Robbar

পেট ‘ভোরে’ খান

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 18, 2025 5:10 pm
  • Updated:December 18, 2025 5:10 pm  

আমাদের দেশে ‘সাহেবি প্রাতরাশ’ অর্থাৎ ‘ব্রিটিশ ব্রেকফাস্ট’ বলতে যা বোঝায়, তা আমরা আসলে কেউ জানিই না। এই সুযোগে একটি শক্ত বাংলা শব্দ সার্ভ করি– ‘অভিযোজন’। আমরা একটা মেনু অ্যাডাপ্ট করেছি। সাহেবদের প্রতি আদেখলেপনা ও সমকালীন মনের ইন্ডিয়ান মাধুরী মিশিয়ে। ডিম-পাউরুটি বলে সেরে দিলে অনেকেই রে-রে করে উঠবেন!

শুভময় মিত্র

ধরে নিচ্ছি, আমাদের মতো নির্দোষ সুবিধেবাদী লোকদের কথা হচ্ছে– যারা সারাদিন আর যা-ই করুক বা না-করুক, রাতে ঘুময়। পাশে আর কেউ, নাকি পাশবালিশ, নাকি নিজের এক পায়ের সঙ্গে অন্যটা নিয়ে, সেটা জরুরি নয়। ‘রাতে ঘুময়’ বললে আবার অনেক কিছু বোঝায়। এক ঘুমে ফুল নিশি সাবড়ে দেয় কেউ। অখুশির ব্যাপার থাকলে উসখুস, এপাশ-ওপাশ। কারওর মিনি যামিনী। কারওর লং-প্লে। ঘুমনোর ঠিক আগের মুহূর্তে, ঘুমের মধ্যে বা ঘুম ভেঙে গেলে অথবা আর ঘুমিয়ে লাভ নেই বলে যেসব কারণে অনেকে উঠে পড়ে, তার অন্যতম কারণ ঘুমের আগে কী খাওয়া হয়েছে। রাতের খাবার হল টানা নাইট ড্রাইভের ফুয়েল। শয়নে-স্বপনে অনেকে ভাবে– ঘুম ফুরলে খাবে কী? তাহলে মোটামুটি বোঝা গেল যে, আদরের ডিনার না-পেলেও রাতে আমরা আর যাই করি, উপবাস করি না।

অনেকেরই ব্রেকফাস্ট চা-বিস্কুট

এবারে তৃতীয় প্রসঙ্গ। সারাক্ষণ পটরপটর করে বাজে ইংরেজি বললেও আদতে শব্দগুলো যে মাইক্রো-হার্ড ওয়ার্ডস, সেটা ভুলে যাই। অনেক ইংরেজি শব্দের কোনও মানে হয় না। এই যেমন ফাস্ট, উপবাস– যা ভাঙার কথা হচ্ছিল। তার আগে ব্রেক। এক রাতের অনাহারের অভিজ্ঞতাকে প্রতি সকালে ভেঙে ফেলা, ব্যাপারটা কি সেরকম কিছু? আসলে যাদের বানানো শব্দ, তারা তো খেতেই শেখেনি। আমাদের সঙ্গদোষে সেই ব্রিটিশগুলো হালে কাঁড়ি কাঁড়ি কারি খাচ্ছে। সাম্প্রতিক কিছু কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও বাঙালির সকালের জলখাবারের ইতিহাসের পাতায় কোনও স্টেইন আছে বলে মনে হয় না।

ফ্লুরিজের ব্রেকফাস্ট

‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজ’ সিনেমার নামটা মনে ধরায় কলকাতার ফান্টুস উচ্চবিত্ত সকালের মর্নিং ওয়াক সেরে পার্ক স্ট্রিটের ফ্লুরিস-এ হাজির হয়ে চলেছে অনেক দিন ধরে। ওই সিনেমাতে দেখা ‘টিফানিজ’ কি ‘পুঁটিরাম’ বা ‘সুফিয়া’র মতো মহার্ঘ ভোজনালয়? যেখানে সূর্যোদয়ের আবেগে উদরস্কেপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে? ১৯৬১ সালের ওই হলিউডি বায়োস্কোপে শুধু একটা কফি খাওয়ার দৃশ্য মনে পড়ছে। সবার যেটা মনে আছে, তা হল ‘লবঙ্গ লতিকা’ অড্রে হেপবার্নকে। হতে পারে যে, সেই নারীর রূপদর্শনেই কারও-র প্রাতের আশ মিটে যায়। বোঝা দায়, দিনের শুরুতেই গুচ্ছের খরচ করে কোলকাত্তাই টিফানিজে নেহাতই সাদামাটা, একটু দামড়া ওমলেট ও ব্রেড খেয়ে কী লাভ?

সিনেমার কথা তুলে ফেলেছি। তাহলে ‘জন অরণ্য’-তে, আলোচ্য সেই দোকানে নটবর মিত্তিরের ‘পুরু করে বানানো ওমলেট’ অর্ডার দেওয়ার অবিস্মরণীয় দৃশ্য ভুলি কী করে? সময়টা নিশ্চয়ই সকালের ছিল না। ঘুম সেরে বিলেতে কে কী খায়, জানি না। আমাদের দেশে ‘সাহেবি প্রাতরাশ’ অর্থাৎ ‘ব্রিটিশ ব্রেকফাস্ট’ বলতে যা বোঝায়, তা আমরা আসলে কেউ জানিই না। এই সুযোগে একটি শক্ত বাংলা শব্দ সার্ভ করি– ‘অভিযোজন’। আমরা একটা মেনু অ্যাডাপ্ট করেছি। সাহেবদের প্রতি আদেখলেপনা ও সমকালীন মনের ইন্ডিয়ান মাধুরী মিশিয়ে। ডিম-পাউরুটি বলে সেরে দিলে অনেকেই রে-রে করে উঠবেন! ওকে, প্রথমত বেশ বনেদি, বড়োলোকমার্কা আবহ হতে হবে। কাচের প্লেট, কাঁটা, ছুরি, চামচ। নুন মরিচদানি। মুখ মোছার ন্যাপকিন থাকবে। প্লেটে গড়াগড়ি খাবে সসেজ, বেকন, সালামি, চিপস। টি-পটে পাতা চা। লোপচু অরেঞ্জ পিকো বা মকাইবাড়ি। ওগুলো ছাড়া ব্যাপারটা কাঞ্চনজঙ্ঘাহীন দার্জিলিং হয়ে যাবে। আবার সিনেমা! দার্জিলিঙের কেভেন্টার্সের টেরাসে অনিল চ্যাটার্জির সানগ্লাসে প্রতিফলিত হওয়া মেয়েটিকে সে যে তার ব্রেকফাস্টে অন্তর্গত করতে চায়, মানিক রায় নির্ঘাত সেটিই মিন করেছিলেন। প্রাতরাশের সময় সত্যজিতের বর্ণিত নেটিভ চরিত্র মনে পড়ে? ঘুম চটকে যাওয়া ভৈরবীতে রেগে যাওয়া রাজা যখন গুপিকে গ্রাম থেকে গাধার পিঠে ছড়িয়ে বের করে দিলেন তখন তিনি ব্রেকফাস্ট সারছিলেন। বিরাট জামবাটি, প্রকাণ্ড বিগমাউথ, সারা মুখে মাখিয়ে দুধ খাচ্ছিলেন তিনি।

বেনারস। কচৌরি গলি। ঋণ: ইন্টারনেট

সকালের খাবার যে সকালেই খেতে হবে, তা কিন্তু নয়। বেনারসে গেলে সকাল হতেই নিজের পেটের মধ্যে ঘণ্টা-শঙ্খধ্বনি শুনে আমরা দৌড়োই কচৌরি গলির দিকে। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলে, মূল ব্যাপার ‘কচুরি’ নয়। শিল্পবিপ্লব ঝোলে ডোবা আলুর তরকারিতে। কয়েকশো গজের মধ্যে তাদের চরিত্র বদলে যায়। উদাহরণ দি’। গঙ্গাকে পিছনে ফেলে রেখে কেদার ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে উঠে প্রাচীন অট্টালিকার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা এক রহস্যময় গলির শেষে বাঙালি টোলার রাস্তায় পৌঁছে যেখানে ধাক্কা লাগে, সেখানকার তরকারিতে রেষারেষি করে আলু ও সয়াবিন। একেবারে আলাদা স্বাদ। সেই দোকানে এবং অন্যত্র উৎকৃষ্ট ধোসা, ইডলি, উত্তাপম খোদ ম্যাড্রাসকে মুশকিলে ফেলে দিতে পারে। কলকাতায় আমরা ভাবতে পারি না। কিন্তু বিশ্বনাথ গলিতে ঢুকে প্রথম ডান দিকে ঘুরলেই এক অপরূপ আর্কটিক চেহারার দইবড়া ভাসতে দেখা যায়। এরপর কয়েক পা পিছিয়ে গেলেই রাবড়ি। দিনে বা রাতে এগুলি আত্মস্থ না করলে পাপ লেগে যেতে পারে।

এক পরিচিত যুগপুরুষের পরামর্শ মেনে একবার ভোরবেলা কচুরি দিয়ে রাবড়ি খেয়ে আমার ব্রহ্মজ্ঞান জেগে উঠেছিল। তাই বলে ফ্যাশনেবল বিদ্রোহী সেজে গোধুলিয়াতে সকালে ভাং শরবত খেয়ে ফেলাটা বাঞ্ছনীয় নয়। কেরলের কোচিতে ব্রেকফাস্টে কলা, গুড়ের পাক দেওয়া এক অপরূপ মিষ্টি খেয়েছিলাম। তার নাম ‘পালাম নুড়ুক্কু’। কানপুরের বিখ্যাত জিলিপির বৈশিষ্ট্য হল– তার মেকিং। এক সুইপে কড়া ভর্তি ঘি-তে অন্তত ৫০টিকে জুড়ে থাকা অবস্থায় ভেজে একটিমাত্র কাঠি দিয়ে লিফ্ট করে, একটিও না ভেঙে বাসন্তী রসে চুবিয়ে দেওয়া হয়। এমন বৈচিত্রময় দেশে ঘুম থেকে উঠে ন্যাসপাতির মতো মুখ করে কিছু ফ্রুটস সাজিয়ে বসে থাকাকে ওয়েস্টার্ন উৎকর্ষ লাইফ-স্টাইল ভাবার কারণ দেখি না।

পালাম নুড়ুক্কু

পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রাতরাশ নিয়ে ফর্দ রচনার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। শুধু একটি শোনা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। বাঁকুড়াতে নাকি সকাল ন’টা নাগাদ সর্বত্র কিছুক্ষণের জন্য সাইরেনের মতো একটা শব্দ শোনা যায়। কাজে বেরনোর আগে খাবার মুড়িতে জল বা দুধ ফেলার ফল। আসলে দিনের শুরুতে লোকে কী খাচ্ছে, সেটা জরুরি নয়। কোন পরিস্থিতে খাচ্ছে, সেটি লক্ষণীয়। তখন আর কী ঘটছে, সেসব ইম্পরট্যান্ট। কলকাতার রবীন্দ্র সরোবরের কাছে পর পর দু’টি দোকানে সকাল থেকেই শিঙাড়া-কচুরি-জিলিপির জন্য লাইন পড়ে। আমি নজর করেছি, এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই স্নিকার, হেডফোন, হাফপ্যান্ট পরে জগিং করে মেদ ঝরিয়ে, ক্যালোরি পুড়িয়ে ক্লান্ত অবস্থায় পৌঁছে যান মনের রিচার্জ করতে। আবার আমাদের বাড়ির কাছে অতি সাধারণ এক মিষ্টির দোকানে, যেখানে কেউ কোনও মিষ্টি খায় না, অথচ রাতে, দোকান বন্ধের আগে কেউ কেউ হিমশীতল রাধাবল্লভী দিয়ে রাতের প্রাতরাশ সেরে ফেলেন।

আলোচনায় ঘুরে ফিরে উত্তর ভারত-গন্ধী ভাজা খাবারের দিকে আমরা ঢলে পড়ছি। কারণ বাজেটের মধ্যে পেট ও মন ভরানো ওই চিজগুলির পরে ঝাঁজরিওয়ালা প্লাস্টিকের জাগ থেকে কয়েক পেগ জল খেয়ে ফেললে ইনস্ট্যান্ট অম্বল শক্তির দাপটে দেহ-যান দুপুর পার করে দিতে পারে। এই বক্রোক্তি মোটেই খাবারের উদ্দেশে নয়। বড়বাজারের কাপড়পট্টির গলিতে ফুটপাথের ধারে, দেওয়ালে অর্ধ-ঝুলন্ত এক দোকানে সারা বছর পাওয়া যায় কড়াইশুঁটির কচুরি। রীতিমতো সস্তায়। অবাঙালিদের নিয়ে কটু কথা বলা আমাদের অভ্যেস। সন্দেহ প্রকাশ করায় এই দোকানের সৎ মালিক আমাকে জানিয়েছিলেন, ওঁরা ছাতুর সঙ্গে সবুজ রং মিশিয়ে পুরটি তৈরি করেন। সারা বছর স্বাদে অবিচল থাকে সেই বস্তু। টেরিটি বাজারের চাইনিজ ব্রেকফাস্ট অথবা বছরের বিশেষ একটি সময়ে জ্যাকারিয়া স্ট্রিটে কাকপক্ষীর আগে পৌঁছে গেলে যে মহার্ঘ বস্তুগুলি পাওয়া যায়, সেসব নিয়ে আমার নতুন করে কী আর বলার আছে। ইউটিউবের কল্যাণে একক্লিকেই চোখের উপযোগী চাকুম ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার করে ফেলা সম্ভব। এখানে ব্লগারদের কল্যাণে অনেক আশ্চর্য আবিষ্কারের খবর পেয়েছি। কাচের বাক্সে ভরা চাপাচাপি করা লুচি ও গা-মাখা গা-মাখা লাল আলুর দম সবাই দেখেছেন। সেটি তৈরি হয় হাজারে হাজারে, প্রত্যেক দিন, কলকাতার কাছে কয়েকটি গ্রামে। পারলে জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে পারেন।

সুফিয়ার বিফ নিহারি

শুধুমাত্র প্রাতরাশের জন্য অনেক কিছুই গণ-উৎপাদন হয় বিশেষ বিশেষ জায়গায়। একটি আমার নিজের দেখা। এখনকার খবর জানি না, কিন্তু অনেক দিন আগে উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে এক আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়েছিল। গভীর রাতে। সে সময় প্রায়ই হোল নাইট আড্ডা মারতাম এক বন্ধুর বাড়িতে। প্রহরে প্রহরে রাস্তায় বেরতাম রাতের হাওয়া খেতে। ঘুরে বেড়াতাম এ-গলি সে-গলিতে। সেই সময় দেখতে পাই এক জায়গায় একটু আলো। বেশ ভিড়। দোতলা খুপরি দোকান। ওপরে পান-সিগারেট। এখন বন্ধ। তলার চেম্বার খুলে গিয়েছে রাতে। শুনলাম সারারাত ভাজাভুজি চলতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের নিরামিষ চপ। ঘন ম্যাজেন্টা রঙের পুর ভরা ভেজিটেবল চপ তৈরি হয় সবথেকে বেশি। এত রাতে লোকে না ঘুমিয়ে চপ খায়? না। হোলসেলে কিনে নিয়ে বিক্রি করা হয় ভোরের ট্রেনে, বাসে। ব্যাপারটা জরুরি কারণ, কার কাছে কখন সকাল, কখনই বা প্রাতরাশের সময়, তা কেউ জানে না। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, রাত ফুরনোর আগেই খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। মনে আছে নিশ্চয়ই, আরও পথ আরও পথ বুঝি হয় লাল পূর্বকোণ।

কলকাতার গলিকথার ‘শো-স্টপার’: কচুরি

প্রভাতি পাত্রে আমরা সাধারণত আমিষ খাই না। ব্যতিক্রম আছে। খুব ভোরের বাস ধরে ঢাকা থেকে কোথাও একটা যাচ্ছিলাম। ছাদে মাল তোলার সময় অনুভব করলাম বঙ্গবিশ্বচরাচর এক অদ্ভুত সুগন্ধে মাতোয়ারা। দেখি নিচে, দোকানের বিশাল চাটুতে কীসব চলছে। তন্দ্রাজড়ানো চোখে অনেকে পরোটার মতো কিছু একটা ডুবিয়ে বৃহৎ মাংসের ঝোল সাবড়ে চলেছেন অম্লানবদনে। ইন্ডিয়ান বেঙ্গলের ব্যাপার আলাদা। ওয়েস্টার্ন খাবারের সঙ্গে দেশির অসামান্য এক কম্বিনেশনের ভক্ত আমরা প্রায় প্রত্যেকে। প্রথমে পাউরুটি। পাউরুটির পাও তো পর্তুগিজ। রুটি হল আমাদের রুটি। শব্দটির সঙ্গে কী অনায়াসে জড়িয়ে থাকে রুজির সম্পর্ক।

ভাত, নুডলস, পাস্তা নয়, রুটিই এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে দুনিয়াকে। তাদের রকমফের আলাদা। কথা হচ্ছে, যখন তাহলে মুড়িকে ডেকে নিই। সিম্পল বাংলার এক প্রোপ্রাইটরি খাবার। উইকি বাংলার বর্ণনা শুনুন। ‘এটি ঐতিহ্যগত স্ফীত চাল, যা মুড়ি নামেই পরিচিত। চালের অন্তর্বীজ গরম করে বাষ্প উপস্থিতিতে উচ্চ চাপের সাহায্যে মুড়ি তৈরি করা হয়।’ সেই মুড়ি বা পাউরুটির সঙ্গে পার্টনার ইন ক্রাইম হল ঘুগনি। উচ্চবিত্তের দরাজ হাতে প্রদত্ত নারকেল বিছোনো টাইট, একটু ড্ৰাই ঘুগনি নয়। এ হল সেই বস্তু যার গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রসম ফিকে হলুদ ঝোলের মধ্যে কোনও এক অন্তঃসলিলা স্রোতে অবিচল থাকে সুসিদ্ধ মটরদানারা। একটু পেঁয়াজ-লঙ্কাকুচি তার আপাত নিরীহ চাক্ষিক অবয়বকে অচিরেই অন্য মাত্রায় উন্নীত করে। এর ওপরে কিঞ্চিৎ ভাজা মশলা, পাতিলেবুর রস ও ধনে পাতার উষ্ণীষ নিতান্ত সাধারণ মানুষকেও বানিয়ে দেয় পাঁচ মিনিটের মহারাজা। আমার মতে, ওয়েস্ট মিটস ইস্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। রবিশঙ্কর, জুবিন মেহতা শুনতে শুনতে অল্প সেঁকা গোলামাথা লম্বা দেশি পাউরুটি আর ঘুগনি খেলে আপনারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন। আমি ঈর্ষা করি আমার পরিচিত কিছু মানুষকে। তাদের জীবনে কোনও দৌড় নেই। রাতে নেই। প্রাতেও কোনও রাশ নেই। সকাল থেকেই তাঁদের মুখ চলতে শুরু করে। সারাক্ষণ সুখের জাবর কেটে চলেন অম্লানবদনে।

পাউরুটির সঙ্গে পার্টনার ইন ক্রাইম হল ঘুগনি

প্রাতরাশকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের বাঁধন প্রায় চুরমার হয়ে যাওয়া পরিস্থিতির একটা ঘটনাবলি, পাত্র-পাত্রীদের পরিচয় গোপন রেখে। অবভিয়াসলি! একটু প্রাচীন মনোভাবাপন্ন বাড়ি। ঘোরতর পশ্চিমবঙ্গীয়। বিয়ে মিটে গিয়েছে। ফুলশয্যা সুসম্পন্ন হয়েছে ধরে নিতে অসুবিধে নেই। সুদীর্ঘ বিবাহ প্রক্রিয়ায় রণক্লান্ত সবাই নিদ্রামগ্ন। নতুন বর ভোর রাতে খাট হাঁকড়ে খেয়াল করেন সদ্য-বিবাহিত স্ত্রী পাশে নেই। বিখ্যাত রহস্য-রোমাঞ্চ আতঙ্ক কাহিনির স্রষ্টা রোয়াল্ড ডাহলের ভাষায়, ‘টিপটোয়িং অ্যাক্রস দ্য রুম’, স্বামী অন্ধকারে বউ খুঁজতে উদ্যত হন। একটা ক্ষীণ কুচুরমুচুর শব্দ পেয়ে পাশের ঘরে পৌঁছে দেখেন স্ত্রী কী যেন খাচ্ছেন। চানাচুর। ছি ছি, নতুন বউ ভোরবেলা চানাচুর খাচ্ছে? জানাজানি হলে বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে। চরম পরিস্থিতির কথা ভেবে, পরম প্রেমে, নরম বাক্যে এর কারণ জানতে চেয়ে উত্তর পান, ‘সঙ্গে নিয়ে এসেছি, আমরা তো রোজ সকালে চ্যানাচুর খাই।’

……………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন শুভময় মিত্র-র অন্যান্য লেখা

……………………..