
১৯৮৮-র জুন মাসের ২ তারিখে রাজ কাপুরের প্রয়াণের সংবাদ খবরের কাগজে পাঠের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যা লিখিত। ১৯৫৩-তে পরিচালক বিমল রায়ের আহ্বানে ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির সুরকার হিসাবে সলিলের প্রথমবার প্রবেশ বোম্বের বাণিজ্যিক সিনেমা জগতে। এবং তারপরেই ইন্ডাস্ট্রিতে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত পরিচালক-নায়ক রাজ কাপুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সূত্রপাত দু’জনের ‘কমনফ্রেন্ড’ পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জির মাধ্যমে। হৃদ্যতা আরও গাঢ় হয়ে ওঠে ওই ’৫৩-র শেষদিকেই, যখন বোম্বে ফিল্ম মহলের একদল শিল্পী-কলাকুশলী ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হিসাবে রাশিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন।
৫.
১৯৪৩-এর নোটবুকটি ছাড়াও সলিল চৌধুরীর একটি ডায়েরিরও সন্ধান দিয়েছেন তাঁর পরিবার। প্রায় জীবনসায়াহ্নে ১৯৮৮ নাগাদ এই দিনলিপি লিপিবদ্ধ করায় খানিক মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন সলিল। যদিও নিয়মিত অভ্যাসে নয়, বিক্ষিপ্ত ভাবনাচিন্তার সূত্রে, মাঝেমধ্যে। অবশ্য যে মুহূর্তে কোনও বিশেষ বিষয়ে দু’-চার লাইন লেখার ইচ্ছা জেগেছে, ডায়েরিতে সেই তারিখের জন্য ধার্য নির্দিষ্ট পৃষ্ঠাতেই তা ব্যক্ত করেছেন। ফলে বেশ কিছু অংশ শূন্যও থেকে গিয়েছে।


যেমন নজর পড়ে, পর পর দু’টি পৃষ্ঠায়। ১৯৮৮-র জুন মাসের ২ তারিখে রাজ কাপুরের প্রয়াণের সংবাদ খবরের কাগজে পাঠের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যা লিখিত। ১৯৫৩-তে পরিচালক বিমল রায়ের আহ্বানে ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির সুরকার হিসাবে সলিলের প্রথমবার প্রবেশ বোম্বের বাণিজ্যিক সিনেমা জগতে। এবং তারপরেই ইন্ডাস্ট্রিতে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত পরিচালক-নায়ক রাজ কাপুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সূত্রপাত দু’জনের ‘কমনফ্রেন্ড’ পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জির মাধ্যমে। হৃদ্যতা আরও গাঢ় হয়ে ওঠে ওই ’৫৩-র শেষদিকেই, যখন বোম্বে ফিল্ম মহলের একদল শিল্পী-কলাকুশলী ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হিসাবে রাশিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন। উপলক্ষ– সেখানে ভারতীয় চলচ্চিত্রের উৎসব। ততদিনে ‘আওয়ারা’ ছবির সূত্রে রুশদেশে রাজ কাপুর এক বিশিষ্ট নাম। সে যাই হোক, প্রায় দেড় মাস ধরে বান্ধববর্গের সঙ্গে বিদেশে একসঙ্গে কাটানো, চেরকাশভ বা পুডফকিনের মতো রাশিয়ান সিনেমা ব্যক্তিত্বদের সাহচর্যের স্মৃতি যে অমলিন ছিল আজীবন, সলিলের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তার দৃষ্টান্ত মেলে। এমনকী, আজারবাইজানের রাজধানী শহর বাকু-র রাতের রাজপথে কাউকে না জানিয়ে রাজ-হৃষী-সলিল ত্রয়ীর বেরিয়ে পড়া, আর পুলিশের চোখে এই রাষ্ট্রীয় অতিথিদের প্রায় নিরুদ্দিষ্ট হিসাবে চিহ্নিত হয়ে ‘তোলপাড়’ ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা বুঝিয়ে দেয়– বেহিসাবী অ্যাডভেঞ্চারিস্ট হয়ে ওঠাও আদপে সৃজনসত্তার অভিমুখকে সজীব রাখারই কোনও অনুশীলন।

রাজ-সলিলের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের আর এক অধ্যায় ১৯৫৬-তে তৈরি দ্বিভাষিক ছবি– হিন্দিতে ‘জাগতে রহো’, বাংলায় ‘এক দিন রাত্রে’। যে ছবির পরিচালকদ্বয় অমিত মৈত্র ও শম্ভু মিত্র, এবং নির্মাতা ও প্রধান অভিনেতা রাজ কাপুর স্বয়ং। সঙ্গীতায়োজনে সলিল চৌধুরী। সেই কাজের সূত্রে প্রায় বছর দেড়েক আর. কে. স্টুডিও-তে দু’জনের দৈনন্দিন সাক্ষাৎ-আলোচনা-কাজকর্মের ব্যস্ততা। রাজ কাপুরের বিভিন্ন সিনেমায় গানের ব্যবহার তো বহুলচর্চিত। শোনা যায়, গানে সুর-সংযোজন বা রেকর্ডিং ইত্যাদি বিষয়ে রাজ কাপুর বহুক্ষেত্রেই রীতিমতো হস্তক্ষেপ করতেন। কিন্তু ‘জাগতে রহো’ ছিল ব্যতিক্রমী, সংগীতকার পেয়েছিলেন কাজের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। আর শ্রোতারাও পেয়ে গেলেন লতাকণ্ঠের কালজয়ী ‘জাগো মোহন পেয়ারে’-কে! কোনও সৃজন দশকের পর দশক ডিঙিয়ে প্রজন্মান্তরে যখন জিইয়ে থাকে, তার গড়ে ওঠার পেছনের ছোটখাটো ইতিহাসগুলো ক্রমশ অনুক্তই থেকে যায়। ডায়েরির পৃষ্ঠায় একান্ত স্বীকারোক্তিগুলোই তখন হয়ে ওঠে ভুলে যাওয়া সেই অতীতকে ছোঁয়ার কিছু খড়কুটো।
রাজ কাপুর প্রসঙ্গে সলিলের স্মৃতিচারণার শেষাংশটুকু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিপণনে ‘Box-office’ স্বীকৃত তথাকথিত ‘মালমশলা’ ব্যতীত একটি ‘Personal film’ বানানোর ইচ্ছাপ্রকাশ। যেখানে আর্থিক লাভ-লোকসানের ঊর্ধ্বে নিজের কথাগুলো বলার দ্বিধাহীন স্বাধীনতা থাকবে। দুর্ভাগ্য ভারতীয় সিনেমা দুনিয়ার, দুর্ভাগ্য আমাদেরও– সে চলচ্চিত্র শেষ অবধি বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, সলিলেরই ভাষায়– ‘…বড়ো মাপের মানুষদের ওপর তথাকথিত প্রত্যাশার বাইরের চাপ এত পড়ে যে নিজের identity হারিয়ে যেতে চায়…’।
………………..
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: অন্তরা চৌধুরী, শুভঙ্কর দে
………………..
ডায়েরির ৯টি পাতা, পড়ুন এক ক্লিকে
প্রথম পর্ব সলিল চৌধুরী নোটবইয়ে এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্কেচ
দ্বিতীয় পর্ব জাপানি খাতায় লিখতে গিয়ে সলিল চৌধুরীর প্রথম মনে পড়েছিল জাপানি বোমার কথা
তৃতীয় পর্ব ফ্যাসিজম কাব্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে, ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন সলিল
চতুর্থ পর্ব সাম্যই প্রকৃতির অন্তরের কথা, এই বিশ্বাস সলিল চৌধুরীর ডায়েরির পাতায় পাতায়
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved