Robbar

হারাচ্ছে খেজুর গুড়ের স্বাদ, মিশছে ভেজাল সংস্কৃতি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 2, 2025 12:52 pm
  • Updated:December 2, 2025 12:52 pm  

এক কলসি গুড় তৈরি করতে একটি শিউলি পরিবারের যে সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয় তার ন্যূনতম মূল্য তাদের হাতে আসে না। কারণ মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণির কৌশল ও মুনাফা লাভের চতুরতার কাছে শিউলিরা পরাজিত। সস্তার চিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যেতে বসেছে গুড়শিল্প। টিকে থাকার লড়াইয়ে খাঁটি গুড়ে মিশেছে ভেজাল সংস্কৃতি। এখন গ্রামবাংলার নানা প্রান্তে গুড়ের শালে দেখা যায় বড় বড় আয়তাকার ধাতব পাত্রে রস থেকে গুড় জ্বাল দেওয়ার চিত্র। সেই সব রসের মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ।

সৃজা মণ্ডল

সাল ১৯০২। জানুয়ারি। স্বামী বিবেকানন্দ তখন বুদ্ধগয়ায়। সঙ্গে জাপানি পণ্ডিত ও শিল্প সমালোচক ওকাকুরা, মার্কিন ভক্ত মিস ম্যাকলাউড, স্বামীজির শিষ্য স্বামী নির্ভয়ানন্দ এবং দুই সেবক নেদা ও নরেশচন্দ্র ঘোষ। সেখানে এক বাঙালি ভদ্রলোক স্বামীজির সঙ্গে প্রতিদিন দেখা করতে আসতেন, সঙ্গে আনতেন এক কলসি তালের রস ও এক কলসি খেজুর রস। কলসি ভর্তি খেজুর রস দেখে উৎফুল্ল বিবেকানন্দ একদিন বললেন, রোজ অত খেজুর রস আসে, নষ্ট হয়, এক কাজ করো– আজ খেজুর রসের জলে ভাত রাঁধো। রান্না হল সেইভাবে। আর সকলের সঙ্গে তিনিও খেলেন। প্রতিদিনের সাধারণ ভাতের সঙ্গে খেজুর রসের এই অসাধারণ যুগলবন্দি ঘটিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।

পুরনো দিনে পল্লিবাংলায় ছিল শীতের সকালে বাড়িতে বাড়িতে জাউভাতের সঙ্গে সদ্য জ্বাল দেওয়া ঘন খেজুর রসের আহ্বান। রানী চন্দের স্মৃতিকথায় পাই পূর্ববঙ্গে তাঁর মায়ের বাপের বাড়ির কথা– ‘সকালবেলা এক মামী রান্নাঘরে ঢুকে বাসী কলসির জল ফেলে নতুন জল তুলে উনুন ধরিয়ে এক হাঁড়ি ভাত বসিয়ে দেন সব কাজের আগে। ক্ষেতের চাল– সুগন্ধি চাল; চাল ফুটতে না ফুটতে সৌরভ ছড়ায়। দিদিমা এ গাছ-ওগাছ থেকে বেগুনটা ঢেঁড়সটা, লতা-আলুটি ছিঁড়ে আলু কয়েকটা তুলে দেন ভাতে দিতে। সঙ্গে থাকে সরের গাওয়া ঘি। ছোট-বড় সকলে এই গলা ভাত খেয়ে ঠান্ডা হয়ে যে যার মতো কাজে হাত দেয়। জাউভাতের সঙ্গে সদ্য জ্বাল দেওয়া ঘন খেজুর রস– অমৃত। সুরভিত রস, সুবাসিত চাল– দুই মিলিয়ে এক প্রাণমাতানো সম্ভার।’ বাঙালির আদি অকৃত্রিম হিমযাপনের সঙ্গী এই সুমিষ্ট খেজুর রস, নলেন ও খেজুর গুড়, মোয়া আর নানা রকম সুস্বাদু পিঠেপুলি।

শীতের খেজুর রস আসে শিউলিদের হাত ধরে। শিউলি– বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, আলপথে হেঁটে চলা এক প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ– যাঁরা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে, মেজাজি শীতকে অগ্রাহ্য করে জীবিকার তাগিদে বেরিয়ে পড়েন খেজুর গাছের সন্ধানে, কঠোর শ্রমে সযত্নে লালন করেন সেই গাছ আর সংগ্রহ করেন অমৃতরস। এই অন্ত্যজ শিউলিদের এক বিচিত্র পরিযায়ী জীবন। উত্তরের শীতের দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা যেমন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উড়ে আসে আর শীতের শেষে আবার ফিরে যায় তাদের শীতের দেশে, ঠিক তেমনভাবেই বেশিরভাগ শিউলিরা বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন প্রান্তে খেজুর গাছ সন্ধানে। নিজস্ব গাছ নয়, অপরের গাছ কেটে তাঁদের চিরায়ত পেশাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন বাঁচার তাগিদে। নদীয়ার দেবগ্রাম, কালীগঞ্জ, ধুবুলিয়া, তেহট্ট থেকে শিউলিরা নভেম্বর মাসে শীতের শুরুতেই ঘাঁটি গাড়েন কেতুগ্রাম ও গঙ্গাটিকুরির আশপাশের গ্রামে। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি, গোয়ালতোড়, গুড়গুড়িপাল, চাঁদড়ার মতো নানা গ্রামে উঁকি দিলেই দেখা যায় কেউ খেজুর গাছে উঠে হাঁড়ি বাঁধতে ব্যস্ত, কেউ আবার বড় কড়াইয়ে ফুটতে থাকা রসের তদারকি করছেন। প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরে পৌঁছে যান শিউলিরা। কেউ আসেন বাঁকুড়া থেকে, কেউ পূর্ব মেদিনীপুর থেকে।

শিউলিরা প্রথমেই চেষ্টা করেন, যার হাতে যতগুলো গাছ আছে, সেগুলোকে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করতে।‌ কার্তিক মাস পড়তেই শুরু হয়ে যায় ‘ছাড়ান পর্ব’ অর্থাৎ গাছের পাতা কেটে পরিষ্কার করা। তারপর রস নির্গমনের জায়গার ছাল তোলা হয়, যাকে বলে ‘চাঁচা’, এরপর ‘ঘাটিমারা’– চাঁচা জায়গাটার মাঝখানে একটা গর্ত করে খেজুর পাতার জিভ তৈরি করা হয়। এরপর শুরু হয় ‘লাগান’ পর্ব, অর্থাৎ রস ঝরতে থাকলে একটা আংটা করে ঠিলি ঝোলানোর কাজ। তারপর মাঝে মাঝে চলে ‘শুকান’ পর্ব। ‘শুকান’ পর্বের পর বের হয় ‘শুকান কাঠের রস’, তার চাহিদা খুব। সাধারণত গাছ মালিকরা এই রস দাবি করে থাকেন।

একটা খেজুর গাছ তিনবার কাটার পর তাতে নলি লাগিয়ে রসের জন্য হাঁড়ি পাতা হয়। অনেকেই বলেন, এই নল থেকেই নলেন গুড়ের নামকরণ। আবার অনেক গুড় সংগ্রাহকদের মতে, প্রথম রাতে যে রস পাওয়া যায়, তার মান উৎকৃষ্ট, একে বলে ‘নলিয়ান’ বা ‘নলেন’। অনেকে মনে করেন ব্রজবুলিতে ‘নওল’ থেকে নলেন শব্দটি এসেছে। রঙের জন্য একে ‘লালি গুড়’-ও বলেন অনেকে। নলেনের আগেও পাওয়া যায় ‘পয়ার গুড়’। এই গুড় গুণমানে শ্রেষ্ঠ হলেও, উৎপন্ন হয় কম। নলেনের পরের কাট থেকে আসে ‘পরনলিয়ান’। এরপরেও পাওয়া যায় ‘ঝরা রস’। এই রস জোলো। একটা খেজুর গাছ থেকে দিনে দু’বার রস পাওয়া যায়। ভোরের রসকে ‘জিরেন’ এবং বিকেলের রসকে ‘ওলা’ বলে। একবার কাটার পর পরপর তিনদিন রস পাওয়া যায়। দ্বিতীয় দিনেরটাকে ‘দোকাট’ এবং তৃতীয় দিনেরটাকে বলা হয় ‘তেকাট’। তিনদিন রস সংগ্রহের পর চার-পাঁচদিনের বিরতি। পৌষ মাসে পুরোদমে রস পাওয়ার পর মাঘ থেকে রস কমতে শুরু করে। ওই সময়ে বাড়ে রসের ঘনত্ব। গাছকাটার পর প্রথম দিকের রসে গুড় ভালো হয়। শিউলিদের মতে, ওই সময়ে খেজুর গাছের ধারে দাঁড়ালে সুগন্ধে চারধার ম-ম করে। তারপর সংগৃহীত রস ছেঁকে বড় পাত্রে রাখা হয়। রসের অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে শুদ্ধিকরণ করে তৈরি হয় তরল সোনা।

এক সময় শীতকালে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে সারা বছরের জন্য গুড়ও তৈরি হত বাড়িতেই। গাছ থেকে নামানো রস জ্বাল দেওয়া হত লোহার কড়ায়। বিরাট উঠোনের ধারে বসানো থাকত ‘দো-আখা’ উনুন– দু’মুখে আগুন ওঠে একই জ্বালানি থেকে। খেজুর গাছের শুকনো ডালপালা, ধানের তুষ, খেতে ধান কাটার পরে অবশিষ্ট ধান গাছের গোড়া, কাঠকুটো ঠেলে দেওয়া চলত দো-আখায়। গ্রামবাংলায় শীত পড়লেই বিভিন্ন সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে খেজুর গাছ কাটতে হাজির হত ধরা-বাঁধা গাছি বা শিউলিরা। পরনে মালকোঁচা ছোট লুঙ্গি বা গামছা, তার ওপরে দড়ি দিয়ে বাঁধা পাটের ছোট বস্তা ‘জোত’, মাথায় গামছা। কোমরে বাঁধা বাঁশের হুকে ঝোলানো ‘গলাস’ সহ ‘ডাবরি’ বা ভাঁড়। দু’পায়ে ‘পাউটা’ দড়িসড়পা লাগিয়ে শিউলিরা গাছ বেয়ে উঠে যায় ওপরে। একটানা কড়া শীত পড়লে শিউলিরা আসে রাতের অন্ধকারে। বাড়ির সবাই শুকনো কাঠি-পাতার আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিতে বসে খেজুর গাছের নিচে, কোলে থাকে কাঁসার বাটি- গ্লাস। শিউলিরা গাছে উঠে এক-একটা রসের হাঁড়ি নামিয়ে সবার হাতে ধরা পাত্রে রস ঢেলে দেয়। ভোরের আবছা আলোয় কাঁপন ধরা ঠান্ডায় সেই রস পানের অনুভূতি ছিল স্বর্গীয়। মাটির কলসি কলসি ভাগের রস সেই সকালেই চলে আসত। বাড়ির রস অর্ধেক গৃহস্থের, অর্ধেক শিউলির– এমনই ছিল সেকালের হিসেব।

কেতাবি ঢঙে নয়, নিজস্ব অভিজ্ঞতায় গাছ মুড়া দিয়ে, চাঁচ দিয়ে, নলি দিয়ে, গোঁজ পুঁতে, ভাঁড় পেতে ঠিলি বোঝাই রস বাঙ্গিতে ঝুলিয়ে শিউলিরা বয়ে নিয়ে আসে বাড়িতে। তারপর সেই তরল রস জ্বাল দিয়ে ঘন পাটালিগুড়ে তৈরি করার ভার ঘরের মেয়েদের ওপর। রসকে জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর কাজও শুরু করতে হয় ঊষালগ্নে। বেলা হলেই গুড় লাল হয়ে যায়। ফলে স্বাদ নষ্ট হতে শুরু করে। কড়াইয়ে গাছ রস ঢেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে জ্বাল দেওয়ার পর্ব। জলের মতো স্বচ্ছ রসে রং ধরানো ধৈর্যের পরীক্ষা। বেশি জ্বালে অনেক সময়ে গুড় কালচে ও তিতকুটে হয়ে যায়। তাই গুড় তৈরির জন্য জ্বাল দেওয়ার মাঝে মাঝে লোহার মস্ত ছাঁকনি দিয়ে ‘গাদ’ তুলে ফেলতে হয়। ‘গাদ’ ফেলতেই চোখে পড়ে, পোড়া বাদামি লালচে রঙের পাকানো গুড়। কড়াই থেকে নতুন গুড়ের মিষ্টি গন্ধে মাতোয়ারা হয় বাতাস। এক কড়াই রস থেকে প্রায় দশ কেজি গুড় তৈরি হয়। তবে অমৃতস্য গুড়ের আসল চাবিকাঠি নিম কাঠ, বেল কাঠ ও আম কাঠ– যা দিয়ে রস জ্বাল দিলে গুড় অত্যন্ত মিষ্টি ও সুবাসিত হয়। তারপর ‘ওরাং’ বা উড়কিমালার সাহায্যে সেই গুড় রাখা হয় আলাদা আলাদা মাটির হাঁড়ি বা বড় বড় ভাঁড়ে। এরপর ‘ভাদালি’ বা সাদা কাপড়ের ওপর নির্দিষ্ট মাপে গুড় জমিয়ে ঠান্ডা করে তৈরি  হয় পাটালি।

সোনার মতো রঙের নলেন বা পাটালি হলে, সবার আনন্দ আর পরিশ্রম সার্থক। আগে খেজুর রস থেকে গুড় করা ছিল রীতিমতো পারিবারিক উদ্‌যাপন, সেই কাজে বাড়ির মেয়ে-বউদের সোৎসাহ অংশগ্রহণ। রস জ্বাল দিতে দিতে ঘন হয়ে এলে তাতে নারকেল কোরা মিশিয়ে নাড়া হত। তারপরে নারকেল মালার হাতায় করে মাটির ছাঁচে ঢালা হত গরম ঘন রস। ঠান্ডা হয়ে জমাট বাঁধলে ছাঁচ থেকে সাবধানে বের করে নেওয়া হত নারকেলি পাটালি। ক্ষীর মিশিয়ে ক্ষীর পাটালি। এলাচ-কর্পূর দিয়েও শৌখিন গুড়। সুপুরি গাছের পাতার খোলে শুধু রস ঢেলে হত মুছি গুড়।

গাছ থেকে রস, রস থেকে গুড় এবং সেই গুড় বিক্রি করে রোজগার করার নেপথ্যে কী নিদারুণ পরিশ্রম, বাস্তব জ্ঞান, দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রয়োজন, তার সাক্ষ্য রয়েছে নরেন্দ্রনাথ মিত্র-এর লেখা ‘রস’ গল্পে– ‘কেবল খাটতে জানলেই হয় না, গাছে উঠতে-নামতে জানলেই হয় না, গুণ থাকা চাই হাতের। যে ধারালো ছ্যান একটু চামড়ায় লাগলেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে মানুষের গা থেকে, হাতের গুণে সেই ছ্যানের ছোঁয়ায় খেজুর গাছের ভিতর থেকে মিষ্টি রস চুঁইয়ে পড়ে।’

নিতান্ত অনাদরে বেড়ে ওঠা খেজুর গাছ নলেন গুড়ের আঁতুড়। নগরায়ন ও উন্নয়নের জোয়ারে কমছে খেজুর গাছ। কখনও রাস্তা তৈরিতে তার ঘাড়ে কোপ পড়ে, কখনও ইটভাটার আঁচ জ্বালতে। কয়েক বছর আগেও নদিয়ার চর শম্ভুনগর বা নতুন শম্ভুনগরে খেজুরের বন ছিল। গ্রামে পাকা রাস্তার জন্য সেসব নিশ্চিহ্ন। চূর্ণী, মাথাভাঙা, ইছামতী আর অসংখ্য বিল-বাঁওড়ে ঘেরা মাজদিয়া, আদিত্যপুর, বার্নপুর, গেদে, ফতেপুর, ছুটিপুর, ভাজনঘাট, মাটিয়ারির বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনও এ-বঙ্গে নলেন গুড়ের প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে গাছের সংখ্যা অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। নতুন করে খেজুর গাছ লাগানো হচ্ছে না। এছাড়া দামও বেড়েছে– প্রতি কেজি ৪০-৫০ টাকা, যেখানে এক সময় কেজি প্রতি কাঁচা রস ৫ টাকায় বিক্রি হত। এখন ঘন রসের দাম ২৫০-৩০০ টাকা। তাই রস জোগাবে কে?

আগে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ থেকেই নতুন গুড়, চাল গুঁড়ি দিয়ে পিঠে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল গ্রামের ঘরে ঘরে। নতুন গুড়ের গন্ধে সুবাসিত হত চারদিক। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে শীতের আয়ু হয়েছে ক্ষীণ। অথচ যত শীত পড়বে, রসের স্বাদ হবে তত ভালো। আবার সংগতও চাই পশমি রোদের। মেঘলা হলে রসে টক ভাব আসে। তাই আকাশে মেঘ জমলেও মুশকিল, ভালো গুড় পাওয়া যাবে না।

এছাড়াও খেজুর রস ফোটাতে প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন। আগে আশপাশের জঙ্গল, ঝোপঝাড় কেটে সংগ্রহ করা হত জ্বালানি, এখন সেই জঙ্গলও নেই। জ্বালানির জন্য খরচ করে তৈরি গুড় বিক্রি করেও লাভ হচ্ছে না। তাই খেজুর গাছ থাকলেও রস সংগ্রহের শিউলি পাওয়া যাচ্ছে না। আর ভালো রস চেনা, তা থেকে গুড় তৈরির মতো অভিজ্ঞ মানুষও কমে আসছে ধীরে ধীরে। যাঁরা আগে দাপিয়ে বেড়াতেন খেজুর গাছ, নিয়ে আসতেন হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টি খেজুর রস, তাঁরা এখন বৃদ্ধ। শিরা-ওঠা হাত এখন কেঁপে ওঠে। এক শিউলির কথায়, ‘শীত এলে এক রকম মনের টানেই গাছ জুড়ে গুড় তৈরির কাজে লেগে পড়ি। কিন্তু বয়স এখন আর সঙ্গ দিতে চায় না। নতুন করে এই কষ্টসাধ্য কাজ কেউ শিখতেও চায় না।’ শিউলিদের মতে, খেজুরগুড় শিল্প ক্রমশ অনিশ্চয়তার আবর্তে এগিয়ে চলেছে।

এক কলসি গুড় তৈরি করতে একটি শিউলি পরিবারের যে সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয় তার ন্যূনতম মূল্য তাদের হাতে আসে না। কারণ মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণির কৌশল ও মুনাফা লাভের চতুরতার কাছে শিউলিরা পরাজিত। সস্তার চিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যেতে বসেছে গুড়শিল্প। টিকে থাকার লড়াইয়ে খাঁটি গুড়ে মিশেছে ভেজাল সংস্কৃতি। এখন গ্রামবাংলার নানা প্রান্তে গুড়ের শালে দেখা যায় বড় বড় আয়তাকার ধাতব পাত্রে রস থেকে গুড় জ্বাল দেওয়ার চিত্র। সেই সব রসের মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। কোথাও গাছে বাঁধা হাঁড়িতে আগে থেকে চিনি রাখা থাকছে, কোথাও রস জ্বাল দেওয়ার সময় মেশানো হচ্ছে চিনি, নলেন গুড়ের রাসায়নিক ‘এসেন্স’ আর ফটকিরি। নকল রস, নকল গুড়। আর সেই গুড় দিয়ে তৈরি পিঠে-পায়েসই হোক, মোয়া বা মিষ্টি, সবেতেই ভেজালের স্বাদ।

আরেক বিপদের নাম ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’। আগে যেখানে গ্রাম-গ্রামান্তরে, রাস্তার পর রাস্তা সারি সারি খেজুর গাছে ঝোলানো মাটির কলসি দেখা যেত, সে দৃশ্য এখন প্রায় বিলীন। মাটির হাঁড়ির জায়গা দখল করেছে নিম্নমানের প্লাস্টিকের বড় বড় হাঁড়ি। সেখানে খেজুর রস সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, রসের আসল স্বাদ কি আগের মতো থাকে? আর স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাই বা কোথায়?

প্লাস্টিক আসলে অর্গানিক পলিমার। প্লাস্টিক একবার ব্যবহারের জন্য তৈরি। বারবার ব্যবহার বা তাপ পেলে ক্ষতিকর রাসায়নিক রসে মেশে, যা পেটের সমস্যা থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করে। মাটির হাঁড়ির ঠান্ডা পরিবেশ পচন রোধ করে, মাটির পাত্রে ফার্মেন্টেশন ধীরে ঘটে, তাই রসের স্বাদ থাকে স্বাভাবিক। প্লাস্টিক বোতলে অক্সিজেন বেশি থাকায় ফার্মেন্টেশন দ্রুত হয়, স্বাদ বদলে যায়। রস দ্রুত নষ্ট হয়। প্লাস্টিকের হাঁড়িতে সংগ্রহ করা রস থেকে তৈরি গুড়ের স্বাদও ভালো হয় না।

খেজুর রস সংগ্রহ করার আগে মাটির হাঁড়ি পোড়ানো হয়। তাতে হাঁড়ি হয় জীবাণুমুক্ত। রস সংগ্রহের জন্য হাঁড়িতে ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধি হলেও হাঁড়ি পোড়ানোয় তা নষ্ট হয়ে যায়। প্লাস্টিকের হাঁড়ি জীবাণুমুক্ত করা যায় না। ফলে রসের সঙ্গে প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণা মানব শরীরে রক্তে মিশে যায়। এতে ক্যানসার-সহ অন্য রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তাই স্বাদ, মানুষের স্বাস্থ্য ও ঐতিহ্য রক্ষায় মাটির হাঁড়ি অপরিহার্য।

কিন্তু তবুও কেন প্লাস্টিকের বাড়বাড়ন্ত? এক শিউলির কথায়, “গত দু’বছর ধরে প্লাস্টিকের হাঁড়ি ব্যবহার করছি। এই হাঁড়ি হালকা, পড়লে ভাঙে না। মাটির হাঁড়ি ভারী। গাছ থেকে রস নামানোর সময়ে হাঁড়ি কোনও কারণে ভেঙে গেলে লোকসান। তা ছাড়া এই হাঁড়িকে আগে পোড়াতে হয়। প্লাস্টিকের হাঁড়ি ধুয়ে নিলেই ফের রস সংগ্রহ করা যায়।” আবার কারও কথায় ‘মাটির হাঁড়ি টেকসই নয়, দাম বেশি, কেউ ইট ছুড়ে ভেঙে দেয়। তাই বাধ্য হয়েই প্লাস্টিক ব্যবহার করছি।’

স্বাভাবিকভাবেই প্লাস্টিক সহজলভ্য ও বহনযোগ্য, কিন্তু সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে উদ্বেগও। খেজুর রসের পরিবর্তন শুধু স্বাদ বা স্বাস্থ্যকেই প্রভাবিত করছে না; আঘাত লাগছে গ্রামের অর্থনীতিতেও। মাটির হাঁড়ি বানানো কারিগররা কর্মহীন হয়ে যাচ্ছেন। মাটির হাঁড়িতে প্রথম ৬–৮ ঘণ্টার মধ্যে রসের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। তাই ঐতিহ্যবাহী মাটির হাঁড়িই ব্যবহার করা উচিত। বিশেষজ্ঞ ও ক্রেতাদের মতে মাটির হাঁড়িতে রস রাখলে শিউলি ও ক্রেতা সন্তুষ্ট থাকে, শিল্পও বাঁচে।

শীতের সকালে মাটির হাঁড়ির ঠান্ডা খেজুর রস আর পিঠের সুবাসিত গন্ধ– সব মিলিয়ে গ্রামীণ জীবনের এক অমূল্য ছবি। পরিবারের স্নেহ-ভালোবাসায় বহু যত্নে বানানো নানা পিঠে-পুলি এখন শহুরে জীবনধারায় দোকানের পণ্য। প্লাস্টিকের সহজলভ্যতা ধীরে ধীরে খেজুর রসের ঐতিহ্যকে সরিয়ে দিচ্ছে। ঐতিহ্যের শিকড় ভুলে যাওয়া নিরুপায় নাগরিক এখন কৃত্রিমতার গ্রাসে আচ্ছন্ন। খেজুর রসের স্বাদ, মানুষের স্বাস্থ্য এবং গ্রামের অর্থনীতি বাঁচাতে এখন ফিরে তাকাতে হবে মাটির হাঁড়ির দিকে। আর ফিরিয়ে আনতে হবে বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেজুর রসের সংস্কৃতি। চাই শিকড় সন্ধান।

……………….

লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি ছবিই তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর তোলা