একদিকে যখন জলের রূপোলি শস্য ইলিশের রেসিপি নিয়ে ইলিশ উৎসব হচ্ছে ঠিক তখনই অন্যদিকে তাকে টেক্কা দিচ্ছে কাড়াহান ছাতু বা দুগ্গা ছাতুর বিভিন্ন রেসিপি। শুধু রেসিপি নয় দামেও এই ছাতু ইলিশের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী– ১২০০ টাকা কেজি দরের ছাতু ছোঁ মেরে ভোজনরসিকরা তুলে নেয়। সেপ্টেম্বরের তীব্র রোদ আর ঝমঝমে বৃষ্টির সঙ্গমেই এই ছাতুর জন্মলগ্ন।
‘আশ্বিনা টানের দিনে
দুগ্গা ছাতুর পার্বণী
আইসব্যে জামাই রাইত্যে
কাড়হান ছাতু দিব উয়ার পাত্যে–’
বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহল এলাকার একটি জনপ্রিয় খাদ্যবস্তু ছাতু এবং তাকে নিয়েই এই জনপ্রিয় স্থানীয় ছড়া। না, এ কোনও প্যাকেটজাত ছোলার ছাতু নয়। এর ডাক নাম ‘দুগ্গা ছাতু’ আর জঙ্গলমহলের অধিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় ‘কাড়াহান ছাতু’। এ ছাতু দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর ব্যাপক ভারী ঘন জঙ্গলের একটি ফসল। খুব সাময়িক এর উৎপাদন আর বিপণন। স্বল্পস্থায়ী এক ফসল। একান্ত জঙ্গলের। বেলপাহাড়ি, ঝাড়গ্রাম, লালগড়, কাঁকড়াঝোড়, লোধাশুলি, গোপীবল্লভপুর প্রভৃতি পাহাড়-জঙ্গল-ঝরনা ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এলাকায় ‘রেইনি সিজন’ বা ‘অটমনাল টুরিজম’ চালু হয়েছে আর এইসব হোমস্টে বা হোটেলের পর্যটকদের কাছে এই ছাতুর বিভিন্ন ‘মাউথওয়াটারিং ডিশ’ খুব জনপ্রিয়।
একদিকে যখন জলের রূপোলি শস্য ইলিশের রেসিপি নিয়ে ইলিশ উৎসব হচ্ছে, ঠিক তখনই অন্যদিকে তাকে টেক্কা দিচ্ছে ‘কাড়াহান ছাতু’ বা ‘দুগ্গা ছাতু’র বিভিন্ন রেসিপি। শুধু রেসিপি নয়, দামেও এই ছাতু ইলিশের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী– ১২০০ টাকা কেজি দরের ছাতু ছোঁ মেরে ভোজনরসিকরা তুলে নেয়। সেপ্টেম্বরের তীব্র রোদ আর ঝমঝমে বৃষ্টির সঙ্গমেই এই ছাতুর জন্মলগ্ন।
মা আসছেন ধরায়। আমরা কত না সজ্জা করি! কিন্তু দুগ্গামা নিজে যে কত কিছুই গুছিয়ে নিয়ে আসেন আমাদের মতো এই অভাগী অভাবী মানুষের জন্য, সে তো আমরা ভেবেই দেখি না! চিরচেনা ছকের বাইরেও এই বিপুল ধরণিতে মায়ের কৃপা কখন, কোথায়, কীভাবে ঝরে পড়ে তার কতটুকুই বা আমরা জানি! জগৎপালিকা মায়ের করুণা থেকে একটি প্রাণীও বঞ্চিত হয় না।
ললিতা মুর্মুরাও হয়নি। দুগ্গাছাতু আর ললিতাদের কথা জঙ্গলমহলের সবাই জানে। সবাই মানে বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুরের শাল-পিয়ালের বন, ভাদর-আশ্বিনের ঘন জঙ্গলের ভিজে মাটি আর কাঠফাটা রোদে সেঁকা ভেজা মাটি থেকে উঠে আসা ভ্যাপসা গরম। সেই ছটফটানি গরমকে আঁতুড় করে জঙ্গল ভর্তি ফুটে ওঠে সহস্র ছাতুর সাদা টুপির ছাতা আর তার লম্বা ধূসর ডান্ডায় লেখা থাকে শত শত ললিতার সম্বৎসরের খোরাক জোগানোর গল্প। জীবিকার টানাপোড়েনের সঙ্গে আনন্দ আয়োজন। লালমাটির ঘন সবুজ জঙ্গলের আড়ে আড়ে ইতিউতি থোকা থোকা সাদা ফুলের মতো ছাতুর সৌন্দর্য দেখে মেটে মনের আশ আর চোখের খিদে। আর্থিক লাভ দিয়ে মেটে পেটের খিদেও।
না, একে শুদ্ধ ভাষায় ‘ছত্রাক’ বললে তার মান থাকে না। এর বৈজ্ঞানিক নাম আছে– ‘Termitomyces heimii’, কিন্তু ভাদ্রের প্রথম কাঁচা রোদের নীরব আহ্লাদ মেখে অঙ্কুরিত হয়ে যে ফুলটি নিজের সাদা ধপধপে মাথাখানি নিয়ে উঁকি দেয় নতুন কুমারী মাটিতে– তাকে ছাতু বই অন্য কিছু নামে ডাকা যায় না। ডাকতে নেই। তার অভিমান হবে। এমনিতেই সে অভিমানী। কুমারী মৃত্তিকার ফসল। সঠিক মাত্রায় উষ্ণতা আর বর্ষণ না পেলে হাসিমুখটি তার দেখতে পায় না ললিতাবালা, কুসুমকলি, পানমণিরা। তাও থাকে তো কেবল মাসখানেক। মা দুগ্গার সঙ্গেই তার ভাব-ভালোবাসা। তার আসা-যাওয়াকে সম্মান দিয়েই প্রকৃতির এই বিশেষ দান ভাদ্রের মাঝামাঝি বা আশ্বিনের শুরু থেকে ফুটতে থাকে। কলকাতা মহানগরী থেকে যোজন যোজন দূরে। এদিকে যখন ঢাকে পড়ে কাঠি, শুরু হয় শিউলি ঝরা ওদিকে শাল, পিয়াল, সেগুন, জারুল মহুয়ার ঘন অরণ্যে ফুটতে থাকে রাশি রাশি ছাতু। একটি অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ফসল। লো কোলেস্টরেল, সুপাচ্য, ভিটামিন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও কিছু খনিজের সুষম মিশেলে এ ছাতু প্রকৃতির নিজস্ব সৃষ্টি। কোনও চাষ নেই, সার নেই, তদ্বির-তদারক নেই– আপনা হতেই গভীর জঙ্গলে ফোটে এই ছাতু। একটি অর্থকরী ফসল। শ্রাবণ-ভাদ্রের বর্ষায় পাতাপচে মাটির খাদ্য তৈরি হয় আর তার ওপরে পড়া ভাদ্র-আশ্বিনের প্রখর সূর্যালোক শুষে যে বিক্রিয়া হয়, তারই ফলে এই ছাতুর জন্ম। জঙ্গলের সঙ্গে যাদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যাঁরা জঙ্গলের ব্যাকরণ জানেন তাঁরাই জানেন জঙ্গলের কোথায় কোথায় ছাতু ফোটে।
অরণ্যবাসীদের ঋতুগত আয়ের একটি জোরালো উৎস এই দুগ্গা ছাতু। ললিতা, কবিতা, সবিতা, খাঁদুমণি, যাদুমণি, ধনি, বীরানী, ছুটকি,জিতু, রামু, বীরসা, হেদোলের মতো কিশোর-কিশোরীরা একটু রোদ উঠলেই বনে যায়। ঝুড়ি ভর্তি করে ছাতু তোলে ঠিক দুক্কুরবেলা। সূর্য হেলে পড়লেই ছাতুও নরম হয়ে হেলে পড়ে, সেই টানটান ভাবটা থাকে না। এলিয়ে পড়ে। তখন তুলতে অসুবিধে হয়। মাটি ভেদ করে ওঠে লড়াকু ছাতু। ১২ থেকে ১৮ ইঞ্চির বেশ শক্ত কাণ্ড। মাথার ছাতা আকৃতিটি সাদা আর দণ্ডটি ধূসর, মাটির তলা থেকে টেনে তুলতে হয়। বিশেষ একজায়গায় চাপ দিলে প্রায় গোটাটাই উঠে আসে। অভিজ্ঞরা জানেন খুব যত্ন করে সাবধানে তুলতে হয়। নতুবা ছিঁড়ে যায়। সেগুলোর দাম বেশি পাওয়া যায় না। তবে সবটা উঠে আসে না কিছুটা থেকে যায় শিকড় বা বীজ হিসাবে পরবর্তী প্রস্ফুটনের জন্য। দুপুর বেলা তুলেই হাটে বা পাশাপাশি এলাকায় বিক্রি করতে চলে যায় ওরা। চলে যায় ১৫-১৬ কিমি দূরে শহরের বাজারে। না, রোজের বাজারে তাদের ঠাঁই হয় না। তাদের জন্য কোনও একটা চারমাথার মোড় বরাদ্দ থাকে। নীল পলিথিনের ওপর সারি সারি সাদা সাদা ফুলফুল ছাতু নিয়ে বসে পড়ে দেহাতি মানুষগুলো। সেই সময়টায় ওই এলাকার রূপটাই খুলে যায়। ছাতুর ঢলঢলে সৌন্দর্যের টানেই শহুরে বাবুরা দাঁড়িয়ে পড়েন পলিথিনের সামনে। দরদাম করেন তুমুল উৎসাহ নিয়ে। এককথায় হামলে পড়ে। দুগ্গাছাতুর হাই ডিম্যান্ড থাকে। ইলিশের মতোই। মনে রাখতে হবে, এগুলো কালচার মাশরুম নয় বা বাটন মাশরুম নয়। দুটোর স্বাদ-গন্ধ এক্কেবারে আলাদা। এখানেই দুগ্গাছাতু টেক্কা দেয় মাশরুমকে। একটু লালমাটি মাখা থাকে গায়ে। তবে জলভর্তি গামলায় ঢেলে ভিজিয়ে রাখলেই ছেড়ে যায় মাটি আপনা থেকে। একেবারে প্রাকৃতিক নিউট্রিশন। দু’ ঘণ্টার মধ্যে স্টক সোল্ড আউট! নায্য দাম বুঝে নিয়ে শহর থেকে ফিরতি বাসে চলে যায় সেই দেহাতিমানুষগুলো শহর থেকে প্রয়োজনের জিনিস সওদা করে।
এর অন্য নাম ‘আড়ানি ছাতু’। জঙ্গলের বিশেষ একটা জায়গা থাকে যাকে ওরা ‘আড়ানি’ বলে। উইয়ের ঢিবির কাছাকাছি জায়গাটার নাম আড়ানি। ওর চারপাশে বেশি পাওয়া যায় তাই ওর নাম ‘আড়ানি ছাতু’। সেজন্যই এর বৈজ্ঞানিক নামটিও তেমনই। আবার এই ছাতু তোলা নিয়ে এত কাড়াকাড়ি পড়ে যায় লোকে বলে ‘কাড়ানি ছাতু’। বাঙালির দুগ্গাপুজোর পরবের সময়েই এর উত্থান বিস্তার ও বিপণন– তাই এর নাম পরব ছাতু, আর দুগ্গার নামে নাম তো আছেই– দুগ্গা ছাতু। বেশ উঁচু দামেই এটি বিক্রি হয়– ৫০০ থেকে ৯০০ এমনকী, ১২০০ টাকা কেজি দামও উঠে যায়। ইলিশের সঙ্গে পাল্লা দেয়। এর বিভিন্ন সুস্বাদু রেসিপি আছে। পেঁয়াজ রসুন আদা দিয়ে কষা রান্না বা ঝিঙে-কুদরি-বরবটি দিয়ে তরকারি বা অল্প পোস্ত-সরষে দিয়ে বাটিচচ্চড়ি। শুরুতে একটু ভেজে নিতে হয়। বড় আহ্লাদিনী সে পদ ভোজনরসিককে বলতে চায়– সারা বছরের একঘেয়ে শহুরে স্বাদের বদল করে চেখে নাও এই ছাতুর স্বাদ– দু’দিন বই তো নয়। কারণ পুজা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ততটা বেশি পরিমাণে আর ফোটে না। তাই আর পাওয়াও যায় না। প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় যেইমাত্র বদল আসতে শুরু করে বা হেমন্তের হিম পড়ার আগে পর্যন্তই জীবদ্দশা এই মরশুমি ফসলটির। তবে ওই দেড় বা দু’মাসে ছাতু বিক্রি করে জঙ্গলমহলের মানুষের মুখে হাসি ফোটে। ছাতুর লাভ থেকে বহু মানুষই অর্থিক ভাবে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। উপরোক্ত ছড়া অনুসারে এ সময় জামাইদের আপ্যায়ন করতে এ ছাতু ইউনিক। দুগ্গামায়ের পুজোর সময় এগিয়ে এলো। জামাইবাবাজি শিবকে ছাতুর কোনও রেসিপি দেওয়ার কথা ভাবা যেতেই পারে।
তবে এত সুখের গল্প কি এতটাই নিরঙ্কুশ? তাও কি হয়? হয় না। কারণ ওই ছাতু তুলতে যাওয়ার বিপদ পদে পদে। জঙ্গলের মধ্যে বিষাক্ত সাপের উপদ্রব তো আছেই। জঙ্গলের গভীরে উইঢিবির পাশে বেশি ছাতু ফোটে আর উইঢিবিগুলোই সাপের বাসস্থান। এছাড়াও বিষাক্ত পোকামাকড়ও। আছে ভয় বিষাক্ত ছাতুরও।
লালমাটির দেশে ছাতুকে খুব খুব মানিয়ে যায়। লালপাহাড়ির দেশের কিশোরীরা কিশোরদের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। কাঁখে নেয় ঝুড়ি, মাথায় থাকে ঝাঁকা। আঙুলে আঙুল কি ছোঁয়? ঝাঁকা ভর্তি করে জঙ্গল থেকে ওরা বেরিয়ে আসে উপচে পড়া খিলখিল খুশি নিয়ে। সে খুশি কীসের সবটা না-ই বা জানা হোল। সব জানলে নষ্ট জীবন।
এ ছাতু টাটকা রেঁধে ফেলতে হয়। বাসি হলে স্বাদ নষ্ট ।
তবে উদ্বেগ ঘনিয়েছে এই ছাতুর স্বাভাবিক সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে। কারণ দ্রুত কমছে জঙ্গল। আর বড় গাছের জঙ্গল না হলে এ ছাতু ফুটবে না। জঙ্গলের ঘনত্ব যত কমছে তত কমে যাচ্ছে এই ছাতু ফুটে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ। অন্যদিকে প্রতি বছর বসন্তের শেষের দিকে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার যে ভয়ানক প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তার ফলেও জঙ্গলের ভেতরের সেই পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক নিয়মে পাতা পচে যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া পাতায় তা হয় না। ফলে ভাদ্র-আশ্বিনের জঙ্গলে এই পুষ্টিকর ছাতু ফোটার পরিমাণ উদ্বেগজনক ভাবে কমছে। ভাবতে হবে পরিবেশবিদদের।
নদীর মোহানার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়ে যেমন ইলিশের জোগান কমে যাচ্ছে, তেমনই জঙ্গলের এই পরব ছাতুর জোগানও সংকটের মুখে। আর সেজন্যই দাম বাড়ছে। তবে লোভনীয় জঙ্গলমহলের দুগ্গাছাতুর চাহিদা দিনে দিনে শহুরে মানুষের কাছেও সমান স্বাদপ্রিয় হয়ে উঠছে। বৃহৎ আকারে এর বিপণন দরকার। ইলিশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে জঙ্গলমহলের দুগ্গাছাতু– স্বাদে আর দামেও।
……………………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন তনুশ্রী ভট্টাচার্য-এর লেখা
…………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved