Robbar

ফুড ভ্লগিং চাকুরিজীবী বাঙালিকে খাদ্যব্যবসায় নামতে উদ্বুদ্ধ করছে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 19, 2025 7:32 pm
  • Updated:December 19, 2025 7:32 pm  

ফুড ব্লগিংয়ের দৌলতে গত কয়েক বছরে চাকুরিজীবী বাঙালির একাংশ খাদ্য-ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। কেউ ক্লাউড কিচেন, কেউ ছোট ক্যাফে, কেউ আবার স্ট্রিট ফুড স্টল খুলছেন। কিন্তু বাস্তব পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রবণতার সাফল্য-ব্যর্থতার অনুপাত বেশ খারাপ। খাদ্য ব্যবসা ও ক্লাউড কিচেন সেক্টরের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি রিপোর্ট মিলিয়ে দেখা যায়, নতুন ফুড ব্যবসার প্রায় ৫০-৬০ শতাংশই প্রথম এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।

আদিত্য ঘোষ

ছোট্ট, অনামী একটা কচুরির দোকান। যে দোকানে হয়তো সারাদিনে ১০ থেকে ১২ প্লেট কচুরি বিক্রি হত, ফুড ভ্লগিংয়ের দৌলতে সেই দোকানে এখন লাইন দিয়ে কচুরি কিনতে হয়। ঠিক একইভাবে মোমো, রোল, ফুচকা ইত্যাদি সাধারণ খাবারের দোকানগুলোকে ‘হিডেন জেম’ ট্যাগ দিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে সেই দোকানগুলোতে পৌঁছতে পারলেই মনে হবে জীবন ধন্য! যদিও সবটাই ফুড ভ্লগিংয়ের অবদান। বলা ভালো, ফুড ভ্লগিংয়ের মরীচিকা। সেই সঙ্গে অঢেল বিরিয়ানির দোকান গজিয়ে উঠেছে। চালু হয়েছে আনলিমিটেডে প্রকল্প। যার ভিডিও করা হচ্ছে এবং যে ভিডিও করছে– দু’পক্ষই বেশ খুশি। খাবারের দোকানের প্রচার হয়ে যাচ্ছে এবং অপর দিকে যিনি ভিডিও করছেন তারও কিছু আয় হচ্ছে। সেই উপার্জনের জন্য কারওর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শক সেই ভিডিও দেখলে ফেসবুক, ইউটিউব টাকা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে একঘেয়ে চাকরি, দশটা-পাঁচটার জীবনে ফুড ভ্লগিং তো বাঙালির জীবনে হলুদ বসন্ত! একপেশে জীবনের দোটানায় না গিয়ে বাঙালি এখন মজেছে খাদ্যব্যবসায়। কারণ সে বুঝেছে, ফুড ভ্লগিংয়ের দৌলতে প্রচার তো হয়ে যাবেই এবং অন্যদিকে দশটা-পাঁচটার জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

নয়ের দশকের শেষ দিকে, পশ্চিমি দেশগুলোতে ফুড ব্লগিংয়ের অর্থ ছিল একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কোনও রেস্তোরাঁয় খাওয়ার স্মৃতি, পারিবারিক রেসিপি কিংবা শৈশবের স্বাদের গল্প। ২০০০-এর দশকের গোড়ায় এই প্রবণতা স্পষ্টভাবে আলাদা একটি ধারায় রূপ নেয়। বিশেষ করে ২০০২ সালে Julie Powell-এর ‘Julia Project’ ফুড ব্লগিংকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দেয়। যেখানে রান্না, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত জীবন একসঙ্গে মিশে যায়। ২০০৫ থেকে ২০১০ এই সময়টা ফুড ব্লগিংয়ের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। ডিজিটাল ক্যামেরা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে খাবারের ছবি লেখার সঙ্গে যুক্ত হয়। খাবার কেমন লাগছে, তার সঙ্গে সঙ্গে কেমন দেখাচ্ছে, এই ভিস্যুয়াল দিকটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এরপর ২০১০-এর পর ইউটিউবের উত্থান ফুড ভ্লগিংকে ভিডিওমুখী করে তোলে। এখানে শুধু খাবার নয়, খাবার খাওয়ার অভিব্যক্তি, ভাষা, হাসি-ঠাট্টা সব মিলিয়ে ফুড ভ্লগিং একটি বিনোদনমূলক ফরম্যাটে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিসর ছাড়িয়ে বাণিজ্যিক কনটেন্টের দিকে এগয়।

ভারতের ক্ষেত্রে ফুড ভ্লগিংয়ের সূচনা তুলনামূলকভাবে দেরিতে। ২০০৮-’১২ সালের মধ্যে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু ও কলকাতার কিছু শহুরে ব্লগাররা খাবার নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। এই পর্যায়ের ভারতীয় ফুড ভ্লগিং ছিল সীমিত। তবে ২০১৪-’১৬ সালের পর, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও ফুড ভ্লগিং দ্রুত জনপ্রিয় হয়। ইউটিউব ও ফেসবুকের হাত ধরে আঞ্চলিক ভাষায় খাবারের কনটেন্ট তৈরি শুরু হয়, যার ফলে ফুড ভ্লগিং শহুরে এলিট পরিসর ভেঙে সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছে যায়। এরপর ২০১৮-এর পর এবং বিশেষত কোভিড মহামারির সময়ে, ভারতীয় ফুড ভ্লগিং একেবারে গণসংস্কৃতিতে পরিণত হয়। ঘরে বসে রান্না, রাস্তার খাবার, ভাইরাল দোকান, কম বাজেটে খাওয়ার ভিডিও, এই সবই বিপুল দর্শক তৈরি করে। এই সময় থেকেই ফুড ভ্লগিং শুধু কনটেন্ট নয়, একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত হয়। ব্র্যান্ড প্রোমোশন, রেস্তোরাঁ মার্কেটিং, ক্লাউড কিচেন এবং চাকরি ছেড়ে খাদ্য-ব্যবসায় নামার স্বপ্ন এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

ফুড ভ্লগিং বাঙালিকে আকৃষ্ট করেছে কারণ বাঙালির সংস্কৃতির কেন্দ্রে বরাবরই আছে খাবার আর খাবার নিয়ে গল্প। ভাত-মাছ-ডাল দিয়ে শুরু করে বিরিয়ানি, কাবাব, চা-কাটলেট খাওয়াটা বাঙালির কাছে শুধু প্রয়োজন নয়, এক ধরনের আবেগ ও স্মৃতির বিষয়। আরেকটা বড় কারণ হল ভাষা ও ভঙ্গি। বাংলায় কথা বলা, স্থানীয় রসিকতা, খাবার নিয়ে আদুরে প্রতিক্রিয়া– এই সব মিলিয়ে বাঙালি ফুড ভ্লগিংকে নিজের সংস্কৃতির সম্প্রসারণ হিসেবেই গ্রহণ করেছে।

এই আকর্ষণ থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে আরেকটি প্রবণতা। খাদ্য-ব্যবসার দিকে ঝোঁক। ফুড ভ্লগিং বাঙালির চোখে খাদ্য ব্যবসাকে দৃশ্যমান ও সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। আগে ছোট খাবারের দোকান মানে ছিল সীমিত পরিসরের লেনদেন। এখন একটি ভ্লগ বা রিলই সেই দোকানকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে দিতে পারে। এই ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালিকে ভাবতে শিখিয়েছে, নিজের রান্না বা খাবারের ভাবনাকে পেশায় রূপান্তর করা যায় কি না। বিশেষ করে চাকরির অনিশ্চয়তা, কম বেতন বা দীর্ঘ কর্মঘণ্টার সঙ্গে তুলনা করে খাদ্য-ব্যবসা অনেকের কাছে স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ভ্লগিং খাবারকে শুধু পণ্য নয়, গল্প ও ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে। ‘ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’র তথ্য অনুযায়ী, ভারতের খাদ্য ও রেস্তোরাঁ শিল্পে বর্তমানে ৮৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ কর্মরত এবং এই সংখ্যা দ্রুত ১ কোটির দিকে এগচ্ছে। কোভিড পর্বের পর স্ট্রিট ফুড, ক্লাউড কিচেন ও ছোট খাবারের দোকানের সংখ্যা শহরাঞ্চলে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও ‘উদ্যম রেজিস্ট্রেশন’-এ নথিভুক্ত ক্ষুদ্র খাদ্য উদ্যোগের সংখ্যা ২০২০ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার বড় অংশই একক বা পারিবারিক উদ্যোগ। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত আসে শহুরে কর্মসংস্থানের পরিবর্তন থেকে। বিভিন্ন সমীক্ষা ও প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে– আইটি, কর্পোরেট অফিস, বেসরকারি পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে অনেকেই আংশিক বা পূর্ণভাবে খাবার সংক্রান্ত ব্যবসায় ঢুকছেন, ফুড স্টল, টিফিন সার্ভিস, হোম কিচেন বা ফুড ট্রাকের মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নতুন খাদ্য উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী, যারা আয়, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার আশায় বিকল্প পথ খুঁজছেন। ভ্লগিং খাদ্য ব্যবসাকে তুলনামূলকভাবে সহজ ও ঝুঁকিহীন বলে দেখাচ্ছে। ভ্লগের ফ্রেমে থাকে রান্না, খাওয়ার আনন্দ আর ভিড়ের আড়ালেই থেকে যায় লোকসান, লাইসেন্স, কাঁচামালের দাম, কর্মী সংকট বা ডেলিভারি অ্যাপের কমিশনের মতো কঠিন বাস্তবতা। এই অসম্পূর্ণ চিত্র অনেক চাকুরিজীবীর মনে বিভ্রম তৈরি করছে যে সামান্য মূলধন আর ভালো রান্না থাকলেই ব্যবসা দাঁড়িয়ে যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে খাবারের সঙ্গে ব্যক্তিগত গল্পের মেলবন্ধন। মায়ের শেখানো রেসিপি বা বাবার স্বপ্নের দোকানের গল্প খাবারকে আবেগী পণ্যে পরিণত করছে, যা বাঙালির গল্পপ্রিয় সংস্কৃতিতে সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ফলে রান্না কেবল দক্ষতা নয়, আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে ব্যবসার দিকে টানছে।

ফুড ব্লগিংয়ের দৌলতে গত কয়েক বছরে চাকুরিজীবী বাঙালির একাংশ খাদ্য-ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। কেউ ক্লাউড কিচেন, কেউ ছোট ক্যাফে, কেউ আবার স্ট্রিট ফুড স্টল খুলছেন। কিন্তু বাস্তব পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রবণতার সাফল্য-ব্যর্থতার অনুপাত বেশ খারাপ। খাদ্য ব্যবসা ও ক্লাউড কিচেন সেক্টরের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি রিপোর্ট মিলিয়ে দেখা যায়, নতুন ফুড ব্যবসার প্রায় ৫০-৬০ শতাংশই প্রথম এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে ছোট ও ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলির ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি। মোটামুটি ২০-৩০ শতাংশ ব্যবসা এগিয়ে যায়, যারা খরচের হিসাব, বাজার বোঝা, মান বজায় রাখা এবং ধীরে ধীরে সম্প্রসারণের পথে হাঁটে। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ হল, ফুড ব্লগিংয়ের জনপ্রিয়তা দেখে অনেকেই ভাবছেন ব্যবসা সহজ, অথচ বাস্তবে খাবারের গুণমান, স্বাস্থ্যবিধি, কাঁচামালের দাম, কর্মী খরচ, অনলাইন ডেলিভারি অ্যাপের ২৫-৩০ শতাংশ কমিশন। সব মিলিয়ে চাপ অনেক বেশি। ভ্লগিং থেকে পাওয়া লাইক ভিউ বা পরিচিতি বাজার ধরতে সাহায্য করলেও, তা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারে না। ফলে দেখা যাচ্ছে, ফুড ব্লগিং চাকুরিজীবী বাঙালিকে খাদ্য ব্যবসায় আনছে ঠিকই, কিন্তু সংখ্যার বিচারে যতজন সফল হচ্ছেন, তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ শেষ পর্যন্ত ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই বাস্তবতাই বলছে স্বপ্ন নয়, পরিকল্পনাই খাদ্য ব্যবসায় টিকে থাকার আসল শর্ত।

……………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন আদিত্য ঘোষ-এর অন্যান্য লেখা

……………………..