নিজের শহর কে না ভালোবাসে? তবু সময়ের ঘূর্ণিতে চরিত্র বদলও কি হয় না শহরের, দেশের? গতি বাড়ছে, প্রযুক্তির পাল্লায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছি আমরাও। ‘দশে মিলি করি’-র কালেক্টিভি সমাজ কোথায় এখন? ইনডিভিজুয়ালিস্টিক সমাজের মানুষ কারও ওপর নির্ভর করার জন্য বসে নেই আজ। তবুও কোথাও যেন হারিয়ে যাওয়া শহরটাকে, আবার খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে। বসতে ইচ্ছে করে, চায়ের দোকানের আড্ডায়।
অনেক দিন আগের কথা। এক ইউরোপিয়ান সাহেব এসেছেন কলকাতায়। সামান্য আলাপন, জিজ্ঞেস করেছিলাম, কলকাতার কতটুকু ভাল লাগল তাঁর, কেনই বা ভাল লাগল?
সাহেব আগেও এসেছেন কলকাতায়, সেবার ‘হিচহাইকিং’ করেছেন। বললেন, ‘দ্যাখো, তোমার শহরে আর কিছু না থাক, প্রাণ আছে! আমি তো ঘুরে বেড়াই, খুঁজি! পথঘাট, দোকানপাট, সর্বত্রই মানুষ খুঁজি। তো, তোমার শহরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি। বালিগঞ্জ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখলাম, একজন মানুষ দুটো প্ল্যাটফর্মের মাঝের রেললাইন পার হয়ে এপারে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, অমনি কেউ না কেউ, দিব্যি হাত বাড়িয়ে তুলে নিচ্ছেন তাঁকে। এঁরা অনেকেই পরস্পরের পরিচিত নন, তবুও, বারবার এমন হচ্ছে। বহুসময় দেখেছি আমি। এ বড় আশ্চর্য, তোমার শহরে অভাব অনটন অনেক, কিন্তু মনটা দরিদ্র নয়!
২৫-৩০ বছর আগে এটা শুনে বুকটা চওড়া হলেও, আজকের দিনে নিজের শহরকে নিয়ে, এমন ভাবতে একটু সংশয় তো আসছেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বালিগঞ্জ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখলাম, একজন মানুষ দুটো প্ল্যাটফর্মের মাঝের রেললাইন পার হয়ে এপারে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, অমনি কেউ না কেউ, দিব্যি হাত বাড়িয়ে তুলে নিচ্ছেন তাঁকে। এঁরা অনেকেই পরস্পরের পরিচিত নন, তবুও, বারবার এমন হচ্ছে। বহুসময় দেখেছি আমি। এ বড় আশ্চর্য, তোমার শহরে অভাব অনটন অনেক, কিন্তু মনটা দরিদ্র নয়!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নিজের শহর কে না ভালোবাসে? তবু সময়ের ঘূর্ণিতে চরিত্র বদলও কি হয় না শহরের, দেশের? গতি বাড়ছে, প্রযুক্তির পাল্লায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছি আমরাও। ‘দশে মিলি করি’-র কালেক্টিভ সমাজ কোথায় এখন? ইনডিভিজুয়ালিস্টিক সমাজের মানুষ কারও ওপর নির্ভর করার জন্য বসে নেই আজ। তবুও কোথাও যেন হারিয়ে যাওয়া শহরটাকে, আবার খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে। বসতে ইচ্ছে করে, চায়ের দোকানের আড্ডায়।
আজকাল কোনও পাড়া নেই কোথাও। তার জায়গা নিয়েছে ভার্টিকাল পাড়া, দশতলা, বিশতলা বিল্ডিং। ফ্ল্যাট-কমপ্লেক্সের নামেই তো কমপ্লিকেটেড একটা গন্ধ যেন! এখানে কারও বন্ধু হয়? কে জানে? নিজস্ব খুপরির জগতে, কলকাতা এখন পৃথিবীর আর পাঁচটা শহরের মতোই। কেউ কারও খোঁজ রাখে না, কারও কাউকে প্রয়োজনও হয় না। রাস্তায় কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, তার সঙ্গে হাসপাতাল যাওয়ার লোক মেলে না। কলকাতার লোক কি বড্ডই স্বার্থপর হয়ে পড়েছে? কোভিড অতিমারীর সময়, এর কিছু আঁচ বোধহয় পেয়েছি আমরা সবাই। সে না হয় হল, কিন্তু বিপর্যয়ের পরেও কি শিখলাম কিছু, তা থেকে? বোধহয় না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ব্রাজিলীয় ফুটবলের সঙ্গে নাড়ির যোগ যদি কারও থাকে, তা মারিও জাগালোর
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কলকাতার মন বলতে, আজ আর তাই নতুন কিছুই বলার জায়গাই নেই হয়তো! নিরাসক্ত কিছু মানুষ এখানে নিরাপদ দূরত্বে মজা দেখে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় চ্যাটে ব্যস্ত সবাই। কেউ অসুস্থ হয়েছে, খবর পেলে আর ছুটে যায় না, বরং হোয়াটস অ্যাপে ‘প্রে’ করে। মৃত্যুসংবাদ পেলে ‘রিপ’ বলে, দায় সারে।
যে শহরের বৈশিষ্ট্য ছিল, অন্যের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর, সে কলকাতা আর নেই। শুনতে খারাপ লাগলেও, নেই! এ শহরে বিসর্জনের বাজনায় হার্টের রোগী, বয়স্ক মানুষ, ছোটদের লেখাপড়া, কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না– কে জানে, আর পাঁচটা বড় শহরে কী হচ্ছে!
কলকাতা, তোমাকে নিয়ে খারাপ কথা লিখতে ভালো লাগে না আমারও। লিখতে লিখতেই মনে পড়ে গেল, আমার এক বন্ধুর কথা। জন্মসূত্রে সে দক্ষিণী, তার স্ত্রী অবশ্য বঙ্গললনা! দু’জনেই ছানাপোনা নিয়ে মনেপ্রাণে কলকাত্তাইয়া। খবর পেলাম, ওদের বাড়ির সামনের দেওয়ালে, এই শীতেই ওরা একটা শীতের পোশাক রেখে যাওয়ার জায়গা করেছে। যে-কেউ সেখানে পোশাক রেখে যেতে পারে, যে-কেউ প্রয়োজনে নিতেই পারে সেসব পোশাক। ছোটদের গরম জামা, বুড়ো মানুষের গায়ের চাদরের ওম্! আশ্চর্যের কথা হল, কোনও পোশাক চুরি হয়নি, কেউ জড়ো করে বদলে বাসন কেনেনি, রোজ-ই কেউ না কেউ দিয়েই চলেছেন!
এই তো আমার শহর!
তবে তো পুরোপুরি হারায়নি তার মন!
এই তো সে-শহর, যেখানে ফুটপাথের পাইস হোটেল থেকে পাঁচতারা, সবই আছে, সবাই টিকে থাকবে, সবাই বাঁচবে বলেই তো এ শহর!
আসলে বাইরের বদলটা এত দ্রুত হয়েছে যে, ভিতরের মনটা সেই কপি-পেস্টের দুনিয়ায় লুকিয়েই পড়লেও পুরোপুরি হারায়নি বোধহয়!
দেখানেপনার আলাপচারিতায় নয়, কলকাতার মন এই ভিতরটাকেই ছুঁয়ে থাক না!