Robbar

ঠিক সময়ে ‘ঠিক ঠিক’ বলার মতো জোর মেলে না কেন?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 15, 2025 9:18 pm
  • Updated:October 15, 2025 9:18 pm  

টিকটিকি মানুষকে দেখে আজকাল কেবলই ধোঁকা খেয়ে যায়! সে বেজায় অবাক হয়ে দ্যাখে, এরাও ‘ঠিক ঠিক’ বলে তারই মতো। তবে সময় বুঝে নয়, সুযোগ বুঝে। হীরকরাজার সভার কথা টিকটিকি জানে না, না হলে সে বুঝতেই পারত, কেবলমাত্র ক্ষমতার গায়ে গা ঘষে নেওয়ার সুযোগ দিয়েই এ দুনিয়া ঠিক-ভুলের বিচার করতে শিখে নিয়েছে বহুদিন। সে-কথা জানে না বলেই টিকটিকি বুঝে উঠতে পারে না, যারা তার মতো বুকে হেঁটে না চলে দু-পায়ে ভর করতে পারে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো জোর যাদের শিরদাঁড়া দিয়েছে, সে শিরদাঁড়ায় ঠিক ঠিক সময়ে ‘ঠিক ঠিক’ বলার মতো জোর মেলে না কেন!

রণিতা চট্টোপাধ্যায়

শিরদাঁড়াতেই যাবতীয় তফাত, কবি বলেছেন। টিকটিকিও মানুষকে সেকথা বলতে পারে দিব্যি। যদিও মানুষকে দেখে সে ভয় খায়। আড়াল-আবডাল থেকে মানুষের কাজকর্মের ওপর নজর রাখাই তার অভ্যাস। যে স্বভাবের দৌলতে মানুষের গোয়েন্দা শ্রেণিটির নামকরণ হয়ে গিয়েছে তারই নামে, জানে টিকটিকি। তবে মানুষের ঘরবাড়িতে থাকলেও, তাদের পাশাপাশি প্রকাশ্যে থাকার মতো জোর তার শিরদাঁড়ায় জোটেনি কখনও-ই। সে বুকে হেঁটে চলে। অন্যের ঘর ছাড়া তার কোনও থাকার জায়গা নেই। অতএব ঘরের কোণে আর স্নানঘরে সে লুকিয়ে বাঁচে। এতদ্সত্ত্বেও, কর্ডাটা বংশের একজন হওয়ার কারণে তার একটা শিরদাঁড়া আছে এবং সেই শিরদাঁড়ার মান রাখার জন্যেই সে সময়ে সময়ে ‘ঠিক ঠিক’ বলতে পারে।

এহেন টিকটিকি মানুষকে দেখে আজকাল কেবলই ধোঁকা খেয়ে যায়! সে বেজায় অবাক হয়ে দ্যাখে, এরাও ‘ঠিক ঠিক’ বলে তারই মতো। তবে তার মতো সময় বুঝে নয়, সুযোগ বুঝে। হীরকরাজার সভার কথা টিকটিকি জানে না, না হলে সে বুঝতেই পারত, কেবলমাত্র ক্ষমতার গায়ে গা ঘষে নেওয়ার সুযোগ দিয়েই এ দুনিয়া ঠিক-ভুলের বিচার করতে শিখে নিয়েছে বহুদিন। সেকথা জানে না বলেই টিকটিকি বুঝে উঠতে পারে না, যারা তার মতো বুকে হেঁটে না চলে দু’-পায়ে ভর করতে পারে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো জোর যাদের শিরদাঁড়া দিয়েছে, সে শিরদাঁড়ায় ঠিক ঠিক সময়ে ‘ঠিক ঠিক’ বলার মতো জোর মেলে না কেন!

টিকটিকি যেহেতু সর্বত্রগামী, সুতরাং সে দুনিয়া ঘুরে দ্যাখে। দ্যাখে মানুষের দুনিয়াদারি। সে দুনিয়াতে দিন দিন উচ্ছেদ হয়ে যায় তার না-মানুষ গোষ্ঠীর অজস্র শরিক। নিয়মহারা হিসেবহীন জঙ্গল কাটার তোড়ে তাদের বাস্তু হারায় রোজ। কানাঘুষোয় সে শুনেছে, শুধু ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল, এর মধ্যেই মোটামুটি ৬ লক্ষ ৬৮ হাজার হেক্টর বন হারিয়ে গিয়েছে কেবলমাত্র ভারত থেকেই। আর গোটা পৃথিবীর নিরিখে সে সংখ্যাটা ঠেলে উঠেছে বার্ষিক ১ কোটি হেক্টরে। রেললাইন বসানোর নামে, হাইওয়ে বানানোর জন্যে, কারখানা তৈরির অজুহাতে, কিংবা বিলাসী রিসর্ট তৈরির দাবিতে, এমনকী নিছক বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং দেখানোর রাস্তা ফাঁকা করতেও বুলডোজার চলছে গাছের ওপর, মাটির ওপর, নদী কিংবা পাহাড়ের বুকে। হারিয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে সেখানে বাসা বেঁধে থাকা পাখি-পোকা-পিঁপড়ে-পশুরা। ভেঙেচুরে তছনছ করে দেওয়া হচ্ছে প্রকৃতির নিজস্ব ভারসাম্যের হিসেব। তবুও, ক্ষমতার বাক্সেই জমা হচ্ছে সমর্থনের ভোট।

ভারসাম্য কি কেবল জল-মাটি-হাওয়ার! আর মানুষের? টিকটিকি নিরুপায় চোখে দেখতে থাকে, হায়দরাবাদের জঙ্গলে বুলডোজার হানায় বাসা হারিয়ে হাহাকার করছে ময়ূর-হরিণরা। আর তাদের পাশেই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, দলিত হওয়ার অপরাধে ছাত্রাবাস থেকে উৎখাত হতে থাকা রোহিত ভেমুলা। খোলা আকাশের নিচে অনন্ত অপেক্ষায় বসে কাঁদছেন দুর্নীতির আক্রোশে চাকরিহারা শিক্ষক কিংবা চাকরির সুযোগই না-পাওয়া ছাত্র। বোমার দাগ মুখে নিয়ে কাঁদছে গাজার ভুখা শিশু। নিজের দেশের সেনার বেয়নেটের মুখে ঝুলতে ঝুলতে নিঃশব্দ আর্তনাদে ফেটে পড়ছে মণিপুর। কোথাও কোনও দেশ খুঁজে না পেয়ে সাগরের জল আর মাটির মাঝখানে মুখ থুবড়ে মরে যাচ্ছে তিন বছরের আয়লান কুর্দি। আর আট বছরের আসিফা, ঈশ্বরের সামনে লাগাতার ধর্ষিতা হতে হতে মরে যাওয়ার আগেই জেনে যাচ্ছে, যোনি ছাড়া মেয়েমানুষের আর কোনও দেশ নেই, কোত্থাও!

আসিফার ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল হয়েছিল। বিলকিসের ধর্ষকদের বরণ করা হয়েছে মালা পরিয়ে। গাজার শিশুদের কাটা ছেঁড়া হাত-পা-মাথার ছবি চায়ে ডুবিয়ে আরামে দেখছে গোটা বিশ্ব। মানুষের চাঁদে যাওয়ার দিনেও যে অনেক মানুষ না খেয়ে রয়ে যাচ্ছে, তা জেনেও কোনও মানুষেরই কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। আর এসব কিছু দেখতে দেখতে টিকটিকি মেনেই নিয়েছে, মানুষের শিরদাঁড়াগুলোকে বাইরে থেকে যতই টানটান দেখতে লাগুক না কেন, আদতে ওরা তার চেয়েও নুয়ে পড়ে বুকে হাঁটছে আজকাল। ক্ষমতার সামনে ঝুঁকে পড়া মানুষের শিরদাঁড়া, আসলে দাঁড়াতে ভুলে যায়।

তবুও, এতদিনকার পাশাপাশি থাকার অভ্যাসে টিকটিকি গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে খোঁজে, সমবেত ঠিক-ঠিক ধ্বনির মধ্যে যদি দু’-একটা মানুষের স্বর ঘুরে যায় ভিন্ন গন্তব্যে। আর কী আশ্চর্য, খুঁজে পেয়েও যায়। উন্নয়নের নামে পাহাড় আর প্রকৃতিকে ধ্বংস করার বিরোধিতা করে দিনের পর দিন অনশনে বসে থাকা সোনম ওয়াংচুক। চোরাশিকারিদের দশ হাতের আক্রমণের সামনে রুখে দাঁড়ানো ডায়ান ফসে। পরিবেশ কিংবা মানুষ, যে কারও নষ্ট হয়ে যাওয়ার মুখে নিরন্তর আওয়াজ তুলে চলা কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ। রাষ্ট্রের ক্ষমতার উল্টো‌ দিকে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে গলা তোলা গৌরী লঙ্কেশ, মহম্মদ জুবেইর, কিংবা মারিও রেসা। নোবেল পদক বিক্রি করে যুদ্ধপীড়িত ইউক্রেনের মানুষের পাশে দাঁড়ানো রুশ সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাটভ। শারীরিক বাধাকে তুড়িতে উড়িয়ে রাষ্ট্রকে সমতা শেখানো জি এন সাইবাবা। কিংবা একটা এঁদো মফস্‌সলে প্রতি রাতে হাতবদল হওয়া, বিক্রি হয়ে যাওয়া মেয়েদের মসিহা হয়ে ওঠা বরুণ বিশ্বাস।

সবকিছু তবে এখনও বেঠিক হয়ে যায়নি, এই ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে গিয়েই টিকটিকির চোখ সতর্ক হয়ে যায়। তার চোখে পড়ে যায়, কারও হাতে বেড়ি, কারও দেহ পড়ে আছে মৃত। শিরদাঁড়ার সাদৃশ্যে মানুষের সমকক্ষ না হোক, নামের জোরে মানুষ গোয়েন্দার ধরনধারণ টিকটিকির কবজায়, সুতরাং এমন বেঠিক হালহকিকত দেখে সে তদন্ত করতে যায়। আর যেহেতু প্রশাসনিক গোয়েন্দার মতো তার শিরদাঁড়া এখনও কারও কাছে বিকিয়ে যায়নি, তাই ঠিক খবরকে ধামাচাপা দেওয়ার দায়ও তার থাকে না। কিন্তু সে খবর জানাবে কে!

টিকটিকি শুনেছিল, মানুষের সমাজে খবর ছড়ায় সংবাদমাধ্যম। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম আদতে তার মেরুদণ্ডের মতোই, সমাজের ঠিক ভুলটুকু ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা এবং দায়িত্ব যার থাকার কথা ছিল। অথচ টিকটিকি দ্যাখে, একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংবিধানকে বেমালুম সরিয়ে রেখে সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে নির্বিঘ্নে জাতি-বর্ণভেদের বিশ্বাসী ঘোষণা শুনিয়ে যান ‘পূজ্য’ লেখক। তালিবান নেতা তাঁর সাংবাদিক বৈঠকে মহিলা সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে চাইলে একটা গোটা দেশের সরকার তো চুপ করে থাকেই, এমনকী সেই ঘটনার সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার, খোদ সংবাদমাধ্যমও নীরবে নিভৃতে লাভের গুড় বুঝে নেয়। নারীবিহীন সাংবাদিক বৈঠক থেকে বিনা প্রতিবাদে খবর তুলে আনেন বাছাই করা ‘পুরুষ’ সাংবাদিক।

চারদিকে তাকিয়ে টিকটিকি দ্যাখে, তালে তাল দিয়ে যাওয়া ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলা সঙেরাই ভিড় করে আছে। সে চুপচাপ ফিরতে থাকে নিজের অভ্যস্ত জায়গায়। বাথরুমের কোনও একটা অন্ধকার কোণ খুঁজে নিতে হবে তাকে। সেই জায়গা, যেখানে প্রত্যেকটা মানুষ তাদের যাবতীয় বর্জ্য উগড়ে দেয়। যেখানে সমস্ত শৌখিন মুখোশ সরিয়ে সে নিরাবরণ। নগ্ন। সেইখানে, স্বভাবমতোই আড়াল থেকে গোয়েন্দা-চোখে টিকটিকি দেখবে তাদের। আর দেখতে দেখতে বুঝে নেবে, মানুষের শিরদাঁড়াটা তার চেয়ে ঠিক কতটা আলাদা।

………………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন রণিতা চট্টোপাধ্যায়-এর অন্যান্য লেখা

………………………..