
কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি-র গানে আমরা পাই, ‘কৃষ্টে আর খৃষ্টে কোনও তফাত নাই রে ভাই’। এ-কথা সত্যিই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতেই নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণনামের নগরসংকীর্তন ছিল এক গণবিপ্লব। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তাতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান ছিল। শ্রীরূপ গোস্বামীর ভাষায় নাম, লীলা ও গুণের উদাত্ত-কণ্ঠে উচ্চারণ-ই ‘কীর্তন’। সুতরাং, ‘কীর্তি’ এবং ‘কীর্তন’ এই দুই শব্দের উৎস একই। তাই কৃষ্ণের কথাও যেমন কৃষ্ণকীর্তন, তেমনই কালীর কথাও কালীকীর্তন। তাই কীর্তনের উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই একসময় শুরু হয়েছিল ‘খ্রিস্টকীর্তন’!
পশ্চিমবঙ্গের একজন নাগরিকের বাঙালি এই পরিচয়টিই বোধহয় যথেষ্ট। বাঙালির ব্রত সংস্কৃতির, বাঙালির সততা সংহতির। বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে যেমন পৌষলক্ষ্মী পুজোর চল রয়েছে, তেমনই মহানগর কলকাতা ও শহর বা শহুরে মফস্সলে বড়দিন এক পার্বণ, যা সেই বিশেষ প্রবাদবাক্যটির মধ্যে থাকা ‘তেরো’ সংখ্যার অন্যতম।

বাংলায় পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, দিনেমারদের আগমন ঘটেছে হুগলি নদীর জলপথের সুগম অর্থকরী ব্যবস্থাপনায়। এছাড়াও ব্রিটিশ শাসনকালে কলকাতা তথা সমগ্র বাংলা-ই যে ভারতের মানচিত্রে এক উল্লেখ্য স্বাক্ষর ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে প্রশাসনিক কার্যক্রমের সুবিধার্থে বাংলার সীমারেখা নানা সময়ে বদলেছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের এক প্রান্তিক জেলা বীরভূম; যার সহজ ডাকনাম ‘লালমাটির দেশ’।
১৭৮৬-’৮৭ সাল থেকেই এর সদর দপ্তর সিউড়ি শহর। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া শাল-মহুয়ার দোলা ছাড়াও এই জেলার কয়েকটি ঐতিহ্য আজও অমলিন। বীরভূমের সবচেয়ে পুরনো খ্রিস্টীয় উপাসনালয় সিউড়ির লালকুঠি-পাড়াতেই রয়েছে। এ যেন চলমান অতীতের বিমূর্ত স্পন্দন। ব্রিটিশযুগের লালচে ঘেঁষা রং-এর প্রলেপ থাকায় সিউড়িবাসীর কাছে এটি ‘লাল গির্জা’। সিউড়ির লালকুঠিপাড়ার বহুখ্যাত লালগির্জা সত্যজিৎ রায়ের ‘বাদুড় বিভীষিকা’ গল্পেও উল্লিখিত হয়েছে। যদিও এর সম্পূর্ণ নাম ‘নর্দার্ন ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল লুথারেন চার্চ’। নামটিই প্রমাণ করে এই গির্জার অভিমুখ ছিল মার্টিন লুথারের প্রচারিত আদর্শে।

খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মানে মার্টিন লুথার ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বাইবেলের পবিত্রতা ও লোকরঞ্জনের বিহিত অপরীক্ষিত নিয়মাবলির সংঘাতে তাঁর অনুগামীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পোপতন্ত্রবাদের বিপরীত শক্তি-ই ‘প্রটেস্ট্যান্ট’ নামে পরিচিত হয়। তারাই হয়ে ওঠেন ‘লুথারেন’। পল ওলাফ বোডিং এবং লার্স ওরসেন স্ক্রেফসরুড ছিলেন এই মতের অনুসারী। এই দুই ইউরোপীয় শিক্ষাবিদ উনিশ শতকে ভারতের সাঁওতাল পরগনা এলাকায় দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন। সাঁওতালি ভাষা নিয়ে গবেষণাও করেছিলেন বোডিং সাহেব। ‘ফোকলোর অফ্ দ্য সান্তাল পরগনাস্’ তাঁর এক অসামান্য কীর্তি।

স্ক্রেফসরুডের প্রতিষ্ঠিত মিশনটি বর্তমানে একটি বিশাল গির্জায় পরিণত হয়েছে। ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং অসম রাজ্য মিলিয়ে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১,৫০,০০০-এরও বেশি। ১৯৫০-এর দশকে এটি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্য নর্দার্ন ইভাঞ্জেলিক্যাল লুথারেন চার্চ’। সিউড়ির এই চার্চের প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে সিউড়ি-গবেষক সুকুমার সিংহ ১৮৭৬ সালের কথাই বলেছেন। তবে খ্রিস্টীয় মিশনটি স্ক্রেফসরুড সাহেবের সময়ে যে একটি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, তার সাক্ষ্য বহন করে ইতিহাসের অনুলিপি।

কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি-র গানে আমরা পাই, ‘খৃষ্টে আর কৃষ্টে কোনও তফাত নাই রে ভাই’। এ-কথা সত্যিই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতেই নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণনামের নগরসংকীর্তন ছিল এক গণবিপ্লব। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তাতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান ছিল। শ্রীরূপ গোস্বামীর ভাষায় নাম, লীলা ও গুণের উদাত্ত-কণ্ঠে উচ্চারণ-ই ‘কীর্তন’। সুতরাং, ‘কীর্তি’ এবং ‘কীর্তন’ এই দুই শব্দের উৎস একই। সুতরাং, কোনও দৈবী মহিমান্বিত অপ্রাকৃত চরিত্র হোক, কিংবা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত কোনও যশস্বী ব্যক্তিত্বের গুণগাথার প্রচার-ই হবে ‘কীর্তন’। তাই কৃষ্ণের কথাও যেমন কৃষ্ণকীর্তন, তেমনই কালীর কথাও কালীকীর্তন। তবে বাঙালির সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি নেহাত সীমিত নয়। তাই কীর্তনের উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই একসময় শুরু হয়েছিল ‘খ্রিস্টকীর্তন’! এর সূচনা সেই নদীয়ার চাপড়াতেই। সেখানে যিশুর বন্দনায় শোনা যেত শ্রীখোল, করতাল ইত্যাদি কীর্তন-উপযোগী বাদ্য।

চৈতন্যভূমি নদীয়ার উদারতা যিশুকে করেছিল আপন। সংগীত-ই সম্প্রীতির সুরকে আহ্বান জানায়। তাই যিশুর গানে সমন্বিত হয়েছিল বাংলার পারম্পরিক ঐতিহ্য। তবে সিউড়ি ও নদীয়ার ভৌগোলিক অবস্থান দু’টি ভিন্ন প্রান্তে। তবে সিউড়িতেও বড়দিনে নিয়ম করে সকালে প্রার্থনা হয়। পবিত্র বাইবেলের নির্দিষ্ট কিছু অংশের পাঠ ও শেষে সকলে মিলে গান গাওয়া হয়। ‘লুথারেন ধর্মগীত’ বইতে সংকলিত ৫০৬টি গানের মধ্যে ৫৯ আর ৬৫নং গান দু’টিই এখানে গাওয়া হয়। প্রার্থনার শেষে ৬৫ নং গান ‘ওড়াও বিজয় পতাকা জয় যীশু বলে’ গানটিতে চার্চের ফাদারের সঙ্গে সকলেই গলা মিলিয়ে থাকেন। তবে হ্যাঁ, এখানে কোনও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার থাকে না। এটি ‘পুত্র খ্রীষ্ট’ পর্যায়ের গান এবং স্পষ্ট লেখা রয়েছে ‘কীর্তন’-এর সুর। অনুকূলচন্দ্র ঘোষ ১৯০৭ সালে এই গান লিখেছিলেন। গানটির শেষ পঙক্তিতে রয়েছে– ‘ধন্য যীশু, দুই বাহু তুলে’; যা চিরায়ত কীর্তনের পদের আঙ্গিক। এই গানটি যিশুর ‘গুণকীর্তন’ পর্বের। এখানে ‘প্রেম অবতার’, ‘দয়াময়’ শব্দেই তার প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়াও বহু পরিচিত ‘ধর লও রে ঈশ্বরের প্রেম’ গানটির সুর ও ছন্দ কীর্তন আঙ্গিকের। মহাপ্রভুর জন্মভূমি যিশুবন্দনা করলেও কীর্তনের আন্তরিক সুর ও ছন্দকে অবহেলা করতে পারেনি। তাই ঘটে গিয়েছে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।

চাপড়ার বড়দিনের মেলায় এই খ্রিস্টকীর্তনের ধারা অব্যাহত থাকলেও একথা বললে ভুল হবে যে, এই অভিনব সংস্কৃতি শুধু নদীয়া জেলার-ই। বীরভূমের সিউড়ির লালগির্জা লুথারেন হওয়ার দরুন অতীতকাল থেকেই তারা সৌহার্দ্যকে স্বাগত জানিয়েছে। তাই ‘লুথারেন ধর্মগীত’ গ্রন্থে সংকলিত গানগুলির বাণীমাধুর্য বাংলার অবিচ্ছিন্ন চিরায়ত সংস্কৃতির পরিচায়ক। সিউড়ির ক্রিশ্চিয়ান-মণ্ডলীর কাছেও এই গানের সুর অজানা নয়। তবে গানটির স্থায়ী, অন্তরা বা সঞ্চারীর মধ্যে তেমন বৈচিত্র্য নেই। অন্তরার সুরটিই বাকি চরণগুলিতে ফিরেছে। অনেকখানি লক্ষ্মীর পাঁচালি বা কৃষ্ণের অষ্টোত্তর-শতনামের মতোই। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে এই বিশেষ গানটির পরম্পরা চলে আসছে।
গান বেঁচে থাকে শব্দে নয়; বরং সুরেই তার গতি সচল থাকে। সিউড়ির লালগির্জা কর্তৃপক্ষ এই চিরন্তনী ধারাকে বজায় রেখেছে বলেই আজও বাংলার বুকে মানবতার জয়গান সমান জনপ্রিয় হয়ে রয়েছে। বীরভূমের জন্য এ এক গর্বের বিষয় যে, নদীয়ার পাশাপাশি এই জেলাও তার অমূল্য ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে সমানভাবেই উজ্জ্বল।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved