
হার্লেমে ১০৮-১১০ ওয়েস্ট ১৩৬ স্ট্রিট এই ঠিকানার দুটো টাউন হাউসকে কিনে এক সঙ্গে জুড়ে মাদাম ওয়াকার তৈরি করেন যে বাড়ি, সেখানে বেসমেন্টে ছিল বিউটি ট্রেনিং কলেজ, একতলায় পার্লার ও উপরে বাসস্থান। পরে এই দোতলাতেই শিল্প সাহিত্য ভিজুয়াল আর্টের সেরা আলোচনাচক্র গড়ে তুলবেন এ’লেইলা, হারলেমের টগবগে তরুণ কাউন্টি কালেন-এর (১৯০৩-১৯৪৬) কলামের নামে নাম হবে ‘দ্য ডার্ক টাওয়ার’।
৭.
এইবার আমরা ম্যানহাটনের হার্লেম-এ পৌঁছেছি। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পরে ইউনিয়ন গঠন হয়ে দাসপ্রথা আইনি পথে নিষিদ্ধ হলেও, দক্ষিণের যে স্টেটগুলি এই আমেরিকা ইউনিয়ন চায়নি সেখানে প্রবলভাবে সেগ্রেগেশান চলতে থাকে। আলাবামা, মিসিসিপি, জর্জিয়া, লুইসিয়ানা, ফ্লোরিডা, টেক্সাস আর সাউথ ক্যারোলাইনা অঞ্চলে খুব কম কৃষ্ণাঙ্গই জমি বা কিছুটা সম্পত্তির মালিক ছিলেন। বিশেষত এই স্টেটগুলিতে ক্লু ক্লুক্স ক্ল্যান বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। কালোদের প্রতি ঘৃণা, অবিচার, অত্যাচার, যে কোনও অছিলায় পিটিয়ে মেরে ফেলা রোজের ঘটনা, কাস্টিজমের সমগোত্র হিসেবে জারি ছিল সেই জিম ক্রো দক্ষিণে। ১৮৭০-এর দশকে স্থানীয় কাউন্সিলের ভোট প্রচার ‘সাদা-কালোর সুষ্ঠু বিভাজনের জন্য ভার্জিল শ্যান্ডলারকে জয়ী করুন’-এর ধাঁচে আমাদের দেশে আজ সবর্ণ-দলিত ভাগাভাগি নিয়ে ভোট প্রচার হলে রামমন্দিরের থেকে কিছু কম কাজ হবে না। কিন্তু না, ওভাবে ভাগ হলে তো হিন্দু জোটই ভেঙে যাবে, সে গান্ধিজি কবেই বলেছেন।

সে যাক, আপনার মুখ আপুনি দেখার যথেষ্ট অন্য সুযোগ আসবে। এখন আমরা বরং দেখি উনিশ শতকের শেষদিক থেকে হার্লেম নদী ধরে ট্যানারি, ব্রিউয়ারি, ছোটখাটো যন্ত্রাংশ থেকে ক্রমে সুগার মিল, গারমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি নর্থ ম্যানহাটনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। হার্লেম রিভার ক্যানাল আর রেললাইনের নতুন শাখা উত্তরের এই সেক্টর পর্যন্ত এসে জনবসতির চেহারার সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। সাধারণ সস্তায় থাকার অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হয়ে ম্যানহাটনের উত্তরে এই রিয়েল এস্টেট ব্যুম ইতিহাসে প্রথম, সেটা আমাদের জন্য খুব জরুরি একটা তথ্য। কারণ শ্বেতাঙ্গ মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের কথা ভেবে শহর বাড়ালেও যখন অর্ধেকের বেশি জায়গা বিক্রি না হয়ে পড়ে রইল, তখন আশেপাশের মিলে কারখানায় খেতে খামারে কাজ করা আফ্রিকি-আমেরিকানদের জন্যও খুলে দেওয়া হল।

আমরা এই অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটটি না জানলে বিশ শতকের শুরু থেকে হার্লেমে কী করে এত কালো মানুষদের বসতি, কিন্তু তা কোনও ‘নিগার গেটো’ নয়, বরং সাদা-কালোর মিশ্র একটা শহরতলি, বর্ণবৈষম্যের আমেরিকায় সেই অবাক করা পরিস্থিতিটা বোঝা যাবে না। এরপর দক্ষিণের স্টেটগুলি থেকে দলে দলে পরিবার এসে ভিড় জমাবে, থিতু হবে উত্তর ও মধ্য-উত্তর আমেরিকায়, যেখানে রোজের জীবনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, চাকরি ও প্রশাসনে আফ্রিকি-আমেরিকানদের সামাজিক সমানাধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। শিকাগো, লস এঞ্জেলেস, ডেট্রয়েট, ফিলাডেলফিয়া, নিউ ইয়র্ক। এক দেশের মধ্যে এই ‘গ্রেট মাইগ্রেশান’-এ এক হার্লেমে তিন বর্গ মাইল এলাকায় এসে বসতি তৈরি করেন প্রায় ১,৭৫,০০০ জন। নন-স্কিলড শ্রমিক থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সকলেই। এইখানে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বসতি তাবৎ পৃথিবীতে সবচেয়ে ঘন।

এখানেই বিশ শতকের প্রথম দুই দশক ধরে দাস প্রথার যৌথ ইতিহাস বহনকারী মানুষ একত্রে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চেয়েছেন, অধিকার আন্দোলনের লড়াই করেছেন, মনন ও সৃজনশীলতার চর্চায় তাঁদের আফ্রিকি উত্তরাধিকারকে দাবি করে আমেরিকার ইতিহাসে মুক্ত নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যৎ গড়তে চেয়েছেন। গদ্যে, কবিতায়, গানে, দর্শনে, মননে, স্থাপত্য-চিত্রশিল্প, নাটক, নাচের বিরাট সৃজনের মধ্যে দিয়ে যৌথ প্রতিবাদ প্রতিরোধ যেমন, যেমন গোষ্ঠীর স্মৃতি ও শরীরের সঙ্গে যোগ, তেমনই ব্যক্তি আফ্রিকি-অ্যামেরিকি হিসেবে নিজের প্রতিভা দিয়ে রেসের উচ্চ-নিচকে প্রাকৃতিক সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার দর্শন, নৃতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও শিল্পকে আঘাত করার এই ঢেউ হার্লেমে চলতে থাকবে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আমেরিকায় কালো হওয়ার অর্থ কী– এই নিয়ে মিলিট্যান্ট ছোট প্রকাশনা, পত্রিকা, সাহিত্যগোষ্ঠী, রাজনীতি, ইশতেহার-আন্দোলন থেকে ফ্যাশান, ক্যাবারে দল– সবকিছুতে কালো স্পিরিচ্যুয়াল শক্তি রাজনীতি ও এস্থেটিক হিসেবে স্পন্দিত হবে। আমেরিকার ইতিহাসে সৃজনশীলতার এই আগ্নেয়গিরিই ‘হার্লেম রেনেসাঁস’ নামে খ্যাত, যা এই আন্দোলনের মহান তুরকি ল্যাংস্টান হিউজেস মোতাবেক, ‘the expression of our individual dark-skinned selves’। সেখানে কবি লেখক শিল্পী দার্শনিক নাট্যকার পারফর্মার স্কলার– কে নেই। রেস নিয়ে আলোকপ্রাপ্তির অ্যাকাডেমিক ও সামাজিক বিভ্রম ভেঙে দিতে এই সৃষ্টিশীল ক্রোধ পরের বা পরের পরের প্রজন্মের আফ্রিকি-অমেরিকীদের সিভিল রাইটস আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, ব্ল্যাক প্যান্থার মুভমেন্ট থেকে অ্যালিস ওয়াকার, টোনি মরিসন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ পর্যন্ত বয়ে চলেছে যেমন, তেমনই দলিত সাহিত্য শিল্প আন্দোলনকেও অনুপ্রাণিত করেছে।


সেই হার্লেমে এখন আমরা অপেক্ষা করছি যে বাড়িটার সামনে তার নাম ‘দ্য ডার্ক টাওয়ার’। এই বাড়ি এ’লাইলা ওয়াকারের। এ’লাইলা ওয়াকারকে তাঁর স্মৃতিকথা ‘দ্য বিগ সী’-তে (১৯৪০) ল্যাংস্টান হিউজেস বলেছেন “the Joy Goddess of Harlem’s 1920s”। তাঁর সালোঁতে একটু পরেই এসে পৌঁছবেন আইকনিক বুদ্ধিজীবী উইলিয়াম এডওয়ার্ড দু বোয়া ও অ্যালেইন লেরয় লক। বার্লিনে স্পনসরশিপ শেষ হয়ে যাওয়ায় আমেরিকার দক্ষিণের স্টেটগুলির কৃষি ইতিহাস তিনি জমা দিতে না পারলেও, তারপরে হার্ভার্ডের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ গবেষক হিসেবে দু বোয়ার পিএইচডি। ১৬৩৮ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত আফ্রিকায় আমেরিকার দাস ব্যবসা নিয়ে তাঁর সন্দর্ভ বই হিসেবে ছেপে হার্ভার্ডের হিস্টোরিকাল স্টাডিজ সিরিজ শুরু হয়। দু বোয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাস থেকে সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস, ফিলাডেলফিয়া ও ফার্মভিল এলাকায় আফ্রিকি-আমেরিকিদের জীবন নিয়ে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা রেস সংলগ্ন ইতিহাসকে পড়ার বিপুল অধ্যায় খুলে দেয় ও নতুন মেথডোলজি তৈরি করে। তাঁর গবেষণা প্রবন্ধগুলি মূলস্রোতের অ্যাকাডেমিক জার্নালে ছাপা হয়ে জ্ঞানচর্চার জগতে এক বৈপ্লবিক দিক বদলের সূচনা করে। দু বোয়া প্যান-আফ্রিকানিজমের প্রবক্তা। এই বৈপ্লবিক আদর্শে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী একটা অবস্থান থেকে জাতি ধারণার পরিসর অতিরেকে ঐতিহাসিক যৌথতার বোধ তৈরি হয়। দু বোয়া প্যান-আফ্রিকানিজমকে মার্ক্সবাদী প্রেক্ষিতে দেখেছিলেন। মুখপত্র ‘দ্য ক্রাইসিস’ হার্লেম রেনেসাঁসের উত্তুঙ্গ তিন দশক ধরে সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। রেস নিয়ে প্রতিবয়ান কী হবে, শিল্পে সাহিত্যে কী হবে তার রাজনৈতিক নান্দনিক রূপ, রেস-বৈষম্যবিহীন সমানাধিকারের জন্য জনমত গড়ে তুলতে ও আইনি সংস্কারের প্রস্তাব ও দাবি দাখিল করায় দু বোয়ার নেতৃত্বে এই তিন দশকে ‘দ্য ক্রাইসিস’-এর অবদান অসামান্য।

অ্যালেইন লকও হার্ভার্ড। তিনি আফ্রিকি-আমেরিকি হিসেবে প্রথম রোডস স্কলার। ১৯৬৮-তে আরেক তুমুল বৌদ্ধিক সৃজনিক পরিবর্তন কালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন, ‘আমাদের পরের প্রজন্মকে বলে যেতে হবে যে শুধু প্লেটো অ্যারিস্টটলই দার্শনিক ছিলেন না, দু বোয়া আর অ্যালেইন লকও মহাবিশ্ব থেকে এসেছিলেন।’ এঁরা সেই সময়ের উচ্চশিক্ষার নানা গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার প্রাপ্ত। শুধু গবেষণাই নয়, এঁরা পত্রিকা সম্পাদনা করে সেখানে নতুন প্রজন্মের প্রাবন্ধিক, লেখক-কবি ও শিল্পীদের গড়ে তুলছিলেন। লকের সম্পাদিত ‘দ্য নিউ নিগ্রো’ সমসাময়িক লেখক কবি প্রাবন্ধিকদের সেই প্রথম একসঙ্গে আমেরিকার মূলস্রোতের পাঠকদের কাছে নিয়ে আসে। এখানে খেয়াল করার যে এটা একটা সামগ্রিক বিপ্লব ছিল। পেডাগজি থেকে মিছিল, সংগীত থেকে থিয়েটার, বই বা পত্রিকা ডিজাইন সব কিছুতেই রাজনৈতিক যৌথ অঙ্গীকার ছিল। আধুনিকতার মূল যে উপাদান– ইনোভেশন– তা সেই অঙ্গীকার থেকেই ব্যক্তি-শিল্পীর নিজস্ব স্টাইল হিসেবে উঠে আসছিল।


এইবার আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাব দক্ষিণ ম্যানহাটনে ‘দ্য ক্রাইসিস’-এর দফতর থেকে ট্রেন ধরে দু বোয়া দিন শেষে ফিরে আসছেন হার্লেমে। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে পত্রিকা দফতর চালিয়ে সন্ধেবেলা এই রুট তিনি নেবেন প্রতিদিন, ২৫ বছর ধরে, ‘দ্য ক্রাইসিস’-এর সম্পাদক থাকাকালীন। তিনি আসছেন দ্য ডার্ক টাওয়ার বাড়িতে। সেখানে একটু আগেই পৌঁছে গিয়ে অ্যালেইন লক। এ’লেইলা ওয়াকারকে তাঁর পরের বই নিয়ে কথা বলছেন। ‘দ্য ক্রাইসিস’ পত্রিকা গোষ্ঠী আর ‘দ্য নিউ নিগ্রো’র লেখকরা তাঁদের নতুন লেখা পড়াচ্ছেন। হার্লেম রেনেসাঁসের অপ্রতিরোধ্য প্রতিভা, ল্যাংস্টন হিউজেস তাঁর স্মৃতিকথা ‘The Big Sea’-তে ডার্ক টাওয়ার নিয়ে অনেক কিছুই লিখে গেছেন। যা থেকে আমরা হারলেমের বুদ্ধিদীপ্তির ইতিহাস অনুসরণ করতে পারি। ল্যাংস্টন বলেছেন, এই সালোঁ এমন সব অতিথিতে ভরে যেত, যাঁদের নাম শুনলে উত্তর ইউরোপের বুদ্ধিজীবীরা ঈর্ষায় সবুজ হয়ে যেতেন। আর তাঁদের সহাবস্থান ছিল খুব চমকপ্রদ। এ’লেইলার এই বিরাট কক্ষে নৃতাত্ত্বিক গবেষক দু বোয়া দার্শনিক অ্যালেইন লকের সঙ্গে একত্র হতেন উত্তাল প্যাশানের জ্যাজ গায়ক-বাদকরা, দাপুটে গায়ক ও অধিকার আন্দোলনের বিপ্লবী শিল্পী সংগ্রামী পল রোবসন, মেবেল হ্যাম্পটনের মতো দুর্ধর্ষ নৃত্যশিল্পীরা। যারা মঞ্চ ও ক্যাবারে ক্লাবে আফ্রিকি ভঙ্গিমা থেকে নতুন নতুন নাচের জঁর তৈরি করছিলেন, যারা ছিলেন ক্যুইয়ার, নিজেদের জীবন নিয়ে অকুণ্ঠ আপসহীনতা, তাঁরা নিজেদের জীবন ও নাচের ভাষায় প্রকাশ করছিলেন। যেমন বলা হয়, হার্লেম ছিল যতখানি নিগ্রো, ততখানি গে। বলাই বাহুল্য ‘নিগ্রো’ নামটি তখন ফিরে দাবি করে নেওয়ার সময় ছিল। তার ইতিহাস স্মৃতির ঋদ্ধতায়, কথন ভঙ্গিমায়, শরীরী বিভঙ্গে, সভ্যতার ভিন্নতর অঙ্গীকারে। ছিলেন আজ সঙ্গে সঙ্গে যাকে হারলেমের অবিসংবাদী শিখা বলে ভাবা হয়, সেই জোরা নেইল হার্সটন। অবশ্য জোরাকেও বিস্মৃতি থেকে অনপনেয় শিখা হয়ে উঠতে দেখার জন্য আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।

আপাতত এই যে বসে আছেন এ’লেইলা বিরাট মহার্ঘ কাউচে, সাত মহলা দ্য ডার্ক টাওয়ারে, এতাবৎকাল আমরা তাতে একটু থতমত খেয়ে যাচ্ছি না? লেখাপড়া, জলপানি, বা মেডেল পুরস্কার অবধি ঠিক আছে। কিন্তু এতাবৎ– সেই রেনেসাঁস কাল থেকে– যে সালোঁনেয়ারদের আমরা দেখে এলাম, তা থেকে বুঝেছি তাঁদের সঙ্গে বৈভব আর বনেদিয়ানার ওতপ্রোত সম্পর্ক। এবার আমেরিকায় আফ্রিকি দাস উত্তরাধিকারের এক জন মহিলাকে (‘লেডি’ বললাম না উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে, ফারাক বুঝতে) বিশেষত সদ্য দাসপ্রথা উচ্ছেদ হওয়ার পরপরই কী করে সেই উচ্চতায় বসতে দেখা যায়? সেই সময়ের পত্রপত্রিকায় খবরের কাগজে বাড়িঘর আসবাব ফ্যাশান ও জীবনযাপনে অ্যা’লেইলার বল্গাছাড়া খরচের অভ্যেসের কথা জানা যায়।


এই রকম একটা ছবি আমরা পেলাম, কারণ, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ধনকুবের মাল্টি-মিলিয়নার মাদাম সি জে ওয়াকারের একমাত্র সন্তান অ্যা’লেইলা। মাদাম সি জে ওয়াকারের কাহিনি একটি সম্পূর্ণ রূপকথা। এই যখন বহু প্রতিক্ষার পরে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আফ্রিকি-আমেরিকিদের শুধু একটা জনগোষ্ঠী হিসেবে না দেখিয়ে আর পাঁচজন সাধারণ ও অসাধারণ আমেরিকানদের মতো দেখানোর একটা চল অবশেষে এসেছে, সেখানে মাদাম সি জে ওয়াকারের জীবন নিয়ে বায়োপিক ‘সেলফ মেড’। তিনি আমাদের হার্লেম গোষ্ঠীর ঠিক আগের প্রজন্মের মানুষ, যখন পরিবারে এক বা দু’ জন সবে মুক্ত মানুষ (free) হিসেবে জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু তখনও কোনও শিক্ষা অর্জন হয়নি, এমনকী বুনিয়াদি স্তরেও। ফলে কর্মসংস্থান নেই। কাজেই সংস্থানের জন্য অধিকাংশ মানুষকে করতে হচ্ছে ভাগচাষ অথবা একেবারে নিচুতলার কাজ। দু বোয়ার মা যেমন, তেমনই মাদাম সি জে ওয়াকারও ঘর মুছে, বাসন মেজে, কাপড় কেচে জীবন চালাতেন। এঁদের অনেকের মতোই মাদাম সি জে ওয়াকার ছোটবেলাতেই বাপ-মাকে হারান। বলাই বাহুল্য এঁদের রোগেরই কোনও চিকিৎসা ছিল না, আর চুল-ত্বকের যত্ন বা প্রসাধন তো কল্পনারই বাইরে। তাই মাদাম ওয়াকার আফ্রিকি মহিলাদের চুলের নানা রোগহর ক্রিম বানিয়ে বিক্রি করতে শুরু করলে, তা তৎক্ষণাৎ একটা নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে মাল্টি-মিলিওনেয়ার হলেন– এই পুঁজিবাদী বাক্যটি লিখে থেমে যেতেই পারি। কিন্তু যে আফ্রিকি শরীরের সাধারণ চিকিৎসারই ব্যবস্থা ছিল না, দাসপ্রথায় মানুষ বলে মর্যাদা দেওয়া হত না তাঁকে, সেখানে দাসপ্রথা উচ্ছেদের ঠিক পরে পরেই নিজেকে যত্ন করার অধিকার ও সৌন্দর্যবিধানের আনন্দ এক বিপুল ক্ষমতায়নের অধ্যায় নয়? সবে দাস প্রথা থেকে বেরিয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা নিজেদের শরীর, যত্ন ও প্রসাধন উপযোগী ভাবতে পারেন, এটা একটা বিরাট ক্ষমতায়নের ইতিহাস। কাজেই এরই ফলশ্রুতিতে ম্যাডাম ওয়াকারের ছোট হাতে হাতে বানানো ক্রিম ও জেল বিপুল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হলে, আমরা যদি একে শুধু পুঁজিপতি হিসেবে কালো মানুষের উত্থান হিসেবে পড়ি, এর মধ্যে দাস প্রথা শেষ হওয়ার পরেই সমাজ বদলের ইতিহাসকে দেখতে পাব। সাব-অলটার্ন তো আর একরকম করেই খালি কথা বলে না। এখানে বহু মানুষের নানা পদে কর্মসংস্থান হয়, নানা শহরে আমেরিকার উত্তরের স্টেটগুলিতে দোকান ও পার্লারের শাখা বিস্তার হয়ে পুরো আমেরিকাতে একটা অভূতপূর্ব দিগন্ত খুলে যায়। হাতে হাতে বানানো চুল ও ত্বকের রোগহর ক্রিম থেকে একেবারে বিপুল বিউটি প্রোডাক্ট ও কেয়ারের যে বিরাট নেটওয়ার্ক তৈরি হয়, তাঁকে নানা স্তরের নানা পদে নারী-পুরুষের কাজের সংস্থান হয়।


যখন ১৯১৬-১৯১৮-তে ম্যাডাম ওয়াকার ভিলা লেয়ারো তৈরি করেন। রকিফেলারের মতো আমেরিকার যে দুঁদে পুঁজিপতিরা পুরো মার্কিন অর্থনীতিকে অঙ্গুলি হেলনে চালাচ্ছিলেন, তাঁদের পাশে পরের জামাকাপড় ধোয়াপাকলা করে জীবন চালানো অনাথ কৃষ্ণাঙ্গ এক বালিকার বড় হয়ে ৩৪ খানা কামরাওয়ালা প্যালাডিয়ান স্টাইলের প্রাসাদের মালিক হওয়া ছিল একটা বিরাট স্পর্ধারই ব্যাপার। ইতিহাসে প্রথম রেজিস্টার্ড আফ্রো-আমেরিকি স্থপতি ভের্টনার উডসন ট্যান্ডি এই ভিলার ডিজাইন করেন। আর ম্যাডাম ওয়াকার তাঁর সাধের ভিলার নামকরণ করেন মেয়ের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে– Lewaro– A’Leila Walker Robinson। কর্নেল ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ আর্কিটেকচারের গ্র্যাজুয়েট ভের্টনারের অফিস ছিল ব্রডওয়েতে। ভিলা লেয়ারো আর নিউ ইয়র্ক সিটির এপিকোস্টাল চার্চ তাঁর দুই বিশেষ কাজ। শিল্পী স্থপতি ডিজাইনার, বাড়ি হোক বা বিজ্ঞাপন, বিপণন কৌশল– সব নিয়েই এঁদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ওয়াকারই শুরু করেন। এ’লাইলা তাকে পূর্ণ মাত্রায় সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির সালোঁ চক্রে পরিণত করেন।


হার্লেমে ১০৮-১১০ ওয়েস্ট ১৩৬ স্ট্রিট এই ঠিকানার দুটো টাউন হাউসকে কিনে এক সঙ্গে জুড়ে মাদাম ওয়াকার তৈরি করেন যে বাড়ি, সেখানে বেসমেন্টে ছিল বিউটি ট্রেনিং কলেজ, একতলায় পার্লার ও উপরে বাসস্থান। পরে এই দোতলাতেই শিল্প সাহিত্য ভিজুয়াল আর্টের সেরা আলোচনাচক্র গড়ে তুলবেন এ’লেইলা, হারলেমের টগবগে তরুণ কাউন্টি কালেন-এর (১৯০৩-১৯৪৬) কলামের নামে নাম হবে ‘দ্য ডার্ক টাওয়ার’।


অবশ্যই এ’লেইলা মায়ের লাডলী ছিলেন। আর পাড়ার লোকে যেরকমটা সুপারহিরো বাপমায়ের ছেলেমেয়েদের থেকে একই প্রত্যাশা করে থাকে আর ঠিক সেইটা হয় না, তেমনই এ’লেইলা ব্যবসায় দড় ছিলেন না। তাঁর মনও ছিল না। বরং তিনি শিল্পসাহিত্য-মননের মাঝখানে থাকতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। তাঁর উষ্ণ অভ্যর্থনাগুলিতে হার্লেম রেনেসাঁসের ব্যক্তিত্বদের কারও জন্য আপ্যায়নে কোনও কার্পণ্য থাকত না। হার্লেমের বৌদ্ধিকতার জন্য জায়গা, এইরকম দিলদার সাবলীলতা, সত্যিই হারলেমে বা সমগ্র আমেরিকাতে আর কোথায় পাওয়া যেত?
… পড়ুন চিন্তামহল-এর অন্যান্য লেখা …
পর্ব ১: চলতি পরিবার ধারণার বাইরের মেয়েদের বেঁচে থাকার জমকালো মঞ্চ প্যারির সালোঁ
পর্ব ২: এনসাইক্লোপিডিয়ার বিপুল কাজ জিন জুলির সালোঁতেই রমরম করে চলতে শুরু করেছিল
পর্ব ৩: মাদাম জারমেইনের বই-ই ইতিহাসে প্রথম, যার পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল শাসক
পর্ব ৪: মাতিস আর পিকাসোর ইগোর লড়াই
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved