
মার্কিনমুলুকে করা ২০২১ সালের একটি সমীক্ষা জানান দিচ্ছে, সে দেশের ১২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কোনও বন্ধু নেই। তিন দশক আগে এই একলা মানুষের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। ২০২২ সালে ব্রিটেনে করা সমীক্ষা বলছে, ৭ শতাংশ মানুষ বন্ধুহীন। শুধুমাত্র বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে পশ্চিমি দেশগুলোর মতো এত বিশদে সমীক্ষা ভারতে অবশ্য হয়নি। তবে যতটুকু হয়েছে, তার থেকে উঠে আসা পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ ছবি দেখায়। সমীক্ষা বলছে, এ দেশের অন্তত ৩২ শতাংশ মানুষ বলেছেন ভরসা করার মতো কোনও নিকট বন্ধুর না থাকার কথা। শহরের পরিসংখ্যান গ্রামের কাছে নতজানু হয়ে থাকে।
স্কুলজীবনের এক বন্ধুর সঙ্গে সেদিন রাস্তায় দেখা। বসেছিল বাসস্ট্যান্ডে। চুপচাপ। ঘাড় নিচু। ব্যস্ত রাস্তার দিকে চেয়েছিল আনমনে। রুমাল দিয়ে মুছছিল ঘাম। ডাকলাম তার নাম।
–মন খারাপ?
–সব শেষ হয়ে গেল।
–কী বলছিস? বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো? কাকু-কাকিমা? কত বছর দেখা হয় না ওদের সঙ্গে।
–সব ঠিক আছে ভাই। সবাই। শুধু আমি শেষ হয়ে গেলাম রে। নিঃস্ব করেছে আমায় কি নিঠুর ছলনায়।
–ফিরিয়ে নাও। তোমার এ হেঁয়ালি তুমি ফিরিয়ে নাও। একটু খুলে না-বললে তো বুঝতে পারব না কিছুই।
বুকপকেট থেকে ফোনটা বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে আমার দিকে সেটা এগিয়ে দেয় ও। এবারে বুঝলাম। তাহলে ফোন খারাপ। ঝটিতি বললাম, ‘আরে এ তো সামান্য ব্যাপার ভাই। ওয়্যারান্টি নেই?’
–ফোন খারাপ তো বলিনি একবারও। মন খারাপ। এবারে দেখতে থাক।
ফোন আনলক করে ও খুলে ফেলল ফেসবুক। নিজের প্রোফাইলে গেল। স্ক্রিনে যা মেসেজ দেখাচ্ছে তার মর্ম হল এই– তোমার বন্ধুসংখ্যা ৫০০০ ছুঁয়ে ফেলেছে। এটাই লিমিট। বন্ধুতালিকা থেকে কিছু না কাটতে পারলে নতুন বন্ধু আর যোগ করতে পারবে না।
বন্ধুর দু’চোখে এল বরষা, সহসা। আমার হাতে হাত রেখে, হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এবারে আমি কী করি?’
–এটা একটা চিন্তার কারণ হল? ভাগিয়ে দে কয়েকজনকে।
–সবাই তো আমার বন্ধু। যাকে কাটাব, সে কষ্ট পাবে না?
–স্কুলে তো দু’তিন জনের বেশি কারও সঙ্গে কথা বলতিস না। এখন তোর ৫০০০ বন্ধু হয়ে গেল? চিনিস সবাইকে?
–এত লোককে চেনা যায় নাকি? প্রশ্নই নেই।
–তাহলে বন্ধু কী করে হল?
–আমার পোস্ট লাইক করে তো। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। যে আমায় ভালোবাসে, সে বন্ধু নয়?
–এই পাঁচ হাজারের মধ্যে দেখেছিস ক’জনকে? নিদেনপক্ষে কথা বলেছিস ক’জনের সঙ্গে?
–১০-১২ জনের বেশি নয়। কিন্তু সবাই আমার বন্ধু। লাইক করে তো।
–আর যারা লাইক করে না?
–তারা আমার বন্ধু নয়।
–যদি সব বন্ধু কেটে যায় একসঙ্গে? কাল সকালে যদি উঠে দেখিস বন্ধুসংখ্যা শূন্য?
একথা শোনার পরে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ ঠায় তাকিয়ে ছিল ও। নিজের মনেই কীসব বিড়বিড় করছিল। মিনিটখানেক পরে মিনমিন করে বলল, ‘বেঁচে যাব। বন্ধুর সংখ্যা হয় লিমিট না রেখে পূর্ণ করো, না হয় একদম শূন্য করো। এই মানসিক টানাপোড়েন, এই থ্রেটনিং ভাল লাগে না আর!’

অভিধান বলছে, ‘বন্ধু’ কথার অর্থ হল– সখা, সুহৃদ, হিতৈষী ব্যক্তি, স্বজন, প্রণয়ী, প্রিয়জন। আজকের সামাজিক মাধ্যমে আমাদের যে এই বিরাট বন্ধুব্যাপ্তি, তার মধ্যে কতজন মানুষ অভিধানকৃত বন্ধুর সংজ্ঞা মেনে চলেন, তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। একথা বলতে দ্বিধা নেই, সোশ্যাল মিডিয়া আসার পরে বন্ধুর অর্থ পাল্টেছে। শব্দটির ভার লঘু থেকে লঘুতর হয়েছে। যাদের সঙ্গে পরিচয় হলে আমার ক্ষতি নেই কোনও, অন্তত ওটুকুই– তাঁরাও অবলীলায় চলে আসছেন আমাদের বন্ধুবৃত্তে। ফলে ‘বন্ধু’ কথাটির প্রকৃত মর্ম খাটো হচ্ছে আরও। সাইবার দুনিয়ার অলিতে-গলিতে ভ্রমণ করা পরিচিত এক তথ্যপ্রযুক্তিবিদকে এ প্রসঙ্গে বলতে শুনেছিলাম, ‘এই প্ল্যাটফর্মে দুটো ভাগ থাকা উচিত স্পষ্ট। পরিচিত এবং বন্ধু। নেটওয়ার্ক আর ফ্রেন্ডস। স্কুলে যে চিরসখার পাশে ১০-১২ বছর একসঙ্গে বসেছি এবং দু’দিন আগে মেট্রোয় যে লোকটির সঙ্গে প্রথমবারের জন্য আলাপ হল, তাঁরা কখনও একই বন্ধনীতে বসতে পারেন না। এখানে কোথাও কাউকে ছোট-বড় করার ব্যাপার নেই। ফেসবুকে থাকা ফ্রেন্ডস যদি সত্যিই আমাদের বন্ধু হত, তাহলে বাড়ির আনন্দ-অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র আমরা নিজেদের ওয়ালে পোস্ট করে দিতাম। বন্ধু মানেই তো হিতৈষী, প্রিয়জন। সেটা করি কি? প্রয়োজনে আমরা ঠিকই ছাঁকনি বসিয়ে নিতে জানি। তাহলে বাইনারি দুনিয়ায় এই দ্বিচারিতা কেন?’

‘পাঁচ হাজার ফ্রেন্ডস হয় কী করে?’, বলার সময় যখন আমাদের ভ্রু দুটোকে দ্বিতীয় বন্ধনীর মতো দেখতে লাগে, তখন দুরু দুরু চিত্তে মাথায় আসতে পারে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ রবিন ডানবারের নাম। ১৯৯২ সালে তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছিল এক আকর্ষণীয় তথ্য! তিনি জানিয়েছিলেন, মানুষের মস্তিষ্ক একসঙ্গে ১৫০টির মতো সম্পর্ক চালিয়ে যেতে সক্ষম। তার বেশি নয়। বলাই বাহুল্য, এখানে সম্পর্ক শব্দের অর্থ ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ লাভ লাভ’ গোছের প্রেম নয়। এটা হল অর্থবহ সম্পর্ক। মিনিংফুল কনট্যাক্ট। বন্ধুত্বের বিষয়টিকে কয়েকটি লেয়ারে ভাগ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, একজন মানুষের খুব প্রিয়জন হতে পারে ৫ জনের মতো লোক। ভালো বন্ধুর সংখ্যা হতে পারে ১৫ জনের কাছাকাছি। বন্ধুবৃত্তের সদস্যসংখ্যা ৫০ জন ছাড়ানোর কথা নয়। পরিচিতি হতে পারে শ’ পাঁচেক মানুষের সঙ্গে। আর আমরা যে পরিমাণ মানুষকে চিনতে পারি, তার সংখ্যা হতে পারে ১৫০০-এর মতো। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, প্রণয়ে-মান-অভিমানে, প্রতিটি স্তর থেকেই কিছু মানুষ বেরিয়ে যাবেন। আরও কয়েকজন ঢুকবেন। কিন্তু প্রতিটি স্তরে মোটের ওপর সংখ্যাটা এমনই থাকবে। এত কিছু যখন বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন ডানবার সাহেব, সামাজিক মাধ্যম তখন দূর আকাশের তারা। আজকের দিনের পাঁচ হাজারি ফ্রেন্ড লিমিট দেখে কি তিনি ফের নতুন করে অঙ্ক কষতেন? জানতে বড় ইচ্ছে হয়।
মুশকিলটা হল, ফেসবুকের বন্ধুবৃত্তে ‘ওই তো অঢেল সবুজের সমারোহ’ থাকলেও বাস্তব জীবনের বন্ধুযাপন একেবারে বিপরীত একটি ছবি তুলে ধরে। ভালো বন্ধুত্ব কীভাবে আমাদের আরও ভালোভাবে বাঁচতে সাহায্য করে, সুখযাপনে বন্ধুত্বের অবদান কতটা– এই নিয়ে সমীক্ষা হয়েছে বিস্তর। এই সমীক্ষায় যে তথ্য উঠে এসেছে, তা আমাদের বিস্মিত করে! মার্কিনমুলুকে করা ২০২১ সালের একটি সমীক্ষা জানান দিচ্ছে, সে দেশের ১২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কোনও বন্ধু নেই। তিন দশক আগে এই একলা মানুষের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। ২০২২ সালে ব্রিটেনে করা সমীক্ষা বলছে, ৭ শতাংশ মানুষ বন্ধুহীন। শুধুমাত্র বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে পশ্চিমি দেশগুলোর মতো এত বিশদে সমীক্ষা ভারতে অবশ্য হয়নি। তবে যতটুকু হয়েছে, তার থেকে উঠে আসা পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ ছবি দেখায়। সমীক্ষা বলছে, এ দেশের অন্তত ৩২ শতাংশ মানুষ বলেছেন ভরসা করার মতো কোনও নিকট বন্ধুর না থাকার কথা। শহরের পরিসংখ্যান গ্রামের কাছে নতজানু হয়ে থাকে। অর্থাৎ, গ্রামগঞ্জে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকলেও শহরে তা নেই। অন্য একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৪০ কোটির দেশের জমজমাট মেট্রো শহরের অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ সামাজিকভাবে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ বোধ করেন।
অর্থনীতির মন্দার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু বন্ধুত্বে মন্দা? ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’-এর গবেষক ড্যানিয়েল কক্সের ব্যবহার করা ‘ফ্রেন্ডশিপ রিসেশন’ শব্দ দু’টি নিয়ে আজকাল আলোচনা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। এই দু’টি শব্দের মধ্যে ক্রমাগত ঢেউ খায় আমাদের একলা চলার হাহাকার। প্রিয় বন্ধুর সংখ্যা তলানিতে ঠেকার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারার যন্ত্রণা। আর নিঃসঙ্গতা কীভাবে আমাদের কুড়ে কুড়ে খায় তা জানার জন্য দৈনিক সংবাদপত্রের টুকরো কলামের খবরগুলিই যথেষ্ট। ‘পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, একাকিত্ব থেকে তৈরি হওয়া চূড়ান্ত মানসিক অবসাদের জেরেই এমন পদক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন তিনি।…’
অফিসে সারাদিন কাজে ডুবে থাকা, খেয়োখেয়ির বাজারে নিজেকে ক্রমাগত টিকিয়ে রাখার চেষ্টা, নিউক্লিয়ার পরিবার, আত্মনিমগ্নতা– অন্তহীন এই মেনু কার্ডের কোন উপকরণ কত চামচ পড়ার ফলে আমাদের এই হাল হল, তা সহজে জানার উপায় নেই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এ তো সবে শেষের শুরু। এখনও অনেক পথ যাওয়া বাকি, অনেক কিছু দেখা বাকি আমাদের।’ নিজেদের শুধরোনোর কোনও সম্ভাবনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি না আপাতত।

আর কী আশ্চর্য! বাস্তবের শূন্যর সঙ্গে বাইনারি পাঁচ হাজার লড়াই করে যায়। তুমুল বিপদের সময় ইমোজি নয়, আমাদের প্রয়োজন হয় ধরার মতো হাতের। সঙ্গের জন্য আমরা কিলবিল করি। পাই না। এই রাস্তা তৈরি করেছি আমরাই। আর বন্ধুসংখ্যা পাঁচ হাজার ছুঁয়ে ফেললে আমাদের ‘দক্ষিণ খোলা জানালা’র মতো মনে উজিয়ে আসে বিষাদ। সেই বিষাদে আমরা তা দিই।
ডানবার সাহেব মুচকি হাসেন।
…………………….
রোববার.ইন-এ পড়ুন অম্লানকুসুম চক্রবর্তী-র অন্যান্য লেখা
…………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved