‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’-র পরিকল্পনা থেকেই বিদ্রোহের আঁচ টের পাওয়া যায়। কালো একটা প্যাঁচা উড়ে যাচ্ছে কলকাতা শহরের ওপর দিয়ে। তার চোখ দিয়ে দেখা যাচ্ছে পথঘাট, পরব-পার্বণ, ঘরবাড়ি, জোট-জটলা। অর্থাৎ, মানুষ। সত্যিই এ বইয়ের পাতায় পাতায় কত মানুষ, কত ধরনের মানুষ। তাদের কীর্তিকলাপ, হইহুল্লোড়, হাঁকডাক, গুজব-কেচ্ছা, খানাপিনা, গানবাজনা, ঝগড়া-কাজিয়া, লোভ-লালসা– সবই অনুপুঙ্খে চলচ্চিত্রের চেয়েও ঢের নৈপুণ্যে ধরা আছে কৃশ বইটিতে। এর পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় তাক লাগানো বহুস্বর, প্রতিবেদনে উৎসবের আড়ালে-আবডালে উঠে আসে রাস্তার লোকের হল্লাবাজি, যেন কার্নিভালের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ফোয়ারা। সঙ সেজে বড়মানুষদের মুখ ভেংচানি আর প্রান্তিকের রগড়। উনিশ শতকী সাহেবভজা বাবুয়ানি আর কোঁচার পত্তন-কেন্দ্রিক ‘ভদ্র’ সাহিত্যকে এ বই নস্যাৎ করে। অন্য ভুবনের খোঁজ দেয়। ১৮৬১ সালে এর আবির্ভাব, যে বছর জন্মাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। মিখাইল বাখতিন জন্মাবেন প্রায় ৩৪ বছর পরে।
বিদ্রোহ আর প্রতিরোধ দিয়ে তৈরি হুতোমের নকশা। কথায়-কথায়, প্রচলিত বড়মানুষের সংস্কৃতি আর ক্ষমতার বিশাল বপুকে চোখ মট্কে থুতু দেওয়া। উত্যক্ত করা। ঠাট্টা-তামাশায় নাজেহাল করে দেওয়া, যা কিছু অভিজাত। কোম্পানির বদান্যতায় চকচকে।
বিদ্রোহ বিষয়ে, বিদ্রোহ আঙ্গিকে, বিদ্রোহ ভাষা প্রয়োগে। ইংরেজি শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা’ প্রযোজিত ‘সাধু’ ভাষার সংস্কৃত চাল নয়, হুতোম আনলেন কলকাতার ‘কক্নি’। ক্রিয়াপদে চলিত। উনিশ শতকের মহামহিমরা তো বটেই, এমনকী, রবীন্দ্রনাথ চলিত ভাষায় প্রথম গল্প লিখলেন ১৯১৪ সালের ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায়। হুতোমের ভাষা কলকাত্তাই জনবৃত্তের ভাষা। সে বুলিতে ধুলোর গন্ধ, দেশি মদের ঝাঁজ। পায়ে কাদা, মনে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি রাগ। বিষয়ে তাই ঘুরে-ফিরে আসে ওপরমহলের প্রতি তির্যক অস্ত্রাঘাত। বাবু-মোসাহেব-বাইজি-ফুর্তির বিরোধিতা, ধর্মব্যবস্থা তথা ধর্মব্যবসার অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে হাসাহাসি আর শেষ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি চোরাগোপ্তা আক্রমণ। ক্ষমতাকে হুতোম আগাগোড়া ‘ড্যামেজ’ করে গিয়েছেন। এত সাহস, এমন বুকের পাটা সে সময় কেউ দেখানোর চেষ্টা করেননি। হুতোমকে নিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ততার একটা অস্বস্তি আছে। মান্য সাহিত্যের ইতিহাসে, বিবেচনা-পুনর্বিবেচনার ইউরোকেন্দ্রিক উচ্চবর্গী নজরে ‘হুতোম’ চলে গিয়েছেন অবহেলার প্রান্তে। দৃশ্যমান থাকলেও, ঔদাস্যে প্রায় নিরাকার।
হুতোম কি সেকথা আন্দাজ করেছিলেন? ‘ভূমিকা উপলক্ষে একটা কথা’ অংশে একটি বাক্য ক্ষমতার বুক ভেদ করে যায়। ‘… নীলদর্পণের হাঙ্গামা দেখেশুনে– ভয়ানক জানোয়ারদের মুখের কাছে ভরসা বেঁধে আরসি ধত্তে সাহস হয় না…’। কাদের জানোয়ার বলছেন হুতোম? কোনও সন্দেহ নেই, কোম্পানি, কোম্পানির বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, তৎকালীন বাবুসমাজ– প্রত্যেকেই তাঁর লক্ষ্য। রণজিৎ গুহ তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘Neel-Darpan: The image of a peasant revolt in a liberal Mirror’-এ দেখিয়েছেন, দীনবন্ধু মিত্র তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘নীলদর্পণ’ নাটকের গভীরে কীভাবে আর কেন কোম্পানি-শাসন, ভিক্টোরিয়ার হস্তক্ষেপ, তথা ব্রিটিশ কর্তৃত্বের প্রতি নতজানু আনুগত্য দেখিয়েছেন। হুতোম কিন্তু নাটক নিয়ে কথা বলেননি, ক্ষমতাকে বেপরোয়া আক্রমণ করেছেন। এই ছদ্মনামীকে গ্রেপ্তার করা কঠিন ছিল বলেই কি এ বই বেঁচে যায়?
অন্যদিকে, ‘মিউটীনি’ ‘প্রতাপচাঁদ’– এইসব ইতিহাস নির্ভর প্রতিবেদনে তিনি ধরে রাখলেন স্থানিক উচ্চবর্গের কিস্সা-দাস্তান। স্বদেশ নিয়ে ভাবালুতা নয়, স্বদেশ সমাজের স্তরগুলির অস্তিত্ব এবং পারস্পরিক টানাপোড়েনের আনাচকানাচ ধরা পড়ল তাঁর কলমে। ধরা রইল, কলকাতা শহরের শুধু সে যুগের বিবরণ নয়, তথ্যনিষ্ঠতার নিগুণ প্রয়োগে ঢুকে গেল তার শব্দ, গন্ধ, স্বাদ এবং স্পর্শের অনুভব। এই পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে গড়ে তোলা উনিশ শতকের শেষার্ধ্বের কলকাতা পুনর্বার নির্মাণ করা দুষ্কর নয়। জেমস জয়েসের লন্ডন অনুপুঙ্খতা উনিশ শতকের গোড়ায়। জন্ম ১৮৮২।
হুতোম প্রকৃতপক্ষে স্থানিক ঐতিহাসিক নন, তিনি সাংস্কৃতিক সামাজিক ইতিহাসের চলমান চিত্রমালা পরিবেশক। প্রযোজকও। ঘটমানতার ছোট ছোট পরিসর দিয়ে তিনি বহুস্বর এবং বহুশরিকের কালের যাত্রা মঞ্চায়িত করেন। এ কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘পাদ্রি লং ও নীলদর্পণ’-এ বহুস্বর এবং বহুশরিকের কালের যাত্রা মঞ্চায়িত করেন। এ কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘পাদ্রি লং ও নীলদর্পণ’-এ তিনি মুখের আগল আর রাখলেন না। ‘শেষে ওই দলের একটা বড় হাঙ্গেরিয়ান হাউন্ড পাদ্রী লং সাহেবকে কামড়ে দিলে।’ ওই বয়ানেই আছে ‘মফস্বলের জেলে আর নিরপরাধীর জায়গা হয় না…’ শাসনতন্ত্রের এত তীক্ষ্ণ বিনির্মাণ, এত নিরীহ মুখে অসিচালনা বাংলাসাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পাশাপাশি, ঢাকের বেলা থেকে ঘোড়ার গাড়ির নানা আকারপ্রকার, তৎকালীন সংগীত বা হুড়া সবই সযত্নে ঢুকিয়ে আনেন বিবরণে। আনেন গুজব, কেচ্ছা, হুজুগ কিংবা তৎকালীন দৈনন্দিনে প্রভাব ফেলে আপাততুচ্ছ অভিজ্ঞতার সাতকাহন।
মনে রাখতে হবে, বাংলা গদ্যচর্চার সেই প্রস্তুতি পর্বে, হুতোম অনায়াসে দীর্ঘবাক্য নিয়ে বাঘে-বখরিতে খেলার মতো অনায়াস মসৃণতা অর্জন করেছেন। এত সাবলীল, চতুর, বহুস্তরিক, দৃশ্য-শ্রাব্য উপাদানে ভরপুর বাংলা গদ্য বিশ শতকেও খুব কমই দেখা গিয়েছে। তাঁর মুনশিয়ানার দস্তরই আলাদা। ‘সময় কারুরই হাত-ধরা নয়– নদীর স্রোতের মতো, বেশ্যার যৌবনের মতো ও জীবের পরমায়ুর মতো, কারুরই অপেক্ষা করে না। গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে দশটা বেজে গেলো, সোঁ সোঁ করে একটা বড় ঝড় উঠলো, রাস্তার ধুলো উড়ে যেন অন্ধকার আরও বাড়িয়ে দিলে– মেঘের কড়মড় কড়মড় ডাক ও বিদ্যুতের চমকানিতে ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা মায়ের কোলে কুনডুলী পাকাতে আরম্ভ কল্লে– মুষলের ধারে ভারী এক পসলা বৃষ্টি এলো।’ (কলকাতার বারোইয়ারি-পূজা) বাক্যে নিহিত দার্শনিকতার দেশি উপমা আর ধ্বনিসুষমার কোনও জবাব নেই।
হুতোম আঙ্গিকেও নিজস্ব ধারা নির্মাণ করেছেন। সে যেন এক বৈচিত্রময় সম্মিলনের ক্ষেত্র। সাংবাদিকের প্রতিবেদনে মিশে গিয়েছে ইতিহাসের রোদছায়া, কখনও আত্মজীবনীর রংরশ্মি, কখনও কাহিনির আলাপ-ঝালা, কখনও নাট্যাংশের মায়াকাজল। একটু আশ্চর্যই লাগে বহুমাত্রিক এই রচনা নিয়ে কোথাও কোনও উদ্যাপন তো হয়নি বটেই, একে কেউ যেন আমল দিতেই রাজি নন। অথচ, বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে বারবার বোঝা যাবে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে এ বই এবং হুতোম তার ডানার দীর্ঘছায়া ফেলে যাচ্ছেন নানা মুহূর্তে।
এ বইয়ে একটি সন্দর্ভ আছে– ‘ভূত-নাবানো’। এক বুজরুক রোজা কীভাবে ডাক্তারি পড়া ছাত্রদের হাতে নাকাল হল, তার সরস বর্ণনা। এই লেখাটিকে আমি পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পের পূর্বসূরি বা উৎস হিসেবে উল্লেখ করতে চাই। অন্যদিকে রাতে উড়ন্ত পেঁচা, সমকালিক শহর, সমকালিক রাজনীতি, নিম্নবর্গের উল্লাস আর শোভাযাত্রা থেকেই কি নবারুণ ভট্টাচার্য-র ফ্যাতাড়ুরা প্রাণ পায়নি? ‘কাঙাল মালসাট’-এর পাতায় পাতায় দণ্ডবায়সের উক্তি-প্রতুক্তি কি হুতোমেরই উত্তরাধিকার নয়? এখানে যদি আমার অনুমানের সামান্য কয়েক শতাংশ মিশেল থাকে, আারেকটি ক্ষেত্রে একেবারেই নেই। বিনয় ঘোষের বিখ্যাত বইয়ের দিকে তাকান। ‘কালপেঁচার কড়চা’। হুতোমদাস মুচকি হাসছেন। উৎপল দত্ত ‘টিনের তলোয়ার’ লিখতে পারতেন, হুতোম যদি না মেলতেন ডানা? হুতোম এখানেই জিতে গিয়েছেন। ধূলি ধূসরিত পণ্ডিতি বই হয়ে আলমারির কোণে পড়ে থাকেননি, কোনও অধ্যাপকের নির্জীব থিসিসের সার্থকতায় ধন্য হবেন বলে। এক সজীব উৎস তিনি নিজেকে চারিয়ে দিয়েছেন শেকড়ে-শেকড়ে, মৃত্তিকার পুনর্নব বিস্তারে।
আমরা মুখে যাই বলি না কেন, কার্যক্ষেত্রে কর্তার ভূতের খপ্পরে দিন গুজরান করি। নইলে, এতদূর ‘রাজনৈতিক’, এতদূর ক্ষমতা-বিরোধী একটি গ্রন্থ নিয়ে নীরবতা পালন করি কেন? সাহেবের কোনও সার্টিফিকেট হুতোম জোটাতে পারেননি বলে? ধর্মব্যবসা এবং ধর্মকেন্দ্রিক বুজরুকি নিয়ে হুতোমের একের পর এক থাপ্পড় আজও প্রাসঙ্গিক। এই ভারতে এখন ধর্মান্ধতা আর সনাতনের নামে মানুষ ঠকানোর, হত্যা-ধর্ষণের নরকদ্বার খুলে গিয়েছে। ভয় হয়, হুতোম কোনও রাজরোষে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে না তো?
হুতোমের নক্শা আমাদের এই জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। সময় এগোলেও, হুতোমের দৃষ্টিভঙ্গি আজকের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। যে নির্বোধ, হিন্দুত্ববাদী নৃশংসতা দেশের শ্বাসরোধ করে রেখেছে, মণিপুর হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশে যার চিহ্ন, যার ক্ষত আজ শত ধৌতের কোনও শুশ্রূষা পাচ্ছে না, সেখানে, সে যুগে হুতোম আবার উড়তে পারেন আকাশে। মানুষের হাতে হাতে ওড়ো তুমি নিশানের মতো….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved