Robbar

প্রেমেও ছিল কবিতার ক্লাস, শুরু হয়েছিল ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ দিয়ে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 25, 2025 4:38 pm
  • Updated:December 25, 2025 4:38 pm  

ছেলেটি বলেছিল, ভাস্করদা নাকি গঙ্গায় এপার-ওপার করতে পারতেন। ভাস্করদা বাইরে খানিক কথা বলে আবার ভিতরে ডুবে যেতেন। শুনছেন চুপচাপ, না আদৌ অন্য কোথাও আছেন কে জানে। আবার এই ভাস্কর চক্রবর্তীকে কবি বিশ্বজিৎ পন্ডার বাড়ি থেকে টানা দু’-ঘণ্টা টেলিফোনে শঙ্খবাবুর সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলে যেতে শুনেছে সে। অবাক হয়ে ভেবেছে, ওপারের ব্যস্ত মানুষটিও তো টানা দু’ ঘণ্টা উত্তর-প্রত্যুত্তরের মধ্যেই আছেন। ফোন তো নামিয়ে রাখছেন না!

সেবন্তী ঘোষ

‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ লিখলেই আদতে অর্থ দাঁড়ায়, সব চরিত্র সত্য। এখানে তাই সব চরিত্র সত্য বলেই শীতের গল্প শুরু হোক। আর সে গল্প একটা কবিতা বই ঘিরে। বলা যেতে পারে– এটি কবি ও কবিতার গল্প। কবির থেকে কি কবিতাকে আলাদা করা যায়? এ বিতর্কে মেয়েটির মতামত, মোটেই আলাদা করা যায় না। এই গল্প যেন কবিতার পিছনে পিছনে অনেক দূর অবধি একটা রাবার ব্যান্ড টেনে নিয়ে যাওয়া। যেখান থেকে ব্যান্ড সাবধানে না-ছাড়লে তা বুমেরাং হয়ে সূত্রধরকেই আহত করবে।

’৯০-এর শুরু। বছর পঁচিশের এক মেয়ে আর বছর তিরিশের একটি ছেলের গল্প, যা শুরু হয়েছে সবে। তারা ঠিক হাত ধরে ভেসে যাওয়া অনিশ্চিত স্বপ্নের মধ্যে নেই। শুরুতেই ঠিক হয়েছে এক বছর পর প্রথাগত সংসার হবে তাদের। তখনও কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা খানিকটা ঢিলেঢালা। চারপাশে হাতে এক-দু’-ঘণ্টা সময় নিয়ে চলা মানুষজন। ছেলেটির পক্ষে সুদূর এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে ট্যাক্সি নিয়ে নন্দন চত্বরে আসাটা বেশ মহার্ঘ্য ব্যাপার। ফলে দূরপাল্লার শাটল বাসের পাঁচ টাকাই ছিল দ্রুতগামিতার সহায়। না হয় ঢিমে তেতলার ৪৫ নম্বর বাস। কলকাতা শহরে মেয়েটির এক-দু’জন যে আত্মীয়-স্বজন নেই তা নয়, কিন্তু প্রেমিক ও হবু বরের সঙ্গে দেখা করার জন্য আত্মীয়বাড়ি বিশেষ সুবিধের বিষয় নয়। ফলে সে শান্তিনিকেতনের এক বন্ধুর সূত্রে তার দিদি, বোনের বাড়িতে এসে ওঠে, যেখান থেকে নন্দন চত্বর সদর্থেই হাঁটা পথ। বাড়ির প্রবেশপথের ফলকে প্রয়াত কর্তার নাম লেখা, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, এম. এ। শীতের সময়। বাড়ির বর্তমান কর্তা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের ছাদের ঘরের সামনে যে খোলা বারান্দা, সেখানে একটা বড় চাঁপা গাছ। বারান্দাটা ঘুরলেই দাদা কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অংশ। এঁদের পরিচয় এই সত্যি গল্পে মোটেও দেওয়া হবে না। বাঙালি আত্মবিস্তৃত জাত, কিন্তু এঁদের ভুলে গেলে তার দায় এই গল্পের কথক নিতে পারে না। মেয়েটি নেমে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নন্দন চত্বরের কাছে পৌঁছয়। বকবক করে যাওয়া ছেলেটির অজস্র বন্ধু-বান্ধব। কোথাও একটা বসে কবিতার কথাই শুরু করে ছেলেটি, কারণ তখনই সে কবি বলে খানিক আলোকিত। মেয়েটিও লেখে। তখনও কেন, কখনওই বলার মতো কিছু নয়।

জয়দেব বসু, সেবন্তী ঘোষ। কোলে পুত্রসন্তান। ছবিঋণ: সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

মণীন্দ্র গুপ্ত? নো! নাম শোনেনি মেয়েটি। মণিভূষণ আচার্য? নো! পার্থপ্রতিম, গৌতম চৌধুরী?

মেয়েটি যুগান্তর চক্রবর্তী, আহসান হাবিব, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, মল্লিকা ও সুতপা সেনগুপ্ত অবধি পড়ে এসেছে, কিন্তু এঁদের লেখা নয়।

এইবার প্রেম গেল চুলোয়। কবিতার ক্লাস চালু হল। শুরু হল ভাস্কর দিয়ে। কিন্তু দেখা দিল একটি বিপদ। যে বাড়িতে মেয়েটি আছে, সেখানে বলেছে– সে গবেষণার কাজে এখানে আছে। সত্যিই যে সে কাজ চলছিল না এমন নয়, কিন্তু যাঁর ওপর কাজ, সেই আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ি গড়িয়ায়। ফলে যাতায়াতের সুবিধা হবে বলে নন্দন, বাংলা একাডেমি চত্বরে কাছাকাছি থাকার কোনও যুক্তি নেই। রাত্তিরে সাড়ে আটটা, ন’টার মধ্যে সেই বিখ্যাত পণ্ডিত বাড়ির সবাই ঘরে ঢুকে যায়। সে একটি করে ভাস্করের পাতলা কবিতার বই নিয়ে রোজ বাড়ি ঢুকছে, এটা কেমনতর গবেষণার কাজ, প্রশ্ন উঠতেই পারে! দেবীপ্রসাদের বিদুষী ও অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী অলকা চট্টোপাধ্যায়ও আছেন। ফলে খেতে বসে হোক বা অন্য কোনও সময় পড়াশুনোর বিষয়ে কথা উঠলে, কী উত্তর দেবে মেয়েটি বুঝে পায় না। ছেলেটি প্রথমে বুঝতে পারেনি কার বাড়িতে মেয়েটি আছে। সে এগিয়ে দিতে আসে। তিনতলার ছাদ থেকে লোকায়ত দর্শনের গুরুগম্ভীর লেখক উঁকি দিয়ে দেখেছেন কেউ একটা পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে। ওই ছাদের চাঁপাগাছ-তলায় বসেছিলেন তিনি। মেয়েটির হাতে ব্রাউন পেপারে জড়ানো, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’। এতক্ষণ সেই পন্থাই নেওয়া হয়েছে, যাতে প্রচ্ছদ দেখে কবিতাবই বোঝা না যায়। তখন কি আর ছাই মেয়েটি জানত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বন্ধু সুবিখ্যাত দেবীবাবু ভাস্করের কবিতার বই দেখলে ভ্রূ-কুঞ্চনের বদলে খুশিই হতেন। কিন্তু প্রেমপর্বে স্বীকৃতি থাকলেও মনে বড় ঢাক ঢাক গুড় গুড় থাকে। এই উত্তেজনাটুকু না-থাকলে প্রেমে পড়ার কোনও মানেও নেই। ফলে একতলার ছাড়তে আসার দরজা আর তিনতলার মধ্যে কোনও যোগাযোগ তৈরি হয় না। তাছাড়া ফিরে এসে শান্তি নেই। এরপরের কাজ, যতই ঘুরে-ফিরে ক্লান্ত হোক না কেন, প্রতিটি কবিতা মন দিয়ে পড়ে নিতে হবে। পরদিন পড়া দিতে হবে তো আবার! পড়ায় পাশ করলে আবার ‘আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে’ পাওয়া যাবে। ফলে পাঠক বুঝতেই পারছেন এই গল্পটা আসলে ভাস্করের কবিতার গল্প। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা না-পড়লে কারওর কবিতা লিখতে আসাই উচিত নয়, এটাই কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে যাচ্ছে ছেলেটি। মেয়েটি এইবারে বলল, ওই বাড়িটি কার জানো? নাম শোনা মাত্র ছেলেটি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ। ঈষৎ তোতলামি সামলে বলল, আজ থেকে আমি আর ওই গলি পেরোব না। ওইটুকু অংশ তুমি চলে যাবে। আর তোমার সঙ্গে কথা হলে বলবে, আমি রাজনীতি করি। পার্টি। মেয়েটি শান্তশিষ্ট, ফলে অনুগতভাবে ঘাড় নাড়ে। সেদিন ফেরার সময় যথারীতি হাতে ভাস্কর, সামনে লোকায়ত। বললেন, ‘ছোকরা আজকে আর দিতে এল না?’

 

এই গল্পের এক বছর পরে এদের দু’জনের বিয়েতে ভাস্কর ও বাসবী এসেছেন। শঙ্খবাবুর বাড়িতে অজস্রবার অতীব সুদর্শন, শান্ত মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তাদের বাড়িতেও এসেছেন, সঙ্গে কবি অভীক বন্দোপাধ্যায়। তুমুল আড্ডা হয়েছে এমনটা মোটেই নয়। ভাস্করদা বাইরে খানিক কথা বলে আবার ভিতরে ডুবে যেতেন। শুনছেন চুপচাপ, না আদৌ অন্য কোথাও আছেন কে জানে। আবার এই ভাস্কর চক্রবর্তীকে কবি বিশ্বজিৎ পন্ডার বাড়ি থেকে টানা দু’-ঘণ্টা টেলিফোনে শঙ্খবাবুর সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলে যেতে শুনেছে সে। অবাক হয়ে ভেবেছে, ওপারের ব্যস্ত মানুষটিও তো টানা দু’-ঘণ্টা উত্তর-প্রত্যুত্তরের মধ্যেই আছেন। ফোন তো নামিয়ে রাখছেন না! মেয়েটি নিজেকে দর্শক, শ্রোতা ভাবতে ভালোবাসে। বলা ভালো, ‘অবজার্ভার’। ছেলেটি বলেছিল, ভাস্করদা নাকি গঙ্গায় এপার-ওপার করতে পারতেন। ততদিনে ভাস্করের কবিতা এমন পড়া হয়েছে যে, তাদের কবিতার বইগুলোতে ডবল ব্রাউন পেপারের মলাট দিতে হয়েছে।

ভাস্কর চক্রবর্তী। ছবি: সন্দীপ কুমার

শীতকাল বলতে মানুষ শীতের প্রতীক্ষার কথাই বোঝায়। শীতের মধ্যে জুবুথুবু, হাবুডুবু খাওয়া অবস্থাটা দুরন্ত, দৌড়ের মানুষেরা উপভোগ করে না। করে অলস, হেলাঢেলার সময় উড়িয়ে দেওয়া কবিরা। ওই যে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে লবটুলিয়া বৈহারের অরণ্যের নির্জনতায় রাজু পাঁড়ে নামে এক কবি-স্বভাবের মানুষের কথা লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ। অল্প একটু জঙ্গল পরিষ্কার করে আর অরণ্য-মধ্যে সেই জমি তৈরির ফাঁকে নিঃসীম একাকী জীবনে পুঁথি পড়ে কাটায়। এই কবি-স্বভাব তাকে মানুষের স্পর্শ থেকে দূরেও রেখেও সজীব প্রাণময় রাখে।

এক কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে কবি অরুণ মিত্র, ভাস্কর চক্রবর্তী, মৃণাল দত্ত, অভী সেনগুপ্ত। ছবিঋণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়

কেউ কেউ ১৯৭১-এর শেষের দিকে প্রকাশিত ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ এই বইটির কবিতার একটা সমাজ-সম্পৃক্ত দিকও খুঁজে পেয়েছেন। সে সময় পার্শ্ববর্তী দেশটিতে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। আবার মনে হয় যে, বরানগর এলাকার বাসিন্দা কবি নকশাল আন্দোলনের তীব্রতা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে তিনি কি কোনও রসদ পাচ্ছেন না? ওই ‘ব্যাঙের রক্ত’, ‘বাজি পোড়ানো’, ‘হৈ হল্লা’ ভাস্করের মতো নির্জনতা-প্রিয় কবিকে উত্যক্ত করছে না? হতেও তো পারে শীতের অপেক্ষায় আছেন, যাতে এই হাইবারনেশনে তিনমাস রক্ত হত্যা শব্দবাণ থেকে মুক্তি পেতে পারেন কিছুটা? যে কোনও হননের বিরুদ্ধে একজন স্পর্শকাতর কবি-মনের যে নিরুচ্চার প্রতিবাদ থাকে, অপেক্ষা থাকে যুদ্ধ-বিভীষিকা সমাপ্তির, তাই যেন লেপটে আছে এই কবিতা শরীরে।

কবিতার অন্দর খুঁচিয়ে তা থেকে শব্দ অর্থ আলাদা করার কাজে মোটেই রাজি নয় কথক মেয়েটি। বিশেষ করে সে যখন কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। যুক্তিহীনতার অনর্থকতায় যে আসন্ন শীতের নিপুণ সোয়েটার বুনে দিচ্ছেন ভাস্কর, তার ডিজাইন কপি নয়, তার উষ্ণতাই তার কাম্য।

‘শীতের আলোয়, আবার আমি ফিরে এসেছি আজ তোমার ঘরে
তোমাদের বিড়াল– দেখি, আগের মতো
ততোটা ক্ষিপ্র নয় আর– তোমার পশমের বল
দেখি, গড়িয়ে চলেছে’

তারপর অনেক দিন পর ছেলেটি রীতিমতো লোক হয়ে উঠেছে যখন, সরকারি তরফে একটি কবিতা উৎসবের সম্পাদনার দায়িত্ব তার ওপর বর্তেছে, তার দলবল সিনিয়র কবিদের আমন্ত্রণ জানাতে তাঁদের বাড়িতে হাজির হত। চিঠিচাপাটির থেকেও মুখোমুখি গিয়ে আমন্ত্রণ জানানোর রীতি শুরু হল। মেয়েটি অবশ্যই তার কবি-বন্ধুদের দলের মধ্যে নেই। কিন্তু দু’জনের বাড়িতে সে যেতে চাইল। এক মণীন্দ্র গুপ্ত, আরেক ভাস্কর চক্রবর্তী। এসব কবেকার যে ঘটনা! কিন্তু যেহেতু এটি সত্য গল্প, তাই মেয়েটির চোখের সামনে এখনও ঘটনাহীন ওই দুটো দিন ঘটনাবহুল দিনের চেয়েও অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে ভেসে থাকে।

যেভাবে কিছুদিন হাঁটার পর কোনও কোনও পথ দু’-পাশে চলে যায়, ছেলেটি ও মেয়েটির পথ সেভাবেই বিপরীত দিকে চলে গিয়েছিল। কিছু কিছু বই ভাগ হল। ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ কিন্তু উষ্ণতম শহর কলকাতায় থেকে গেল। উত্তরবঙ্গের কড়া শীত না চাইতেই বড় গায়ে-পড়া বলেই বোধহয় তার আর শীতকাল চাওয়া হল না।

………………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন সেবন্তী ঘোষ-এর অন্যান্য লেখা

………………………..