Robbar

এখনও আমাদের কোনও ‘গলি গার্ল’ নেই

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 1, 2025 8:27 pm
  • Updated:September 1, 2025 8:28 pm  

সেই কবে মেয়েদের কাগজে-কলমে মননে স্বাধীনতা এসে গিয়েছে, তাই এখন তাদের বল নিয়েই ছোটার কথা। ঝনঝন করে পড়শির সার্শি ঝরে পড়ার কথা। সেই শব্দে মাথায় হাত দিয়ে গালি শোনা বা লুকিয়ে পড়া বা নর্দমা থেকে বল কুড়িয়ে আনার কথা। পাঠক বলবেন, সোশ্যাল মিডিয়ায়, কাগজ খুললে এসব দেখেন না? দেখি। ব্যতিক্রম বলেই এগুলো হাইলাইট করা হয়। কিন্তু ছুটির দিনে গলি বন্ধ করে যে ছেলেরা ‘হাউজ দ্যাট’ আর স্ট্যাম্প ওড়ানোর সুতীব্র চিৎকারে কান ঝালাপালা করে দিল, তার মধ্যে আমার-আপনার বাড়ির খেলতে ভালোবাসা মেয়েটি কোথায়? 

সেবন্তী ঘোষ

গলির মেয়েটি ছুটছে। কী নিয়ে? না, হাতে বা পায়ে বল নিয়ে নয়; কেউ পিছু নিয়েছে, কেউ তাড়া করেছে তাই সে ছুটছে।

এমনটাই আমাদের সব গল্পে, সিনেমায় এখনও দেখতে পাওয়া যায়। সেই কবে মেয়েদের কাগজে-কলমে-মননে স্বাধীনতা এসে গিয়েছে, তাই এখন তাদের বল নিয়েই ছোটার কথা। ঝনঝন করে পড়শির সার্শি ঝরে পড়ার কথা। সেই শব্দে মাথায় হাত দিয়ে গালি শোনা বা লুকিয়ে পড়া বা নর্দমা থেকে বল কুড়িয়ে আনার কথা। না হলে দু’-চারটে বন্ধু জড়ো করে অপেশাদারের আনন্দে কোরিয়ান ধুনে হাততালি পাওয়ার গল্পও তো হতে পারত।

‘মহানগর’ ছবির একটি দৃশ্য

পাঠক বলবেন, কেন, সোশ্যাল মিডিয়ায়, কাগজ খুললে এসব দেখেন না? অবশ্যই দেখি। ব্যতিক্রম বলেই এগুলো হাইলাইট করা হয়। কিন্তু ভেবে দেখেছেন ছুটির দিনে গলি বন্ধ করে যে ছেলেরা ‘হাউজ দ্যাট’ আর স্ট্যাম্প ওড়ানোর সুতীব্র চিৎকারে কান ঝালাপালা করে দিল, তার মধ্যে আমার, আপনার বাড়ির খেলতে ভালোবাসা মেয়েটি কোথায়? স্রেফ নেই।

এতদিনের তো তাদের পথের চায়ের দোকান আর ক্যারাম বোর্ডে গুলতানির কথা। এটুকু করার পরে আপনি গলা তুলবেন– না, না, ছেলেদের সময় নষ্টের দোষগুলি আমরা বাপু মেয়েরা নেব না। আচ্ছা, আমার আপনার বাবা-দাদা-ভাই-ছেলে গলির, ক্যারাম ক্রিকেট পিটিয়ে এলে আপনি সময় নষ্ট ভাবেন তো? ভাবেন না আদৌ। আপনি মেয়ে হলে অবসরের সময়ে বাড়ি গোছানো, শৌখিন সুতোর কাজ, বাগান, রান্না, অতীব প্রশংসনীয় কিন্তু সব মেয়ে কি এসব কাজ পছন্দ করে? অনেক মেয়েরাই নিজেরা মন থেকে কী পছন্দ করে, সেটা ভাবতেই শেখে না। অভিভাবকদের পছন্দ তার পছন্দ হয়ে ওঠে। সমাজ নির্ধারিত মেয়েদের নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকাই পছন্দের বিষয় হয়ে ওঠে। এখনও সংখ্যালঘুর মতো তাদের সবসময় যথাযথ ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ বা নিখুঁত হওয়ার ভার বহন করতে হয়। এ হারকিউলিসের বোঝা নিজেরাই নিজেদের ঘাড়ে চাপায়। অমনি বলে উঠবেন, কে বলেছিল, অবসর সময়টাও সংসার সাশ্রয়ে কাজে লাগাতে? মারুক না আড্ডা। বললেই কি আর হয়? হাজার বছরের অভ্যাস শিক্ষা সহজে যাওয়ার?

…………………………………………..
অনেক মেয়েরাই নিজেরা মন থেকে কী পছন্দ করে, সেটা ভাবতেই শেখে না। অভিভাবকদের পছন্দ তার পছন্দ হয়ে ওঠে। সমাজ নির্ধারিত মেয়েদের নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকাই পছন্দের বিষয় হয়ে ওঠে। এখনও সংখ্যালঘুর মতো তাদের সব সময় যথাযথ ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ বা নিখুঁত হওয়ার ভার বহন করতে হয়। এ হারকিউলিসের বোঝা নিজেরাই নিজেদের ঘাড়ে চাপায়। অমনি বলে উঠবেন, কে বলেছিল, অবসর সময়টাও সংসার সাশ্রয়ে কাজে লাগাতে? মারুক না আড্ডা। বললেই কি আর হয়? হাজার বছরের অভ্যাস শিক্ষা সহজে যাওয়ার?
…………………………………………..

বাবারা যেমন খুকি-খোকা ঠিক ১২টায় খাবে, একথা মাথায় গেঁথে না রাখলেও ভালো বাবা হতে পারে, মায়েরা তা পারে না। সে একটু উল্টোরকম হলে, সংসার কথা শোনায়, ‘তাহলে একা থাকলেই ভালো ছিল তো? সংসার করতে এলে কেন হে?’ ফলে বাইরে সরকারি দোর্দণ্ডপ্রতাপ অফিসার হলেও রাতে শাশুড়ি-শ্বশুরের আয়া না এলে, বা হেঁশেলে কোন চচ্চড়ি চড়বে, তার খেয়াল রাখতে হয় তাকে।

যেই এই নিয়মের উল্টোদিকে যাবে মেয়েরা, অমনি বাড়ির পুরো নিয়মকানুন ধসে ধ! খাঁচা থেকে বের করে দিলেও সব মেয়েরা উড়তে পারে না, কারণ ওড়ার শিক্ষাটাই তো কেউ দেয়নি। ছোট থেকেই অলিখিত বাধা-নিষেধে বড় হয়েছে সে। চারপাশে ভয়ের জুজু। তার শরীর তার ভয়। দেড় বছরের কন্যার শরীর চিহ্ন বিছানা ভেজানোর নিমিত্ত মাত্র, কিন্তু সেখানেও তার আতঙ্ক। এমনটা নয় যে, পুরুষ শিশু নিরাপদ। কিন্তু তুলনায় কন্যা বৃদ্ধাবস্থা অবধি এক অনিশ্চিত ‘থ্রেট’-এর মধ্যে থাকে। না হলে রাস্তার ধুলো-কাদামাখা, মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েটিকে সন্তানসম্ভবা হতে হয় কেন?

শিল্পী: বিকাশ ভট্টাচার্য

এমত অবস্থায় মেয়েরা সুখী গৃহকোণে নিরাপদ গ্রামোফোন বেছে তো নেবেই। পারিবারিক হিংসা, রক্ত সম্পর্কের হাতে নিগ্রহ, এসব কি আর ঘরের মধ্যে নেই? আছে, অবশ্যই আছে। সে তো রাস্তায় বেরলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও আছে। বছরে সাপে কাটা, বাঘে মারা মৃত্যুর চেয়ে দুর্ঘটনায় বেশি লোক মারা যায়। তাই বলে কি মানুষ পথে নামে না?

তবে গলির খেলা যখন কারও রোজগারের অঙ্ক যোগ করে, পিছিয়ে পড়া পরিবারও তাকে সমর্থন করে। যেমন দেখেছি, নারী বঞ্চনা ও নির্যাতনের শীর্ষে থাকা উত্তর ভারতের গ্রাম মফস্সলের মেয়েদের কুস্তির গল্পে। আমাদের দরিদ্র গ্রামগুলিতে অভাবী মেয়েরা এমন নানারকম খেলার মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থাৎ, শেষ অবধি ওই অর্থনীতি। অর্থ উপার্জন হলেই মেয়েদের যে কোনও কাজ ‘চলতা হ্যায়’। শখের কাজ, আড্ডা, ফুর্তি, নিছক বিনোদনে সমাজের ভারী ভ্রুকুটি।

‘দঙ্গল’ ছবির একটি দৃশ্য

গলির ছেলে গান গাইতে গাইতে বিশ্বজয় করতে পারে, কারণ তার ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’-এর সুযোগ আছে। মেয়েদের নেই। প্রকৃত স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারের মধ্যে তফাত একেবারে নিচুতলা থেকে আমরা শেখাতে পারিনি বলে অল্প, অর্ধশিক্ষিত শ্রমজীবী মেয়েদের সমাজে এক ভয়ানক ভাঙচুর ঘটে গেছে। পুরনো পাপ-পুণ্য বোধের ট্যাবু ভেঙেছে, নতুন বিচারবোধ, ভালো-মন্দ শেখানো যায়নি বলে সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল ফোন তাদের পারিবারিক সামাজিক জীবনে একটা বিধ্বংসী বন্যা এনে দিয়েছে।

……………………………………………………………

রোববার.ইন-এ সেবন্তী ঘোষের সমস্ত লেখা পড়তে ক্লিক করুন: সেবন্তী ঘোষের রোববার.ইন-এর লেখালিখি

……………………………………………………………

খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই, বিবাহিত জীবন ফেলে রেখে প্রতিদিন অজস্র মেয়েরা নতুন স্বপ্নের হাতছানিতে বাচ্চাকাচ্চা ত্যাগ করে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এতদিন এদের পুরুষরা এই কাজগুলি করে এসেছে এবং তা মোবাইল ফোন সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াই। ফলে নীতিপুলিশ না হলে এ কাজে আপনি চোখ রাঙাতেও পারবেন না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠকছে মেয়েরা। নিজের রোজগারের তেমন ক্ষমতা না থাকায় আবার পুরনো সংসারে ফিরতে হচ্ছে। যে পুরুষদের মায়ায় ঘর ছাড়ছে হয়, তারা অন্য কোথাও বিক্রি করে দিচ্ছে আর না হয় তাদের ফেক প্রোফাইল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, শ্রমজীবী বা নিম্নবিত্ত স্তরের গৃহবধূদের মধ্যে স্বাধীনতার নামে যে ছন্নছাড়া স্বেচ্ছাচার দেখা যাচ্ছে, বিনোদনের বা সহজ আনন্দ উদযাপনের আয়োজন সেখানে নেই। খোলামেলা রিলের দুনিয়ায় নিজেদের অগোচরে পণ্য হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। প্রাথমিক শিক্ষায় অনীহা, স্কুলছুট হওয়া, স্বেচ্ছায় বা পারিবারিক চাপে অল্পবয়সে বিয়ে তাদের অন্ধকার ঘূর্ণির ভিতর তলিয়ে দিচ্ছে। এই যেখানে অবস্থা, খানিকটা পিছন দিকে ফিরে যাচ্ছি যখন, তখন গলির ঝলমলে মেয়েটিকে কোন স্বপ্নে পাব আমরা?

এই যে ধান ভানতে দুঃখের গীত, এ কেবল গলির দুরন্ত মেয়ের নয়, নাচতে চেয়ে গান শিখতে ঢোকা, গাইতে চেয়ে ছবি আঁকায় ঠেলে দেওয়া, রং তুলি চাইলে হাতা বেড়ি দেওয়া– এমন সব মেয়েদের।

সূত্র: ইন্টারনেট

মনে পড়ছে এক ছাত্রীর কথা। নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার তীব্র ইচ্ছা, সে ক্রিকেট খেলবে। তার তুতোভাই স্কুলের বেশ নামডাকওয়ালা ক্রিকেটার। গেলাম ক্রিকেট কোচের কাছে। বললেন, ‘আগে ২২টা মেয়ে জোগাড় করুন এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে লিখিয়ে আনবেন, প্র্যাকটিসে ও খেলতে গেলে আঘাত পেলে আমরা দায়ী নই।’

না, ৪০০০ বাচ্চার স্কুলে ২২টি মেয়ে খুঁজে পাইনি, যে ওই শর্তে খেলবে। মেয়েটির বিমর্ষ মুখ এখনও পীড়া দেয়। মেয়েটি তার ছটফটানি নিয়ে খেলা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল গান-বাজনার জগতে। এসরাজ বাজিয়ে হিসেবে তার এখন বেজায় নামডাক। কে বলতে পারে, সুযোগ পেলে তার আজকের সরস্বতীরূপিণী ছবির বদলে একজন ডায়ানা এডুলজি বা ঝুলন গোস্বামী উঠে আসত না?

………………………….

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

………………………….