসন্তকাল। ঋণ: সঞ্জীত চৌধুরী

ভানুজ্যাঠাকে ওঁর বাড়িতেও দেখেছি। সাধারণ বাকি পাঁচজন ছাপোষা লোকের মতোই। তিনি যে দুম করে ওরকম একটা ‘চরিত্র’ হয়ে যেতেন, বুঝতেই পারতাম না। অনেক সময়ই আমি মেকআপ রুমে বসে থাকতাম। ভানুজ্যাঠা নাটকের পোশাক পরে, মেকআপ নিয়ে আসতেন। তখনও মনে হত না, তিনি পাল্টে গিয়েছেন। কিন্তু স্টেজে নামলেই দেখতাম লোকটা কেমন বদলে গেল!

পরে দেখেছি, ভানুজ্যাঠার সমসাময়িক এমন অনেকেই, দেখতে-শুনতে সাধারণ মানুষ, ভেতর ভেতর অসামান্য অভিনেতা লুকিয়ে রাখতেন। জহর রায়, রবি ঘোষ, চিন্ময় রায়, অনুপ কুমার, তুলসী চক্রবর্তীকে মনে হয় এই সারির লোক।

নাটক দেখার আকর্ষণ তো ছিলই। ওটাই বড় মাপের আকর্ষণ। তাছাড়া, একটা ছোট আকর্ষণও ছিল। কারণ বিরতির সময় আসত চমৎকার সব খাবারদাবার– পপকর্ন, আইসক্রিম– এইসব লোভনীয় বস্তু ! ভানুজ্যাঠার নাটক দেখলে আইসক্রিম জুটবে, এ জিনিসটাও সে বয়সে মাথায় কাজ করত।

আড্ডার মধ্যমণি বসন্ত চৌধুরী। সঙ্গে ছবি বিশ্বাস ও বাকিরা। ঋণ: সঞ্জীত চৌধুরী

ছবি বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ি ছিল বাঁশদ্রোণী বাজারের কাছে। রাস্তার ওপরেই, লাল রঙের বাড়ি। সেই বাড়ির আশপাশেই বাবা বিবাহ-পূর্ব জীবনে থাকতেন। দু’জনের ঠিকানা এতই কাছাকাছি ছিল যে, ছবি বিশ্বাস প্রবল জনপ্রিয় যখন তখনও হেঁটে আসতেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাবার সঙ্গে সেসময় থেকেই একটা বন্ধুত্ব ছিল, বয়সে ছবি বিশ্বাস অনেকটা বড় হলেও।

‘শ্রেয়সী’ নাটকের পুরস্কার বিতরণী উৎসব। বসন্ত চৌধুরীর হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন ছবি বিশ্বাস। পিছনে দেবনারায়ণ গুপ্ত ও চপলাকান্ত ভট্টাচার্য। ঋণ: সঞ্জীত চৌধুরী

বাবা আর ছবি বিশ্বাসের বন্ধুত্বের একটা বড় কারণ ছিল এক চিনা খেলা– বোর্ড গেম– নাম ‘মাহজং’। বাবার একটা ক্যানভাসের ব্যাগ ছিল, যার মধ্যে থাকত খেলার পুরো সেটটা। বাবা, বাবার কয়েকজন বন্ধু নিয়মিত মাহজং খেলতেন। ছবি বিশ্বাসও হয়তো সে সময় হাজির হয়েছিলেন কোনও দিন। পরে আসক্ত হয়ে পড়েন এই খেলায়। এমনও শুনেছি, শুটিংয়ের গাড়ি চলে এসেছে, কিন্তু ছবি বিশ্বাস মাহজং খেলে চলেছেন, কারণ খেলাটা শেষ করতে পারেননি! মাহজং খেলতে আর. পি. গুপ্তর ভাগনে পল্টুকাকাও মাঝে মাঝে আসতেন। একসময় আমেরিকায় লেবার পার্টির জরুরি এক সদস্য ছিলেন। ওঁর কাছ থেকেই ছবি বিশ্বাসের মাহজং খেলার গপ্প শুনেছি নানা সময়।

Mahjong - the Chinese game of the four winds, with Arabic numbers – ROMBOL
মাহজং

খেলা নিয়ে বাবার আগ্রহ ছিল যুবক বয়স থেকেই। নাগপুরে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তখন ক্রিকেট-ফুটবল– দুই-ই খেলেছেন। ফুটবল খেলতে গিয়ে একবার দাঁত ভেঙে গিয়েছিল। বায়োস্কোপের জীবনে এসে তা অবশ্য ঠিক করে ফেলেন। পুরনো বাড়ির উঠোনে যখন দুই ভাই মিলে ক্রিকেট খেলতাম, বাবা মাঝেমধ্যে এসে দু’চার ওভার বল করতেন। দারুণ স্পিন বল। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যারা জমিয়ে ব্যাট করত, তাদেরকেও বাবার স্পিন বলে হকচকিয়ে যেতে দেখেছি। ব্যাট পারতপক্ষে করতেন না। একবার অভিনেতাদের ম্যাচে ভানুকাকা, উত্তমকুমার, তরুণকুমার, বাবা– এঁরা উপস্থিত ছিলেন।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তমকুমার, তরুণকুমার, বসন্ত চৌধুরী। ঋণ: সঞ্জীত চৌধুরী

‘দেনাপাওনা’ (১৯৭৯) নাটকেও বাবার অভিনয় দেখেছি। মনে পড়ে, খুব ঝকঝকে নাটক ছিল। এছাড়া তেমন কোনও স্মৃতি এই মুহূর্তে নেই।

রাসবিহারী সরকার নির্দেশিত ‘দেনাপাওনা’ (১৯৭৯)। ঋণ: সঞ্জীত চৌধুরী

আমি যখন মাঝ-কৈশোরে তখন আলাপ হচ্ছে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শাশ্বতর সঙ্গেও তখনই আলাপ। আর্থার মিলারের ‘অল মাই সন্‌স’ নামের একটি নাটক অনুবাদ করেছিলেন। তার রিহার্সাল শুরু হয়েছিল সেসময়। নাটকে ‘বাবা’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বসন্ত চৌধুরী এবং ‘ছেলে’র চরিত্রে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তখন রেলওয়ের ক্লেমব্রাউন ইনস্টিটিউট হল-এ হচ্ছিল রিহার্সাল। কিন্তু এই মঞ্চখানা অদ্ভুত! কারণ দর্শকের জায়গায় বসে এমন অনেক জিনিস দেখা যেত, যা দেখতে পাওয়ার কথা নয়। আবার এমন অনেক জিনিস, যা দর্শকের দেখতে পাওয়ার কথা– তা দেখা যেত না!

ক্লেমব্রাউন ইনস্টিটিউট। সূত্র: ইন্টারনেট

শুভেন্দুকাকা জানতেন এই মঞ্চে দীর্ঘকাল অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। বাবা বললেন, ‘শুভেন্দু, তুই একবার উৎপলকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর যে কী করা যায়।’ শুভেন্দুকাকা সলজ্জ ও একমুখ হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘আমি যাব না।’ বাবা একদিন ফোন করে উৎপল দত্তর কাছে গেলেন। বললেন, ‘ক্লেমব্রাউনে একটা নাটক করছি, আর্থার মিলারের অল মাই সন্‌স।’ উৎপল দত্ত শুনেই বললেন, ‘খুব ভালো, কিন্তু ক্লেমব্রাউনে করিস না।’ বাবা বললেন, ‘করিস না বললে তো হবে না, আমি তো কনট্র্যাক্টে সই করে ফেলেছি!’ ‘তোর তো পৃথ্বীশ বাগচী আছে, দুর্দান্ত ভালো ল-ইয়ার এবং তোর দাদার মতো! ও ঠিক সামলে দেবে। তুই কনট্র্যাক্ট ছিঁড়ে ফেলে দে।’

ঋণ: কমল সাহা

সেসব অবশ্য কিছুই হয়নি। নাটক হয়েছিল ওই মঞ্চেই। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম নাটক দেখে। একটা দুর্দান্ত ট্রেনের দৃশ্য ছিল, যা অপূর্ব এক আলো দিয়ে বুঝিয়েছিলেন তাপস সেন। তাপস সেনকে ‘তাপসকাকা’ বলতাম, কারণ আরও অনেকের মতো তিনিও মাঝে মাঝেই সকালবেলা আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন।

তাপস সেন। সূত্র: ইন্টারনেট

তাপসকাকা থাকতেন অদূরেই। কথা বলতেন খুব কম। এমনও হয়েছে, তাপসকাকা আসবেন বলে বাবা আগে থেকে চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। একদিন আমাদের পুরনো বাড়ির গোল বড় বারান্দায় তাপসকাকা বসে আছেন। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছেন আনমনে বাইরের দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী দেখছ তাপসকাকা?’ তাপসকাকা বলেছিলেন, ‘সকালের আলো যে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে, সেটাই দেখছি।’ এখন বুঝি, আলোকে এত দূর পর্যন্ত আত্মার বন্ধু করে নিয়েছিলেন বলেই নাটকে ওরকম সব কাজ করতেন পারতেন তাপসকাকা!

…………………………………………

অনুলিখন সম্বিত বসু